গত মাসে দুটি গবেষণাপত্র চিকিৎসাশাস্ত্রে রীতিমত হইচই ফেলে দিয়েছে। বয়সকালে মস্তিষ্কের কলকব্জাগুলি কেন ঝিমিয়ে পরে, আর কেনই বা পেশীতে আঘাত লাগলে সারতে চায় না — তার রহস্য কিছুটা হলেও হয়ত ভেদ করতে পেরেছেন হার্ভার্ড স্টেম সেল সংস্থার কিছু বিজ্ঞানী। শুধু রহস্যভেদই নয়, বয়স হওয়ার প্রক্রিয়াগুলিকে উল্টো দিকে পরিচালনা করতেও সক্ষম হয়েছেন তারা ।
না, মানুষ অব্দি পৌঁছয়নি তাদের গবেষণা। তবে তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে মানুষের উপর প্রয়াস করার কথা ভাবছেন বিজ্ঞানীরা। আপাতত ইঁদুর দিয়ে শুরু। ইঁদুরের মধ্যে বার্ধক্যের কিছু প্রক্রিয়া তারা বিপরীত পথে নামিয়ে ফেলেছেন। বিজ্ঞানীরা এর আগে দেখেছিলেন যে বয়সের সাথে সাথে মস্তিষ্কের বা পেশীর স্টেম কোষগুলি প্রজননক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। সেই থেকে মস্তিষ্কের দুর্বলতা কিম্বা পেশীতে আঘাতের পর চোট সারতে না চাওয়া। সেই প্রজননক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার উপায় হয়তো তারা বার করে ফেলেছেন।
উপায়টা কি তা বলার আগে যেভাবে তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন সেটা নিয়ে একটু বলা যাক। দুটি গবেষণার একটিতে দুমাসের বাচ্চা ইঁদুরের সাথে সার্জারি করে পনের মাস বয়সী ধেড়ে ইঁদুরকে জুড়ে দিলেন তারা। এমনই সার্জারি যে একের রক্ত অন্যের ধমনী দিয়ে অনায়াসে বয়ে যেতে পারে। এই পদ্ধতিটি বহু বছর আগে থেকে গবেষণাতে ব্যবহার করা হচ্ছে। একে বলে প্যারাবায়োসিস (parabiosis)। হার্ভার্ড স্টেম সেল সংস্থার বিজ্ঞানীরা ভাবলেন জোয়ানের সাথে বয়স্ক ইঁদুরকে জুড়ে দুটো বয়স্ক ইঁদুরের জোড় বা দুটো জোয়ান ইঁদুরের জোড়ের সাথে তফাতটা দেখা যাক। দিয়ে হপ্তা পাঁচেক পর তাদের স্নায়বিক স্টেম কোষ গোনা হলো। দেখা গেল, বয়স্ক ইঁদুরের জোড়ের তুলনায় জোয়ান-বয়স্কর জোড়ের স্নায়বিক স্টেম কোষের সংখ্যা অনেক বেশি। তারপর সেই স্টেম কোষগুলিকে আলাদা করে সেই কোষগুলির স্নায়ু জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা মাপা হলো। সেখানেও জোয়ান-বয়স্কর জোড়ের জিত।
এবার প্রশ্ন হলো, স্নায়ুর স্টেম কোষের প্রজননক্ষমতা বাড়লেই কি আদপে বয়স্ক ইঁদুর তার হারানো তীক্ষ্ণতা ফিরে পায় ? সেটাও পরীক্ষা করা হলো। সার্জারি করে জোয়ান-বয়স্ক জোড়ের বয়স্কদের আলাদা করা হলো। আলাদা করা হলো বয়স্ক-বয়স্ক জোড়ের বয়স্কদেরও। সামনে রাখা হলো জলের সাথে দুটো আলাদা অনুপাতে মেশানো সুগন্ধি। জোয়ান-বয়স্ক জোড়ের বয়স্করা দুটির পিছনে আলাদা পরিমাণ সময় কাটাল। বয়স্ক-বয়স্ক জোড়ের বয়স্করা একই সময় কাটাল দুটি সগন্ধির পেছনেই, যা থেকে বোঝা গেল তারা দুটির মধ্যে তফাত করতে পারছে না। নিঃসন্দেহে, জোয়ানের রক্তে কিছু একটা আছে যা জোড়া থাকাকালে বয়স্কের ঘ্রাণশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছে।
সেটা যে কি, সেই খোঁজে গেলেন বিজ্ঞানীরা। জোয়ান ইঁদুরের রক্তে কোন ফ্যাক্টরগুলি বেশি আছে সেগুলি দেখা হলো। একটি বিশেষ প্রোটিন, GDF11, বেশি পাওয়া গেছিল জোয়ান ইঁদুরের রক্তে। এই প্রোটিনটি চার সপ্তাহ ধরে রোজ নিয়ম করে দেওয়া হলো বয়স্ক ইঁদুরদের। আগের মত না হলেও স্টেম কোষের সংখ্যা এভাবেও বাড়ানো সম্ভব বলে দেখা গেল। দ্বিতীয় গবেষণাটি ছিল পেশীর স্টেম কোষগুলি নিয়ে। সেখানেও একই পদ্ধতি। প্রথমে প্যারাবায়োসিস করে বয়স্ক-জোয়ানের জোড়, তারপর GDF11 দেওয়া। এক্ষেত্রেও দেখা গেল যে স্টেম কোষের প্রজননক্ষমতা GDF11 দিয়ে বাড়ানো সম্ভব।
এর পরের প্রশ্নটি হবে: এই প্রোটিনটি ঠিক কিভাবে কাজ করে? আশা করা যাচ্ছে বায়োকেমিস্ট্রির লোকজন এখানে উৎসাহী হবেন। সাথে সাথে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মানুষের উপর পরীক্ষা করার জন্য যে প্রস্তুতি দরকার, সেগুলি নেওয়া হচ্ছে। ভাবা হচ্ছে যে, বয়সের সাথে সাথে মস্তিস্কে যেসব রোগ দেখা দেয়, যেমন আলজাইমার্স রোগ, তার একটা চিকিৎসার উপায় হয়ত এই গবেষণার মধ্যে লুকিয়ে আছে। দেখা যাক। হয়ত আর বেশীদূর নেই যখন বয়সের আক্রমণের ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতে হবে না।
ছবি: যশ মিটেলডর্ফের সাইন্স ব্লগ