প্রয়োজনের তাগিদে কেবলমাত্র বন্য পশুপক্ষীকে বশীভূত করেই মানুষ ক্ষান্ত থাকেনি, বিভিন্ন জাতীয় কিট-পতঙ্গকেও পোষ মানিয়ে তাদের দ্বারা প্রয়োজনীয় কার্যোদ্ধার করিয়ে নিচ্ছে। মৌমাছি এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মধু আহরণ করবার নিমিত্ত কোন সময়ে মানুষ প্রথম মৌমাছি পালন শুরু করেছিল, তা সঠিক নির্ণয় করতে না পারলেও সেটা যে সহস্রাধিক বছর পূর্বের কথা, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে বর্তমান যুগে যেরূপ উন্নত কার্যকর পন্থায় মৌমাছি পালন করা হয়, প্রাচীন প্রথা যে তার চেয়ে বহুলাংশে নিকৃষ্ট ছিল, তা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে। মোটের উপর তখন মধু আহরণের নিমিত্ত সুবিধামত স্থানে চাক নির্মাণে মৌমাছিগুলোকে প্রলুব্ধ করবার জন্যেই বিবিধ কৌশল অবলম্বিত হতো। আজও পল্লী অঞ্চলে মৌমাছির ঝাঁক উড়ে যাবার সময় সেগুলিকে চাক বাঁধতে প্রলুব্ধ করবার জন্যে কয়েক প্রকার অদ্ভূত প্রথার প্রচলন দেখা যায়। যাহোক, মৌমাছি পালন সম্বন্ধে আলোচনা বর্তমান প্রসঙ্গের উদ্দেশ্য নয়। এস্থলে সাধারণ-ভাবে তাদের জীবনযাত্রা-প্রণালীর বিষয় কিঞ্চিত আলোচনা করবো।
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে নানা জাতীয় মৌমাছি দেখা যায়। আমাদের দেশেও বিভিন্ন জাতীয় কয়েক রকমের মৌমাছি দৃষ্টিগোচর হয়ে থাকে ; এদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বৃহদাকারের বুনো বা বাঘা মৌমাছিই সবচেয়ে উগ্র প্রকৃতির এবং অধিকতর মধু-সঞ্চয়ী। উঁচু গাছের ডালে, বড় বড় গাছের ফাটলে, দালানের কার্নিশে অথবা ছায়াছন্ন কোন গাছের ডালে মৌমাছিরা বড় বড় চাক নির্মাণ করে বসবাস করে। এক-একটা চাকে ৩০/৪০ হাজার থেকে ০৭/৮০ হাজার মৌমাছি দেখা যায়। পরস্পর গাত্র সংলগ্ন হয়ে এক-একটি চাকে এত অধিক সংখ্যক মৌমাছি বাস করলেও তাদের পরস্পরের সঙ্গে কখনও ঝগড়াঝাঁটি ঘটতে দেখা যায় না। অবশ্য সময়ে সময়ে এক চাকের মৌমাছি অন্য চাকের মৌমাছিগুলিকে আক্রমণ করে লুঠতরাজ করবার চেষ্টা করে থাকে। এরা ব্যক্তিগত সুখসুবিধার বিষয় উপেক্ষা করে সমাজের মঙ্গলের জন্যই দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রমে কাজ করে থাকে এবং প্রয়োজন হলে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিতেও কিছুমাত্র ইতস্তত করে না। যাঁদের একটু বিশেষভাবে মৌচাক লক্ষ করবার সুবিধা হয়েছে , তাঁরা জানেন যে ; কিরূপ বুদ্ধিমত্তা ও শৃঙ্খলার সঙ্গে মৌমাছিগুলি তাদের দৈনন্দিনকর্ম নির্বাহ করে থাকে। সারা