আমরা অনেকেই জানি, পুরুষ মশার মানুষের রক্তে অরুচির কথা। কিন্তু এরকমটা কেন হয়েছে?
স্ত্রী মশার উষ্ণ রক্তের প্রয়োজন
গবেষণায় দেখা গেছে, ডিম্বাণু পরিস্ফুটনের (egg development) মাধ্যমে বংশ বিস্তারের জন্য স্ত্রী-মশার দেহ উষ্ণ রাখার একটা তাগিদ থাকে। এ কারণে তারা খাদ্য হিসেবে উষ্ণ রক্তবিশিষ্ট প্রাণীদের দংশন করে সেই রক্ত পান করে। আর এছাড়াও প্রাণীজ রক্ত প্রোটিন, আয়রন এবং অ্যামিনো অ্যাসিডের একটা দারুণ উৎস। সুতরাং একসঙ্গে অনেকগুলো হৃষ্টপুষ্ট ডিম পাড়ার জন্য স্ত্রী মশাকে রক্ত পান করতে হয়।
আর ঠিক একারণেই দেখা যায় বহুল পরিচিত ম্যালেরিয়া রোগটি অ্যানোফিলিস গণভুক্ত বিভিন্ন প্রজাতির স্ত্রী মশার মাধ্যমেই বিস্তার লাভ করে। এই মশারা লালায় পরজীবী প্লাজমোডিয়ামের স্পোরোজয়েট (plasmodium sporozoite) বহন করতে পারে। যখন মানুষের রক্ত পান করে, তখন জীবাণুটি মানুষের রক্ত স্রোতের মধ্য দিয়ে মাত্র ত্রিশ মিনিটেই যকৃতে পৌঁছে যায় আর এভাবেই স্ত্রী মশার কামড়ে একজন মানুষ ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়।
পুরুষ মশা রক্ত খায় না কারণ তাদের হুল (proboscis) প্রাণীর ত্বকে ছিদ্র করার মতো শক্তিশালী নয়। পুরুষ মশা গাছের রস, ফুলের মধু খায়। এছাড়া তারা গাছের অন্য অংশে যে রস নিঃসৃত হয় (extrafloral nectar) সেই রস বা পচা ফলও খায়। যেহেতু তারা রক্ত খায় না, পুরুষ মশা কখনোই মানুষকে দংশন করে না; ম্যালেরিয়া এবং ডেঙ্গু জ্বরের মতো রোগ ছড়ানোর জন্যও তাই এরা দায়ী নয়।
পুরুষ মশাও মানুষের কাছে আসে
তবে পুরুষ মশা মানুষকে এড়িয়ে চলে, তাদের ধারেপাশে আসে না — এই ধারণাটা কিন্তু ঠিক নয়।
2021 সালের একটা গবেষণা [1] বলছে যে এডিস ইজিপ্টি (Aedis aegypti) প্রজাতির পুরুষ মশারা সম্ভবত তাদের গোত্রের স্ত্রী মশাদের মতোই মানুষকে পছন্দ করে — তবে তাদের পছন্দের কারণ এবং তারা যেভাবে তা প্রকাশ করে সেগুলো কিন্তু খুব আলাদা।
স্ত্রী মশা আসে রক্তের লোভে, কিন্তু পুরুষ মশার লক্ষ্য শুধুই মানুষের সান্নিধ্য। বিজ্ঞানীদের পরীক্ষায় দেখা গেছে, পুরুষ মশা ক্রমাগত মানুষের চারপাশে ভিড় করে আসে কিন্তু খুব কমই শরীরের উপর নেমে আসে। বিপরীতভাবে, স্ত্রী মশা সরাসরি ত্বকের উপর এসে বসে, পেট ভরে রক্ত পান করে, আর তারপর বিশ্রামের জন্য উড়ে চলে যায়।
আরও আশ্চর্যের কথা মানুষের প্রতি মশকীদের যেমন আকর্ষণের ভিন্নতা রয়েছে [3], তা পুরুষ মশার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে মশকীদের মতো অত দূর থেকে তারা একটা মানুষের গন্ধ ইত্যাদি শনাক্ত করতে পারে না।
একটা প্রশ্ন তবু থেকেই যায়, রক্তই যদি না খেতে পারে, তাহলে মানুষের কাছে আসে কেন পুরুষ মশারা? বিজ্ঞানীরা মনে করছেন যে এর একটাই সম্ভাব্য কারণ হতে পারে — স্ত্রী মশাকে খুঁজে পাওয়া। যেহেতু স্ত্রী মশা প্রায়শই মানুষের আশেপাশে থাকে, তাই একই প্রবণতা থাকা পুরুষ মশাদের প্রজনন সাফল্য বেশি হওয়া উচিত।
