ভূমিকা
সম্প্রতি শিক্ষামহলের কাছে দাবী উঠেছে: পরীক্ষার প্রশ্ন সোজা করতে হবে, নম্বর দিতে হবে বেশি, ল্যাবে কাজ করিয়ে ছাত্রছাত্রীর সময় নষ্ট করা চলবে না – কিন্তু প্র্যাক্টিক্যালে একেবারে উঁচু মানের নম্বর চাই। এই সব দাবী পূরণ করতে গিয়ে কিছু শিক্ষককে হতে হয়েছে খলনায়ক, আবার এই দাবী প্রাসঙ্গিক মনে করে কিছু শিক্ষক সেই মোতাবেক সচেষ্টও হচ্ছেন। কিন্তু এরকম অবস্থায় করণীয় কী?
Indian Association of Physics Teachers (IAPT) এর প্রতিষ্ঠাতা ভুয়োদর্শী অধ্যাপক ড: দয়াপ্রসাদ খান্ডেলওয়ালের বক্তব্য ছিল: শিক্ষকই হোক শিক্ষার মুখ্য নায়ক, প্রাচীন গুরুকুল আদলে শিক্ষকই তাঁর ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা সম্পর্কিত সমস্ত সিদ্ধান্ত নেবেন, সেগুলি কার্যকর করবেন। বিজ্ঞান শিক্ষা, বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে ড. খান্ডেলওয়ালের এই বক্তব্য অনুসরণ করে কীভাবে বর্তমান পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যায়, সেইটা ভাববার সময় এসেছে।
অন্য ধরণের এপিডেমিক
অতি সম্প্রতি ভারত সরকারের প্রাক্তন মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অধ্যাপক কৌশিক বসু তাঁর একটি পর্যবেক্ষণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন: “গত দু’আড়াই বছরে পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার জন্য অতিমারি না খারাপ নীতি, কোনটি বেশি দায়ী, তা অন্য প্রশ্ন। তবে মানুষ যতটা বুঝেছে, ক্ষতির গভীরতা তার চেয়ে বেশি।” এই প্রসঙ্গেই ভাল শিক্ষক তৈরি জরুরি বলে জানান তিনি। এখন যদি ভাল শিক্ষক তৈরি না হয়, উপযুক্ত শিক্ষা না পেলে কুড়ি-পঁচিশ বছর পরে ভাল পড়ুয়াও তৈরি হবে না। তখনও এই ভাল শিক্ষকের ঘাটতি চলতে থাকবে। যা সমাজকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাবে [১]।
এক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য কিছুটা হতাশার। কিন্তু আবার আশার বাণী শুনতে পাই তাঁর গলায় – ছাত্রছাত্রীদের কথা বলতে গিয়ে। পুরুলিয়া জেলার পাড়া ব্লকের এক স্কুলের পড়ুয়াদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা [২]: “এই এলাকার স্কুলে দেখলাম, সম্ভাবনার অভাব নেই। আমি দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘গেম থিয়োরি’ নিয়ে যা পড়াই, সেটাই পাড়ার একটা স্কুলে বলতে গিয়ে দেখলাম, বাচ্চারা বুঝছে। তা দেখে মনে হল, ওদের ভিতরে দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা যথেষ্ট। আশা আছে দেশের। আশা আছে সব মানুষের।’’
সত্যিই তাই! আমরা তো সকলেই জন্মাই জন্ম-কৌতূহলী হয়ে। কী যেন ব্যবস্থা আছে আমাদের শিক্ষা পরিকাঠামোতে যে আমাদের ছেলেমেয়েদের যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও বড় হওয়ার সাথে সাথে কৌতূহল কমতে থাকে। যথার্থ বিজ্ঞানশিক্ষা থেকে পড়ুয়াদের বিচ্যুতি দেখে সেই কবে (১৯৯২ সালে) Indian Association of Physics Teachers (IAPT) এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড: খান্ডেলওয়ালের বক্তব্য ছিল [৩]: “A child has a natural curiosity to explore, learn and master. Since science provides additional experiences, it should attract the child more than other subjects. But, science education as it obtains in India, by and large, does not provide that additional excitement. Worse is that in the name of science we ask for rote memorisation, often of items which are well beyond comprehension. The result is that child is repelled from science. To him science is collection of statements, …., not an area of exploration and excitement.”
