কৌশিকঃ জ্যামিতির প্রতি আপনার ভালবাসা দেখে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, জ্যামিতি আপনাকে ঠিক কী কারণে এত টানে? এই মহাবিশ্বের সাথে আপনি জ্যামিতির কি কোনো যোগসূত্র খুঁজে পান? আমাদের কেমন যেন মনে হয় আপনি এই বিশ্বসংসারকে জ্যামিতির মধ্যে দিয়ে দেখতে চেষ্টা করেন, অনেকটা ঠিক পিকাসো যেমন কিউবিজমের মধ্যে দিয়ে জগতসংসারকে দেখতে চেয়েছেন, সেরকম। আপনি কি সবকিছুর মধ্যেই জ্যামিতি খুঁজে পান?
ড: মহাদেবনঃ বিজ্ঞান আর জ্যামিতির যোগটা কিন্তু নতুন নয়। প্লাটোর অ্যাকাডেমীতে ঢোকার সময় গ্রীক ভাষায় একটা কথা প্রচলিত ছিল, যার মানেটা দাঁড়ায়, “যারা জ্যামিতি ভাল জানো না, দয়া করে এখানে প্রবেশ করতে যেও না।” জ্যামিতি বা জিওমেট্রি শব্দটার উৎসের মধ্যেই আমার আকর্ষিত হবার কারণটা লুকিয়ে আছে। “জিও” মানে আমাদের এই পৃথিবী আর “মেট্রি” হল মাপা। “আমাদের পৃথিবীকে কীভাবে মাপবে”- সেখান থেকেই জিওমেট্রি বা জ্যামিতি শব্দের উৎপত্তি। জ্যামিতি মূলত আমাদের চারপাশের বিভিন্ন জিনিসের মধ্যে মাপজোখগত সম্পর্ক বুঝতে সাহায্য করে। শুরুর দিকে সম্পর্কগুলো ছিল আকার আকৃতিগত। প্রথম দিকে মূলত মানচিত্রকারীরা বা নাবিকেরা জ্যামিতি নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। এরপর যত আমরা এই গ্রহকে জানতে বুঝতে শিখলাম, আমাদের জীবনে জ্যামিতির মূল্য আরো অনেক বেড়ে গেল।
এরও অনেক আগে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বে আমাদের গ্রহের অবস্থান জানার চেষ্টা করছিলেন এবং আরো বড় প্রেক্ষাপটে জ্যামিতিক নকশা দেখতে পেয়েছিলেন। যেমন, আজকের খবরের কাগজটাই যদি দেখ, প্রথম পাতায় দেখবে প্রথমবার জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের থেকে পাঠানো সব ছবি। এখানেও সেই জ্যোতির্বিজ্ঞান আর জ্যামিতিরই গল্প। মানুষ সেই সভ্যতার আদিকাল থেকেই সূর্য বা তারাদের সাথে আমাদের পৃথিবীর সম্পর্ক খোঁজার জন্য জ্যামিতি নিয়ে ভাবতে শুরু করে। পরে গ্রহের সাপেক্ষে নিজেদের অবস্থান বুঝতে শুরু করে। তাই এ কোনো নতুন ভাবনা নয়।
আমি জ্যামিতিকে কীভাবে দেখি, সেই নিয়ে বলতে গেলে অত দূরও যেতে হবে না। আমাদের সামনেই যা কিছু দেখতে পাচ্ছি, তার মধ্যেই জ্যামিতি রয়েছে। আমার মনে যেসব প্রশ্ন আসে সেগুলো হয়তো যে কোনো বাচ্চার মনেই আসবে। আমি শুধু এই বয়েসে এসেও প্রশ্নগুলো নিয়ে হাল ছাড়িনি। এবং আমাদের চোখের সামনেই জ্যামিতি ছড়িয়ে আছে। যেমন, আমি যখন তোমায় দেখছি, তোমার চেহারার কিছু জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্য দেখছি যা তোমাকে তোমার বন্ধুদের থেকে আলাদা করে দেয়। একই জিনিস বলা যায় তোমার সাথে আমার চেহারার পার্থক্য নিয়ে। আবার যদি আমি একটা পর্বতের আকার, কিম্বা চামড়ার ভাঁজ অথবা আমার মাথার উপর চুলের আকার বুঝতে চাই, এই সব প্রশ্নগুলোই আমি জ্যামিতির প্রশ্ন হিসেবে পেশ করতে পারি।