দাবানলের রোষ থেকে কিছুই বাঁচে না, পশুপাখি, গাছপালা সব জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায়। মাইলের পর মাইল উজাড় হয়ে যায় সব কিছু। লেলিহান আগুনের তাণ্ডবলীলার পর গোটা এলাকা জুড়ে কয়েক মুঠো ছাই ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
পৃথিবীর কিছু জঙ্গল অত্যন্ত দাবানলপ্রবণ, প্রায় প্রতি দশকেই অন্তত একবার করে বিধ্বংসী আগুন লাগে এই সব জঙ্গলে [১]। উত্তর আমেরিকার ক্যালিফর্নিয়া প্রদেশে সিয়েরা নেভাডা পর্বতমালার দক্ষিণে অবস্থিত সেকুওইয়া ন্যাশনাল ফরেস্ট (Sequoia National Forest) এমনই এক আগুনে জঙ্গল।
অথচ এই জঙ্গলেই দেখা যায় বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘজীবী এবং সুউচ্চ সেকুওইয়া গাছ। এক একটি সেকুওইয়া গাছ ৩০০০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। লম্বায় প্রায় ৯০ মিটার পর্যন্ত হতে পারে এই দৈত্যাকার গাছগুলি। বর্তমানে সেকুওইয়া ন্যাশনাল ফরেস্টে সর্ববৃহৎ গাছটির পোশাকি নাম জেনারেল শেরম্যান। এর সর্বোচ্চ ব্যাস ১১ মিটার, উচ্চতা ৮৪ মিটার এবং আয়তন ১৪৮৭ কিউবিক মিটার। আয়তন বা ওজনের নিরিখে এই গাছটি এই মুহূর্তে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গাছ। এই গাছটির বয়স ২,২০০ বছর, অর্থাৎ এই গাছ সাক্ষী থেকেছে রোমান সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে যীশু খ্রিস্টের জন্মের, ভারতবর্ষের স্বর্ণযুগে বিশ্বের প্রথম গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দার পত্তন, শিল্পবিপ্লব, প্রথম, এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের! অসংখ্য ঝড়-ঝাপ্টা, দাবানল পেরিয়ে আসা গভীর ধ্যানমগ্ন এই কালোত্তীর্ণ মহীরুহের সামনে দাঁড়ালে আপনা থেকেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।
স্বাভাবিক ভাবেই মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে শতাব্দীর পর শতাব্দী বিধ্বংসী লেলিহান আগুন সহ্য করেও কি করে হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকে এই সেকুওইয়া!
সেকুওইয়া গাছের প্রস্থচ্ছেদ নিরীক্ষণ করলে নিচের বৈশিষ্ট্য গুলো দেখা যায়:
- সেকুওইয়া গাছের ছাল ২ ফুট (০.৬ মিটার) পর্যন্ত মোটা হতে পারে। এই তন্তুময় ছাল অগ্নি এবং তাপ নিরোধক বর্মের কাজ করে যাতে আগুনের প্রবল তাপ গাছের গুঁড়ির তত ক্ষতি করতে না পারে। উদাহরণস্বরূপ পাকা থোড় (কলা গাছের গুড়ি) তন্তুময়, মানে ওটাকে লম্বালম্বি কাটলে প্রচুর সুতোর মত তন্তু দেখা যায়। বাঁশ কিম্বা আখ-ও তাই। তেমনই সেকুওইয়া গাছের ছাল তন্তুময় ও স্পঞ্জের মত। ফলে ছালের মধ্যে প্রচুর বাতাসের পকেট থাকে যা তাপ পরিবহনে বাধা দেয়, ও খুব ভালো তাপের অপরিবাহী (insulator) হিসাবে কাজ করে [২]। প্রচুর পরিমান ট্যানিন রাসায়নিকের উপস্থিতি এই ছালকে ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গের হাত থেকেও রক্ষা করে। বাইরের এই মোটা ছাল ভেতরের নরম cambium cell layer-কে আগুনের তাপ ও অন্যান্য আঘাত থেকে রক্ষা করে। এই নরম স্তরেই নতুন কোষের জন্ম, গাছের বেড়ে ওঠা।
- তন্তুময় ছালের পরের স্তর জোলো এবং অগ্নিনিরোধক রসযুক্ত স্যাপউড (sapwood)। সেকুওইয়া গোত্রের গাছে প্রচুর পরিমান জল ও আর্দ্রতা থাকে। এই জল ও আর্দ্রতা দাবানলের সময় গাছের তাপমাত্রা কাঠের প্রজ্জলন তাপমাত্রার উপরে উঠতে দেয় না, কাঠকে আগুন ধরে যাওয়া থেকে রক্ষা করে (কারণ আগুনটাকে গাছের সব জল বাষ্পে পরিণত করে তবে কাঠের তাপমাত্রা বাড়াতে হবে)। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে একটা ৫ ফুট (১.৫ মিটার) ব্যাসের ২০০ ফুট (৬১ মিটার) লম্বা রেডউড (সেকুওইয়া গোত্রের গাছ) ১৭ টন (১৭,৩১১ লিটার) জল ধরে রাখতে পারে [৩]। স্যাপউডে এই প্রচুর পরিমান জলের উপস্থিতিও সেকুওইয়া গাছকে আগুনের হাত থেকে রক্ষা করে।