উচ্চশিক্ষার ফানেল দিয়ে ঢুকতে হলে
অন্যান্য দেশের মতোই ভারতবর্ষের সার্বিক উন্নয়ন নির্ভর করছে সামগ্রিক শিক্ষার উৎকর্ষের উপর। সবার কাছে এটা একটা ধাঁধা – দেশের মৌলিক শিক্ষা অত্যন্ত নিম্নমানের হওয়া সত্ত্বেও উচ্চশিক্ষা কি করে উঁচুমানের হয়।
এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে দুটি বিষয়ের উপর: আমাদের দেশের বিরাট জনসংখ্যা, আর সম্পদ বণ্টনে তীব্র অসাম্য। সম্পদের অসম বণ্টনের ফলে দেশের শতকরা প্রায় দশ ভাগ মানুষ অর্থাৎ চোদ্দ কোটি মানুষ কিন্তু উন্নত দেশগুলির নাগরিকদের মতই সম্পদশালী [৩]।
স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগে উচ্চশিক্ষায় ভারত যতটা এগিয়েছে, তার থেকে এই একাংশই সবথেকে বেশি লাভবান হয়েছে। উচ্চশিক্ষার এই ভিত-টা তৈরি হয়েছিল স্বাধীনতার পরে পরেই। স্বাধীন ভারতের শিক্ষার বিকাশের স্বপ্নটা আমরা শুনতে পাই ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদের কথায়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মৌলিক গবেষণার গুরুত্ব বুঝে তিনি মন্তব্য করেছিলেন: “There can be no advance in either industry or technology without fundamental research work. The scope of such research should, however, be extended and cover not only the scientific subjects but also the humanities, including philosophy, the social science, anthropology, etc.”। খড়গপুরে Indian Institute of Technology (IIT) উদ্বোধনের সময় তিনি বলেছিলেন: “The Government of India had already initiated a scheme for the establishment of four institutions to standard of Massachusetts Institute of Technology. I can clearly visualize the day when the great potentials of this institute will be fully realized”। স্বাধীনতার পর প্রথমে চারটি IIT তারপর ক্রমে ক্রমে আরো বিভিন্ন IIT, IISER এবং NIT প্রতিষ্ঠা করে ভারত কিন্তু উচ্চশিক্ষার পরিকাঠামো উন্নয়নের চেষ্টা করে চলেছে। এইসব প্রতিষ্ঠানের গুণমান বজায় রাখার জন্য এদের প্রবেশিকা পরীক্ষার মান উঁচু তারে বেঁধে দেওয়া হয়।
কিন্তু সমস্যা হল যে শুধুমাত্র সাধারণ বিদ্যালয়ের গণ্ডির মধ্যে পড়াশোনা করে ঐসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্র- ছাত্রীদের প্রবেশাধিকার পাওয়া বেশ দুরূহ। তাই ছাত্রদের সুবিধার জন্য তৈরি হল কর্পোরেট সংস্থার আদলে বিভিন্ন কোচিং ইনস্টিটিউট। এমন কি একটা আস্ত শহরও। শিক্ষাসচেতন ও উচ্চ আয়ে সক্ষম অভিভাবকরা, যাঁরা প্রধানত ঐ চোদ্দ কোটির অংশবিশেষ, তাঁরাই তাঁদের সন্তান সন্ততিদের ঐ ধরনের খরচ সাপেক্ষ কোচিং ইনস্টিটিউটে ভর্তি করান। তাদেরই একটা অংশ সফল হয়ে IIT, IISER, NIT এর মত জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে। এই কারণে উচ্চতর শিক্ষায় ভারতবর্ষের সাফল্য মন্দ নয়। কিন্তু একটা কথা বলে রাখা ভালো, IIT বা IISER এ ভর্তির জন্য যে প্রশিক্ষণ দরকার, ১০+২ স্তরের ৮০ ভাগ পরীক্ষার্থী তার বাইরে থাকে।
তত্ত্বেই শেষ
যারা এইসব প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ পায়, তাদের ক্ষেত্রে দাঁড়ায় আর এক গেরো। কি সেই গেরো?
যারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির স্নাতক স্তরের কোর্সে ভর্তির সুযোগ পেলো, সেই ছাত্রছাত্রীদের কথাই ধরি। এইসব প্রবেশিকা পরীক্ষার সিলেবাসে ব্যবহারিক বিজ্ঞানের উপর হাতে-নাতে দক্ষতা নির্ণয়ের কোনো সুযোগ থাকে না। ব্যবহারিক বিজ্ঞানে তাই এইসব “উপরের সারির” ছাত্রছাত্রীদেরও একটা সহজাত দুর্বলতা থেকে যায়। ফলে উঁচুমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ নেওয়া এই সব স্নাতকরা বিজ্ঞানের তত্ত্ব ও ধারণা কতটা আত্তীকৃত করতে পেরেছে, ব্যবহারিক ক্ষেত্রে মৌলিকতা প্রয়োগ করার কতটা উপযুক্ত হয়েছে, সেখানে কিন্তু প্রশ্নচিহ্ন থেকেই যায়।
সাধারণত তত্ত্ব ও গণিত নির্ভর কাজেই তারা বেশি দক্ষ হয়ে ওঠেন। মাথা দিয়েই যে কাজগুলো সেরে ফেলা যায়, সেখানেই তাদের বেশী দেখা যায়। যেমন সফটওয়্যার এর শিল্পজগতে। অনেকে আবার বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বাদ দিয়ে একেবারে প্রশাসনিক কাজে বেশি উৎসাহী হয়। তাই ভারতীয়রা ম্যানেজমেন্টেও অনেক এগিয়ে, এখানেও কিন্তু মূলত মাথাটাই লাগে। হাত নোংরা করে কৌতূহল মেটানোর সহজাত প্রবৃত্তিটাই সমূলে বিনাশ করার বীজ নিহিত আছে আমাদের শিক্ষা পরিকাঠামোর মধ্যেই। এই ব্যাপারটা স্পষ্ট দেখতে পাই আন্তর্জাতিক স্তরের পদার্থবিদ্যার অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতায়। তত্ত্বগত দিক দিয়ে ভারতীয় পড়ুয়ারা উল্লেখযোগ্য ভাবে ভালো ফলাফল করে, কিন্তু ব্যবহারিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাদের ফলাফল বেশ নিচু মানের।
প্রায় বছর ত্রিশ আগে অধ্যাপক খান্ডেলওয়ালেরও উপলব্ধি ছিল তাই [৪]: “The most important thing is an insistence that unless there is a large enough laboratory space, no school should be allowed to carry on science education. When science was made compulsory at High School level it was pointed out that we must wait for 2-3 years till every school has provided for lab space. But a surprising statement was made then: “How does it matter if for a few years science is taught from the blackboard?” It shocked me then, coming from a science-based person. But, now I find that the “few years” have gone on for some 15 years. The damage is very serious. We are repelling students from science.”
আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষক ও বিজ্ঞানী সমাজেও এই বিষয়ে বহু বছর ‘ব্রাহ্মণ্যবাদে’র ছায়া বিদ্যমান। শূদ্রের মতো নিচু কাজকম্মো করে বিজ্ঞান বুঝতে হবে? – আজও এমন ধারণা অনেকের মনে বদ্ধমূল হয়ে বসে আছে। এই সূত্র ধরে বিজ্ঞানে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক বিজ্ঞানীদের মধ্যে গড়ে উঠেছে পারস্পরিক অশ্রদ্ধাবোধ।
“প্র্যাকটিক্যাল-এ সর্বোচ্চ নম্বর দিতে হবে”
এর একটা মারাত্মক পার্শ্বপ্রভাবও আছে। স্কুলগুলোতে পরীক্ষাগারভিত্তিক পড়াশোনা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রবেশিকা পরীক্ষাগুলোর সাথে ব্যবহারিক বিজ্ঞানের কোন সম্পর্ক নেই বলে অভিভাবকরা মনে করেন ও দাবি করেন: সিলেবাসের রুটিনে এক্সপেরিমেন্ট বা প্রজেক্ট ক্লাস রেখে তাদের ছেলেমেয়েদের সময় নষ্ট করা হচ্ছে। এসব চলবে না। কোন কোন স্কুলে আন্দোলনও হয়েছে। সেখানেও থামলেন না তাঁরা। এক চরম অনৈতিক দাবি করলেন, ছাত্রছাত্রীদের কেউ এক্সপেরিমেন্ট বা প্রজেক্ট কিছু করুক বা না করুক, ব্যবহারিক বিজ্ঞানের মূল্যায়নে সর্বোচ্চ নম্বর কিংবা কাছাকাছি নম্বর দিয়ে দিতে হবে।
আস্তে আস্তে এই ব্যবস্থা দস্তুর হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সমাজও তা মেনে নিচ্ছে। আসলে বিজ্ঞান শিক্ষা মানে তাত্ত্বিক বিজ্ঞানে ব্যুৎপত্তি বোঝায়, ব্যবহারিক বিজ্ঞান ঐচ্ছিক বিষয়ের মতো – এমন ভাবনা সমাজে বদ্ধমূল হয়েছে। কিন্তু থিওরি এর সাথে প্র্যাকটিক্যাল এর যুগপৎ সঠিক মিশেলই যে সঠিক বিজ্ঞান শেখার উপায় – তা আমাদের বহুজনের মন থেকে উবে গিয়েছে। আমাদের মনে নেই প্রখ্যাত বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যানের সেই বিখ্যাত উক্তি: “It does not matter how beautiful your theory is, it does not matter how smart you are. If it doesn’t agree with experiment, it’s wrong”।
যাই হোক, এসব কিছুর ফলশ্রুতি হিসেবে বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষককে হতে হয়েছে এই প্রহসনের খলনায়ক – তাঁর মূল্যবোধ, নীতি, বিবেক সব বিসর্জন দিয়েই। হালের তরুণ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এক অংশ এই ব্যবস্থাকে সময়ের স্রোতে স্বীকার করে নিয়েছে। আসলে এটা শিক্ষক সমাজের দোষ নয়। যে বিজ্ঞান শিক্ষাভাবনা ও রূপায়ণের পদ্ধতির পরিকাঠামোর মধ্যে দিয়ে আমরা সকলে বড় হচ্ছি, তাতে এগুলো গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছে, নীতিহীনতাই নিয়ম হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাতে আমরা শিক্ষক-শিক্ষিকারা চাই বা না চাই, মনের কোথাও নীতিহীনতা সম্পর্কে উদাসীনতা কিংবা নীতিহীনতা যে স্বাভাবিক – এমন ভাবনা দানা বাঁধছে।
শুধু তাই নয় এর প্রভাব পড়ে আমাদের জীবনে ও মননে। প্রকট ফল হিসেবে আমরা দেখতে পাই, বিজ্ঞানের বইতে উল্লিখিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার দিকে উৎসাহ জাগানোর সুযোগ থাকলেও হাতে নাতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়াস সামান্য সংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষিকাদের থাকে। ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণী থেকে প্রকল্পের জন্য নম্বর দেওয়া থাকলেও অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকা যেমন নিজেরা উৎসাহিত বোধ করেন না, তেমনি উৎসাহ দেন না ছাত্রছাত্রীদের।
