বাড়ির আনাচে-কানাচে হোক কিংবা খাবার পাতে, ছোটোবেলার সহজপাঠের বইয়ের ব্যাঙের ছাতার সঙ্গে পরিচয় আছে আমাদের সকলের। এহেন মাশরুমদের আমরা চিনি ভুঁইফোড় নামেও। সারা বছর কমবেশি দেখা গেলেও বর্ষাকালের আর্দ্র, স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশই তাদের বেশি পছন্দের। পচে যাওয়া কাঠ, পাতা থেকে শুরু করে কেটে রাখা গাছের গুঁড়ি, গোবর এমনকি মাটি ফুঁড়েও এরা জন্মায়।
বহুকাল ধরে মানুষ বিভিন্ন কাজে মাশরুম ব্যবহার করে আসছে। প্রাচীনকাল থেকেই মাশরুম জঙ্গলে বসবাসকারী আদিবাসী মানুষদের আহার্য। তাই বলে সবরকম মাশরুমকে খাওয়া যায় এমনটা নয়। সাধারণত সাদা, হালকা বাদামি, ধূসর এবং ধূসর বাদামি বর্ণের মাশরুমগুলিই ভোজ্য হয়। কিছু কিছু প্রজাতিতে বিষাক্ত রাসায়নিক (আলফা আমান্টিন (Alpha-amanitin), অরেলালিন (Orellanine) ইত্যাদি) থাকে ফলে সেগুলো খেলে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। আমরা সাধারণত যে মাশরুম খাই তা বাণিজ্যিক ভাবে চাষ করা হয়। বিভিন্ন জনজাতির উৎসব, রীতি-রেওয়াজের সাথে জড়িয়ে আছে মাশরুম। বহুকাল ধরে চিনারা মাশরুম বিভিন্ন ঔষধ প্রস্তুত করতে কাজে লাগিয়ে আসছে। এমনকি মায়ান ও ইনকাদের লিপিতেও এদের উল্লেখ পাওয়া যায়। আগেকার দিনে উল বা সুতো রং করবার কাজে এর ব্যবহার বহুল প্রচলিত ছিল।
পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় 14000 প্রজাতির মাশরুম পাওয়া যায়। প্রত্যেকের আকার যেমন বিচিত্র তেমনই কেউ রঙচঙে, কেউ বা ফ্যাকাসে। প্রকৃতিতে আমরা যে সব ধরনের মাশরুম দেখতে পাই, তাদের বাইরের গড়নের ওপর ভিত্তি করে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই যেমন — ‘অ্যাঁগারিক্স’ (Agarics), ‘বেল্ট’ (Belts), ‘ব্রাকেট’ (Brackets), ‘চানটারেল’ (Chanterelles), কোনোটা আবার রং বেরঙের ‘কোরাল মাশরুম’ (Coral ),‘কাপ’ (Caps), ‘জোলি’(Jelly), ‘পলিপোরাস’ (Polypores) কিংবা ‘সাইকোডেলিক’ (Psychedelic)। কেউ বা পাফবল (Puffball) আবার শিং-এর মতো দেখতে ‘স্টিংহর্ন (Stinghorn) বা টুথ (Tooth)’ প্রকৃতির। তবে মাশরুম চেনা সর্বদা সহজ হয় না। বিশেষজ্ঞরা সাধারণত এর টুপির গঠন, রং, টুপির নিচের ফুলকার মতো গড়নের বৈচিত্র্য, গন্ধ, বাসস্থান এবং ভেতরের মাংসল অংশ দেখে এদের শনাক্ত করেন। এবার পরিচয় করা যাক আমাদের আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা বেশ কিছু প্রজাতির মাশরুমের সঙ্গে।
জেলি মাশরুম (Jelly mushroom)
ডাক্র্যরোপিনাক্স (Dacryopinax) প্রজাতির এই মাশরুমটি উজ্জ্বল কমলা বর্ণের। সাধারণত বাকল বিহীন পচা কাঠের উপর একসাথে অনেকগুলি জন্মায়। দেখতে ভারী সুন্দর। চিন দেশের লোকেরা এটিকে ভালোবেসে কমলা ওসম্যানথাস (Osmanthus) ফুলের সাথে তুলনা করে। খেতেও সুস্বাদু। ‘বুদ্ধা’স ডিলাইট’ (Buddha’s Delight) নামক জনপ্রিয় চিনা খাবারে এটি ব্যবহৃত হয়।
ডেড ম্যানস ফিঙ্গার (Dead man’s finger)
শক্তপোক্ত গঠন, গায়ের রং ধূসর বা বাদামি। মাথার দিকটা আমাদের নখের মতো, উজ্জ্বল। কিছু কিছু প্রজাতিকে দেখতে অবিকল মৃত মানুষের আঙ্গুলের মতো। বনবাদাড়ে হঠাৎ চোখে পড়লে ভয়ের সঞ্চার হবে বৈকি!