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে গাউস আর রাইম্যানের মত গণিতজ্ঞরা বিমূর্ত জ্যামিতির (abstract geometry) ধারণাটা নিয়ে এলেন। ওনাদের কাজের ফলে বহু মাত্রার বস্তুকে জ্যামিতিতে ধরা সম্ভব হলো। যে জ্যামিতি চোখে দেখছি, তাতেই সীমাবদ্ধ থাকার দরকার রইলো না। এতক্ষণ কিন্তু আমরা সনাতন জ্যামিতির কথাই বলছিলাম – যা দিয়ে আমাদের ত্রিমাত্রিক জগতকে বোঝা যায়। তবে আজকে তো আমরা জানি শুধু যে তিনটেই মাত্রা আছে তা নয়। যেমন, আইনস্টাইন-এর বিখ্যাত কাজ ছিল এইটা দেখানো যে স্থান আর কাল আলাদা নয়, একটা জ্যামিতিক তত্ত্বের মাধ্যমে দুটোকে একটা চতুর্মাত্রিক স্থানকালের অংশ হিসেবে ভাবা যায়। আমার মনে হয় — শুধু মনে হয় বলা ঠিক নয়, জানি — খোদ আইনস্টাইনের মত ব্যক্তিত্ব যে জ্যামিতিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় দিয়েছিলেন, সেই জ্যামিতিক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে রোজকার জগৎকেও দেখা সম্ভব।
আমি সেই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে কিছু সরল ভাবনা ধার নিয়ে অরিগ্যামি বা কিরিগ্যামির মত জিনিস ব্যবহার করে জীববিজ্ঞানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ — গুরুত্বপূর্ণ না হলেও কঠিন — প্রশ্নের উত্তর খোঁজ করি। যেমন, কীভাবে আমরা তৈরী হলাম, সেই প্রশ্ন। জানোই তো, আমরা শুরু করি একটামাত্র কোষ থেকে আর মানুষের ক্ষেত্রে সেটা ন’মাস ধরে বিভাজিত হয়। কিন্তু বিভাজিত হয়ে শুধু আরো একগুচ্ছ গোলক তৈরী করে, এমন নয়। এমন একটা আশ্চর্য জিনিস তৈরি হয়, যা চারিপাশের পৃথিবীকে অনুভব করতে পারে, তার সাথে আদান-প্রদান করতে পারে, আর কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের মত প্রশ্নও করতে পারে।
এই আকার ধারণের (morphogenesis) প্রশ্নটা কিন্তু মূলত একটা জ্যামিতিক প্রশ্ন। স্নায়ুবিজ্ঞানের নানান ক্ষেত্রেও, আমার মনে হয়, ভিত কিন্তু সেই জ্যামিতি। কারণ অসংখ্য স্নায়ু পরস্পরের মধ্যে সংবাদ আদানপ্রদান করছে একটা ত্রিমাত্রিক পরিসরের মধ্যে। যদি স্নায়ুর মধ্যে যে সিগনাল যাচ্ছে তার কথা ভাবি, তাহলে অনেক বেশি মাত্রা নিয়েও ভাবতে হয়।
তাই আমার এই জ্যামিতিক ভাবনা নতুন কিছু না। তোমার কাছে এটা একটু নতুন লাগছে কারণ আমার যেসব কাজে হাত দেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে, তাতে এই ব্যাপারটা খুব স্পষ্ট। আমি কিন্তু মনে করি জ্যামিতির প্রভাব সর্বত্রই রয়েছে।
সম্পূর্ণ একমত। তবে আমার মনে হয় আপনি জ্যামিতির বিমূর্ত রূপটাকে হাতেকলমে করে দেখানোর ফলে স্নাতক স্তরে বা উচ্চ-বিদ্যালয় স্তরে ছেলেমেয়েদের কাছে এটা অনেক সহজবোধ্য হয়েছে। আমি তো এই টেবিলেও অনেক রকমের জ্যামিতির নকশা দেখতে পাচ্ছি। যে অরিগ্যামি বা কিরিগ্যামির উপর আপনি কাজ করছেন, তার থেকে কোনো উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা আরেকটু বিশদে বলবেন, যাতে আমাদের বুঝতে আরেকটু সুবিধা হয়?
