১৯৩০ সাল। জার্মানির টিউবিঙ্গেন শহরে একটা পদার্থবিদ্যার সম্মেলন হচ্ছে। অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ উল্ফগাং পাউলি (Wolfgang Pauli) সেখানে এক অদ্ভুত চিঠি পাঠালেন। চিঠিটা তেজস্ক্রিয় বিকিরণ নিয়ে গবেষণারত তামাম বিজ্ঞানীসমাজকে উদ্দেশ্য করে লেখা। তাতে উনি ওনার একটা ধারণার কথা প্রায় চুপি চুপি বললেন। সাধারণত তাত্ত্বিক বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণার ফল অঙ্কের ভাষায় কোনো গবেষণাপত্রে প্রকাশ করে থাকেন। কিন্তু পাউলি-র কাছে ধারণাটা এতই অদ্ভুত লেগেছিল যে ওটা নিয়ে গবেষণাপত্র ছাপাতে উনি সাহস পাচ্ছিলেন না। চিঠিতে উনি বিজ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করলেন, ধারণাটা ঠিক কি না সেটা কি আদৌ পরীক্ষার মাধ্যমে বার করা সম্ভব?
আসলে পাউলি তখনো অব্দি দেখা যায়নি, এমন এক কণার কথা বলছিলেন। সেই কণাকে আজকে আমরা নিউট্রিনো (neutrino) নামে চিনি। মহাবিশ্বে এই কণা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে [১]। এর অস্তিত্বের পরীক্ষামূলক (experimental) প্রমাণও পাওয়া গেছে।
কিন্তু সেসময় এরকম একটা কণার কথা ভাবার কোনো কারণ ছিল না। কোনো যন্ত্রে এই কণা সরাসরি ধরা পড়তো না। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই কেন এরকম একটা কণার দ্বারস্থ হতে হলো, সেই কাহিনিই এখানে বলা হয়েছে। পদার্থবিদ্যা গবেষণা কিভাবে আচমকা নতুন দরজা খুলে দেয়, এই কাহিনি তারই প্রতীক।
পরমাণু যখন স্থায়ী (stable) নয়
ইশকুলে পড়ার সময় আমরা শিখেছি যে আমাদের পরিচিত জিনিসগুলো তৈরি হয় অণু (molecule) দিয়ে। আর এই অণুকে ভাঙলে পাওয়া যায় পরমাণু (atom)।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ফরাসি বিজ্ঞানী আন্তোয়ান অঁরি বেকারেল আবিষ্কার করলেন, কোনো কোনো পদার্থ থেকে আপনা-আপনিই নানা রকম জোরালো রশ্মি বেরিয়ে আসে। এই ঘটনাকে তেজস্ক্রিয়তা (radioactivity) বলে। কিন্তু তেজস্ক্রিয় বিকিরণের উৎস কোথায়, সেইটা বুঝতে আরো সময় লাগলো।
বিংশ শতকের শুরুতে ইংরেজ বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড ও তার সহযোগীরা পরীক্ষা করে দেখালেন যে পরমাণুর মধ্যে একটা ছোট্ট আঁটোসাটো অংশ আছে। এর নাম কেন্দ্রক বা নিউক্লিয়াস (nucleus)। আর তাকে ঘিরে রয়েছে এক ধরণের মৌলিক কণা, ইলেকট্রন ()। এই কেন্দ্রকের ভিতর দু-রকমের কণা জড়াজড়ি করে থাকে – নিউট্রন () আর প্রোটন ()।
কিন্তু সব কেন্দ্রক সময়ের সাথে স্থায়ী (stable) হয় না। যেমন, কিছু কেন্দ্রকে স্থায়ী অবস্থার তুলনায় অতিরিক্ত নিউট্রন থাকে। এই ধরণের কেন্দ্রকে, যেখানে অনুপাত স্থায়ী অবস্থার তুলনায় কম, এদের ক্ষেত্রে সাধারণত এক বিশেষ ধরণের তেজস্ক্রিয় বিক্রিয়া দেখা যায়।
