হাতেকলমে শেখা
শ্রেণীকক্ষে মাস্টারমশাই যুক্তি প্রয়োগ করে ব্ল্যাকবোর্ডে যা পড়ান, পড়ুয়া যখন হাতে-কলমে পরীক্ষার মাধ্যমে তা চাক্ষুষ করে তখন সে পায় বিশ্বজয়ের আনন্দ। হাজার মুখস্থ করেও এই অনুভূতি পাওয়া অসম্ভব। আর সাথে সাথে অধীত বিষয়ও আত্মস্থ হয়। সংশ্লিষ্ট ধারণাও বহুদিন টিকে থাকে মনে।
আবার যদি পরীক্ষা করার সময় সামান্য কিছু অদল বদল করে নতুন কোন ঘটনা সে পর্যবেক্ষণ করে, এমন ঘটনা যা সে আগে কখনো দেখেনি বা শোনেনি, তবে তা হবে নতুন সৃষ্টি – যা অনাসৃষ্টি নয়। এটাই তো ঐ ছাত্র বা ছাত্রীর কাছে গবেষণা।
এই গবেষণা শুরু হতে পারে কৈশোর থেকেই। কিন্তু এ তো এক অভ্যাস – নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সঠিক ভাবে জানার প্রক্রিয়া। কৌতূহল উস্কে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ও সাথে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কৌতূহলের নিবৃত্তি (Curiosity driven learning) – এই হল পথ। হঠাৎ করে পড়ার বিষয়ে কিছু যন্ত্রপাতি দিয়ে ঐ কৈশোরে পড়ুয়াদের আকর্ষণ করা কি এতই সোজা কাজ?
যা আছে হাতের কাছে
এক্ষেত্রে একটু বিকল্প পথ ধরতেই হবে। খুব সহজলভ্য কোন বস্তু দিয়ে পড়ুয়াদের বিভিন্ন কাজ দেওয়া যেতে পারে – এটা বানাও, ওটা বানাও। চিত্র ১ এ কিছু নমুনা আছে যার উপর বিভিন্ন প্রশ্ন দেখতে হলে তথ্যসূত্র – ১ দেখুন।
নিজেদের চারিপাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণের উপরও অনেক রকম কাজ হতে পারে। কাজগুলোর মধ্যে পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ দেওয়া থাকবে না। অর্থাৎ বিভিন্ন জন একই কাজ আলাদা আলাদা রকম করে নতুনত্ব আনতে পারে। একই কাজে নিজেদের ভিন্ন ভাবনা ও উদ্ভাবনী কৌশল প্রয়োগ করে যখন তারা নতুন নতুন এবং আলাদা আলাদা জিনিস বানাবে, তারা নিজেই বুঝবে সৃজনশীলতার গুরুত্ব। এই ধরণের কাজের জন্য জটিল সরঞ্জামের প্রয়োজন নেই। ছেলেমেয়েদের বাড়িতে থাকা জিনিসপত্র বা কম দামের কিছু যন্ত্রপাতি দিয়ে ছোট ছোট পরীক্ষা এবং প্রকল্প সহজেই করানো যায়।
এই ভাবে কিছু তৈরি করা বা পরখ করার আসল উদ্দেশ্য হবে পড়ুয়াদের হাতে-নাতে কাজ করার মজা ধরানো। আশা রাখা যায়, এই মজার কাজগুলো করতে করতে তারা বিজ্ঞান পড়ার সময়ও প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার দিকে ঝুঁকবে। বিভিন্ন প্রশ্ন আসবে ওদের মধ্যে। উত্তর খুঁজতে ওরা নিজেরাই ক্রমে আকৃষ্ট হবে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার একটু অদল-বদল ঘটিয়ে নতুন ভাবে পরীক্ষা করতে।
এছাড়াও মাস্টারমশাই এবং অভিভাবকদের লক্ষ্য থাকবে বাড়ি বা স্কুলে, যতটা পারা যায়, প্রয়োগমূলক কাজে ওদের উদ্বুদ্ধ করা। এতোসবের যেটা চূড়ান্ত লক্ষ্য তা হল, এগুলোর মধ্যে ওদের lateral, critical এবং creative চিন্তার বিকাশ ঘটানো।
ছাত্রদের দ্বারা কতটা সম্ভব
এইরকম হাতেকলমে পরীক্ষার অভ্যাস করতে থাকলে এক ধরণের ‘দেখার চোখ’ তৈরি হবে পড়ুয়াদের। সমস্যা নিজেরা চিহ্নিত করতে পারবে।
সাধারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যেও যে কত রহস্য লুকিয়ে থাকে, তার একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
একদিন ঘরের মেঝেতে একটা উত্তল লেন্সকে (convex lens) আটার লেচির উপর বসিয়ে দিয়ে তার সামনে একটা ৬০ ওয়াটের ফিলামেন্ট ল্যাম্পকে রাখা হল। দেওয়াল থেকে বাল্বের দূরত্ব বাড়িয়ে কমিয়ে এমন ভাবে স্থির করা হল যাতে করে লেন্সের পিছনের দেওয়ালে ফিলামেন্টের স্পষ্ট প্রতিবিম্ব তৈরি হয়। এটা তো হবেই, আমরা সবাই জানি। কিন্তু অবাক হয়ে দেখা গেলো ফিলামেন্টের এক উজ্জ্বল প্রতিবিম্ব, তা ফিলামেন্টের দিকে ও লেন্সের বেশ কাছেই (চিত্র ৩)।
এই ঘটনার সঠিক পর্যবেক্ষণ করে লেন্সের উপাদানের প্রতিসরাঙ্ক ও তার দুই তলের বক্রতা ব্যাসার্ধও নির্ণয় করা হয়, আর তা নিতান্ত অবহেলায়। কিন্তু ঐ অনুসন্ধান এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে সংশ্লিষ্ট গবেষণা পত্রটি একটি সুখ্যাত আন্তর্জাতিক মানের পত্রিকায় প্রকাশিত হয় [৪]। বলে রাখা ভালো, চূড়ান্ত স্তরের পরীক্ষাটি করা হয়েছিল এই গবেষণা পত্রের প্রথম লেখকের বাড়ীর টেবিলে।
কেউ কেউ বলবেন উপরের উত্তল লেন্সের পরীক্ষা এক আকস্মিক ঘটনার পরিণতি মাত্র। ছেলেমেয়েরা যদি পরীক্ষা করে, তারা সবসময়ই কি এই ধরনের “অ-স্বাভাবিক” ঘটনা পর্যবেক্ষণের সুযোগ পাবে? ঐ ঘটনা দেখলেও সে কি পরবর্তী ধাপের অনুসন্ধানের জন্য প্রয়াসী হবে?
হয়ত সত্যিই তা নয় বা সবাই হয়তো বিজ্ঞানে ঠিক সৃজনশীল হবে না। কিন্তু প্রত্যেকেরই কোন না কোন বিষয়ে বিশেষ ধরনের পারদর্শিতা থাকেই। আর সেটা আবিষ্কার করাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা শিক্ষকদের কাজ। স্কুলে যাওয়ার পর থেকেই সব শিশুকেই ভূগোল, ইতিহাস, সমাজ সম্পর্কে, এমনকি আমাদের সংবিধান সম্পর্কেও অবহিত করানো হয়। আর তা করা হয় একান্ত সঠিক ভাবেই, শিক্ষার প্রয়োজনীয় উপাদান হিসাবেই। কতটা আমরা সফল হই, সেটা অন্য কথা। কিন্তু এটা তো ঠিক যে, এই শিক্ষাক্রমের কোন উদ্দেশ্য নেই প্রতিটি পড়ুয়াকে ভবিষ্যতের ঐতিহাসিক, ভৌগলিক, সমাজবিজ্ঞানী বা সংবিধান বিশেষজ্ঞ হিসেবে গড়ে তোলার। প্রতিটি শিশু ভবিষ্যতে সমাজসচেতন সুনাগরিক হবে – এটাই শিক্ষাক্রমের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। সেরকমই বিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের পাঠ দেওয়ার উদ্দেশ্য নয় নিছক বৈজ্ঞানিক তৈরি করা। কিন্তু আশা করা যায় তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হবে বৈজ্ঞানিক।
আসলে এইরকম চর্চার ফলে আস্তে আস্তে একটা বিশ্লেষণী মন, যথার্থভাবে ভাবার ক্ষমতা, সমস্যা বাছার ক্ষমতা এবং শেষপর্যন্ত সঠিক সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার ক্ষমতা তাদের মধ্যে জন্মাবে। ভবিষ্যতে বিজ্ঞান বা অন্য যে কোন পেশায় তারা এই বিজ্ঞান অনুসন্ধিৎসু মনের পরিচয় দিতে পারবে। এটা আখেরে সমাজের পক্ষে শুভ ও মঙ্গলদায়ক।
কতটা শিখেছে বুঝবে কীভাবে
