মশাকে কেউ দু-চোখে দেখতে পারে না, কারণ ওরা সবসময় শিকারের খোঁজে ছোঁকছোঁক করে আর মনমতো শিকার পেলেই তার রক্ত সাবাড় করার তালে থাকে। রক্ত চোষার সময় ওরা যে শুধু শিকারের শরীরের জায়গায় জায়গায় কামড়ে, লাল করে ফুলিয়ে, জ্বালা-চুলকুনি ধরিয়ে দেয় তাই নয়, ওদের কামড় থেকে সাংঘাতিক সাংঘাতিক সব রোগ ছড়াতে পারে। ম্যালেরিয়া, জিকা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ফাইলেরিয়া, ইয়েলো ফিভার, হার্টওয়ার্ম, ইকুয়াইন এনসেফালাইটিস, রিফ্ট ভ্যালি ফিভার, ওয়েস্ট নাইল, টুলারেমিয়া ইত্যাদি, রোগের তালিকাতে অনেক বড় বড় ভিলেন রয়েছে।
মশার মেনুতে মানুষ বিরিয়ানি
মশাদের শিকার একা মানুষই নয়। পোষ মানে এমন প্রাণী, যেমন গবাদি পশু, ঘোড়া, ভেড়া, ছাগল, কুকুর, বেড়াল, কিংবা বনের স্তন্যপায়ী প্রাণী, যেমন হরিণ, ইঁদুর, বাদুড়, এমনকি পাখি, সরীসৃপ, উভচর এবং বেশ কিছু অন্যান্য পোকামাকড়ও মশার শিকার হতে পারে।
শিকারের এই দীর্ঘ তালিকার মধ্যে শেষমেশ কোনটিকে মশারা বেছে নেবে, সেটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। শিকারের সহজলভ্যতা, শিকারের শরীরের গন্ধ, মশার প্রজাতি এবং নির্দিষ্ট মশার পরিবেশগত বিবর্তনীয় অভিযোজন (evolutionary adaptation), এইগুলোর সবকটারই কিছুটা ভূমিকা রয়েছে।
তবে মশার প্রিয় শিকার কিন্তু মানুষ। প্রথমত, মানুষের ত্বক প্রায়শই বেশি উন্মুক্ত থাকে, লোমের আড়ালে ঢাকা থাকে না। ফলে মশার জন্য উপযুক্ত কামড়ের স্থান খুঁজে পাওয়া সহজ। এছাড়াও দায়ী আমাদের শরীরের আকর্ষণকারী রাসায়নিক যৌগ (যেমন ল্যাকটিক অ্যাসিড এবং কার্বন ডাই অক্সাইড), শরীরের তাপ, এবং অন্যান্য নানা আচরণ ও পরিবেশগত কারণ।
কয়েক ধরনের মশা যেন মানুষকে ঘিরেই বাসা বাঁধে। এডিস ইজিপ্টাই এবং অ্যানোফিলিস গাম্বিয়া সহ আরও অনেক মশার প্রজাতি মানুষের রক্ত খাওয়ার জন্য মানুষের পরিবেশে দারুণভাবে অভিযোজিত। যেমন, এককালে বনে গাছের কোটরে যে মশা থাকতো, এখন দিব্যি মানুষের তৈরি পাত্রের জমা জলে সেগুলো বড় হতে পারে।
মোদ্দা কথা, নানা কারণে মানুষ প্রায়শই অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় বেশি মশার কামড় অনুভব করে। আমরাই মশার প্রধান শিকার।
মানুষের মধ্যে শিকারের প্রকারভেদ
মানুষ বনাম অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে মশা যেমন মানুষকেই বেশি পছন্দ করে, সেরকম প্রশ্ন উঠতে পারে — মানুষের মধ্যেও কি মশার পছন্দ অপছন্দ রয়েছে? আপনাদের কি মাঝে মাঝে মনে হয় যে কোনো কোনো লোককে যেন মশারা বেশি পছন্দ করে এবং তার চারপাশেই বেশি ঘুরঘুর করে? আবার কিছু লোক যেন মশার কামড় থেকে বেশ সুরক্ষিত, তাদের ধারেপাশে মশারা বিশেষ ঘেঁষাঘেঁষি করে না?
