প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘আত্মচরিত’-এ লিখছেন—”সম্প্রতি পারদের উপর অ্যাসিডের ক্রিয়ার দ্বারা মার্কিউরাস নাইট্রেট প্রস্তুত করিতে গিয়া, আমি নীচে এক প্রকার পীতবর্ণের দানা পড়িতে দেখিয়া কিয়ৎ পরিমাণে বিস্মিত হইলাম। … এই নূতন মিশ্র পদার্থ গবেষণার যোগ্য বিষয় মনে হইতেছে।”
কী ছিল সেই আবিষ্কার? সেই গোড়ার কথা জানতে গেলে আমাদের চলে যেতে হবে প্রায় দেড়শো বছর আগের কলকাতা শহরে।
ভ্যাজাল ধরার গবেষণা
সেকালে বাঙালির রান্নাঘরে ঘি এবং সরষের তেলের বেশ প্রচলন ছিল। আজও যেমন আছে। সরষের তেলে ভাজা মাছ। আর ঘিয়ে ভাজা লুচি।
তবে বাজারে এইসব জিনিসে ভেজাল দেওয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল তখন থেকেই। ভেজালের পরিমাণ কীরূপ এবং কতটা তা খতিয়ে দেখতে প্রফুল্লচন্দ্র তৎপর হলেন। নানান জায়গা থেকে ঘি-তেল আনানো হল। নিজের তত্ত্বাবধানে খাঁটি ঘি আর সরষের তেলও বানানো হল। ‘কন্ট্রোল এক্সপেরিমেন্টে’-এর জন্য। সেজন্যে তাঁর সামনে গাই-মহিশ দোয়ানো হল। সেখান থেকে মাখন। মাখন থেকে ঘি। আবার সরষে ভাঙিয়ে সরষের তেলও তৈরি হল।
সেই তেলে ভেজাল তেল মিশিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে একটা ‘স্ট্যান্ডার্ড’ তৈরি করে নিলেন। তারপর এই সব প্রামাণ্য ঘি-তেলের সাথে দোকানের ঘি তেলের কতটা তফাৎ, তা খুঁজে বার করলেন। সেই সব গবেষণা প্রকাশ করেন 1894 সালে। ‘দ্য জার্নাল অব এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল’ পত্রিকায়।
বাংলায় বিশ্বমানের ল্যাবরেটরি
গবেষণা তার বেশ লাগছিল। ঠিক যেন ‘ডিটেকটিভ ওয়ার্কস’। গোয়েন্দারা যেমন তাদের ক্ষুরধার বুদ্ধি দিয়ে কোনো জটিল রহস্যের উন্মোচন করেন। বৈজ্ঞানিক গবেষণাও অনেকটা সেইরকম। প্রকৃতির গূঢ় রহস্যের উন্মোচন।
কিন্তু ভালো গবেষণা করতে গেলে প্রয়োজন ভালো ল্যাবরেটরির। প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়ন বিভাগের ল্যাবরেটরি তেমন যুতসই ছিল না। পরীক্ষাগারে উৎপন্ন ক্ষতিকর গ্যাস নিষ্কাশনের তেমন সুব্যবস্থা কই? বিশেষত বর্ষাকালে ধোঁয়া আর গ্যাসে আচ্ছন্ন হয়ে থাকতো সারা ল্যাবরেটরি। বলা বাহুল্য, এইসব গ্যাস স্বাস্থ্যের পক্ষে মোটেই ভালো নয়।
তাই প্রফুল্লচন্দ্র কলেজের প্রিন্সিপাল টনী সাহেবকে অনুরোধ করলেন— ‘ল্যাবরেটরিতে একবার আসবেন প্লিজ’? সাহেবের ছিল ফুসফুসের রোগ। ল্যাবে ঢুকে টনী সাহেব তো একেবারে যায় যায় অবস্থা। মিনিট কয়েকের বেশি সেই স্থানে থাকতেই পারলেন না। বেরিয়ে গেলেন। তবে সত্বর একটি ভালো ল্যাবরেটরির প্রতিশ্রুতি দিলেন প্রফুল্লচন্দ্রকে!