শীতকালটা এরা সঞ্চিত মধুর উপর নির্ভর করে অনেকটা নিশ্চেষ্টভাবে কাটাবার পর বসন্তের আবির্ভাব থেকে যেভাবে মধু আহরণ, চাক নির্মাণ, বাচ্চা প্রতিপালন, বাসার আবর্জনা পরিষ্কার এবং শত্রুপ্রতিরোধ প্রভৃতি বিভিন্ন কার্যে ব্যাপৃত থাকে, তা দেখলে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। এই রকমের বিভিন্ন কাজের জন্যে এদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণী বিভাগ দেখা যায়। যার যা কাজ, সে যেন তা যন্ত্রের মতোই করে যাচ্ছে। এতে তাদের কণামাত্র ক্লান্তি বা অবসাদ নেই। কোনো কারণে অক্ষম বা দুর্বল না হওয়া পর্যন্ত এই কর্ম-প্রচেষ্টার বিরাম ঘটতে দেখা যায় না। চাকের অধিকাংশ মৌমাছিই দিনের বেলায় ফুলে ফুলে মধু আহরণে ব্যস্ত থাকে। তারা যে কেবল মধুই সংগ্রহ করে তা নয় ; সঙ্গে সঙ্গে পিছনের ঊরুদেশের চিরুণীর মতো যন্ত্রের সাহায্যে যথেষ্ট পরিমাণে ফুলরেণুও সংগ্রহ করে বাসায় নিয়ে আসে। ফুলের ওপর থেকে একটা মৌমাছি ধরলেই দেখা যাবে – তার পিছনের পায়ের মধ্যস্থলে হলুদ বর্ণের ফুলের রেণুগুলি যেন কাইয়ের মত সঞ্চিত রয়েছে। কতকগুলি মৌমাছি আবার বাসার জন্য জল সংগ্রহেই ব্যাপৃত থাকে। তারা ফুলের ওপর না বসে সোজা কোনোও জলাশয়ের উপর উড়ে যায়। জলাশয়ের ভাসমান জলজ পত্রাদির উপর বসে প্রচুর র্পরিমাণে জল শুষে নিয়ে বাসায় ফিরে আসে। গরু-ছাগল যেমন করে জলপান করে, সারবন্দিভাবে ভাসমান শালুক বা পদ্মপাতার কিনারায় বসে অনেক সময় তাদের জলপান করতে দেখা যায়। এতদ্ব্যতীত কতকগুলি মৌমাছি সর্বদাই চাকের মধ্যে অবস্থান করে। কোন সময়েই সেগুলিকে বাসা ছেড়ে বাইরে যেতে দেখা যায় না। এদের মধ্যে কতকগুলি প্রকোষ্ঠ নির্মাণ, কতকগুলি বাচ্চা প্রতিপালন এবং কতকগুলি মধু ও চাক রক্ষার কার্যে নিযুক্ত থাকে। পাহারাদার মৌমাছিগুলি সর্বদা সতর্কভাবে বাসার চতুর্দিকে ঘুরে বেড়ায় পূর্বেই বলা হয়েছে, সময় সময় বাসার মৌমাছিরা অপর বাসায় লুঠতরাজ করবার চেষ্টা করে থাকে। তাছাড়া অনিষ্টকারী বিবিধ পোকামাকড়ের অভাব নেই। তারা এদের বাচ্চা, ডিম ও মধুর লোভে, এমন কি – বাসার মোম খাবার জন্যেও আক্রমণ করতে কসুর করে না। এক জাতীয় ‘মথ’ আছে, যাদের শোঁয়াপোকারা মোম খেয়েই জীবনধারণ করে। মৌচাকের গন্ধ পেলেই এক জাতীয় শোঁয়াপোকা দল বেঁধে সেখানে উপস্থিত হয় এবং মুখ থেকে সূক্ষ্ম সুতা বের করে পাতলা কাগজের মতো জাল বুনে বাসার নিচের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এরূপে বাসার অধিকাংশই ক্রমশ সুতার জালে ঢেকে ফেলে। প্রথম থেকে বাধা দিতে না পারলে