উদাহরণস্বরূপ, স্থায়ী হাইড্রোজেন পরমাণুর কেন্দ্রকে একটা প্রোটন থাকে। কোনো নিউট্রন থাকে না। কিন্তু এই হাইড্রোজেন মৌলেরই ট্রিটিয়াম নামে আরেক অস্থায়ী রূপ আছে। তাতেও একটাই প্রোটন (এবং একটাই ইলেকট্রন) রয়েছে, নইলে সেটা হাইড্রোজেন মৌল থাকতো না। কিন্তু নিউট্রনের সংখ্যা দুই। অর্থাৎ, স্থায়ী অবস্থার তুলনায় দুটো অতিরিক্ত নিউট্রন রয়েছে ( অনুপাত এখানে 1/2, যেখানে স্থায়ী অবস্থাতে সেটা অসীম)। কেন্দ্রকে স্থায়ী অবস্থার তুলনায় অতিরিক্ত নিউট্রন থাকলে সেই অতিরিক্ত নিউট্রনগুলোর স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিলয় (decay) ঘটে। তৈরি হয় প্রোটন। এই বিলয়ের ফলে কেন্দ্রকটা আগের চেয়ে স্থায়ী কেন্দ্রকে পরিণত হয়।
সাথে সাথে সেখান থেকে সরাসরি একটা রশ্মি বেরিয়ে আসে। এটাকেই তখন বলা হতো বিটা () রশ্মি।
বিটা রশ্মি আসলে কী
ধরা যাক, একটা পদার্থে এমন পরমাণু আছে যাদের কেন্দ্রকগুলো বিটা-তেজস্ক্রিয়। অর্থাৎ, সেগুলো উপরের উদাহরণের মতো। এইরকম পদার্থের খানিকটা নমুনা গবেষণাগারে রেখে দেওয়া হয়েছে।
সবকটা বিটা-তেজস্ক্রিয় কেন্দ্রকের যে একই সময়ে বিলয় শুরু হবে তা নয়। তবে অনেকক্ষণ রেখে দিলে এদের মধ্যে অনেকগুলোরই বিলয় ঘটবে। শুরুর কেন্দ্রকটাকে নাম দেওয়া যাক । বিলয়ের ফলে তৈরি হবে আরেকটি কেন্দ্রক। তাকে নাম দেওয়া হোক । সাধারণত এই ধরণের কেন্দ্রকীয় বিক্রিয়ায় -কে আদি-কেন্দ্রক (parent nucleus) আর -কে পরিবর্তিত-কেন্দ্রক (daughter nucleus) বলা হয়।
এই ধরণের বিক্রিয়ার পর কেন্দ্রকের পরিবর্তনটাকে দুটো সংখ্যা দিয়ে ধরা হয়। কোনো পরমাণুর কেন্দ্রকের মোট প্রোটন সংখ্যাকে পারমাণবিক সংখ্যা (atomic number) বলে। সাধারণত, সেটাকে অক্ষর দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। প্রোটন আর নিউট্রন দুটো মিলিয়ে সংখ্যাটাকে ভরসংখ্যা (mass number) বলা হয়। এটাকে চিহ্নিত করা হয় অক্ষর দিয়ে।
ধরা যাক আমাদের পরীক্ষায় -কেন্দ্রকের ভিতরে -খানা প্রোটন আর খানা নিউট্রন আছে। দেখা গেলো, কেন্দ্রকীয়-বিটা-ভাঙনের ফলে তৈরি হওয়া -কেন্দ্রকের ভরসংখ্যা -কেন্দ্রকের সমান থাকে, অর্থাৎ দুটোকেই দিয়ে প্রকাশ করা যায়। কিন্তু পারমাণবিক সংখ্যা এক বেড়ে থেকে হয়ে যায়। অর্থাৎ, মোট প্রোটন আর নিউট্রন এক থাকলেও প্রোটনের সংখ্যা এক বেড়েছে, নিউট্রনের এক কমেছে। রাদারফোর্ড আর ফ্রেডেরিক সডি-র পরীক্ষাতে এটাই দেখা গেছিল।
প্রতিবার এই ঘটনা ঘটার সময় বেরিয়ে এসেছিল বিটা রশ্মি। ডেনমার্কের বিজ্ঞানী নিলস বোর দেখালেন এই বিটা রশ্মি আসলে ইলেকট্রনের স্রোত। তবে এই ইলেকট্রন কণাকে কোনোভাবেই পরমাণুতে কেন্দ্রকের বাইরে থাকা ইলেকট্রন-এর সাথে গুলিয়ে ফেলা যাবে না। কারণ বিটা-রশ্মির গতিশক্তি কেন্দ্রকের বাইরের ইলেকট্রনের চেয়ে অনেক বেশি, প্রায় ১০ লক্ষ () গুণ।