চেষ্টা করতে পারি। অরিগামি কী সেটা বলি। এতে কাগজ ভাঁজ করে করে একেকটা শিল্পকর্মের সৃষ্টি করা হয়। একটা কাগজের পাতা থেকে শুরু করে ভাঁজ করতে করতে বানিয়ে ফেলতে পারো একটা মুখাকৃতি, ড্রাগন, বক, শালিক, নৌকো, প্লেন, এরকম আরো কত কিছু।
এরকম জিনিস বানানোর ক্ষেত্রে শিল্পীরা বিজ্ঞানীদের থেকে অনেকটা এগিয়ে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমি অনেক শিল্পীর সাথে কাজ করেছি। বুঝেছি যে তাঁরা এগিয়ে কারণ তাঁরা কাজ করেন খেলাচ্ছলে, এবং তাঁদের একটা ধারণা আছে কীভাবে পদার্থ নিয়ে নাড়াচাড়া করে সৌন্দর্য সৃষ্টি করা যায়। বিজ্ঞানী হিসাবে আমি একটা প্রশ্ন করতে চেষ্টা করিঃ একজন শিল্পী যেটা খেলাচ্ছলে সহজাতভাবে করে ফেলতে পারে, সেটা অঙ্কের ভাষায়, নিয়ম মেনে কীভাবে বোঝা যায়? এই দুইটি পন্থাই কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি বিশ্বাস করি যে সহজাত ভাবনার সাথে নিয়মমাফিক বা চিন্তনশীল পন্থার মিলন ঘটলে স্ফুলিঙ্গের জন্ম হতে পারে।
যেমন একটা প্রশ্ন করতে পারো, অরিগ্যামিতে জটিল আকৃতি কীভাবে বানানো যায়? আমি তোমায় একটা জিনিস দেখাই, এটা আমার তৈরী না যদিও। এটা তুমি কিনতে পারবে। এটা দেখে মনে হবে খুব সাধারণ। অনেকগুলো ষড়ভূজ একটার পর একটা বসিয়ে বানানো হয়েছে যেন।
মজার ব্যাপার হল, এটাকে আমি যত টানব, এটা থেকে বেরিয়ে আসবে একটা বোতল, কিংবা আরো টানলে হোল্ডার, প্রত্যেকটাই বেশ শক্তপোক্ত।
যেকোনোভাবেই রাখো না কেন, এরা ভেঙে পড়বে না। তাহলে এই সব আকৃতি ঐ একটা বস্তুই ধারণ করতে পারে। শুনতে খুব তুচ্ছ মনে হলেও এই ধারণাটা ব্যবহার করা যায় সৌর কোষে (solar cell)। এর প্রয়োগ করা যায় স্টেন্টে, অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিসের প্রভাব থেকে শরীরকে রক্ষা করার জন্য। আবার এই একই চিন্তাভাবনা বাইরে জগতকে ঠেকিয়ে রাখতেও কাজে লাগে, যেমন এই বোতলটা করছে।
এমনকি জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ …
একদম তাই। এবার দেখা যাক, আমি ঠিক কোন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাইছিলাম? আমি ভাবছিলাম এর উল্টো সমস্যাটা নিয়ে। উল্টো সমস্যা কী রকম? কাগজ নিয়ে নাড়াচাড়া করে সমাধান খুঁজে বের করার পরিবর্তে, যদি আমি জানি ঠিক কোথায় পৌঁছাতে হবে, যেমন, আমি অমুকভাবে এক এক ধাপে খুলবে এমন একটা সোলার সেল বানাতে চাই, তাহলে আমি ভাঁজগুলো কোথায় বসাবো? কটা বসাবো? কোনদিকে ভাঁজ হবে, কতটা কোণ থাকবে তাদের মধ্যে? এভাবে প্রশ্নটা সাজালে সেটাই হবে একটা গণিতের প্রশ্ন।