সেগুলিকে প্রতিরোধ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই এরা চাকে প্রবেশ করবার সকল প্রকার সম্ভাব্য পথে খাড়া পাহারা মোতায়েন করে। এই প্রহরীরা এতই সতর্ক যে, নিজেদের দলের যে কেউ বাইরে থেকে বাসায় উপস্থিত হোক না কেন, পরীক্ষা না করে তাকে ছেড়ে দেয় না। খুব সম্ভব শরীরের গন্ধ থেকেই এরা স্বজাতীয় বা বিজাতীয় দলের মৌমাছি বলে চিনতে পারে। কতকগুলি প্রহরী আবার চাকের অতি প্রয়োজনীয় জায়গা বিশেষে অবস্থান করে অতি দ্রুতগতিতে ডানা কাঁপাতে থাকে। বাসার নিকটে গেলেই একসঙ্গে অনেকগুলি মৌমাছির ডানা কাঁপানোর ঝন্ ঝন্ শব্দ প্রাণে একটা আতঙ্কের সঞ্চার করে।
চাকের যাবতীয় মৌমাছিকে প্রধানত দু-ভাগে ভাগ করা যায় – এক কর্মপটু শ্রমিক অর্থাৎ কর্মী ; ওপর দল সম্পূর্ণ কর্মবিমুখ। রানী ও পুরুষ মৌমাছিরাই শেষোক্ত ভাগে পড়ে। চাক নির্মাণ, বাচ্চা প্রতিপালন থেকে সুরু করে বাসা রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কিত যাবতীয় কাজ শ্রমিকেরাই করে থাকে। পুরুষ মৌমাছি প্রধানত আহার-বিহারেই মত্ত থাকে। রানী মৌমাছির প্রধান কাজ মৌমাছির বংশবৃদ্ধি করা। পুরুষেরা প্রায়ই দিনের শেষভাগে উচ্চ শব্দ করে বাসা থেকে উড়ে যায় এবং কিছুক্ষণ প্রমোদ ভ্রমণ করে বাসায় ফিরে আসে। প্রত্যেক চাকেই একটি মাত্র পরিণত বয়স্ক রানী মৌমাছি দেখতে পাওয়া যায়। কদাচিৎ এর ব্যতিক্রম লক্ষিত হয়ে থাকে। মৌমাছিদের কার্যকলাপ দেখে মনে হয় – একটিমাত্র রানীকে অবলম্বন করেই যেন সমাজ বন্ধন গড়ে উঠেছে। কিন্তু রানী বলে তাকে চাকের মৌমাছিদের শাসনকর্ত্রী বুঝায় না। এদের মধ্যে রাজতন্ত্র বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। রানীর কাজ একমাত্র প্রজনন করা। একটি মাত্র রানীই চাকের প্রায় অধিকাংশ মৌমাছির মাতা। রানী কেবল ডিম পেড়েই খালাস। একমাত্র যৌন মিলনে অংশ গ্রহণ করা ছাড়া পুরুষ মৌমাছিদেরও আর কোন প্রয়োজনীয়তা দেখা যায় না। কাজেই মৌমাছিদের কথা বলতে গেলে প্রধানত কর্মী মৌমাছিদেরই বুঝায়। কর্মীদের দ্বারাই মৌমাছি সমাজের পরিচয়।
পূর্বে লোকের ধারণা ছিল যে , ফুল থেকে মোম সংগ্রহ করে মৌমাছিরা তার সাহায্য চাকের কুঠুরিগুলি নির্মাণ করে। কিন্তু অনুসন্ধানের ফলে দেখা গেছে যে, কর্মী মৌমাছিদের পেটের নিম্নভাগে অবস্থিত কতকগুলি গ্রন্থি থেকেই মোম উৎপাদিত হয় এবং সেই মোমের সাহায্যেই এরা চাক নির্মাণ করে থাকে। মৌমাছির ঝাঁক উড়ে যেতে অনেকেই দেখে থাকবেন। উড়তে উড়তে সুবিধামত স্থান দেখতে পেলে সেখানেই কোনও গাছের ডালে বসে পড়ে। বাসা নির্মাণের