আবার জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল হাইজেনবার্গের ‘অনিশ্চয়তার তত্ত্ব’ অনুযায়ী কেন্দ্রকের ভিতরে আগে থাকতে ইলেকট্রন উপস্থিত থাকতে পারেনা [২]। তার মানে, ঠিক নিউট্রন বিলয়ের মুহুর্তে নিশ্চয় এই ইলেকট্রন কেন্দ্রকের ভিতরেই তৈরি হয় এবং সেখান থেকে সঙ্গে সঙ্গে পরমাণুর বাইরে বেরিয়ে আসে। বিটা রশ্মি তাহলে কেন্দ্রকের ভিতরে তৈরি হওয়া সেইসব ইলেকট্রন-এর স্রোত।
বিক্রিয়াকালে শক্তির হিসেব
হরে-দরে বলা চলে, -কেন্দ্রকের বিলয়ে এখনো অব্দি দুটো জিনিস পাওয়া গেছে – -কেন্দ্রক আর ইলেকট্রন। এই কেন্দ্রকীয় বিক্রিয়াটার সমীকরণ লিখলে এইরকম দাঁড়াবে:
এখন শক্তির সংরক্ষণ সূত্র (conservation of energy) দাবী করে যে এই বিক্রিয়ার আগে-পরে মোট শক্তির কোনো কমা-বাড়া হয় না। তাহলে বিক্রিয়ার আগে -কেন্দ্রকের শক্তি বিক্রিয়ার পরে -কেন্দ্রকের এবং ইলেকট্রনের সম্মিলিত শক্তির সমান হবে। সেই শক্তির হিসেবটাই কষা যাক।
মূলত দুটো শক্তির কথা হচ্ছে:
(ক) স্থির অবস্থায় শক্তি।
এটাকে দিয়ে চিহ্নিত করা যাক। আইনস্টাইনের বিখ্যাত সূত্র অনুযায়ী, এই শক্তিটা আসছে একটা বস্তুর স্থির অবস্থার ভর -এর কারণে:
এখানে হলো শূন্য মাধ্যমে (empty space) আলোর গতির মান। এমন এককে যদি লেখা হয় যেখানে এর মান ১, উপরের সমীকরণটাকে লেখা যায়:
(খ) চলার কারণে গতিশক্তি (kinetic energy)।
এটাকে অক্ষর দিয়ে চিহ্নিত করা যাক।
মোট শক্তিকে যদি দিয়ে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে শক্তির সংরক্ষণ সূত্র অনুযায়ী দাঁড়ায়:
আমরা শুরুতে তেজস্ক্রিয় পদার্থের খানিকটা নমুনা গবেষণাগারে রেখে দিয়েছিলাম। অর্থাৎ, গবেষণাগারের দর্শকের সাপেক্ষে শুরুর -কেন্দ্রকের কোনো গতিশক্তি নেই। তাহলে উপরের সমীকরণটাকে স্থির অবস্থার শক্তি আর গতিশক্তিতে ভাঙলে দাঁড়াবে:
গতিশক্তিগুলোকে একদিকে আনলে আর স্থির অবস্থার শক্তিটাকে ভরে প্রকাশ করলে উপরের সমীকরণটা দাঁড়াবে:
এখানে দুটো আসন্নয়ন (approximation) করা যায়। প্রথমত, কেন্দ্রকের ভর ইলেকট্রনের থেকে অনেক বেশী (প্রায় ২০০০ গুণ)। অতএব ইলেকট্রনের ভরকে ধর্তব্যে না আনলেও চলে। দ্বিতীয়ত পরিবর্তিত-কেন্দ্রকটা বেশ ভারি বলে ওর গতিশক্তি প্রায় নেই বললেই চলে (পরীক্ষাতেও তাই দেখা যায়)। অতএব, সেটাকেও বাকি শক্তিগুলোর তুলনায় শূন্য ধরে নেওয়া যায়। তাহলে, শেষমেশ শক্তির হিসেবটা দাঁড়ালো:
অর্থাৎ, প্রতিটা বিলয়ের জন্য দুটো কেন্দ্রকের ভরের তফাতের কারণে শক্তিটা একা ইলেকট্রন নিয়ে নেবে। ধরা যাক, এতটা সময় অপেক্ষা করা হয়েছে যে দশ কোটি -কেন্দ্রকের বিলয় ঘটে গেছে। তাহলে আমাদের পরীক্ষায় বিলয় থেকে পাওয়া দশ কোটি ইলেকট্রনের প্রত্যেকটার গতিশক্তিই এর সমান হবে।
অঙ্ক বনাম বাস্তব