একবার প্রশ্নটাকে এরকম গাণিতিক রূপ দেওয়া গেলে তখন গাণিতিক ভাবনা, গাণিতিক সরঞ্জাম, গাণিতিক অ্যলগরিদম সব লাগিয়ে সমাধান খুঁজে বের করতে পারি।
ঠিক তাই। তাই, আমরা যদি স্কুলের গণিতের পাঠক্রম এমন করে ডিজাইন করি, যাতে জ্যামিতি তো থাকেই, কিন্ত পড়াবার সময় ধরুন জ্যামিতি পড়ানো হল, তারপর আবার অরিগ্যামি করে হাতে কলমে সেই জ্যামিতি করেও দেখা গেল। তাহলেই আমার মনে হয় বাচ্চাদের মধ্যে গণিতের প্রতি খুব সহজেই আগ্রহ বাড়বে।
আমারও তাই মনে হয়। তবে এটা শুধু জ্যামিতির জন্যেই প্রযোজ্য, এরকম নয়। একই ভাবে বীজগণিত, গাণিতিক বিশ্লেষণ, বা টোপোলজিও পড়াতে পারো।
গিঁট বাঁধার কথা ভাবো। দেখো সামনে একটা দড়ি আছে, যাতে গিঁট বাঁধা আর প্রান্তগুলো আঠা দিয়ে জোড়া।
এই গিঁটটা খোলা অসম্ভব। এবার এটা দিয়ে কী প্রশ্ন করা যায়? একটা মজার প্রশ্ন যেটার হাতেকলমে উত্তর দেওয়া যায় সেটা হলো, জটিলতা স্থির রেখে সবথেকে শক্ত গিঁট কী হতে পারে? কতবার একটা দড়ি গিঁটে পড়ার সময় নিজের উপরে আর নিচে পেঁচিয়ে যায়, সেটাই তার জটিলতা। কিন্তু একটা গিঁটের একটা নির্দিষ্ট বেধ আছে কারণ একটা দড়িরও তো বেধ আছে। তাই তুমি প্রশ্ন করতে পারঃ জটিলতা স্থির রেখে কত কম আয়তনের মধ্যে একটা গিঁটকে আবদ্ধ রাখা যায়?
এই প্রশ্নটার কিন্তু বাস্তবে একটা উত্তর আছে। দেখা গেছে যে একটা অনুভবসিদ্ধ (empirical) নীতি বাস্তবে রয়েছে যেটা বলে দেয় অমুক জটিলতার গিঁট কতটা আয়তনের মধ্যে আঁটতে পারবে। একই সাথে এটা এমন একটা প্রশ্ন যেটার উত্তর দিতে একটা শিশু নিছক খেলা করতে পারবে।
আর একটু বড়ভাবে ভাবলে এই প্রশ্নটা অন্য ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যদি তোমার প্রয়োগ নিয়ে মাথাব্যথা থাকে — সেটা না থাকলেও চলবে, তুমি স্রেফ কৌতূহলের টানে চলতে পারো — এর প্রয়োগ রয়েছে আণবিক জীববিজ্ঞানে (molecular biology)। একটা কোষের নিউক্লিয়াসের ভিতর ডিএনএ কীভাবে পেঁচিয়ে আছে, সেটা বুঝতে গেলে এই প্রশ্ন আসে। কিম্বা সূর্যের ভিতর চুম্বকীয় ক্ষেত্র কীভাবে গিঁট বেঁধে থাকে, সেখানেও এই প্রশ্ন আসে। অতিক্ষুদ্র থেকে অতিবিশাল, এই প্রশ্নটা নিয়ে অনেকদূর অব্দি যাওয়া যায়।
কিন্তু এর মূল তত্ত্বটা কী? মূল তত্ত্বটা এমন যেটা একটা শিশুর খেলার জিনিস হতে পারে। তাই হ্যাঁ, তোমার সাথে আমি একমত।
এটা সত্যি অভাবনীয়। এটা সেই গণিত যা স্কুলে বা কলেজে ছেলেমেয়েরা ভয় পায়। তার একটা কারণ হল এটা বিমূর্ত, দেখা যায় না, সবটাই অঙ্কের মধ্যে। কিন্তু আজ আপনার কাছে যা দেখলাম সেটা শুধু ব্ল্যাকবোর্ডে বা হোয়াইটবোর্ডে দেখা নয়, এটা একেবারে ছুঁয়ে দেখা। জ্যামিতি দেখতেও পাচ্ছি, সেই নিয়ে খেলাও করতে পারছি।