প্রফুল্লচন্দ্রের কাছে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারের একটি বর্ণনাপত্র ছিল। কিছু জার্মান ল্যাবেরও নকশা জানা ছিল। সেই সব প্ল্যান অনুসরণ করে আধুনিক এক ল্যাবরেটরি তৈরি করা হল।
সে একটা দেখার মতো জিনিস হল। দেশের নানা প্রান্ত থেকে সেই নতুন পরীক্ষাগার দেখতে গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আসতে লাগলেন। এর ফলে প্রফুল্লচন্দ্র নতুন নতুন গবেষণায় বেশ উত্তেজনা পেলেন।
তিনি কিছু ধাতুর রাসায়নিক বিশ্লেষণ করছিলেন। আশা ছিল যদি নতুন কিছু আবিষ্কার করা যায়। টমাস হল্যান্ড ছিলেন জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সহকারী এবং প্রেসিডেন্সি কলেজের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক। হল্যান্ড সাহেব কিছু ধাতুর নমুনা প্রফুল্লচন্দ্রকে দিয়েছিলেন। প্রফুল্লচন্দ্র সেগুলি ‘Crooks Select Method in Chemical Analysis’ অনুসরণ করে বিশ্লেষণ করছিলেন (Nature 1871, 4, 81–82))। এই বিষয়ে গবেষণা চলতে চলতেই তিনি এমন একটি মিশ্র পদার্থ আবিষ্কার করেন, যাতে তাঁর নাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাটি ঘটে অপ্রত্যাশিতভাবেই।
বিক্রিয়ায় অচেনা পদার্থ
বিজ্ঞানে অপ্রত্যাশিত আবিষ্কার বা ‘serendipity’ নতুন কিছু নয়। 1879 সালে কন্সতান্টিন ফালবার্গ আমেরিকার জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে আলকাতরা থেকে পাওয়া কিছু যৌগ নিয়ে কাজ করছিলেন। কোনো কারণে তার হাতের আঙুল চেটে দেখলেন কেমন যেন মিষ্টি মিষ্টি লাগছে। সেখান থেকেই তৈরি হল স্যাকারিন-— artificial sweetner। 1928 সালে অ্যালেক্সান্ডার ফ্লেমিং লন্ডনের সেইন্ট মেরি হাসপাতালে কাজ করার সময় দেখলেন তার ব্যাকটেরিয়া প্লেটে ‘পেনিসিলিয়াম নটেটাম’ নামে একপ্রকার ছত্রাক বাসা বেঁধেছে। আর এই ছত্রাক যেখানে জন্মেছে সেখানে ব্যাকটেরিয়া জন্মাচ্ছে না। সেখান থেকেই পেনিসিলিন অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কার। আমেরিকার ডুপন্ট কেমিক্যাল ফার্মের রসায়নবিদ রয় প্লাঙ্কেট টেট্রাফ্লুওরো ইথিলিন নিয়ে কাজ করছিলেন। তিনি দেখলেন একটা সিলিন্ডারের নিচে টেট্রাফ্লুওরো ইথিলিন জমাট বেঁধে তৈরি করেছে একটা non-stick এবং তাপরোধী একটা পদার্থ। যা আজকে ‘টেফ্লন’ নামে পরিচিত। এটি নন-স্টিক বাসনপত্র বানাতে ব্যবহার হত। এইরকম উদাহরণ প্রচুর। তাই বিজ্ঞানীদের চোখ-কান খোলা রেখে কাজ করতে হয়। সর্বদা সজাগ থাকতে হয়। কী জানি কী বানাতে গিয়ে কী তৈরি হয়ে যায়! কী জানি কোথা থেকে আপেল মাথায় পড়ে মহাকর্ষের সূত্র বলে যায়!