উপরের অঙ্কটা সত্যিই বাস্তবে হয় কিনা পরীক্ষায় যাচাই করা যায়। বিশ শতকের গোড়ায় ইংরেজ বিজ্ঞানী জেমস চ্যাডউইক সেই পরীক্ষাটাই করেছিলেন।
ওনার পরীক্ষাতে শুরুর -কেন্দ্রক-টা ছিল হাইড্রোজেন মৌলের ভারী সংস্করণ, ট্রিটিয়াম ()। এই কেন্দ্রকের বিলয়ের ফলে তৈরি হয় হিলিয়াম কেন্দ্রক () আর ইলেকট্রন। অর্থাৎ, বিক্রিয়ার সমীকরণটা হওয়ার কথা:
আগের অংশে দেখানো শক্তির হিসেব অনুযায়ী সহজেই আদি আর পরিবর্তিত কেন্দ্রকের স্থির-ভরের পার্থক্য থেকে ইলেকট্রনের গতিশক্তির মান বার করা যায়। মানটা দাঁড়ায় ইলেকট্রনপিছু 18.6 KeV মত [৩]। তাহলে বিভিন্ন বিটা-তেজস্ক্রিয় ট্রিটিয়াম কেন্দ্রকের বিলয়ের জন্য তৈরি হওয়া সবকটা ইলেকট্রনের গতিশক্তি এই মানের সমান হওয়া উচিৎ।
কিন্তু, কি আশ্চর্য! চ্যাডউইক সূক্ষ্মভাবে মেপে দেখলেন মোটেই তা হচ্ছে না। এই পরীক্ষার ফল হিসেবে একটা লেখচিত্র (plot) তৈরি করা যায়, যাতে -অক্ষে থাকবে শক্তি আর -অক্ষে থাকবে সেই শক্তিতে কটা ইলেকট্রন পাওয়া গেছে (নিচের ছবিতে দেখানো হয়েছে)। এই প্লট-টা হওয়া উচিত ছিল 18.6 KeV-তে একটা লম্বা দাঁড়ির মত: সব ইলেকট্রনের যেহেতু একই গতিশক্তি হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে যন্ত্রে ধরা পড়া ইলেকট্রনগুলোর গতিশক্তি মেপে দেখা গেল, সেটা শূন্য থেকে শুরু করে একটা সর্বোচ্চ মান অব্দি যেতে পারে! সর্বোচ্চ মানটা অর্থাৎ যেখানে curve-টা -অক্ষে গিয়ে মিলছে, তাকে বলে end-point শক্তি। শুধু এই শক্তিটা অঙ্ক কষে পাওয়া মানের সঙ্গে মেলে।
এমনকি, বেশিরভাগ ইলেকট্রনের গতিশক্তি end-point শক্তির নীচে থাকে। উদাহরণস্বরূপ দেখা যাচ্ছে যে ছবিতে ইলেকট্রন সংখ্যা সবচাইতে বেশি end-point শক্তির অনেকটাই নিচে (3.72 KeV শক্তির জন্যে)।
শক্তির সংরক্ষণ সূত্র অনুযায়ী সবকটা ইলেকট্রনের গতিশক্তি এক হওয়া উচিত ছিল। বাস্তবে পাওয়া গেল, শূন্য থেকে অঙ্ক কষে বার করা শক্তি, সবকটা শক্তিই ইলেকট্রনের থাকতে পারে। অঙ্ক বনাম বাস্তবের তুলনা করলে মনে হবে, কেন্দ্রকীয় বিক্রিয়ার সময় খানিকটা শক্তি উধাও হয়ে গেছে। কিন্তু শক্তি এরকম বেমালুম উধাও হয়ে যাওয়ার তো কথা নয়। যেমন, বিজ্ঞানী নিল্স বোর বললেন, শক্তি সংরক্ষণের সব নিয়মই তো সনাতন (classical) জগতে খাটে। এখানে পরমাণুর ভিতরে কেন্দ্রক নিয়ে কাজ হচ্ছে। তাই “..we have no argument,..for upholding the energy principle…”। অর্থাৎ, অণুর ভিতরের জগতে সনাতন শক্তি সংরক্ষণের নিয়ম যে খাটবেই, সেটা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। এ-এক জটিল ধাঁধা। পদার্থবিদ্যা যদি একটা ইমারত হয়, সংরক্ষণের নিয়ম তার ভিত্। এছাড়া আরও কয়েকটি সংরক্ষণ সূত্র পরীক্ষার ফল বোঝাতে ব্যর্থ হলো [৪]।
“অদৃশ্য” কণা