হাতেকলমে পরীক্ষা ছাড়াও শিক্ষাবিজ্ঞানের আধুনিক চিন্তাধারা প্রয়োগ করার অন্যান্য পদ্ধতি রয়েছে। ছেলেমেয়েদের মধ্যে সৃজনাত্মক চিন্তাভাবনা করার দক্ষতা বাড়িয়ে তোলার জন্য real-time feedback (চিত্র ২) নেওয়ার বন্দোবস্ত করা যায় শ্রেণীকক্ষে [২]।
শিক্ষক বা শিক্ষিকাকে অধীত বিষয়ের উপর পড়ুয়াদের বোধ যাচাইয়ের জন্য কিছু সময় অন্তর নিজের তৈরি করা সম্পূর্ণ বোধমূলক প্রশ্ন করতে হবে। এইভাবে real-time অর্থাৎ শ্রেণীকক্ষে পড়ানোর সময় শিক্ষক হাতেনাতে বুঝে যাবেন তাঁর বক্তব্য কত ছাত্রছাত্রী ঠিকমত বুঝতে পেরেছে। এব্যাপারে ছাত্রদের উৎসাহ বাড়াতে মজাদার কার্টুন প্রশ্নের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে [৩]।
এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, যে সব স্কুলে Atal Tinkering Laboratory (ATL) আছে, তাদের তো পোয়া বারো। প্রশ্নগুলি পড়ুয়াদের সকলের সামনে একসাথে তুলে ধরার জন্য সবচেয়ে কার্যকরী হতে পারে ATL এর প্রজেক্টর। এছাড়াও, ATL-এ নতুন নতুন কাজকর্ম করে পড়ুয়াদের মজা ধরানোর সুযোগ হাতের মুঠোয়।
এতক্ষণ যা আলোচনা করা হচ্ছিলো তা পোশাকী ভাষায় বলতে গেলে “Bottom-up Approach”। এই উপায়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষিকারা যেমন তাদের বিজ্ঞান পড়ানোর উপায় সম্পর্কে মনোভাব বদলাবেন, তেমনি পড়ুয়ারাও সঠিক ভাবে বিজ্ঞান নিয়ে ভাবতে ও শিখতে পারবে।
আর একটি পথ কিন্তু খোলা আছে, যাকে বলা যাবে “Top down Approach”। আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষার একেবারে উপরের স্তরে যারা আছেন, অর্থাৎ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অধ্যাপিকাগণ বা গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীগণ, তারা এই পথে অংশগ্রহণ করতে পারেন। তারা একেবারে আধুনিক গবেষণার বিষয়ের খুঁটিনাটি বা তার কোন অংশ সহজ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর স্তরের ছেলেমেয়েদের সামনে সহজ ভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। ঐ স্তরের পড়ুয়ারা তাতে আধুনিক গবেষণার হাল-হকিকত সম্পর্কে যেমন জানবে, তেমনি তারা এইসব তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী বা পরীক্ষাবিদ বিজ্ঞানীদের মধ্যে থেকে নিজেদের icon খুঁজে পাবে ও সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পাবে। তবে এখানেও তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী এবং পরীক্ষাবিদ বিজ্ঞানীদের একটি গুরুদায়িত্ব থাকবে নিজেদের মধ্যে সময়োপযোগী মেলবন্ধন গড়ে তুলে বিজ্ঞান শিক্ষার পরিপূর্ণ অভিমুখ ছেলেমেয়েদের সামনে তুলে ধরার।
হাতেকলমে বিজ্ঞানচর্চা থেকে জীবিকার সুযোগ
পরীক্ষাগারনির্ভর হাতেকলমে বিজ্ঞানচর্চা মানুষকে অনেকটা সপ্রতিভ আর অভিজ্ঞ করে তোলে যা পরবর্তীকালে জীবিকা অন্বেষণেও সহায়ক হয়।