আরেকটা প্রসঙ্গ বোধহয় উঠে আসছে তোমার প্রশ্ন থেকে, অন্তত যেভাবে প্রশ্নটা করছো তার থেকে। এই যে বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে একটা বিভেদ রয়েছে, এটা বোধহয় একটু সাজানো।
হ্যাঁ, সেটাই।
মনে হয় না আমাদের বলার দরকার আছে যে এবার যাও গণিতের ক্লাসে, বা এবার জীববিজ্ঞানের ক্লাসে অথবা এখন ইতিহাস পড়তে পারো। আমার তো মনে হয় বিষয়গুলোর মধ্যে যাতায়াতের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
একটা সমন্বয় (harmony) রয়েছে বলা যায়।
হ্যাঁ, তুমি বলতে পারো: ইতিহাসের আবার অঙ্ক বা পদার্থবিদ্যার সাথে কী সম্পর্ক? এর একটা উত্তর হলো — কেন একটা বিষয় একভাবে বেড়ে উঠেছে, সেটা তার ইতিহাস ঘাঁটলে তবেই বোঝা যাবে। নিউটন আবিষ্কার করেছিলেন মাধ্যাকর্ষণের সূত্র, পরে আইনস্টাইন আরো বড় স্তরে অনুরূপ সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন, শুধু এটুকু জানাই যথেষ্ট নয়। এটাও বুঝতে হবে, নিউটন কেন আগে এলেন, পরে আইনস্টাইন? এর উত্তর হয়ত রয়েছে আমরা পৃথিবীকে কীভাবে দেখি তার মধ্যে। প্রথমে আমরা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যে জগৎটা দেখি, সেইটুকু সম্বন্ধেই আমাদের একটা ধারণা তৈরী হয়। কিন্তু বিষয়গুলো যত জটিল হয়েছে, আমাদের ইন্দ্রিয়কে সমৃদ্ধ করেছে ক্যামেরা, টেলিস্কোপ, মাইক্রোস্কোপ এবং আরো অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। এগুলো দিয়ে মাপজোখ করা সম্ভব হয়েছে। কৌতূহলের সীমারেখা গেছে বেড়ে।
একটা শিশুর কাছে তার ইন্দ্রিয়গুলোই জগতটাকে চেনা জানার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। অতএব, সেটার সুযোগ নাও। আমাদের সুযোগ নেওয়া উচিত। প্রথমেই একটা বাচ্চাকে আণবিক জীববিদ্যা কি মহাকাশবিদ্যার আশ্চর্যগুলোর সাথে পরিচয় করাতে হবে না। আমার মতে, আরো ভালো হয় যদি চারপাশের জগতটাকে ব্যবহার করে তাদের কৌতূহল জাগিয়ে তোলা যায় এবং সেই কৌতূহলকে ধীরে ধীরে পরিপক্ক হতে দেওয়া যায়। পরে তাদের মধ্যে হয়ত কেউ কেউ আরো পড়তে বা জানতে চাইবে, আরো বড় স্তরের প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পেতে চাইবে। আমার মনে হয়না ওই প্রশ্নগুলোই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। আমি বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে অমুকটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ বা তমুকটা কম গুরুত্বপূর্ণ এসব মানি না।