এই সমস্যার সমাধানের উদ্দেশ্যেই গল্পের শুরুতে বলা পদার্থবিদ্যার সম্মেলনে বিজ্ঞানী পাউলি-র চিঠিটা এলো। এতে বিটা-তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে তৈরি হওয়া অসঙ্গতি কাটানোর ইঙ্গিত আছে। চিঠির খানিকটা অংশ হচ্ছে এরকম:
“Dear Radioactive Ladies and Gentlemen,…as a desperate remedy to save the principle of energy conservation in beta decay,…I propose the idea of a neutral particle…The continuous beta-spectrum would be understandable under the assumption that during beta-decay a neutron is emitted along with the electron….So, dear radioactive folks, put it to the test and judge…..।”
অর্থাৎ, বিটা তেজস্ক্রিয় কেন্দ্রকের বিলয়ের সময় কেন্দ্রক থেকে শুধুমাত্র যে ইলেকট্রন বার হচ্ছে তা নয়, তার সঙ্গে বার হচ্ছে আরও একটা কণা। নতুন এই কণাটার স্থির-ভর, বৈদ্যুতিক আধান (Electric charge) কিচ্ছুটি নেই। বিজ্ঞানের পোষাকি ভাষায় আধান নেই এমন কণাদের neutral বলা হয়। সমঝদার পাঠক সহজেই খেয়াল করবেন পাউলি এই কল্পিত কণাটিকে ‘নিউট্রন’ নামে উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু ‘নিউট্রন’ নামটা ততদিনে নেওয়া হয়ে গেছে। নিবন্ধের শুরুতেই বলা হয়েছে পরমাণুর কেন্দ্রকে প্রোটন ছাড়া আরও একটি কণা আছে – নিউট্রন। এরও আধান নেই। কিন্তু এটা প্রোটনের চেয়ে সামান্য ভারি। চ্যাডউইক-এর অন্য একটি পরীক্ষা থেকে এর খোঁজ পাওয়া গেছিল। মহা ঝামেলা বাধলো। একদিকে পাউলির প্রস্তাবিত কণা, আরেকদিকে চ্যাডউইক-এর আবিষ্কৃত কণা – দুটির নামই এক। ইতালির পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মি অঙ্কের সাহায্যে তাত্ত্বিক ভাবে পাউলির অনুমানটাকে দাঁড় করালেন। আর সেই তত্ত্বে আলাদা করে বোঝবার সুবিধের জন্য পাউলির কল্পনা করা কণাটির নাম দিলেন – ‘নিউট্রিনো’(little neutral one)।
নিরুদ্দেশ শক্তির হদিশ
এই ‘নিউট্রিনো’ কণাটিরই এক যমজ বিপরীত-কণা (antiparticle) রয়েছে। আগের বিক্রিয়ায় উধাও হয়ে যাওয়া শক্তির পিছনে আসলে রয়েছে এই বিপরীত প্রকৃতির কণা।
বিশ শতকে পদার্থ-বিজ্ঞান গবেষণায় দুটো নতুন ধারা গড়ে উঠছিলো। এর প্রভাব ‘নিউট্রিনো’ গবেষণাতে পড়লো। কোনো বস্তুকণা শূন্য মাধ্যমে আলোর গতির প্রায় কাছাকাছি গতি নিয়ে দৌড়লে তার অবস্থা ব্যাখ্যা করতে লাগে ‘বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব’ (special relativity)। আবার অণু-পরমাণুর জগৎ সম্পর্কে জানতে হয় কোয়ান্টাম বলবিদ্যা (quantum mechanics) ব্যবহার করে।
কিন্তু দুটোই যদি একসাথে ধরতে হয় তখন? ইংরেজ বিজ্ঞানী পল ডিরাক বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ আর কোয়ান্টাম বলবিদ্যা – এই দুই তত্ত্বের মিলন ঘটালেন। সেখান থেকে সলতে পাকাতে পাকাতে তৈরি হলো ‘কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব’ (quantum field theory)। এই তত্ত্ব অনুযায়ী প্রত্যেক কণারই একটা করে বিপরীত-কণা আছে। নিউট্রিনোর বিপরীত-কণাকে বলা হয় ‘বিপরীত-নিউট্রিনো’ (antineutrino)। বিপরীত প্রকৃতির কণার আরেকটা উদাহরণ হলো ইলেকট্রন আর পজিট্রন। দুজনেরই একই ভর কিন্তু উল্টো আধান। নিউট্রিনোর যেহেতু আধান নেই, এই বৈপরীত্যের সূত্র আলাদা [৬]।