মুক্ত মাশরুম (Pearl mushroom)
ধবধবে সাদা এই মাশরুমগুলি লেন্টিনাস (Lentinus) গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। বর্ষাকালে গাছের গুড়িতে দল বেঁধে জন্মায়। শক্ত গড়ন এবং খেতে সুস্বাদু। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা প্রথম এর চাষ শুরু করে। আজ সারা বিশ্বে বাণিজ্যিক ভাবে এর উৎপাদন হচ্ছে।
ফুলকা মাশরুম (Gill mushroom)
উপরের পিঠ সাদা, নিচের দিকটা বাদামি বর্ণের। ছোটো অবস্থায় গরুর গাড়ির চাকার মতো লাগলেও পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় মাছের ফুলকার মতো দেখায়। পচে যাওয়া কাঠের গুড়ি, কাটা ডাল, গাছের বাকলের উপর দলবদ্ধ ভাবে জন্মায়। এই মাশরুমগুলি ঔষধি গুণে ভরপুর। মনিপুরে এটি ‘ক্যাঁনগ্ল্যায়েন’ (Kangla yen) নামে পরিচিত। মনিপুরি লোকেরা এটি দিয়ে ‘পাকনাম’ (Paknam) নামক এক ধরনের সুস্বাদু পিঠে বানায়। পাশের রাজ্য মিজোরামে ‘পাসি’ (Pasi) নামে এর পরিচিতি রয়েছে।
স্টিংক হর্ন মাশরুম (Stinkhorn mushroom)
এদের জীবন শুরু হয় ডিমের মতো অংশ থেকে। সময়ের সাথে সাথে তা বিকশিত হয়ে লম্বা, মাংসল দেহটি বেরিয়ে আসে। বেশিরভাগ প্রজাতিই সাদা কিংবা ধূসর হলুদ। দেহের শেষ প্রান্তে চটচটে টুপির মতো অংশ থাকে। এটিকে রিসেপটিকুলাম (Receptaculum) বলে। এই মাশরুমের কাছে গেলে পচা গোবর অথবা মরা জীবজন্তুর মতো কটু গন্ধ নাকে আসে। তবে এই দুর্গন্ধেই আকর্ষিত হয় বিভিন্ন প্রকারের পোকামাকড়রা। যেমন — বিভিন্ন প্রজাতির মাছি, গুবরে পোকা, এমনকি প্রজাপতিও। এরা রেণু ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। কিছু কিছু প্রজাতির স্টিং হর্ন (Stinkhorn)-এ রিসেপটিকুলাম (Receptaculum) থেকে সাদা জালের মতো অংশ নেমে আসে মাটি অবধি। ভারী সুন্দর দেখায় এদের তখন। তবে মাত্র কয়েকদিন বাঁচে এরা। স্যাঁতস্যাঁতে জায়গা বা বাঁশঝাড়ে একটু খোঁজ করলে এদের দেখা পেতে পারো।
অ্যাসকোবোলাস (Ascobolus)
সারা পৃথিবীতে প্রায় 61 প্রজাতির অ্যাসকোবোলাস মাশরুম পাওয়া যায়। হালকা সবুজ রঙের গোলাকার দেহ। ভেতরের অংশ কালো রেণুতে ঢাকা। ছোটো অবস্থায় দেখলে মনে হবে অনেকগুলো ছোটো বাটি বসানো আছে যেন। পূর্ণাঙ্গ হলে একত্রে ফুলের পাপড়ির মতো দেখায়। তৃণভোজী প্রাণীদের মলের উপর জন্মালেও নিজস্ব সৌন্দর্যের পরিচায়ক।
নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন, বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞরা মাশরুম চাষ ও গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এবারে বলি, মাশরুমদের আমরা চিনবো কী করে। কী করেই বা জানবে তাদের নামধাম, ঠিকুজি। এর জন্য মাশরুম-বিশারদ না হলেও চলবে। পড়াশুনা বা কাজের মাঝে ফুরসৎ মিললেই ক্যামেরাকে কিংবা মোবাইল সঙ্গী করে ঢুঁ মারা যায় বাড়িরই বাগানে কিংবা আসেপাশে। ঝটপট লিখে ফেলা যায় কোন মাশরুম কেমন আর কী বা তার বৈশিষ্ট্য। প্রয়োজনে ইন্টারনেটের সাহায্যও নেওয়া যেতে পারে। উৎসাহীরা পশ্চিমবঙ্গ জীববৈচিত্র্য পরিষদ-এর “বাংলার ভোজ্য ছাতু” বইটি সংগ্রহে রাখতে পারেন। এভাবেই প্রকৃতির মাঝে যত সময় কাটাবে, ততই মাশরুমের বর্ণময় জগৎ ধরা পড়বে আমাদের চোখে।
ছবি: সৌরভ বিশ্বাস