কিন্তু নম্বর তো পেতে হবে। সেই সুযোগও নিয়েছেন শিক্ষা ব্যবসায়ীরা। নির্দিষ্ট শ্রেণীর জন্য বিজ্ঞান প্রকল্পের বই বের করেছেন তাঁরা। অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা আবার ঐসব বই থেকে টুকে নম্বর পাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন ছাত্রছাত্রীদের। ফলে আমাদের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জানতে বা অজান্তে নীতিহীনতার শিক্ষা সঞ্চারিত হচ্ছে উত্তরসূরীদের মধ্যে – বাড়িতে কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। আগে অন্তত লিখিত তাত্ত্বিক বিষয়ের মূল্যায়ন হত নিয়মমাফিক। ব্যবহারিক বিষয়ের মূল্যায়নের প্রহসন সেটারও গলা টিপে ধরতে লাগলো। উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষায় প্রায়শ শতকরা পঞ্চাশ ভাগ পরীক্ষার্থী পাচ্ছেন শতকরা আশির বেশি নম্বর। এই মার্কস বণ্টন, যা আদৌ গসিয়ান (Gaussian) বন্টন অনুসরণ করে না, তা শিক্ষাবিজ্ঞানের নীতির পরিপন্থী। আবার একটি ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়, বিভিন্ন পরীক্ষায় নজরদারি কড়া (যদিও ব্যাপারটি আপেক্ষিক) মনে হলে কোথাও শুধু পরীক্ষার্থী, কোথাও বা সাথে অভিভাবক মিলে সংগঠিত বিক্ষোভ শুরু হয়। অতিমারীর পরের পর্যায়ে এমন প্রবণতা বহুগুণে বেড়েছে।
এককথায়, দুর্ভাগ্যজনক হলেও, আকাঙ্খিত উচ্চশিক্ষার বিকাশ লক্ষ্যে পৌঁছানো তো দূরের কথা, বরং তার বিপরীতমুখী গতি আদতে দুর্বল করেছে শিক্ষার ভিত্তিকেই। অনেক নিচে নেমেছে মৌলিক শিক্ষার গুণমান। বর্তমান পরিস্থিতি মনে করিয়ে দিচ্ছে ‘বৃত্রসংহার’ কাব্যের একটি পংক্তি: “দধিচী ত্যাজিলা তনু দেবের মঙ্গলে”। এই হতাশাজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে অনাকাঙ্খিত অনুপ্রবেশ ঘটে গেলো নীতিহীনতার পাঠের।
কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা
একজন পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষককে অনেকক্ষণ ধরে ফোন করেও বার বার শুনতে হল উনি ব্যস্ত। কিছু সময় পরে উনি লজ্জা মাখানো স্বরে জানালেন: “সামনে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা সেখানে পরীক্ষার্থীরা যাতে কোন অসদুপায় অবলম্বন করতে না পারে সেজন্য স্কুলে সিসিটিভি বসাতে হবে। তাই কী ভাবে কী করতে হবে সে ব্যাপারে প্রধানশিক্ষক আমাকে উপদেশ দিচ্ছিলেন।” প্রসঙ্গটি ভাবলে মনে হয়, আমাদের ভাবনা ও কাজে কি বৈপরীত্য! যাদের দেশের উপযুক্ত নাগরিক বলে গড়ে তুলতে চাচ্ছি তাদের উপর আমাদের কি অপরিসীম ভরসা! তাদের রুখতে হাজারো বেড়াজাল আমদানি করতে হচ্ছে।
আবার অন্যরকম একটি ছবি দেখার সুযোগ হয়েছিল অন্য একটি খুব সুন্দর পারিকাঠামোযুক্ত স্কুলে। সেদিন ঐ উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞানের শেষ পরীক্ষা। প্রধানশিক্ষক খবর দিলেন উনি একটু ব্যস্ত আছেন, ল্যাবে পরীক্ষা আছে। ল্যাবের অবস্থান জানা থাকায় তাই সরাসরি গন্তব্য হল ল্যাব। কিন্ত ল্যাব তখন তালাবন্ধ। এমনি করে কেটে গেলো বহু সময়। ছেলেমেয়েদের কলরবে বোঝা গেলো টিফিনের ঘন্টা বেজে গেছে। কিন্তু সেই শ্রেণীকক্ষ আর পরীক্ষাগার দুইই বন্ধ, এতটা সময় পরেও।