যেহেতু রুচি আলাদা হওয়া সত্ত্বেও স্ত্রী-পুরুষদের একসাথেই পাওয়া যায়, মশা নিয়ন্ত্রণের দিক থেকে ভাবলে পুরুষ মশাদের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। বিজ্ঞানীরা ইদানীং রাসায়নিক পদ্ধতির বিকল্প হিসেবেই সেই ধরনের চেষ্টাই করছেন।
মশা দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ
মশা দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণের কিছু কৌশল ইদানীং বেশ সাড়া ফেলেছে।
এগুলোর পোশাকি নাম হলো এসআইটি (Sterile Insect Technique / SIT), আইআইটি (Incompatible Insect Technique / IIT), এবং আরআইডিএল (Release of Insects carrying Dominant Lethals / RIDL)। তিনটি পদ্ধতিতেই পরিবর্তিত পুরুষ মশার মাধ্যমে বন্য স্ত্রী মশার সংখ্যা দমন করা হয়। পদ্ধতিগুলোকে এবার এক এক করে বিশদে দেখা যাক।
বন্ধ্যা মশাদের প্রতিযোগিতায় নামানো
এসআইটি (Sterile Insect Technique / SIT) পদ্ধতিটি মূলত ফসলের ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ যেমন ফ্রুটফ্লাই, স্ক্রু-ওয়ার্ম, মথ ইত্যাদি প্রজাতির সংখ্যাকে দমন করার জন্যই প্রথমে আবিষ্কৃত হয়। কৃষিকাজে এর প্রয়োগে বেশ সুফলও পাওয়া যায়। পরবর্তীতে এই কৌশল মশা নিয়ন্ত্রণের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।
ল্যাবরেটরিতে এক্স-রে জাতীয় বিকিরণ ব্যবহার করে বন্ধ্যা পুরুষ মশা তৈরি করা হয় এবং তারপরে প্রচুর সংখ্যায় এই পরিবর্তিত মশাদের প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া হয়। বন্ধ্যা পুরুষ মশারা বুনো স্ত্রী মশাদের সাথে সঙ্গমের জন্য ইতিমধ্যে বিদ্যমান স্থানীয় পুরুষ মশাদের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। সংখ্যায় অনেকগুণ বেশি থাকায় তারা সফলও হয় সেই কাজে। কিন্তু এই প্রজননের ফলস্বরূপ, স্ত্রী মশার ডিম ফোটে না।
এইভাবেই, সময়ের সাথে সাথে স্থানীয় মশার সংখ্যা হ্রাস পায় এবং কালক্রমে বিলুপ্ত হয়। এই পদ্ধতি পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না কারণ এটি কোনো নতুন মশক প্রজাতির প্রবর্তন করে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এডিস ইজিপ্টি মশা নিয়ন্ত্রণে এসআইটি ব্যবহার করা হয়েছে। এই প্রজাতির মশা ডেঙ্গু, জিকা এবং চিকুনগুনিয়ার মতো ভাইরাস ছড়ায়।
তবে, মশার ক্ষেত্রে এসআইটি প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে কিছু অসুবিধা রয়েছে। যেমন, মশার প্রজনন হার এত দ্রুত যে কৌশলটি কার্যকর হওয়া অনেক সময়েই কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়া পুরুষ মশাকে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ্যা করতে উচ্চ মাত্রার বিকিরণের প্রয়োজন, যা তাদের শারীরিক ফিটনেস এবং স্থানিক মশাদের সাথে প্রতিযোগিতার ক্ষমতা কমাতে পারে। গণ লালন-পালনও বন্ধ্যা মশার যৌন ক্ষমতা হ্রাস করতে পারে।