অনুপযুক্ত মনে করলে দু -একদিন সেখানে অবস্থান করে আবার উড়ে যায়। উপযুক্ত স্থানে উপস্থিত হলে চাক নির্মাণ করবার পূর্বে কর্মী মৌমাছিরা বাসা বাঁধবার জন্য নির্বাচিত স্থানে ঘনসন্নিবিষ্টভাবে ঝুলে কিছুকাল নিশ্চেষ্টভাবে অবস্থান করে। এই সময় তাদের উদরের নিম্নদেশে মোম উৎপন্ন হতে থাকে। আমরা সাধারণত যেরূপ মোমের সঙ্গে পরিচিত – প্রথম উৎপন্ন হবার সময় তা মোটেই সেরূপ অবস্থায় থাকে না। মৌমাছির উদরের নিম্নভাগে প্রথম যে মোম উৎপন্ন হয় তা দেখতে অনেকটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বচ্ছ অভ্র খণ্ডের মতো। এই স্বচ্ছ মোমের পাতাগুলি মৌমাছির উদরের শক্ত খোলার ভাঁজে ভাঁজে প্রলম্বিত অবস্থায় সজ্জিত থাকে। বাসা নির্মাণ করবার সময় এরূপ অসংখ্য মোমের টুকরা বাসার নিচে ভূমির উপর পড়ে থাকতে দেখা যায়। মৌমাছিরা এই টুকরাগুলি খুলে নিয়ে চিবিয়ে মুখ-নিঃসৃত অম্লরসাত্মক লালার সঙ্গে মিশ্রিত করে। সেগুলিকে এক প্রকার অস্বচ্ছ বাসা তৈরির মণ্ডে পরিণত করে। এই মণ্ড কাদামাটির মতো প্রয়োগ করে এরা ছয় কোণ-বিশিষ্ট ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুঠুরি নির্মাণ করে। কুঠুরি নির্মাণ শেষ হলে রানী তার শরীরের পশ্চাদ্ভাগ কুঠুরির ভিতরে প্রবেশ করিয়ে প্রত্যেকটিতে এক-একটি করে ডিম পেড়ে যায়। ডিম ফুটে কীড়া বের হবার পর কর্মীরা তাদের শরীর থেকে উৎপন্ন এক প্রকার সাদা ঘন তরল পদার্থের সঙ্গে ফুলের রেণু প্রভৃতি মিশিয়ে তাদের খেতে দেয়। এই পদার্থকে ‘রয়েল জেলী’ বা মৌমাছির দুধ বলা হয়। কুঠুরির পার্থক্য অনুযায়ী অর্থাৎ বাচ্চাগুলির ভবিষ্যৎ পরিণতির উপর লক্ষ্য রেখেই বোধ হয় খাদ্যের পরিমাণের তারতম্য করা হয়ে থাকে। বাচ্চাগুলির শৈশবাবস্থা অতিক্রম করবার পর মোমের সাহায্যে কর্মীরা তখন কুঠুরির মুখ বন্ধ করে দেয়। তখন থেকেই বাচ্চাগুলির কৈশোর অবস্থা চলতে থাকে। কুঠুরির মুখ বন্ধ হবার পরেই বাচ্চা তার মুখে সূক্ষ্ম সুতা বের করে দেহের চতুর্দিকে একটি যুগ্ম আবরণী গড়ে তোলে। এই আবরণীর মধ্যে নিশ্চেষ্টভাবে অবস্থান করে কীড়া পুত্তলীতে রূপান্তরিত হয়। কীড়া অবস্থায় তাদের হাত-পা বা অন্য কোনও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চিহ্নমাত্র থাকে না। পুত্তলী অবস্থায় বাচ্চার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আত্মপ্রকাশ করে; অর্থাৎ কতকটা অসম্পূর্ণ থাকলেও এই সময়ে বাচ্চা প্রকৃত মৌমাছির আকৃতি পরিগ্রহণ করে। অবস্থাটা অনেকটা মাতৃগর্ভে অবস্থিত পরিণত মনুষ্যভ্রুণের মতো। আরও কিছুকাল