আজকের দিনে কণা-পদার্থবিজ্ঞানীরা পাউলির চিঠিতে লেখা কণাটিকে বলেন ‘ই-বিপরীত-নিউট্রিনো’ () । ‘ই’ বলার কারণ হলো – কেন্দ্রকীয় বিক্রিয়ায় যখন এই কণা বেরিয়ে আসে, তখন এর সাথে ইলেকট্রনও বেরোয়।
আগের সমীকরণটাকে শুধরোনোর সময় এসেছে। সেটা দাঁড়াচ্ছে এরকম:
এই বিক্রিয়াতে যেহেতু একটা অতিরিক্ত নিউট্রন একটা প্রোটনে পরিণত হচ্ছে, সমীকরণটাকে এভাবেও লেখা চলে:
তার মানে, আগে আলোচিত পরীক্ষায় -কেন্দ্রকের বিলয়ে দুটো নয়, তৈরি হচ্ছে তিনটে জিনিস। শক্তির হিসেবটাতেও তিনটে জিনিসকে ধরতে হবে:
আগের বারের মতো শক্তিগুলোকে স্থির অবস্থার ভর-এর কারণে শক্তি আর চলন্ত অবস্থার শক্তিতে ভাঙলে আর তারপর তুলনায় ছোট সংখ্যাগুলোকে ধর্তব্যের বাইরে রাখলে, আমরা এরকম একটা সমীকরণ পাবো:
অর্থাৎ, শুরুর আর শেষের কেন্দ্রকের ভরের তফাতের কারণে যে বাড়তি শক্তি থাকে, সেটা একা কেন্দ্রক থেকে নির্গত ইলেকট্রনে যায় না। বিটা তেজস্ক্রিয়াতে যে একমুঠো শক্তির হিসেব করা যাচ্ছিলো না, সেটা এই ই-বিপরীত-নিউট্রিনো নিয়ে চলে যায়।
বিটা বিলয় থেকে বেরোনো যেসব হাতে গোনা ইলেকট্রনের গতিশক্তি প্রায় end-point শক্তির সমান, তাদের ক্ষেত্রে ই-বিপরীত-নিউট্রিনোর ভাগে কিছুই জোটে না। আবার উল্টোদিকে যদি সব শক্তি ই-বিপরীত-নিউট্রিনো নিয়ে নেয়, তাহলে স্যাঙাৎ ইলেকট্রনের জন্য কোনো গতিশক্তি বরাদ্দ হয় না।
অর্থাৎ, ইলেকট্রনের শূন্য থেকে শুরু করে end-Point শক্তি অব্দি সবটাই থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। শক্তি সংরক্ষণের নিয়মে কোনো ভুল নেই, ভুল যা আছে তা আমাদের বোঝার ক্ষেত্রে। ইলেকট্রন ও ই-বিপরীত-নিউট্রিনোর মোট শক্তির হিসেব ধরলে শক্তির সংরক্ষণ সূত্র অটুট থাকে।
কিভাবে দেখা যায় নিউট্রিনো
এই নিবন্ধে এই পর্যন্ত আলোচনায় ঋণাত্মক বিটা-তেজস্ক্রিয়তার কথা বলা হয়েছে। এটা ছাড়াও আছে ধণাত্মক বিটা-তেজস্ক্রিয়তা [৫]। এতে ই-নিউট্রিনো () বেরোয়। কিন্তু এরা যে বেরোয়, সেটা তখনো অব্দি পরোক্ষভাবে শক্তির হিসেবের মাধ্যমে জানা গেছিল, সরাসরি এদের উপস্থিতি ধরা পড়েনি।
