বিজ্ঞান.অর্গ.ইনঃ আলো দিয়ে একটা কণাকে শূন্যে ভাসিয়ে রাখা – এটা কীভাবে সম্ভব?
বাসুদেবঃ আলোর ভর নেই কিন্তু ভরবেগ (momentum) আছে – বিজ্ঞানীরা এটা অনেকদিন আগে থেকেই জানতেন। ক্রিকেট বলের ভরবেগের ধাক্কায় যেমন উইকেট ছিটকে যায়, তেমনি আলোর ভরবেগের ধাক্কাতেও বস্তুকণার ছিটকে যাওয়া সম্ভব। বিজ্ঞানী আর্থার অ্যাশকিন আলোর এই ধাক্কাকে কাজে লাগিয়ে মাইক্রোকণিকাদের শূন্যে এক জায়গায় ভাসিয়ে রাখা যায় কিনা তার পরীক্ষা করছিলেন। মাইক্রোকণিকা মানে হল মাইক্রন সাইজের কণা – এক মাইক্রন মানে এক মিলিমিটারের হাজার ভাগের একভাগ।
বিজ্ঞানঃ এক জায়গায় কী করে ভাসিয়ে রাখা যাবে? আলো যদি ধাক্কা দেয় তাহলে তো একটা কণা ছিটকে দূরে সরে যাবে সেই ধাক্কা খেয়ে …
বাসুদেবঃ ঠিক। অ্যাশকিন সেই জন্য দু’দিক থেকে দুটো লেজার রশ্মি ফেলছিলেন মাইক্রোকণিকার উপর। দুদিক থেকে ধাক্কা খেয়ে কণাটা এদিকেও পালাতে পারবে না আর ওদিকেও না – এমনটাই তাঁর ভাবনা ছিল।
বিজ্ঞানঃ সেটা কি সত্যি সম্ভব হল?
বাসুদেবঃ এই পরীক্ষায় অ্যাশকিন যা দেখলেন তা সত্যিই চমকপ্রদ। তিনি দেখলেন এই ছোট্ট স্বচ্ছ মাইক্রোকণিকাগুলো আসলে লেজার রশ্মির কেন্দ্রের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে! তিনি বুঝতে পারলেন যে আলো প্রতিটা কণার উপর আরেকটা বল (force) প্রয়োগ করছে, যে বলের অভিমুখ লেজার রশ্মির সবথেকে তীব্র অংশ তার দিকে, অর্থাৎ, রশ্মির কেন্দ্রের দিকে।
বিজ্ঞানঃ অর্থাৎ, এই বলটা আছে এই কারণে যে লেজার রশ্মির তীব্রতা রশ্মির বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নরকম সেই জন্য?
বাসুদেবঃ ঠিক তাই। বাজারে যে সস্তার লেজার পয়েন্টার কিনতে পাওয়া যায়, তার আলো একটা কাগজের উপর ফেললে দেখতে পাবে যে যত কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে যাচ্ছো, তত তীব্রতা কমতে থাকছে। শুধু তাই নয়, এই রশ্মিকে একটা লেন্সের সাহায্যে ফোকাস করলে দেখা যাবে ফোকাস থেকে যত দূরে যাওয়া হচ্ছে, তত তার তীব্রতা কমছে। অ্যাশকিন বুঝলেন, এই বলটা আসলে স্থানের সাথে তীব্রতার মান পালটানো, অর্থাৎ, গ্রেডিয়েন্ট (gradient) থাকার জন্যই তৈরি হচ্ছে। তাঁর মাথায় একটা দারুণ বুদ্ধি খেলে গেল। দুটো লেজার রশ্মির দরকার নেই। একটা রশ্মিকেই লেন্স দিয়ে কড়াভাবে মানে খুব ছোট জায়গার মধ্যে ফোকাস করতে পারলে মাইক্রোকণিটাকে ফোকাসের কেন্দ্রের দিকে ঠেলে সেখানে আটকে রাখা যাবে! সত্যিই তাই হল, শুধুমাত্র আলো দিয়ে কণাকে ত্রিমাত্রিক স্থানে বন্দী করে রাখা সম্ভব হল। এই যন্ত্রের নামই হল ‘অপটিক্যাল ট্যুইজার’ যা এখন বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। অ্যাশকিন ২০১৮ সালে নোবেল পুরস্কার পান অপটিক্যাল ট্যুইজার আবিষ্কারের জন্য।
বিজ্ঞানঃ এই পরীক্ষাটা কি শূন্যস্থানে মানে ভ্যাকুয়ামেই করতে হবে?