এসবের উপর, যদি ভুলবশত স্ত্রী মশা পরিবেশে মুক্তি পায়, তাহলে তারা উপস্থিত স্ত্রী মশাদের মতোই রোগের জীবাণু ছড়াতে পারে। সাথে সাথে এরাই সদ্য ছাড়া পুরুষ মশাদের দাবি করে নিয়ে এসআইটি প্রোগ্রামের কার্যকারিতা হ্রাস করতে পারে।
ব্যাকটেরিয়া-সংক্রমিত মশাদের প্রতিযোগিতায় নামানো
এই সব অসুবিধাগুলো মাথায় রেখে বিজ্ঞানীরা আইআইটি কৌশলটি আবিষ্কার করেন।
আইআইটি (Incompatible Insect Technique / IIT) পদ্ধতিতে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট অন্তঃকোষীয় এন্ডোসিমবায়োটিক ব্যাকটেরিয়াকে (endosymbiotic bacteria) মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হয়। ওলবাচিয়া (Wolbachia) হলো এমনই একটি ব্যাকটেরিয়া যা মশা সহ বেশিরভাগ কীটপতঙ্গ প্রজাতিকে সংক্রামিত করে।
ধরা যাক, একটা বিশেষ এলাকার মশার প্রজাতিকে টার্গেট করা হচ্ছে। ওলবাচিয়া দ্বারা সংক্রামিত পুরুষ মশাকে সেই এলাকায় ছেড়ে দেওয়া হয়। এরা যখন অসংক্রামিত স্ত্রী মশার সাথে সঙ্গম করে, তার থেকে কিছু ডিফেক্টিভ ভ্রূণ তৈরি হয়। আরো বিশদে বললে, ওলবাচিয়া-প্ররোচিত সাইটোপ্লাজমিক ইনকমপ্যাটিবিলিটি (cytoplasmic incompatibility) বলে এক ধরনের প্রজনন ম্যানিপুলেশনের ফলে মশার ভ্রূণের মৃত্যু হয়। এইভাবেই সময়ের সাথে সাথে মশার সংখ্যা হ্রাস পায়।
কিন্তু এখানেও এসআইটি পদ্ধতির মতো ভুলবশত স্ত্রী মশা মুক্ত হওয়ার সমস্যা রয়েছে। আইআইটি পদ্ধতিতে মুক্তিপ্রাপ্ত পুরুষদের মতো একই ওলবাচিয়া-স্ট্রেন বহনকারী স্ত্রী মশারা যদি ভুলবশত প্রকৃতিতে ছাড়া পেয়ে যায়, তখন তাদের মধ্যে সঙ্গমের ফলে আর ডিফেক্টিভ ভ্রূণ তৈরি হবে না। তখন আবার মশকসংখ্যা প্রতিস্থাপনের সমস্যা তৈরি হতে পারে। এই ঝুঁকি দূর করার জন্য সংক্রামিত স্ত্রী মশাদের তখন আবার এসআইটি প্রক্রিয়ায় কম-ডোজ রেডিয়েশন দিয়ে বন্ধ্যা করে দেওয়া হয় এবং এই স্ত্রী মশার মধ্যে ওলবাচিয়ার বিস্তার রোধ করা সম্ভবপর হয়। ওয়ার্ল্ড মসকুইটো প্রোগ্রাম 2011 সালে অস্ট্রেলিয়ার কেয়ার্নে প্রথম ওলবাচিয়া-সংক্রামিত মশা ব্যবহার করে সুফল পায়।
অতএব এককভাবে ব্যবহার করার চেয়ে এসআইটি-আইআইটির একটা সংমিশ্রণ ব্যবহার করলে মশা নিয়ন্ত্রণে অনেক বেশি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জিন-পরিবর্তিত মশাদের প্রতিযোগিতায় নামানো
অন্যদিকে আরআইডিএল (Release of Insects carrying Dominant Lethals / RIDL) পদ্ধতিতে স্ত্রী মশা নির্দিষ্ট প্রাণঘাতী জিন ঢুকিয়ে দেওয়া হয় পুরুষ মশার শরীরে।
জিনগতভাবে পরিবর্তিত (genetically modified) এই মশার একটি স্থিতিশীল স্ট্রেন (stable strain) যদি একবার পাওয়া যায়, তখন জেনেটিক রিপ্রেসার অপসারণ করে ল্যাবরেটরিতে এই মশাদের পালে পালে বড়ো করে তোলা হয়। কিন্তু এই মশাদের লালন-পালন করা হয় টেট্রাসাইক্লিন-যুক্ত জলে যেখানে এরা প্রাণঘাতী জিন থাকা সত্ত্বেও সুরক্ষিত থাকবে।