বিশেষ কোনো কণা শনাক্ত করার যন্ত্রে তখনই ধরা যায় যখন যন্ত্রের উপাদানের সাথে ঐ কণাটির আন্তঃক্রিয়া (interaction) হয়। না-হলে কণাটি যে আদৌ আছে বা তার ধরণ (characteristics) কী এসব নিয়ে জানবার রাস্তা নেই। ফার্মির নিউট্রিনো তত্ত্ব বলে, অন্য কোনো বস্তুকণার সাথে নিউট্রিনোর আন্তঃক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। এই তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে দেখানো গেছে যে 2.3 MeV গতিশক্তির একটা ই-নিউট্রিনো কি.মি. পুরু কোনো কঠিন পদার্থ ভেদ করে যাওয়ার সময় পদার্থের মধ্যে থাকা কণার সাথে গড়ে একবার মাত্র সংঘর্ষ ঘটায়। বেথে এবং পাইয়ের্লস নামে দু-জন বিজ্ঞানী একটা গবেষণাপত্রে হিসেবটা করেছেন। বোধহয় হতাশ হয়েই তারা শেষে লেখেন: “…There is no practically possible way of observing the neutrino”। অর্থাৎ, বাস্তবে নিউট্রিনো পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ধরার কোনো উপায় নেই।
কিন্তু শুধু তত্ত্বের কচকচানিতে তো চিড়ে ভেজে না, হাতে নাতে ধরতে না পারলে বেখাপ্পা কণাটার অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ কাটানো মুশকিল। বিটা-তেজস্ক্রিয়তায় ই-নিউট্রিনো বা তার বিপরীত কণার সংখ্যা অনেক কম। ওরা শনাক্তক যন্ত্রে আঁচড় না কেটে পালিয়ে যায়। ১৯৫০ এর দশকে কেন্দ্রকীয় চুল্লী (nuclear reactor) বানানো শুরু হলো। এই চুল্লীতে যে বিক্রিয়া হয়, তা থেকে প্রতি সেকেণ্ডে অসংখ্য (প্রায় ) ই-বিপরীত-নিউট্রিনো বেরোয়। সংখ্যাটা এতটাই বেশি যে এর মধ্যে গুটি-কয়েকও যদি শনাক্তকারী যন্ত্রে এসে পড়ে, তাহলেই কেল্লা ফতে। মার্কিন দেশে রাইনেস, কাওয়ান আর তাদের সহযোগী আরও কয়েকজন বিজ্ঞানী মিলে ঠিক এই কঠিন কাজটাই করছিলেন। অবশেষে পাউলির ঘোষণার দীর্ঘ ২৫ বছর পর তারা নাগাল পেলেন ই-নিউট্রিনোর। যুগান্তকারী এই আবিষ্কারের খবর জানতে পেরে পাউলি বলেন: “Everything comes to him who knows how to wait”।
সেই শুরু। তারপর দশকের পর দশক ধরে চলতে লাগলো নিউট্রিনো নিয়ে গবেষণা। জন্ম থেকে ভুতুড়ে স্বভাবের হওয়া সত্ত্বেও কণাটি সম্বন্ধে এখন অনেক কিছু জানা গেছে। তত্ত্ব এবং পরীক্ষা থেকে প্রমাণ হয়েছে যে প্রকৃতিতে ই-নিউট্রিনো ছাড়া আরও দু-ধরণের নিউট্রিনো আছে। ইলেকট্রনের মতো আরও দুটো মৌলিক কণা আছে – মিউঅন () ও টাউঅন ()। এদের নিজস্ব সঙ্গী যথা: মিউ-নিউট্রিনো () এবং টাও-নিউট্রিনো ()।
তবে, এখনও বহু রহস্যের জট ছাড়ানো বাকি। বিজ্ঞানীরা অবশ্য চেষ্টার কসুর করছেন না। তারা বুঝতে পেরেছেন মহাবিশ্বকে চিনতে হলে এই কণাটিকে ভালভাবে জানা চাই-ই-চাই। তাই দেশে দেশে নিবিড় গবেষণা চলছে নিউট্রিনো নিয়ে। আমাদের দেশও তাতে পিছিয়ে নেই। খোঁজ চলছে সৃষ্টিতত্ত্ব(Cosmology), মহাকাশবিজ্ঞান(Astro-Physics) এবং কেন্দ্রকবিজ্ঞানে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে।
(প্রচ্ছদের ছবি: বিজ্ঞানী উল্ফগাং পাউলি এবং নিলস বোর, ছবি তুলেছেন এরিক গুস্তাফসন – সূত্র)
টীকা:
[১] নিউট্রিনোর যে সর্বত্র অবাধ বিচরণ রয়েছে, সেটা বোঝাতে কবি John Updike ‘Cosmic Gall’ বলে একটা মজাদার ছড়া লিখেছিলেন। তার কিছুটা অংশ এরকম:
Neutrinos, they are very small.