বাসুদেবঃ না না, অপটিক্যাল ট্যুইজার বাতাসে, তরল পদার্থের মধ্যে, বা শূন্যস্থানেও তৈরী করা যায়। যেখানে কণাকে বন্দী করতে চাও, সেখানে একটা লেজার রশ্মির তীব্র ফোকাস তৈরি কর – ব্যাস, তাহলেই হবে! ভাবতে পারো কণাটিকে তিনদিকে তিনটি স্প্রিং দিয়ে আটকে ফেলা হয়েছে। পালাতে গেলেই এই কল্পিত স্প্রিংগুলো বল প্রয়োগ করে আবার আগের জায়গায় ফেরত পাঠাবে। আবার, ট্যুইজারটাকে (মানে আলোর ফোকাসকে) সরাতে গেলেও এই স্প্রিংগুলো কণাটার উপর বল প্রয়োগ করবে। ফলত, কণাটাকেও ট্যুইজার দিয়ে টেনে একজায়গা থেকে অন্য জায়গা নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
বিজ্ঞানঃ কণাটা অপটিক্যাল ট্যুইজারে আটকে গেছে মানে কি সে আর একদমই নড়তে পারবে না?
বাসুদেবঃ এমনটা নয়। কণাটা পালাতে পারবে না, কিন্তু কাঁপতে পারে। বিজ্ঞানীরা স্প্রিং-এর উদাহরণ ব্যবহার করেন কারণ তা দিয়ে এই কম্পনগতি বোঝা যায় ভালোভাবে। ত্রিমাত্রিক স্থানে একটা দৃঢ় বস্তুর (rigid body) মোট ছয় রকমের গতি হতে পারে। তিনদিক বরাবর তার সরণ হতে পারে – কম্পনগতি এর মধ্যে পড়বে। আবার, সে ঘুরতে পারে কোন অক্ষ বরাবর। ত্রিমাত্রিক স্থানে এরকম তিনটি অক্ষ সম্ভব।
বিজ্ঞানঃ আলো দিয়ে কণাকে ঘোরানো সম্ভব? মানে, আলো কাজ করবে টর্ক রেঞ্চের মত? যেমন রেঞ্চ দিয়ে স্ক্রু নাট ঘোরানো হয়, সেভাবে?
বাসুদেবঃ হ্যাঁ, তাও হল। এ জন্য যে ধরণের কণা উপযুক্ত তাদের একটা বিশেষ ধর্ম থাকতে হবে, যার নাম বাইরিফ্রিনজেন্স (birefringence)।
বিজ্ঞানঃ সেটা কী একটু ব্যাখ্যা করবে কি?
বাসুদেবঃ অবশ্যই। বাইরিফ্রিনজেন্স হল পদার্থের একটা ধর্ম, যার ফলে তার প্রতিসরাঙ্ক (refractive index) নির্ভর করে আলো কোন দিকে যাচ্ছে তার উপর। আমরা জানি যে একটা বস্তুর মধ্যে দিয়ে যখন আলো যায়, তখন বস্তুর মধ্যে আলোর গতিবেগ শূন্যস্থানে আলোর গতিবেগের থেকে কম হয়। কতটা কম হয় তা নির্ণয় করে সেই বস্তুর প্রতিসরাঙ্ক। জলের প্রতিসরাঙ্ক যেমন ১.৩৩, অর্থাৎ, জলের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় আলোর গতিবেগ হয় শূন্যস্থানে আলোর গতিবেগের ১.৩৩ ভাগ। জলের মধ্যে আলো কোনদিক থেকে কোনদিকে যাচ্ছে, তার উপর এই প্রতিসরাঙ্ক বা আলোর গতিবেগ নির্ভর করে না। কিন্তু, কিছু পদার্থ আছে, যেমন কোয়ার্জ, রুবি ইত্যাদি, যাদের প্রতিসরাঙ্ক দিকনির্ভর। তাই, জল বাইরিফ্রিনজেন্ট নয়, কিন্তু, কোয়ার্জ বা রুবি বাইরিফ্রিনজেন্ট।
প্রতিসরাঙ্ক কোন এক দিক বরাবর বেশী, আর অন্য দুই দিক বরাবর তূলনামূলকভাবে কম – এমন কোন বাইরিফ্রিনজেন্ট কণাকে অপটিক্যাল ট্যুইজারের সাহায্যে ঘোরানো সম্ভব। সেক্ষেত্রে আলোর পোলারাইজেশান বলে একটা ধর্মকে ব্যবহার করা যায়।
বিজ্ঞানঃ পোলারাইজেশান?