সেরকম যদি সন্দেহ হয় বা দেখে থাকেন, সেটা কিন্তু মনের ভুল নয়। গবেষকরা দেখেছেন যে মানুষের প্রতি মশার এই আকর্ষণ-বিকর্ষণের পিছনে একটা গূঢ় রাসায়নিক কারণ রয়েছে। এই সম্পর্কটার সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন ঘটাও অসম্ভব নয়।
এই আলোচনার গভীরে যাওয়ার আগে আমরা কিছু সাধারণ ব্যাপার ঝালিয়ে নিই আসুন। আগেই বললাম, রক্তখেকো মশারা শুধু মানুষ নয়, অন্যান্য প্রাণীদেরকেও আক্রমণ করে।
এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, রক্তচোষা মশারা কি তাদের শিকারের মধ্যে পার্থক্য ধরতে পারে? নাকি রক্তটাই প্রধান, কোন প্রাণী তাতে যায় আসে না?
উত্তরটা শুনলে অবাক হয়ে যাবেন — হ্যাঁ, ওরা মানুষকে শনাক্ত করতে পারে। বুঝতে পারে যে অমুক স্থানে মানুষ রয়েছে, গরু বা ছাগল নয়।
কীভাবে?
গন্ধের তীব্র অনুভূতি, নির্দিষ্ট রাসায়নিক, এবং চাক্ষুষ সংকেত শনাক্ত করার ক্ষমতার মাধ্যমে।
কী, খুব আশ্চর্য হচ্ছেন? হ্যাঁ, তেমনটাই হওয়ার কথা!
গন্ধ দিয়ে যায় চেনা
ভাবছেন গন্ধ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে?
ঠিক ধরেছেন! মানব শরীরের গন্ধ।
প্রতিটি মানুষের একটা সহজাত এবং নির্দিষ্ট গন্ধ রয়েছে। জানতে চাইবেন নিশ্চয়ই, কোত্থেকে আসে এই গন্ধ যা মশাকে আকৃষ্ট করতে পারে? উত্তরটা কিন্তু খুবই সহজ! আমাদের ঘামের গন্ধ! জানেন কি, কীভাবে এই গন্ধের সৃষ্টি হয়?
মানুষের ত্বকের মাইক্রোবায়োম বা অণুজীবরা ঘামের মধ্যে থাকা কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাটি অ্যাসিড এবং পেপটাইডগুলোকে উদ্বায়ী (volatile) পদার্থে ভেঙে দিতে পারে। ভেঙে তৈরি করে কার্বন ডাই অক্সাইড, ল্যাকটিক অ্যাসিড এবং অন্যান্য জৈব যৌগ (organic compounds)। সেখান থেকেই শরীরের নির্দিষ্ট গন্ধের সৃষ্টি।
প্রশ্ন আসতেই পারে, মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীদের শরীরে কি ঘামের সৃষ্টি হয় না? নাকি তাদের ঘামের কোনো গন্ধ নেই?
এর জন্য সর্বপ্রথমে আমাদের জানতে হবে, শরীরে ঘাম তৈরি হয় কেন? এককথায় বলা যেতে পারে যে এই ঘাম উৎপাদন শরীরের অতিরিক্ত তাপ নিয়ন্ত্রণের একটা প্রাথমিক উপায়। বাষ্পীভূত শীতলীকরণের মাধ্যমে শরীরের অতিরিক্ত তাপ বেরিয়ে যায় ত্বক-কোষে ঘামের মধ্যে দিয়ে। অন্যান্য প্রাণী, বিশেষ করে ঘোড়া এবং কিছু বাঁদর গোত্রীয় প্রাণীর (primates) শরীরেও ঘাম উৎপন্ন হয়, কিন্তু তাপ পরিচালনার জন্য ঘামের ব্যবহার এদের ক্ষেত্রে মানুষের তুলনায় নিতান্তই নগণ্য। বরঞ্চ অন্যান্য শীতলীকরণ প্রক্রিয়া, যেমন হাঁপানো, চাটা, এবং আচরণগত অভিযোজনের ওপরই এরা প্রধানত নির্ভরশীল।
ঘামের মধ্যে থাকা এই রাসায়নিক সংকেতগুলির সংমিশ্রণই মশাদের সাহায্য করে মানুষকে অন্যান্য প্রাণীর থেকে আলাদা করতে।
বিভিন্ন মানুষের ত্বকে বিভিন্ন জীবাণুর গঠন থাকে, ফলে ঘামের গন্ধ আলাদা। এটা মশার কাছে তাদের কম বা বেশি আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে।
মশা বোঝে আরো অনেক কিছু
শুধু কি গন্ধ দ্বারাই মশারা আকৃষ্ট হয়?