নিশ্চেষ্টভাবে অবস্থান করবার পর পূর্ণাঙ্গ মৌমাছির রূপ ধারণ করে কুঠুরির মুখ কেটে বাইরে আসে। নতুন কর্মী জন্মগ্রহণ করবার পর প্রথমত কিছুদিন সে বাসা ছেড়ে মোটেই বাইরে যায় না, বাসার আভ্যন্তরীণ কার্যেই ব্যাপৃত থাকে। আবর্জনা সরিয়ে তারা কুঠুরিগুলিকে পরিষ্কার রাখে, ডানা কপিয়ে কুঠুরির অভ্যন্তরে বিশুদ্ধ বায়ু সঞ্চালন করে। চাকের প্রবেশ-পথে পাহারায় মোতায়েন থেকে আক্রমণকারী কীট-পতঙ্গ তাড়াবার ব্যাবস্থা করে এবং কেউ কেউ সংগৃহীত মধু সংরক্ষণের কার্যেও ব্যাপৃত হয়ে থাকে। পক্ষাধিক কাল গৃহকার্যে আত্মনিয়োগ করবার পর মধু সংগ্রহে বহির্গত হয়। মৌমাছিরা সাত-আট সপ্তাহ থেকে প্রায় ছয় মাস কাল জীবিত থাকে, রানী-মৌমাছিকে তিন বছর থেকে প্রায় চার বছর পর্য্যন্ত জীবিত থাকতে দেখা যায়। পুরুষ-মৌমাছিরা গ্রীষ্মের মাঝামাঝি জন্মগ্রহণ করে যৌন-অভিযানের পর প্রতিকুল অবস্থায় পড়ে নানাভাবে প্রাণত্যাগ করে এবং অবশিষ্ট যারা থাকে তারাও কর্মীদের দ্বারা সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়।
পূর্বেই বলা হয়েছে – একটি রানী থেকেই হাজার হাজার মৌমাছি জন্মগ্রহণ করে থাকে। পুরুষ, কর্মী ও নতুন রানীরা তারই সন্তান। যৌন-মিলনের ফলে স্ত্রী ও পুরুষ মৌমাছি উৎপন্ন হবার ব্যাপারে কিছুমাত্র নতুনত্ব নেই। জীবজগতে অহরহই এরূপ ব্যাপার ঘটছে। কিন্তু একই রকম বৈশিষ্ট্য সমন্বিত হাজার হাজার কর্মী মৌমাছির উৎপত্তি হয় কিরূপে ? মৌমাছি-জীবনের এটা এক অদ্ভূত রহস্য। গবেষণার ফলে – স্ত্রী, পুরুষ ও কর্মী – এই তিন শ্রেণীর মৌমাছির জন্ম-বৃত্তান্ত সম্বন্ধে যতদুর জানতে পারা গেছে তা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক।
মৌমাছিদের জীবনযাত্রাপ্রণালী পর্যবেক্ষণ করলে সহজেই একথা মনে হয় যে, রানী মৌমাছি ইচ্ছামত স্ত্রী, পুরুষ, কর্মী মৌমাছি উৎপাদন করতে পারে। ডিম পাড়বার সময় হলেই রানীকে সর্বক্ষণই চাকের উপর ঘুরে ঘুরে প্রত্যেকটি শূন্য কুঠুরিতে এক-একটি করে ডিম পাড়তে দেখা যায়। যে সকল কুঠুরিতে পুরুষ-মৌমাছি উৎপন্ন হয় সেগুলির আয়তন শ্রমিক মৌমাছিদের কুঠুরি থেকে কিঞ্চিৎ বৃহদাকার। এই উভয় শ্রেণীর কুঠুরি থেকে রানীর কুঠুরির আকৃতি সম্পূর্ণ পৃথক এবং আয়তনেও তা অনেক বড়। পর্যবেক্ষণের ফলে দেখা গেছে – কুঠুরিগুলির আকৃতি বা আয়তনের পার্থক্য সম্বন্ধে কিছুমাত্র বিবেচনা না করেই রানী একাদিক্রমে ডিম পেড়ে যায়। কিন্তু সর্বশেষে দেখা যায় – কুঠুরির আয়তনের তারতাম্যনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেণীর মৌমাছি জন্মগ্রহণ করেছে ; অর্থাৎ ছোট কুঠুরি থেকে কর্মী, মাঝারি কুঠুরি থেকে পুরুষ এবং বড় কুঠুরি থেকে রানী জন্ম গ্রহণ করেছে। কাজেই পর্যবেক্ষকের পক্ষে এ কথা অনুমান করা স্বাভাবিক যে , রানী ইচ্ছামত কর্মী,পুরুষ ও রানীর ডিম প্রসব করে থাকে। যৌন পার্থক্য হিসাবে প্রকৃত প্রস্তাবে রানী ও কর্মী মৌমাছিদের মধ্যে প্রভেদ অতি সামান্য। রানীদের মতো কর্মী-মৌমাছিরাও স্ত্রী জাতীয়। কিন্তু রানীরা সন্তান-উৎপাদনে সক্ষম পক্ষান্তরে কর্মীরা বন্ধ্যা। রানীদের প্রজনন যন্ত্র যেরূপ পরিপূর্ণতা লাভ করে কর্মী-মৌমাছিদের প্রজনন যন্ত্র সেরূপ পরিণত অবস্থায় উপনীত হয় না। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও রানী ও কর্মী মৌমাছিরা একই রকমের ডিম থেকেই জন্মগ্রহণ করে থাকে। অদ্ভূত হলেও ব্যাপারটা সহজেই উপলব্ধি হতে পারে। স্ত্রী জাতীয় মৌমাছিদের প্রজনন যন্ত্রে যথাযথ পরিপূর্ণতা নির্ভর করে খাদ্য ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর। শ্রমিক মৌমাছিরা স্ত্রী জাতীয় হলেও শৈশবাবস্থা থেকেই তারা প্রতিপালিত হয় ক্ষুদ্রায়তন কুঠুরির মধ্যে। এই সকল কুঠুরিতে মৌমাছির রয়েল জেলী বা দুধ প্রচুর পরিমাণে সরবরাহ করা হয় না। ঠিক যতটুকু প্রয়োজন কর্মীরা বাচ্চাগুলিকে ঠিক ততটুকু খাদ্যই দিয়ে থাকে। রানীর কুঠুরি অনেক বড়। তাতে বেশী পরিমাণ খাদ্যের স্থান সংকুলান হয়। কাজেই বড় কুঠুরির বাচ্চা শৈশবাস্থায় প্রচুর পরিমাণ সহজ পাচ্য রয়েল জেলী উদরস্থ করতে পারে। প্রচুর খাদ্য উদরস্থ করার ফলে সে যে কেবল আকৃতিতেই অনেক বড় হয় তা নয়, তার দেহ-যন্ত্রাদিও যথাযযথ পরিপুষ্টি লাভ করতে পারে। কিন্তু রানী ও শ্রমিক-মৌমাছির পার্থক্য কেবল প্রজনন যন্ত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, আকৃতি ও প্রকৃতিগত বহুবিধ পার্থক্য দৃষ্টিগোচর হয়। খাদ্যের পরিমাণের তারতম্যে হিসাবে যদি কেবল ক্ষুদ্র ও বৃহদাকৃতির পার্থক্য দেখা যেত তবে ব্যাপারটা সহজবোধ্য হতো সন্দেহ নেই। কিন্তু কর্মীর শরীরের প্রান্তদেশ গোলাকার এবং রানীর শরীরের পশ্চাদ্ভাগ লম্বা ও সূচালো। রানী ও কর্মীর চোয়াল এবং জিভ ভিন্ন ধরনের। রানীর দেহে মোম-উৎপাদক বা রেণু-সংগ্রাহক যন্ত্র নেই, উভয়ের দেহবর্ণেও যথেষ্ট তারতম্য দেখা যায়। তাছাড়া বুদ্ধিবৃত্তিতে রানী মৌমাছিরা কর্মীদের অপেক্ষা অনেক নিম্নমানের বলে বোধ হয়। রানী জন্মগ্রহণ করবার পর যৌন মিলনের জন্যে একমাত্র বাসা থেকে উড়ে যায়। মিলনের পর চাকে ফিরে সে ডিম পাড়তে আরম্ভ করে। দলের বাসা পরিবর্তন করবার সময় ছাড়া আর কখনও তাকে বাসা