বাসুদেবঃ আলো তো একটা তরঙ্গ, তার মধ্যে তড়িৎক্ষেত্র একটা নির্দিষ্ট দিক বরাবর দুলতে পারে। তড়িৎক্ষেত্র যে দিকে দোলে সেই দিককে ওই আলোর পোলারাইজেশান বলে। অপটিক্যাল ট্যুইজারের পোলারাইজেশান ঘুরিয়ে বাইরিফ্রিনজেন্ট কণাকেও ঘোরানো যায়।
এই ঘোরানোটা একটা নির্দিষ্ট অক্ষের সাপেক্ষে হয়। ত্রিমাত্রিক স্থানে তিনটে অক্ষের বাকী দুটি অক্ষ বরাবর নিয়ন্ত্রিতভাবে ঘোরানো কী করে সম্ভব, সেটা এখনো গবেষণার বিষয়।
বিজ্ঞানঃ আলো দিয়ে কণাকে বন্দী করার, আবার তাকে বনবন করে ঘোরানোর এই কাহিনী রোমাঞ্চকর। কিন্তু, বিজ্ঞানীরা এই ট্যুইজারের ফাঁদে বন্দী কণাকে কি কোন কাজে ব্যবহার করতে পারে? না কি শুধুই মজার জন্য এ সব করা …
বাসুদেবঃ অপটিক্যাল ট্যুইজারের অনেক ব্যবহার আছে। কোষের মধ্যে ট্যুইজার দিয়ে কোষের মধ্যেকার তরল মাধ্যম বা সাইটোপ্লাজমের সান্দ্রতা (viscosity) মাপা যায়। এই সান্দ্রতা কোষটির স্বাস্থ্য সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয় [1]। মলিক্যুলার বায়োলজিতে DNA, RNA, প্রোটিন অণু ইত্যাদিকে ট্যুইজার দিয়ে টেনে ও সলতের মত পাকিয়ে (twist) নানা পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা যায়। DNA-অণুগুলো কীভাবে ফোল্ড করে তা জানা যায়। বিজ্ঞানী স্টিভেন ব্লক-এর পরীক্ষাটি [2] এখানে উল্লেখযোগ্য। তাঁরা একটা DNA-অণুর দু’দিকে দুটো মাইক্রোকণা লাগিয়ে দেন। তারপর একটাকে স্থির রেখে অন্যটাকে ট্যুইজার দিয়ে টানতে থাকেন।
আবার, প্রোটিনের সাথে বাইরিফ্রিনজেন্ট কণা লাগিয়ে ট্যুইজার দিয়ে সলতে পাকিয়ে প্রোটিনটা কীভাবে ফোল্ড করে সেটাও বোঝা যায় [3]। DNA বা প্রোটিন কীভাবে ফোল্ড করে সেটা বিজ্ঞানীরা বোঝার চেষ্টার করেন, কারণ অনেকে মনে করেন যে এর সাথে বিভিন্ন দুরারোগ্য রোগের সম্পর্ক আছে।
বিজ্ঞানঃ ফিজিক্সে অপটিক্যাল ট্যুইজারের ব্যবহার আছে?
বাসুদেবঃ অবশ্যই! অপটিক্যাল ট্যুইজারের মাধ্যমে পরমাণুদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাদের বিশেষভাবে সাজানো যায়। কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার পরীক্ষা-নীরিক্ষায়, এমনকি কোয়ান্টাম কম্প্যুটিং নিয়ে গবেষণাতেও ট্যুইজার এখন প্রবলভাবে ব্যবহৃত।
সব মিলিয়ে Optical tweezer বিজ্ঞানীদের কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র, নানা ক্ষেত্রে যার ব্যবহার ক্রমাগত বেড়েই চলছে।
বিজ্ঞানঃ অনেক ধন্যবাদ এমন একটা আধুনিক গবেষণার বিষয়কে সহজ করে বোঝানোর জন্য। আশা করি ‘বিজ্ঞান’-এর তরুণ পাঠকদের মধ্যে কেউ ভবিষ্যতে এই বিষয়ে গবেষণায় উদ্যোগী হবে!
Cover Image: physicsworld.com; courtesy: Justus Ndukaife
তথ্যসূত্র:
[1] “Size and speed dependent mechanical behavior in living mammalian cytoplasm”, J. Hu et al., Proc. Nat. Acad. Sci. (USA), 114, 9529-9534 (2017).
[2] Fazal, F.M., Meng, C.A., Murakami, K., Kornberg, R.D., Block, S.M. Real-time observation of the initiation of RNA polymerase II transcription. Nature 525: 274-277.
[3] Kinesin rotates unidirectionally and generates torque while walking on microtubules A Ramaiya*, B Roy*, M Bugiel, E Schaffer, Proceedings of National Academy of Sciences (USA) 114, 10894 (2017).
Thank you very much for this valuable article.