না, না, এই তালিকায় আরও অনেক কিছুই আছে। সেগুলো সম্বন্ধে তাহলে এক এক করে বলা যাক।
প্রথম হলো কার্বন ডাই অক্সাইড। সেই কার্বন ডাই অক্সাইড যেটা মানুষ নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শরীর থেকে বর্জন করে। যারা বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে, যেমন বড়োসড়ো চেহারার মানুষ, বা শারীরিকভাবে বেশি সক্রিয় মানুষ, তারা কিন্তু মশাকে বেশি আকৃষ্ট করতে পারে।
তারপর আছে শরীরের তাপ। যাদের শরীরের তাপমাত্রা বেশি তাদের দিকে মশারা বেশি আকৃষ্ট হতে পারে। রক্তের ধরনেরও কিছুটা ভূমিকা রয়েছে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে ‘’টাইপ ও’’ রক্তের মানুষরা ‘’টাইপ এ’’, ‘’টাইপ বি’’, অথবা ‘’টাইপ এবি’’ রক্তের তুলনায় মশার কাছে বেশি আকর্ষণীয়।
গর্ভবতী মহিলাদের প্রতি মশা বেশি আকৃষ্ট হয়। অদ্ভুত শোনালেও এর মধ্যে একটা আংশিক সত্যতা রয়েছে। মশাদের আকর্ষণ করার কারণ হলো, গর্ভাবস্থায় মহিলারা বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে এবং তাদের শরীরের তাপমাত্রাও বেশি থাকে।
পোশাকের রংয়ের কারণেও তফাত হয়। দূর থেকে শিকারকে শনাক্ত করার জন্য মশারা তাদের দৃষ্টি ব্যবহার করে। কালো, নেভি ব্লু বা লালের মতো গাঢ় রং পরলে, আপনি মশার কাছে আরও বেশি দৃশ্যমান হয়ে উঠতে পারেন।
অ্যালকোহল সেবনেরও একটা ভূমিকা রয়েছে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, মদ্যপান করা আপনাকে মশার কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে, সম্ভবত শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং শরীরের গন্ধের পরিবর্তনের কারণে।
আর এটাও হতে পারে যে একেবারে জন্ম থেকেই আপনি জেনেটিক কারণে মশার কাছে আকর্ষণীয়। কিছু মানুষ স্বাভাবিকভাবেই বেশি রাসায়নিক তৈরি করে যেটা মশাদের কাছে তাদের আরও লোভনীয় করে তোলে।
মশাকে ঠেকিয়ে রাখা
কিসে মশাকে টানে, তার সবকটা কারণ আপনার নিয়ন্ত্রণে নেই।
তাই আপনার প্রতি মশার আকর্ষণ কমাতে প্রচলিত যে পদ্ধতিগুলো রয়েছে, সেগুলোর আশ্রয় নেওয়াই ভালো। সেগুলো সব ধরনের মানুষের জন্যেই কাজ করে। যেমন হালকা রঙের পোশাক পরতে পারেন বা পোকামাকড় নিরোধক ব্যবহার করতে পারেন। মশার উপদ্রবের সময়, অর্থাৎ সন্ধ্যা ও ভোরে বাইরের কার্যকলাপ কমাতে পারেন। এছাড়া রাতে শোয়ার সময় মশারি টাঙানো তো রয়েইছে।
তবে মশা নিরোধক যে কাজ করবেই, সেই গ্যারান্টি অনন্তকাল দেওয়া মুশকিল। অভিযোজনের ফলে মশার মধ্যেও প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠতে দেখা গেছে। তাই নানারকম গবেষণা চলছে মশাদের নিয়ন্ত্রণ করার নতুন ফিকির বার করতে। সেই গল্প থাকবে পরের পর্বে।
প্রচ্ছদ: শ্রেয়া সুধীর