ছেড়ে উড়তে দেখা যায় না। কর্মী-মৌমাছিরা তার আহার জোগায়, ডিম পাড়বার স্থান নির্দেশ করে এবং তার যাবতীয় কার্যনির্বাহ করে। মোটের উপর রানীরা কর্মীদের হাতে যন্ত্রের মতো পরিচালিত হয়। তাছাড়া রানীদের এক অদ্ভূত মনোবৃত্তি দেখা যায়। যদি কোনও চাকে কখনও অপর রানী-মৌমাছির আবির্ভাব হয়, তবে উভয়ের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ বেধে যায়। একটি সম্পূর্ণরূপে পরাজিত ও নির্জীব না হওয়া পর্যন্ত্ যুদ্ধের অবসান ঘটে না। কর্মীরা চতুর্দিকে ঘিরে এই যুদ্ধের ফলাফল দেখতে থাকে। যুদ্ধ শেষ হওয়ামাত্রই তারা বিজয়ীনিকে তাদের রানীর পদে বরণ করে নেয়। কাজেই রানী ও শ্রমিকের এই যে কতকগুলি গুরুতর পার্থক্য বিদ্যমান, সেটা কি কেবল খাদ্যবস্তুর তারতম্যের উপরেই নির্ভর করে ? অথচ শ্রমিক ও রানী মৌমাছি যে একই রকমের ডিম থেকে উৎপন্ন হয়ে থাকে, তা অতি সহজেই প্রমাণিত হয় ? ডিম ফোটাবার পর দু-তিন দিনের মধ্যে শ্রমিকের কুঠুরি থেকে বাচ্চা তুলে নিয়ে তাকে যদি রানীর কুঠুরিতে এবং রানীর কুঠুরির বাচ্চা শ্রমিকের কুঠুরিতে রাখা যায় , তবে দেখা যাবে – পরিবর্তন সত্ত্বেও শ্রমিকের কুঠুরি থেকে শ্রমিক এবং রানীর কুঠুরি থেকে রানী-মৌমাছিই উৎপন্ন হয়েছে। এই পরীক্ষা থেকে সহজেই বুঝতে পারা যায় যে, এই জাতীয় ডিম থেকে খাদ্যের তারতম্যানুসারে রানী ও কর্মী মৌমাছি উৎপন্ন হয়। ভিন্ন রকমের একপ্রকার ডিম থেকে পুরুষ-মৌমাছি উৎপন্ন হয়ে থাকে। যৌন-মিলন না হলেও রানী মৌমাছিকে ডিম পাড়তে দেখা যায়। এই অনিষিক্ত ডিম থেকেই পুরুষ-মৌমাছি উৎপন্ন হয়ে থাকে। যৌন-মিলনের পর ডিম্ব-নিষেককারী রস ডিম্বাধারে না গিয়ে ডিম্বনলের সঙ্গে সংযুক্ত একটি নির্দিষ্ট থলিতে সঞ্চিত হয়। ডিম বাইরে নির্গত হবার সময় ওই নলের মুখে তা নিষিক্ত হয়ে থাকে। কেউ কেউ অনুমান করেন, রানী যখন ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে ডিম পাড়বার জন্যে শরীরের পশ্চাদ্ভাগ প্রবেশ করিয়ে দেয় তখন চাপ লাগবার ফলে অভ্যন্তরস্থ থলি থেকে পুং-রস নির্গত হয়ে ডিমটিকে নিষিক্ত করে দেয়। পুরুষ-মৌমাছিদের প্রকোষ্ঠ অপেক্ষাকৃত বড় বলে তাতে ডিম পাড়বার সময় চাপ লাগে না। কাজেই পুং-রস থলি থেকে নির্গত না হবার ফলে ডিমটি অনিষিক্তভাবেই বহির্গত হয়। এই অনিষিক্ত ডিম থেকে পুরুষ-মৌমাছি জন্মগ্রহণ করে থাকে।