বিখ্যাত বিজ্ঞানী ল্যান্ডাউ বলতেন, কী নিয়ে কাজ করছি, সে বিষয়ে কোনো দেমাক থাকা উচিত না। আমিও এটা মনেপ্রাণে মানি। আমি প্রবলভাবে বিশ্বাস করি যে অনেক গভীর, গূঢ় সত্য আমরা চারধারে তাকালেই বুঝতে পারবো। এরকম নয় যে উন্নত যন্ত্রপাতি থাকতে হবে বা সেইসব সমস্যা নিয়েই ভাবতে হবে যেগুলো কেউ বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে দিয়েছে। চোখের সামনে যা দেখতে পাচ্ছি, সেগুলো নিয়ে ভাবলেও চলবে — দেখতে পাচ্ছি কিন্তু সহজে বুঝতে পারছি না।
এটাই আপনার কাজের বিশেষত্ব। আপনি খুবই সহজ জিনিস থেকে শুরু করেন।
অতটাও সহজ নয়। সহজ মনে হয় কারণ সহজে দেখা যায়, কিন্তু তার মানে এই নয় যে এগুলো সহজ। সবসময় নয়।
সহজ মানে আমি বলতে চাইছি, লাখ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি লাগবে কিছু বুঝতে, এরকম নয়। দেখতে সহজ কিন্তু সেই সামান্য পরীক্ষার মধ্যেও পাওয়া যাবে অনেক অন্তর্নিহিত, জটিল বিজ্ঞান বা বৈজ্ঞানিক সূত্র কিংবা জ্যামিতির প্রভাব। একটু আগে যখন আমরা বলছিলাম পরীক্ষানিরীক্ষার ব্যাপারটা কেন অবহেলা করা হয় স্কুলে, আপনি বললেন, হয়তো যন্ত্রপাতির খরচের কারণে। এখন আপনি দেখাচ্ছেন যে টেবিলের উপর করা যায় এমন পরীক্ষা দিয়েও অনেক গূঢ় বিজ্ঞান বেরিয়ে আসতে পারে।
অবশ্যই। চিন্তার সীমাবদ্ধতাটাই শেষ সীমান্ত হওয়া উচিত, যন্ত্রপাতির সীমাবদ্ধতা নয়।
ঠিক তাই। তাই, আমাদের দেশের স্কুলকলেজের ছাত্রছাত্রীরা, যারা বড় হয়ে ভালো চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী বা প্রযুক্তিবিদ হতে চায়, বা স্রেফ ভাল মানুষ হয়ে যারা প্রকৃতির বা সমাজের জন্য ভবিষ্যতে কিছু করতে চায়, তাদের উদ্দেশ্যে আপনি কী বলবেন?
শুধু ভারতীয় ছাত্রছাত্রী নয়, সব অল্পবয়েসীদের জন্য, মনের বা হৃদয়ের দিক থেকে অল্পবয়েসী, তাদের সবাইকেই বলব, সবকিছু নিয়ে কৌতূহলী হওয়ার একটা রেওয়াজ বাঁচিয়ে রাখতে। ভুল হবে বলে ভয়ে পিছিয়ে না যেতে। অনিশ্চয়তাকে ভয় না পেতে। বরং মনে রাখতে যে, এই ভয়, অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়েই আরো গভীরে, আরো বিস্তারে বোঝার সুযোগ রয়েছে। এবং প্রতিটা প্রশ্নকেই, তা সে বিজ্ঞান হোক বা জীবনের অন্য কোন ক্ষেত্র, অনেক বিনম্রভাবে, নিরহঙ্কার ভঙ্গিতে ভাবতে হবে। বুঝতে হবে যে আমাদের জ্ঞানের সীমা খুবই পরিমিত। আমরা আসলে অজ্ঞতার মহাসাগরে একটি জ্ঞানের দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে ভেসে বেড়াচ্ছি মাত্র। আর এটা উপলব্ধি করাটাই একটা বিরাট ব্যাপার যে আমরা খুবই নগণ্য, একক ভাবে এমনকি সমষ্টিগতভাবেও আমাদের শক্তি খুবই কম। এভাবে ভাবতে পারলে মনে হয় জগতের খানিকটা হয়ত বোঝা যেতে পারে।