NCERT উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞানের যে গ্রন্থ প্রকাশ করেছে, তাতে এমন কিছু বিষয় ঢোকানো হয়েছে যেগুলির অনুশীলন করলে উচ্চ মাধ্যমিকের পড়ুয়ারা দৈনন্দিন ব্যবহারের বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবে। শুধু তাই না, তারা সেগুলি সারাতে পারবে, এমনকি তৈরিও করতে পারবে। একটু চেষ্টা করলে ওরা বাড়ির প্রয়োজনীয় বৈদ্যুতিকীকরণেও সফল হবে।
আমরা সবাই জানি কয়লা পুড়িয়ে যে বিদ্যুৎ তৈরি করা হয় তার দাম ক্রমশঃ বাড়ছে, অন্য দিকে সোলার প্যানেল, যার সাহায্যে সূর্যরশ্মি থেকে যে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়, তার দাম কমছে। তাই অর্থনৈতিকভাবে সোলার প্যানেল ব্যবহার করে বিদ্যুৎ তৈরি করা তুলনামূলক লাভজনক [৫]। উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়াদের প্রত্যেকেই এই কাজ করতে পারে যদি তারা দ্বাদশ শ্রেণীর ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের সিলেবাসের যে সব পরীক্ষা আছে তার অধিকাংশ কাজ করে।
তারপর যাঁরা বাড়িতে বা বড় জায়গায় সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা গড়তে দক্ষ তাদের সাথে একমাসের মত সময় নিয়ে Internship করলে ১০+২ পাশ ছেলেমেয়েরা নিজের কাজ নিজেই খুঁজে নিতে পারবে। তাদের জানতে হবে কি করে সোলার প্যানেল install করতে হয়, রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। সাথে শিখতে হবে ব্যাটারির রক্ষণাবেক্ষণ ও বাড়ির বৈদ্যুতিকীকরণ, এবং জানতে হবে সংশ্লিষ্ট কিছু বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতির গঠন পরিচয় ও ব্যবহার। তার সাথে ছেলেমেয়েরা যদি নিজস্ব উদ্ভাবনী ক্ষমতার গন্ধ জুড়ে দিতে পারে, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। গত কয়েক বছর ধরে Innovation (উদ্ভাবন) এর প্রচারবন্যা বয়ে চলেছে ও উদ্ভাবনের ভাবনা ছাড়িয়ে দেওয়ার জন্য খোলা হচ্ছে Instituion’s Innovation Council (IIC) – কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্তর থেকেই উদ্যোগপতি গড়ার প্রস্তুতি। পড়ুয়ারা স্থানীয় সমস্যা ও চাহিদার উপর ভিত্তি করে তার উদ্যোগের বিষয় ঠিক করবে ও প্রয়োজনীয় বাজার সমীক্ষা করে ব্যক্তিগত উদ্ভাবনী কৌশল মিলিয়ে প্রকল্পকে করে তুলবে অভিনব – এই হচ্ছে এই মিশনের লক্ষ্য। কিন্তু মৌলিক বিজ্ঞানের বিষয়কে আগাপাশতলা না জানলে কীভাবে কর্মনিযুক্তির এই প্রকল্প সফল হওয়া সম্ভব?
কান্ডারি হুঁশিয়ার : ত্রাণকর্তা শিক্ষক
বর্তমানে কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক সমস্যায় নাগরিকদের (বিশেষ করে যারা বৌদ্ধিক স্তরে উন্নত) মধ্যে চুপ ও নিষ্ক্রিয় থাকার এক প্রবণতা এসেছে, যা সত্যি এক সামাজিক সংকট রূপে প্রতিভাত। যে কোনো ব্যাপারে আমাদের সহজ সরল সাফাই: এটা তো আমার কাজ নয়। শিক্ষার এই দুর্দিনে যে কোনো কারণে স্থানীয়, রাজ্য বা কেন্দ্রীয় প্রশাসনের শ্লথতা বা নিষ্ক্রিয়তা থাকলে এক্ষেত্রে সক্রিয় হতে হবে শিক্ষকদেরই। প্রজন্মের পর প্রজন্মে এভাবে বিজ্ঞানশিক্ষায় অপূর্ণতা থেকে গেলে জাতি কিন্তু আঙ্গুল তুলবে শিক্ষকদের দিকে, শিক্ষা প্রশাসক, নীতি নির্ধারক বা মাতব্বরদের দিকে নয়। তাই কান্ডারি হুঁশিয়ার!