প্রফুল্লচন্দ্র বানাতে চাইছিলেন মারকিউরাস নাইট্রেট।
তার জন্য পারদের সঙ্গে লঘু নাইট্রিক অ্যাসিডের বিক্রিয়া ঘটাতে হয়। এমনিতে নাইট্রেট জলে দ্রবীভূত হয়ে যায়। কিন্তু প্রফুল্লচন্দ্র লক্ষ্য করলেন একটা হলুদ রঙের স্ফটিক পদার্থ। অদ্ভুত ব্যাপার। এটা আবার কী? এইরকম তো কোনো বইয়ে লেখা নেই। তিনি ওয়াটস-এর Dictionary of Chemistry খুলে দেখলেন। রস্কো-শারলেমার বিখ্যাত বইটিতে তখনকার দিনের সব যৌগের বিস্তারিত বিবরণ ছিল। প্রফুল্লচন্দ্র সেই বইটিতেও অনুসন্ধান চালালেন। কিন্তু না, এরকম কোনো যৌগ উৎপন্ন হবার কোনো কথা লেখা নেই। তাহলে কি তিনি কোনো নতুন কিছু আবিষ্কার করে ফেললেন? প্রফুল্লবাবু বেশ ভালো করে বস্তুটিকে দেখলেন। তারপর সেই হলুদ স্ফটিক পদার্থের রাসায়নিক বিশ্লেষণ চালালেন।
‘মাস্টার অব নাইট্রাইট’
তিনি রাসায়নিকভাবে প্রমাণ করলেন পদার্থটিতে মারকিউরাস এবং নাইট্রাইট দুইই আছে। সুতরাং এটি মারকিউরাস নাইট্রাইট। পারদের এইরকমের যৌগ (+1 অক্সিডেশন স্টেট) তখন খুব কমই পাওয়া যেত। সুতরাং প্রফুল্লচন্দ্র রাতারাতি বিজ্ঞানী মহলে পরিচিত হয়ে গেলেন। ভারতের মতো দেশে যেখানে ভালো গবেষণার সুযোগ ছিল না, সেই রকম পরিবেশে একটি নতুন যৌগের আবিষ্কার বেশ গুরুত্বপূর্ণই। উত্তেজনাপূর্ণও বটে। এই যৌগের আবিষ্কার তাঁর জীবনে একটা নতুন অধ্যায় খুলে দেয়। তারপর থেকে তিনি আরও অনেক নাইট্রাইট যৌগ যেমন, অ্যামোনিয়াম নাইট্রাইট, অ্যালকাইল অ্যামোনিয়াম নাইট্রাইট ইত্যাদি তৈরি করা শুরু করলেন। বিজ্ঞানীমহলে অচিরেই ‘মাস্টার অব নাইট্রাইট’ বলে পরিচিত হলেন। তবে প্রফুল্লচন্দ্রের মারকিউরাস নাইট্রাইট নিয়ে পরে বেশ জলঘোলা হয়।
1966 সালে আমেরিকার নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আর. এ. পটস প্রভৃতি বিজ্ঞানীরা প্রফুল্লচন্দ্রের পদ্ধতি অনুসরণ করে মার্কিউরাস নাইট্রাইট তৈরি করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। তাঁরা কিছু হলুদ পদার্থ উৎপন্ন হতে দেখেন। কিন্তু সেটা যে মারকিউরাস নাইট্রাইট সেটা প্রমাণ করতে পারেননি। সেটা খুবই অস্থায়ী যৌগ ছিল। তাঁরা লিখছেন – “This compound was reported by Ray, and an attempt was made to prepare it by his method. The described yellow crystals were obtained, but they slowly decomposed with an odor of nitrogen dioxide over them, leaving an unidentified solid.” তবে পরবর্তীকালে বাঙালি রসায়নবিদ অনিমেষ চক্রবর্তী ওই হলুদ স্ফটিক পদার্থের বিশ্লেষণ করেন। 2011 সালে এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির সাহায্যে তিনি প্রমাণ করেন যে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বর্ণিত হলুদ বস্তুটিতে পারদ এবং নাইট্রাইট দুইই রয়েছে। সুতরাং বিতর্কের অবসান হয়।