আর এইভাবে ভাবার একটা উপায় হলো নিজের কৌতূহল বাঁচিয়ে রাখা, আর ব্যক্তিগত চেষ্টায় কৌতূহল না মিটলে অন্যদের জিজ্ঞেস করা, একসাথে মিলে শেখা। খেয়াল রাখতে হবে যে, একদিন আমাদের এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। যেভাবে পৃথিবীটাকে পেয়েছিলাম, যাবার সময় যেন তার থেকে আরেকটু ভালোভাবে রেখে যেতে পারি। কবি ইটস বলেছেন, আমার স্বপ্ন বিছিয়ে গেলাম তোমার পায়ের তলে, তারই উপর ধীর পদে যেও চলে। আমাদের তাই করতে হবে, আমাদের আগামী প্রজন্মকেও তাই শেখাতে হবে।
ধন্যবাদ, প্রফেসর মহাদেবন! অনেক ধন্যবাদ আপনার মূল্যবান সময় আর বার্তা আমাদের উপহার দেবার জন্য, এই কথপোকথনের জন্য। আমরা বিজ্ঞান আর দর্শন দুটোই ছুঁয়ে গেলাম, বুঝলাম মানবসমাজের বড় ছবিটা — শিক্ষার্থী হিসেবে কোথায় যাচ্ছি আমরা। যেটা বললেন, এই বিশাল মহাবিশ্বে প্রতিটা ব্যক্তিই নগণ্য।
তার মানে কিন্তু এই নয় যে আমাদের করার কিছু নেই। আমরা বিশ্ব-জগত সম্বন্ধে চোখকান খোলা রাখতে পারি, সেই নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি না করলেই হলো। আমি কিন্তু আশা করবো এই কৌতূহল আমাদের সব কাজেই ধরা পড়বে, যেকোনো কাজেই আমরা অত্যধিক পক্ষপাত বা আগাম ধারণার শিকার না হয়ে এগোতে পারবো। আমার মতে বিজ্ঞানের অ্যাডভেঞ্চার তো এটাই।
বিজ্ঞান আসলে জগতকে বোঝা বা জানার একটা মাধ্যম, অসম্ভব শক্তিশালী এক মাধ্যম। আমি “দরকারি” কথাটা ব্যবহার করলাম না, কতকটা ইচ্ছে করেই। কারণ আমার সিংহভাগ কাজ, প্রায় সবটাই কারো দরকারে লাগবে না। কিন্তু সেটা ঠিক আছে কারণ বিজ্ঞানকে আমাদের শুধু প্রয়োজনীয়তার মাপকাঠিতে মাপা উচিত নয়, ঠিক যেমন বিঠোফেন, মোজার্ট, বা শেক্সপিয়ারকে তো আমরা প্রয়োজনীয়তার মাপকাঠিতে মাপি না। বিজ্ঞান আমাদের জানতে সাহায্য করে আমরা কারা, কোথা থেকে এসেছি, আর কোথায় যেতে চলেছি। আর সেটাই যথেষ্ট।
আর এই কারণেই বিজ্ঞানের দরকার। আমাদের নিজেদের সম্পর্কে ও আমাদের চারিপাশ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন হওয়া, নিজেদের জানা ও বোঝা এবং সে সঙ্গে এই জগতে আমাদের ভূমিকা সম্পর্কে অবহিত হওয়া খুবই জরুরি। আর যেমন আপনি বললেন, যথার্থভাবে জীবন অতিবাহিত করা, যাতে আমরা যখন এই দুনিয়া ছেড়ে যাব যাতে নিজেদের ছাপ রেখে যেতে পারি। ঠিক ছাপ না, আমরা যাতে নিজেদের বলতে পারি যে, আমরা একটা অর্থপূর্ণ জীবন কাটিয়েছি, জীবনে কিছু করে যেতে পেরেছি।
আমার মনে হয়, আমরা যখন ছাপ রেখে যাওয়ার কথা বলতে শুরু করি মাঝেমাঝে সেটাই সর্বস্ব হয়ে যায়, সব কাজের পেছনে ওই উদ্দেশ্যটা ঢুকে যায়। তাই আমি বলতে চাইঃ সবসময় বিনম্রভাবে নিরহঙ্কার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সবকিছুকে দেখতে হবে।
ঠিক তাই। ধন্যবাদ!