রাস্তার কুকুরদের খাবার দিয়েছেন কখনও? কী দিয়েছেন? বিস্কুট? আচ্ছা, চোখের সামনে যদি মাংসের টুকরো পড়ে থাকে, আপনার কি মনে হয় কোনও কুকুর সেটা খেতে দেরি করে অন্য কাজে সময় নষ্ট করবে? হ্যাঁ, আমাদের আইসার কলকাতায় প্রফেসর অনিন্দিতা ভদ্রের “ডগ ল্যাব” -এর গবেষণায় এমনটাই দেখা গেছে। ছাইরঙা বাটিতে কুকুরকে মাংস দিলেও তার থেকে মাত্র এক ফুট দূরে থাকা খাবারের নামগন্ধহীন ফাঁকা হলুদ বাটির দিকেই কুকুরদের বেশি আকর্ষণ। হলুদের প্রতি সারমেয়দের এমনই ভালবাসা!
কুকুরেরও প্রিয় রঙ থাকতে পারে ভেবে অবাক হবেন না। প্রাণিজগতে বর্ণপ্রেমের প্রচুর উদাহরণ রয়েছে। এই আচরণ দেখা গেছে সামান্য ফলের মাছি থেকে নানা জাতের পাখি, মায় বাঁদরদের মধ্যেও। ফসিলস্ এর ভক্তরা হয়তো জেনে খুশি হবেন, বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীও গড়পড়তাভাবে নীল রঙকেই বেশি পছন্দ করে। মানুষের “বর্ণ মনস্তত্ত্ব” বা “কালার সাইকোলজি” নিয়ে পড়াশোনা করতে হয় চিত্রশিল্পী, সিনেমা ও বিজ্ঞাপন নির্মাতাদেরও। মনুষ্যেতর প্রাণিজগতে অদ্যবধি এই বিষয়ে কাজ তুলনামূলকভাবে অনেকটাই কম। তারা তো আর ভাষায় বলতে পারে না কোন রঙ তাদের কেমন লাগছে! তাই কাজটা অনেক সময়েই কঠিন হয়ে যায়। তবে বিজ্ঞানীরা অনেক ক্ষেত্রেই দেখতে পেয়েছেন নানা বর্ণময় প্রাণীদের গায়ের রঙ তাদের সঙ্গীচয়নের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নেয়। অনেক প্রাণীদেরই বর্ণপ্রেমের কারণ আবার আজও অজানা।
ফিরে আসি সারমেয় কথায়। “কুকুর বর্ণান্ধ” কথাটি সম্পূর্ণ ঠিক নয়। মানুষের চোখের তিন প্রকার শঙ্কু আকৃতির বর্ণান্বেষী কোষের (কোন্ সেল) জায়গায় কুকুরদের এবং সকল অ-বানর স্তন্যপায়ীদের চোখে রয়েছে দুই প্রকার বর্ণান্বেষী কোষ। এর ফলে সাতরঙা রামধনুর পরিবর্তে তারা দেখতে পায় নীল, হলুদ এবং ধূসর রঙ। সাদা আর কালোকে ধূসরের রকমফেরই ধরা যায়। আমাদের গবেষণার শুরু এখানেই। নীল, হলুদ ও ধূসর – এই তিনটি রঙে তিনটে বাটিকে রঙ করে আমরা নদীয়া, উত্তর ২৪ পরগণা, ও কলকাতার অলিগলিতে 134টি কুকুরের সামনে রেখে তাদেরকে “আয় আয়” বলে ডাকি, এবং বাটিগুলোকে পরখ করার সুযোগ দিই। 76টি কুকুরের ক্ষেত্রে আমরা প্রতি বাটিতে একটুকরো বিস্কুট রেখেছিলাম, আর বাকি 58টি কুকুরের জন্য বাটি ছিল ফাঁকা। দুই ক্ষেত্রেই বেশিরভাগ কুকুর প্রথমেই হলুদ বাটিটিকে শোঁকা শুরু করে। 134 -এর মধ্যে 72টি কুকুর প্রথমে হলুদ পছন্দ করে, যেখানে ধূসর আর নীল পছন্দ করে যথাক্রমে মাত্র 32টি ও 30টি কুকুর। দৃশ্যতই, পছন্দের তালিকায় হলুদ অনেক এগিয়ে।
আর সেই খাবার ফেলে হলুদ রঙের দিকে যাওয়া? হ্যাঁ, সেটি আমাদের পরবর্তী পরীক্ষা। বাটির ভেতরে থাকা খাবার বাইরে থেকে দেখা নাও যেতে পারে এই ভেবে আমরা বাটিগুলো উলটে দিই। এর পরে উল্টানো ধূসর বাটির ওপরে দেওয়া হয় খাবার – এক টুকরো মুরগির মাংস। তারপর যথারীতি কুকুরদেরকে ডেকে আনা হয়। 113টি কুকুরের ওপরে এই পরীক্ষা করা হয়, যার মধ্যে 88টি কুকুর (77%) খাবার ফেলে প্রথমেই হলুদ বাটির সামনে গিয়ে সেটিকে শুঁকতে, বা কখনও কামড়াতে শুরু করে।
ঠিক কী কারণে হলুদ এমন চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠল তা এখনই নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। হতে পারে আমাদের ফেলে দেওয়া হলদে বা লালচে (লালকেও কুকুররা হলুদ দেখে) ঝোলমাখা ভাত খেয়ে এই ভালোলাগা জন্মেছে। আবার এমনও হতে পারে বিবর্তনের পথে এই আচরণ কোনও এক সময় কুকুরদের বেঁচে থাকার জন্য এতটাই অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল যে আধুনিক কুকুর তার জিন ও মস্তিষ্কে এই প্রেম নিয়েই জন্মায়। এই রহস্য সম্পূর্ণ ভেদ করতে পারলে প্রাণিজগতের বিবর্তন এবং শহুরে পরিবেশে প্রাণীদের অভিযোজন নিয়ে আমাদের ধারণা বাড়বে। আর মনুষ্যেতর প্রাণীদের আরও ভালো ভাবে বুঝতে পারলে আশা করা যায় তাদের প্রতি আমাদের সহনশীলতা বাড়বে। আশা করা যায় প্রকৃতির সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দিকে আমরা একটু একটু করে এগিয়ে যেতে পারবো।
তথ্যসূত্র:
Ready, set, yellow! color preference of Indian free-ranging dogs. https://link.springer.com/article/10.1007/s10071-024-01928-9