না ! এটি কোনো বিচ্ছিন্ন চিত্র নয়। আসলে কোনো উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে যদি পরীক্ষাগার ব্যবহারযোগ্য না হয়ে থাকে, তবে তার দায় কিন্তু বিদ্যালয়ের শিক্ষা প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষক বা শিক্ষকমণ্ডলী নীতিগতভাবে এড়াতে পারেন না। তাঁরাও কি তাহলে সচেতন অভিভাবকদের মতই,ভাবতে শুরু করেছেন – ব্যবহারিক বিজ্ঞান শিক্ষা শুধুমাত্র সম্পূর্ন নম্বর পাওয়ার জন্য? উপরের বিষয়বস্তুর সমর্থনে এগুলি বিচ্ছিন্ন ঘটনা তো নয়ই, শিক্ষা প্রাঙ্গনে আমরা কীভাবে নৈতিকতা সরিয়ে রেখে দ্বিচারিতার আশ্রয় নিই তারও প্রমাণ বটে।
তত্ত্বগত বিষয়ে লিখিত পরীক্ষার সময় আমাদের নীতিজ্ঞান খুব সজাগ। অপরদিকে ব্যবহারিক পরীক্ষার সময়ে নীতিজ্ঞান অন্ধ ও বধির। শুধু পশ্চিমবঙ্গে এমন দেখা যায় তা নয়, অন্যত্রও দেখা যায় অন্য মোড়কে। বিশ্বস্ত সূত্রে শোনা গেছে, পশ্চিমবঙ্গের বাইরের একটি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের পদার্থবিদ্যা প্রাক্টিক্যাল পরীক্ষার্থীদের বলা হয়েছিল মোবাইল ফোনে সব ডাটা টুকে রাখতে, যাতে পরীক্ষার সময় তাই লিখে দেওয়া যায়। পরীক্ষার্থীদের সবাইকে কাছাকাছি শতকরা একশ নম্বর দিতে হবে, কেন না বেশ ভালো অংকের টাকা দিয়ে ছেলেমেয়েরা ঐ স্কুলে পড়ে।
এসবে আর অবাক না হওয়া ভালো। তার কারণ বলতে গেলে আরেকটি গল্পের অবতারণা করা যাক। বলেছিলেন উচ্চমাধ্যমিক ব্যবহারিক পদার্থ বিজ্ঞানের প্রধান পরীক্ষক – তবে গল্প নয়, সত্যি কাহিনী। একটি বিখ্যাত বিদ্যালয়ের খাতা দেখছেন তিনি, যার ছাত্রদের অনেকেই প্রথম কুড়ি জনের মধ্যে থাকে। দেখলেন যে, পরীক্ষার্থীদের সবাইকে একই পরীক্ষা করতে দেওয়া হয়েছে, আর তাদের পাওয়া ডেটাগুলোও (Data) এক। স্পষ্টতই, কেউ কিছু কাজ করেনি, নকল করেছে। প্রধান পরীক্ষক এও জানতেন, যদি পরীক্ষক ল্যাবের টেবিলে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রেখে শুধু আদেশ করতেন যে পরীক্ষা করে দেখাতে হবে, কোন সাহায্য ছাড়াই ছাত্রদের কিছু জন তা করতে পারতো – এমনই ছিল ঐ ছাত্রদের মেধা। তবুও নিয়মমাফিক কিছু নম্বর কাটতে হয়েছে, নিতান্ত অনিচ্ছায় – ছাত্ররা তো সত্যিই দোষী নয়, অথচ শাস্তিটা তারাই পেয়ে গেল, সে বছর ওই স্কুল থেকে কেউ প্রথম কুড়ির মধ্যে এল না। মামলা হল প্রধান পরীক্ষকের বিরুদ্ধে, স্কুল কর্তৃপক্ষ কিন্তু হারল সে মামলায়। কিন্তু কেন এমনটা হচ্ছে? দুটো ব্যাখ্যা হতে পারে: এক, ল্যাবে যন্ত্রপাতির অভাব বা সেগুলো অকেজো। দুই, ছাত্ররা পরীক্ষা দিয়ে শতকরা একশ নম্বরই পাবে পরীক্ষক-শিক্ষক সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না। কিন্তু স্থানীয় বা কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রশাসন, অভিভাবক, বিশেষ করে যাঁরা শিক্ষা “সচেতন” তাঁরা সবাই চান, তাই হয়ত পরীক্ষক-শিক্ষকও একান্ত নিরুপায়।
শিক্ষায় নীতিহীনতা না নীতিহীনতার শিক্ষা ?
এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
উপায় যে একটা খুঁজতেই হবে, সেটা বোঝাতে আরেকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। স্থান পশ্চিমের একটি দেশের রাজধানী শহর। সেখানে ভিন্ন ভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের গাড়ি পার্ক করার জন্য একটি নির্দিষ্ট জায়গা ছিল। কিন্তু সবাই একসাথে এসে গেলে জায়গাটা যথেষ্ট ছিল না সব গাড়ি একেবারে নিয়ম মেনে পার্কিং করার জন্য। তাই কাউকে কাউকে পাশের জায়গায় দখলদারি করতে হত। কিন্তু সেটা তো বেআইনি। তা হলেও রাষ্ট্রদূতদের ক্ষেত্রে শাস্তির কোনো নিয়ম ছিল না। সেই সূত্রে কেউ কেউ বেআইনি কাজ করতে পিছপা হতেন না। তবে কোন দেশের রাষ্ট্রদূত কবে কখন এই ধরনের নিয়মবিরুদ্ধ কাজ করেছেন, তার একটা রেকর্ড রাখা হত। সেই রেকর্ড পর্যবেক্ষণ আর বিশ্লেষণ করে দেখা গেল যে, রাষ্ট্রদূতদের আইন ভাঙার রেকর্ড আর transparency international এ তাদের রাষ্ট্রের অবস্থান বেশ সামঞ্জস্যপূর্ন। অর্থাৎ, দেশে যাঁরা আইন মানতে অভ্যস্ত নন, বিদেশেও তাঁরা এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী নন।
তাই একটু আগে বলা কাহিনীর নীতিবাক্য ভেবে যদি তা আমাদের আলোচনার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তার নির্যাস হলো: ব্যবহারিক বিষয়ের পরীক্ষায় যাদের অসদুপায় অবলম্বন করতে সাহায্য করা হচ্ছে, বৃহৎ জীবনে, ভবিষ্যতেও সম্পূর্ণ অন্য পরিস্থিতিতে কি তারা এই অভ্যাসের ছায়া পরিত্যাগ করতে পারবে? এ প্রসঙ্গে, সম্পূর্ন বিপরীত অর্থে প্রযুক্ত, বঙ্কিমচন্দ্র রচিত কপালকুণ্ডলার একটি লাইন মনে পড়ছে: ‘পরের কাষ্ঠাহরণ করা যাহার স্বভাব, সে পুনর্ব্বার পরের কাষ্ঠাহরণে যাইবে।’ আজ শিক্ষাক্ষেত্রে যে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির আভাস মিলছে, তাতে কি শুনতে পাই ‘বলাকা’র রবি ঠাকুরের সেই আওয়াজ: “ওরে ভাই, কার নিন্দা কর তুমি। মাথা করো নত। এ আমার এ তোমার পাপ।” কবিতার এই পংক্তি এখানে প্রযোজ্য কিনা, সেই প্রশ্ন সমাজ মনস্তাত্বিকদের গবেষণার জন্য তোলা রইল।
নম্বর পাওয়াকে চরম লক্ষ্য না ভেবে যদি শিক্ষাদান করা হতো, বিজ্ঞানশিক্ষা কীরকম হতে পারতো? কীরকম হওয়া উচিত? বিজ্ঞানশিক্ষার চরম লক্ষ্যটাই বা কী হওয়া উচিত? সেই আলোচনা থাকবে পরের পর্বে।
(চলবে)
তথ্যসূত্র:
[১] ১১ই জানুয়ারি, ২০২৩, আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইন
[২] ১৩ই জানুয়ারি, ২০২৩, আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইন
[৩] Richest One Per Cent In India Own More Than 40% Of Nation’s Wealth, Says Oxfam Report, Outlook, 17 Jan 2023. Link
[৪] ১৯৯২ IAPT বুলেটিন সম্পাদকীয় (জানুয়ারি)