এই পুরুষ মশাগুলোকে তারপর পরিবেশে ছেড়ে দেওয়া হয় বুনো স্ত্রী মশাদের সাথে যৌন সঙ্গমের জন্য। প্রজননের ফলে যে নতুন বংশধর মশাদের জন্ম হবে, তারা প্রাণঘাতী জিনের উত্তরাধিকারী হয়। তাদের সুরক্ষার জন্য পরিবেশে টেট্রাসাইক্লিন না থাকায় এই বংশধররা মারা যায়।
এইভাবে, যদি পর্যাপ্ত পরিবর্তিত পুরুষ মশাদের ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে বন্য-টাইপ এডিস ইজিপ্টির সংখ্যা শেষ পর্যন্ত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে।
অবশ্য জিন পর্বিরতিত মশা মানুষের ক্ষতি করে এমন অজানা প্যাথোজেন বহন করতে পারে বা বিকাশ করতে পারে। এই সম্ভাবনার কথা ভেবে সমালোচকরা বলছেন যে জিএম (genetically modified) মশা ব্যবহার করার আগে তাদের পর্যাপ্ত পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।
উপসংহার
এই তিনটে পদ্ধতিতেই পুরুষ মশাদের একটা মস্ত বড় ভূমিকা রয়েছে। তারা আমাদের রক্তে অনাসক্ত হলেও তাদের ব্যবহার করে মশাদের নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
বিশ্বব্যাপী মানব রোগের প্রধান আর্থ্রোপড ভেক্টর বা বাহক হিসাবে মশার খুবই দুর্নাম আছে। মশা-বাহিত রোগগুলোর তালিকায় বড় বড় সব নাম রয়েছে — ম্যালেরিয়া (অ্যানোফিলিস মশা); ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ইয়েলো ফিভার, রিফট ভ্যালি ফিভার, এবং জিকা (এডিস মশা); জাপানিস এনসেফালাইটিস, লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস এবং ওয়েস্ট নাইল ফিভার (কিউলেক্স মশা)।
দুর্ভাগ্যবশত, এই ভেক্টর-বাহিত (Vector borne disease/VBD) রোগগুলোর বেশিরভাগের জন্য কোনো টিকা বা প্রচলিত প্রতিষেধক ওষুধ বাজারে সহজলভ্য নয়। তাই এখনও পর্যন্ত মশার নিয়ন্ত্রণই এই রোগগুলো প্রতিরোধের প্রধান রূপ। এবং মশা দ্বারা মশা নিয়ন্ত্রণ আমাদের রাসায়নিক পদ্ধতিগুলো থেকে বেরিয়ে আসার একটা সম্ভাব্য উপায় দেখাচ্ছে।
প্রচ্ছদের ছবি: বনানী মণ্ডল
তথ্যসূত্র:
[1] Long-Range But Not Short-Range Attraction of Male Aedes aegypti (Diptera: Culicidae) Mosquitoes to Humans
Brogan A Amos, Ary A Hoffmann, Kyran M Staunton, Meng-Jia Lau, Thomas R Burkot, Perran A Ross, Journal of Medical Entomology, Volume 59, Issue 1, January 2022, Pages 83–88
[2] Male mosquitoes don’t want your blood, but they still find you very attractive, Perran Ross.The Conversation.September 28, 2021
[3] মশারা কি শিকারবিশেষে আক্রমণ করে?, বিজ্ঞান
[4] Incompatible and sterile insect techniques combined eliminate mosquitoes. Xiaoying Zheng et al., Nature, 572, 56–61 (2019).
[5] Biological Control of Mosquito Vectors: Past, Present, and Future. Giovanni Benelli, Claire L. Jeffries এন্ড Thomas Walker. Insects 2016, 7(4), 52;