সাধারণত আমরা দেখতে পাই, জীবজগতে পিতা ও মাতার সহযোগে সন্তান জন্মগ্রহণ করে এবং সেই সন্তান পিতা অথবা মাতার অনুরূপই হয়ে থাকে। জীবতত্ত্বের গোড়ার কথা আলোচনা করলে দেখা যাবে – আদি জীব-কোষে পিতা ও মাতার বৈশিষ্ট্য অন্তর্নিহিত থাকে। পুং-বৈশিষ্টসমূহ প্রাধান্য লাভ করলে ভ্রূণে ক্রমশ পুং-লক্ষণসমূহ আত্মপ্রকাশ করে, অন্যথায় স্ত্রী-লক্ষণসমূহ বিকশিত হয়ে থাকে। আদি জীব-কোষে স্ত্রী ও পুং বৈশিষ্ট্যের অস্তিত্ব থাকে বলেই স্ত্রী অথবা পুং-সন্তান উৎপন্ন হতে পারে। কিন্তু মৌমাছিদের ক্ষেত্রে জীবের জন্মরহস্যের মূল তত্ত্বের দিক থেকে বিচার করলে তাদের স্ত্রী ও পুরুষ উৎপত্তির ব্যাপারটাকে কিরূপে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে ? পুরুষের সম্পর্ক থাকলেই সেখানে স্ত্রী-সন্তান উৎপন্ন হবে-অথচ পুরুষ-সংস্রব না থাকলে সেখানে কেবলই পুরুষ সন্তান উৎপন্ন হবে – এ অতীব বিস্ময়কর ব্যাপার। পুরুষ-সংস্রব বর্জিত স্ত্রী-গর্ভস্থ ডিম্ব অথবা জীব-কোষে পুরুষের বৈশিষ্ট্যসমূহ কেমন করে আত্মপ্রকাশ করে ? বিভিন্ন জাতীয় প্রাণীর দেহ-কোষ, বিশেষ করে জীব কোষে অবস্থিত ‘ক্রোমসোমে’র কথা আলোচনা করলেই এর সহজ সমাধান হতে পারে। মানুষ হতে আরম্ভ করে প্রায় অধিকাংশ প্রাণীর পুরুষদের শরীরে যতগুলি পুং-কোষ উৎপন্ন হয়, তার অর্ধসংখ্যক কোষগুলিতে X এবং বাকি অর্ধেকে থাকে Y-ক্রোমোসোম। স্ত্রীদের ডিম্বকোষের প্রত্যেকটিতেই থাকে X-ক্রোমোসোম। অর্থাৎ ক্রোমোসোমের দিক থেকে বলতে গেলে-পুরুষেরা YX এবং স্ত্রীরা XX। পুং-কোষের X-ক্রোমোসোম ডিম্বকোষের X-ক্রোমোসোমের সঙ্গে মিলিত হলে সন্তান হবে স্ত্রী এবং পুংকোষের Y – ক্রোমোসোম ডিম্বকোষের X-ক্রোমোসোমের সঙ্গে মিলিত হলে সন্তান হবে পুরুষ। Y – ক্রোমোসোমটাকেই পুং-বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বলে মনে করা হয়। মৌমাছির ক্রোমোসোমও যদি এই অবস্থায় থেকে থাকে তবে অনিষিক্ত ডিম্ব থেকে পুং-মৌমাছি উৎপন্ন হতে পারে না। কাজেই মনে হয়, পাখি, প্রজাপতি প্রভৃতি কয়েক জাতীয় প্রাণীদের মতো পুং-মৌমাছি-XX এবং রানী-মৌমাছি -XY ক্রোমোসোম সমন্বিত। মৌমাছির সমগোত্রীয় অন্যান্য প্রাণী সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলে অন্তত এই ধারণাই সমীচীন বোধ হচ্ছে।
চৈত্র, ১৩৪৯
প্রবাসী
(গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের লেখা এই প্রবন্ধগুলি প্রকাশ করতে পারার জন্য আমরা তাঁর পুত্রবধূ শুভা ভট্টাচার্য, দৌহিত্রী মালা চক্রবর্ত্তী, গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য বিজ্ঞান প্রসার সমিতির সম্পাদক দীপক কুমার দাঁ এবং আকাশবাণী কলকাতার মানস প্রতিম দাস-র কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।)
প্রচ্ছদের ছবি: PixaBay