শিক্ষার বড় সমস্যা হচ্ছে, প্রাচীন গুরুকুল ব্যবস্থায় শিক্ষকের যে সম্মান ছিল, যে বিশ্বাস ছিল, তাঁর উপর সমাজের যে নির্ভরতা ছিল তার ছিটে ফোঁটাও আর অবশিষ্ট নেই। এ বিষয়ে ড: খান্ডেলওয়ালের পর্যবেক্ষণ প্রণিধানযোগ্য [৬]:
“…সিলেবাস তৈরি, শিক্ষণপদ্ধতি নির্ধারণ বা ছাত্রদের মূল্যায়নের উপর আজকের শিক্ষকের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই ছাত্রদের কাছ থেকে তিনি কোন সম্মান পান না। প্রায়ই সিলেবাসে যা চাওয়া হচ্ছে তার সাথে পরীক্ষার প্রশ্ন পত্রের কোন মিল নেই; আন্দোলনের চাপে প্রশ্নপত্রের গুণমানের অবনমন হচ্ছে। সংজ্ঞা অনুসারে তিনিই ভালো শিক্ষক যাঁর ছাত্ররা লিখিত পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পায়, কিন্তু তিনি ভালো শিক্ষক নন যাঁর ছাত্র বিষয়টা ভালো বুঝেছে।
আমরা এও দেখেছি, এমনকি শিক্ষকদের সম্মান প্রদান অনুষ্ঠানেও শিক্ষক সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করা হচ্ছে – এই হচ্ছে সমাজে শিক্ষকদের অবস্থান। আমরা মন্দ শিক্ষকদের সায় দিচ্ছি না, কিন্তু সমাজকে ঠিক করতে হবে নিচের দুটোর মধ্যে কোন একটি পথ: ক) শিক্ষকদের উপর নজরদারির মত আরো নিয়ন্ত্রণ, অথবা খ) তাঁদের গুরুর সম্মান দেওয়া।”
আমরা চাই দ্বিতীয় পথ (খ) অবলম্বন করা হোক। এর দুটো কারণ। প্রথমত যাঁরা শিক্ষকদের উপর নজরদারি করছেন তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা শিক্ষকদের চেয়ে ভালো নয়, তাঁরা উঁচু সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন, কোন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে না। দ্বিতীয়ত, নজরদারি কখনো সমস্যার মুলে গিয়ে সমাধান করতে পারে না। পরন্তু নজরদারির অজুহাত তৈরি করে বলবেন, যদি কোন ভুল হয়েও থাকে তো তার জন্য তিনি নন, অন্য কেউ দায়ী। কিন্তু সরাসরি দায়িত্ব থাকলে তাঁকেই তার কর্মফল ভুগতে হবে।
সুতরাং জরুরি প্রয়োজন হল (নির্দিষ্ট নির্দেশনামার পরিপ্রেক্ষিতে) শিক্ষককে দায়িত্ব দিতে হবে পাঠক্রম তৈরি করার (তাঁর পছন্দমতো প্রদর্শন এবং পরীক্ষাগার ও পরীক্ষা দেখানোর ভিত্তিতে), পড়ানোর নকশা তৈরি করার, এবং পরীক্ষক হিসেবে কাজ করার (তিনি যেভাবে পছন্দ করেন সে ভাবেই তাঁর ছাত্রদের পরীক্ষা নিয়ে তাঁদের মূল্যায়ন করবেন এই শর্তে)। এই ভাবেই শিক্ষককে তাঁর ছাত্রদের শিক্ষাক্রমের কেন্দ্রীয় অবস্থানে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।”
ড: খান্ডেলওয়ালের এই বিশ্লেষণ এবং সিদ্ধান্ত ছত্রিশ বছর আগের এবং বর্তমানে তো আরো বেশি করে সময়োচিত। শিক্ষকই হোক শিক্ষার মুখ্য নায়ক – এই দাবির সমর্থনে ড. খান্ডেলওয়াল বহুবার বিভিন্ন প্রবন্ধে লিখেছেন, আর অনেক বক্তৃতায় সোচ্চারও হয়েছেন। কিন্তু নীতি নির্ধারকরা এ দাবিতে কর্ণপাত করতে রাজি নন।