মারকিউরাস নাইট্রাইট নিয়ে আরেকটি বিতর্কের কথা না বললেই নয়। সেটা হল— প্রফুল্লচন্দ্র সত্যই এই যৌগ প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন কি না। এই বিতর্কের মূলে রয়েছে জাপানের ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ডাইভার এবং হাগা প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র। এই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয় 1887 সালে। প্রফুল্লচন্দ্রের মারকিউরাস নাইট্রাইট আবিষ্কারেরও (1896) প্রায় এক দশক আগে। এই গবেষণাপত্রে জাপানের বিজ্ঞানীদ্বয় মারকিউরাস নাইট্রাইট যৌগটির কথা লিখেছেন। কিন্তু সেটি কীভাবে তৈরি করতে হবে তাঁর বিশদ বিবরণ দেননি। তাই এটা বলা হয়তো ভুল হবে প্রফুল্লচন্দ্র মারকিউরাস নাইট্রাইট আবিষ্কার করেছিলেন। বলা যেতে পারে তিনি এই যৌগটি বানানোর একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। সেই আবিষ্কার ছিল অপ্রত্যাশিত। সেই বিতর্ক এখন থাক। পরে বিস্তারিত ভাবে কোথাও আলোচনা করা যেতে পারে।
তবে বাংলার তথা ভারতের নবজাগরণের অন্যতম কান্ডারি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের অবদান শুধু এই হলুদ রঙের মারকিউরাস নাইট্রাইটে খুঁজলে ভুল হবে। তাঁর অবদান ইংরেজদের অধীনে থেকেও একটা ‘modern school of chemistry’ গড়ে তোলায়। সত্যেন বোস আর মেঘনাদ সাহার মতো সুযোগ্য ছাত্র তৈরিতে। বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশবাসীকে স্বনির্ভর করে তোলার প্রচেষ্টায়। ‘A History of Hindu Chemistry’-র মতো প্রামাণ্য গ্রন্থ রচনায়। দেশের দুঃখ-দুর্দশায় ঝাঁপিয়ে পড়ায়। আর সর্বোপরি ‘বাঙ্গালীর মস্তিষ্কের অপব্যবহার’ রুখতে পথ দেখানোয়।
তথ্যসূত্রঃ
1) আত্মচরিত, প্রফুল্লচন্দ্র রায় (Publisher: Oriental Book Company, 1930)
2) On Mercurous Nitrite, PC Ray (Asiatic Society of Bengal, 1896, Vol LXV, Part II, 1-9)
3) An intellectual history of P.C. Ray’s papers on the nitrites of mercury, সুব্রত দাশগুপ্ত (Indian Journal of History of Science, 2023, 58, 20)
4) Thermodynamic and Kinetic Aspects of the Stability of Sir P.C. Ray’s Mercurous Nitrite compound, অসীম কুমার দাস (Resonance, 2020, 25, 787-799)
5) Mercury (I) compounds, Potts & Allred (Inorganic Chemistry, 1966, 5(6),), 1066-1071.
6) Chemistry of nitrites: Contributions of PC Ray and some later developments, অনিমেষ চক্রবর্তী, 2014 (J. Indian Chem. Soc., 2014, 91, 1205)
7) The reactions between sulfites and nitrites of metals other than potassium, Divers & Haga (Journal of the Chemical Society, Transactions, 1887, 51, 659-663).
8) Mercurous nitrite, Rajarshi Ghosh (Resonance, 2014, 19(10), 958-960).