- সবচেয়ে ভেতরের অংশ জমাট এবং শক্ত গুঁড়ি বা হার্টউড (heartwood)। এই অংশটা ছত্রাকজনিত ক্ষয়রোধক রাসায়নিক যুক্ত। আগুন থেকে বাঁচলেও, ছত্রাকের হাত থেকে না বাঁচতে পারলে এত দীর্ঘজীবী হতে পারতো না এই গাছগুলি।
এই তিন অভিযোজনের সম্মিলিত ফলে দৈত্যাকার সেকুওইয়া গাছগুলি আগুনকে সঙ্গী করেই বহু বছর বেঁচে থাকতে পারে।
তবে দৈত্যাকার সেকুওয়ার অভিযোজনের সবচেয়ে চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হল যে শুধু মাত্র বেঁচে থাকাই নয়, তার বংশবিস্তারের জন্যও আগুন এক অতি প্রয়োজনীয় এবং অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। প্রকৃতির এক অবিশ্বাস্য অভিযোজনে সাইপ্রাস গোত্রের এই সেকুওইয়া গাছ এই বিধ্বংসী আগুনকেই তাদের বিবর্তনের খেলার সাথী করে।
সেকুওইয়া গাছের ফল শঙ্কু আকৃতির। এই শঙ্কু গুলির সাইজ দৈত্যাকৃতি গাছগুলির তুলনায় অতি ক্ষুদ্র, ৪-৫ সেন্টিমিটার। এই শঙ্কুর ভেতরে থাকা বীজের সাইজ আরো নগন্য, ৪-৫ মিলিমিটার।
এই ক্ষুদ্র বীজগুলি শক্ত এক ধরণের আঠার সাহায্যে শঙ্কুর মধ্যে আটকে থাকে। সাধারণ আবহাওয়ায় কোনোভাবেই এই বীজ শঙ্কুর ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে মাটিতে পড়তে পারে না, তাই নতুন গাছের অঙ্কুরোদ্গমও হতে পারে না। দাবানলের অত্যন্ত উচ্চ তাপমাত্রা এই আঠা গলিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়। শঙ্কুর মুখ খুলে যায়, মাটিতে পড়তে পারে বীজ। সেকুওইয়া এতো লম্বা গাছ যে মাটির কাছাকাছি আগুন একদম টঙে থাকা শঙ্কু পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। কিন্তু তাপ যেহেতু উর্ধমুখী, তাই সেকুওইয়ার বীজধারক শঙ্কু গুলোর মুখ তাপে খুলে যায়। বীজ পরবর্তী কালে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। উপরন্তু সেকুওইয়ার বীজ এতো ছোট যে এক একটা সেকুওইয়া গাছ অজস্র বীজ তৈরী করে ও ছড়িয়ে দেয়। তার মধ্যে কিছু হয়ত পুড়ে যায়, কিন্তু বিবর্তনের নিয়ম অনুযায়ী দু-একটা নতুন গাছ তৈরী হওয়ার মত অনুকূল পরিবেশ পায়।
এছাড়াও দাবানল অন্য সব কিছু পুড়িয়ে সেকুওইয়া বীজের অঙ্কুরোদগমের অনুকূল খনিজ সমৃদ্ধ ছাইমাটির বীজতলা তৈরী করে রাখে। ছোটোখাটো গাছগাছালি পুড়ে গিয়ে আকাশ উন্মুক্ত হয়, পর্যাপ্ত আলোর যোগান তৈরী হয়। আগুন অন্যান্য ক্ষতিকারক কচি গাছ ধ্বংসকারী কীটপতঙ্গ বা ছত্রাকদের পুড়িয়ে দিয়ে নতুন সেকুওইয়া চারার বেড়ে ওঠার অনুকূল পরিবেশ তৈরী করে, যেখান থেকে আবার নতুন এক মহীরুহ তৈরী শুরু হয়।
আগুনের পরশমনির ছোঁয়ায় পূর্ণতা পায় সেকুওইয়ার জীবনবৃত্ত।
তথ্যসূত্র ও অন্যান্য টুকিটাকি:
[১] অধিকাংশ সময় আগুন ধরে মানুষের অসাবধানতার কারণে, কিন্তু সবসময় নয়। বাজ পড়ে বা অন্য যে কোনো স্ফুলিঙ্গ থেকে আগুন লাগতে পারে। পড়ন্ত পাথর বা শুকনো কাঠে ঠোকাঠুকি থেকে স্ফুলিঙ্গ তৈরী হতে পারে। আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ থেকে আগুন আসতে পারে। সূর্যের আলো গাছের রসের মধ্যে দিয়ে গিয়ে ফোকাস হয়ে আগুন লাগতে পারে। এক্ষেত্রে গাছের রসটা কনভেক্স লেন্সের মত কাজ করে। এ ছাড়াও খুব বিশেষ অবস্থায় একেবারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য প্রাকৃতিক গ্যাস আগুন তৈরী করতে পারে।
[২] Bold, G., Langer, M., Börnert, L. and Speck, T., 2020. The protective role of bark and bark fibers of the giant sequoia (Sequoiadendron giganteum) during high-energy impacts. International Journal of Molecular Sciences, 21(9), p.3355.
[৩] Resistant vitality of the Sequoias, by W. Kenneth Johnson, A Thesis Presented to the Faculty of the School of Forestry, Oregon State College, 1948.