They have no charge and have no mass
And do not interact at all.
The earth is just a silly ball
To them, through which they simply pass,
Like dustmaids down a drafty hall
Or photons through a sheet of glass.
They snub the most exquisite gas,
Ignore the most substantial wall,
Cold-shoulder steel and sounding brass,
Insult the stallion in his stall,
And, scorning barriers of class,
Infiltrate you and me! Like tall
And painless guillotines, they fall
Down through our heads into the grass.
At night, they enter at Nepal
And pierce the lover and his lass
From underneath the bed—you call
It wonderful; I call it crass.
[২] মনে করি সম্পূর্ণ নিখুঁত (precision) কোনো যন্ত্রের সাহায্যে একটা জিনিসের অবস্থান() এবং ভরবেগ () মাপা হচ্ছে। এতে অনিশ্চয়তার (uncertainty) পরিমাণ যথা: ও । তাহলে, natural এককে (=1) অনিশ্চয়তার নীতি অনুযায়ী এই দুটোর গুণফল এর চেয়ে বেশি হবেই হবে। রাদারফোর্ড-এর পরীক্ষা থেকে কেন্দ্রকের সাইজ সম্বন্ধে একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। পরমাণুর কেন্দ্রকটি গড়নে সুষম গোলকের মতো হলে এর ব্যাসার্ধ 10 Fermi-র(= মিটার) মতো হয়। এখন ধরা যাক সত্যি সত্যি পরমাণুর কেন্দ্রকের ভিতরে ইলেকট্রন আছে। তাহলে -এর পরিমাণও 10 Fermi-র কাছাকাছি হবে। বিটা তেজস্ক্রিয়তা থেকে পাওয়া ইলেকট্রন গুলোর গড় গতিশক্তি 1 MeV-র আশেপাশে থাকে। সেখান থেকে ইলেকট্রনের বার করা যাবে। দেখা যায় দুটোর গুনফল –এর মানের চাইতে অনেক কম হয়।
[৩] পারমাণবিক ভর এককে (a.m.u.) আর -এর ভর যথা: 3.01695 এবং 3.01693।
[৪] রৈখিক (linear) আর ঘূর্নী-কৌণিক (spin angular) momentum-এর সংরক্ষণ সূত্র।
[৫] কুরি আর জুলিও নামে দুজন বিজ্ঞানী দেখালেন ধণাত্মক বিটা-তেজস্ক্রিয়াতেও আদি ও পরিবর্তিত কেন্দ্রকের ভরসংখ্যা পালটায় না। কিন্তু পরিবর্তিত কেন্দ্রকের পারমাণবিক সংখ্যা আদির তুলনায় এক একক কমে যায় ()। এর সাথে আরও দুটি কণা – পজিট্রন() আর ই-নিউট্রিনো() বেরোয়।
[৬] ই-নিউট্রিনো আর ই-বিপরীত-নিউট্রিনো – এই দুই-এর ‘Chirality’ আলাদা। গ্রীক শব্দ ‘chiros’ মানে হচ্ছে হাত। Goldhaber Experiment থেকে পাওয়া গেছে ই-নিউট্রিনো সবসময় বামহাতি, আর ই-বিপরীত-নিউট্রিনো ডানহাতি।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
১। ‘তিন প্রজন্মের কণা’, পলাশ বরণ পাল, (দেশ পত্রিকা, ২০শে এপ্রিল, ১৯৯৬)
২। Nuclear and Particle Physics, Satadal Bhattacharya
৩। প্রবন্ধে ব্যবহৃত ছবিগুলি আর্ন্তজাল(Internet) থেকে নেওয়া।