বিভিন্ন স্তরের কার্যকরী শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠক্রম ঢেলে সাজাতে গেলে নির্দিষ্ট স্তর গুলি থেকে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের যথোপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব থাকা দরকার। শিক্ষা সম্বন্ধীয় নীতি-নির্ধারণ হোক তৃণমূল স্তরের সুযোগ ও সম্ভাবনার সঠিক বিচার করে। এমন ভাবার একবারেই কোন কারণ নেই যে বিশ্ববিদ্যালয়, IIT প্রভৃতি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মত মৌলিক শিক্ষার সাথে যুক্ত শিক্ষকদের স্বাধীন দায়িত্ব নেওয়ার যোগ্যতা, মূল্যবোধ কিংবা মেধা নেই। গত পঁচাত্তর বছর ধরে তো মৌলিক শিক্ষার ক্ষেত্রে স্বাধীন ভারতবর্ষে অনেক পরীক্ষা – নিরীক্ষা হয়েছে, তবুও তো শিক্ষার অবনমন ক্রমাগত হয়েই চলেছে। সেক্ষেত্রে না হয় আরেকবার পরীক্ষা নিরীক্ষা হোক শিক্ষকদের উপরই সব দায়ভার অর্পণ করে। কিন্তু সেক্ষেত্রে তা করতে হবে সবরকম রাজনৈতিক অনুপ্রবেশের সম্ভাবনার পথ রুদ্ধ করে।
অবশ্য এটাও ঠিক, যাঁদের গুরুর আসনে বসিয়ে গুরু দায়িত্ব দেওয়ার কথা যদি ভাবা হয়, তাঁদেরও প্রমাণ করতে হবে এ কাজে তাঁরা যথার্থই যোগ্য। আমরা জানি বর্তমানের শিক্ষকরা সত্যিই যোগ্য। তা কিন্তু শুধু সাদা-কালোয় লেখা থাকলেই হবে না, নিজেদের প্রয়োগ করে সমাজের কাছে প্রমাণ করতে হবে।
কোভিড-১৯ এর পরে এ দায়িত্ব যেন বহুগুণ কঠিন হয়ে গেছে, কারণ কোভিড-১৯ এর পরবর্তী পর্যায়ে অফলাইনে যেসব পরীক্ষা হচ্ছে, তাতে ছাত্র-ছাত্রীদের ফলাফলের হাল বেশ খারাপ। একটি খোলসা করে বলে যাক। সম্প্রতি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফল দেখে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের বক্তব্য উল্লেখযোগ্য [৭]:
“এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকর্ড। করোনার পরে পড়াশোনার অভ্যাসটাই চলে গিয়েছে। অভ্যাসকে গড়ে তোলার জন্য, পড়ুয়াদের কলেজমুখী করার চেষ্টা শিক্ষকদের করতে হবে।”
তাই শিক্ষকদের প্রমাণ করতে হবে উচ্চ শিক্ষায় প্রবেশাধিকারের জন্য তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের স্থানান্তরে যেতে হবে না। বিশেষ করে কোভিড-১৯ এর পরবর্তী এ সময়ে ছাত্রছাত্রীদের মজার মজার পরীক্ষার মাধ্যমে ভাবনার রসদ জুগিয়ে পড়াশোনায় প্রথমে মন বসাতে হবে। এভাবে পরীক্ষাগারভিত্তিক শিক্ষায় অভিনবত্ব এনে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিজ্ঞান সম্পর্কে আরো কৌতুহল তৈরি করতে হবে, তাদের বিজ্ঞানে আকৃষ্ট করতে হবে। এইভাবেই ছাত্রছাত্রীরা হয়ে উঠবে প্রকৃত বিজ্ঞানপ্রেমী ও বিজ্ঞান মনস্ক, গড়ে উঠবে বিজ্ঞান বিষয়ে তাদের কর্তৃত্ব। বিদ্যালয়ের প্রথাগত পড়াশোনার বাইরেও সমস্ত কাজকর্মে শিক্ষক শিক্ষিকাদের মূল্যবোধ, মেধা, বুদ্ধিমত্তা ও উদ্যোগের দাগ রাখতে হবে। তখনই সমাজ বুঝবে, শিক্ষকরাই জাতির মেরুদণ্ড।
তথ্যসূত্র :
[২] https://bigyan.org.in/2020/10/classroom-science-teaching-by-cards/
[৩] https://bigyan.org.in/2019/11/science-with-cartoon-01/
[৪] Soumen Sarkar & Surajit Chakrabarti, ‘Determination of the refractive index of an equiconvex lens by measuring its focal length and using it as a concave mirror’, Phys. Educ. 57 (2022) 015004
[৫] https://www.cnet.com/home/energy-and-utilities/do-solar-panels-save-money-yes-heres-how/
[৬] ১৯৮৭ IAPT বুলেটিন, পৃষ্ঠা ২১ [৭] https://tv9bangla.com/west-bengal/darjeeling/student-got-fail-in-north-bengal-university-au54-758302.html