নিচের ছবিটা কি বলুন তো? মিউজিয়ামে ঢুকে হঠাৎ করে এইটা চোখ পড়তে বেশ ঘাবড়ে গেছিলাম। কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো এইটা ঠাওর করতে যে কি দেখছি।
যদি দুর্ভাগ্যবশত একটা উত্তর অতলান্তিক রাইট তিমির (North Atlantic Right Whale) সামনে পড়ে যান, তাহলে তিমির পেটে যাওয়ার আগে আপনি যা দেখবেন, এটা তার একটা মডেল। এইভাবে হাঁ করে এরা জলসুদ্ধ মুখে যা আসে, সব তুলে নেয়। তারপর জল ছেঁকে বার করে বাকিটা দিয়ে পেটপূজা করে। তাতে ছোটবড় সবরকমের প্রাণী থাকতে পারে।
তিমি যে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ প্রাণীদের মধ্যে পড়ে (নীল তিমি সবথেকে বড়), সেটা আমরা পড়ে এসেছি। কিন্তু সেটা চাক্ষুষ দেখতে চাইলে গোটা তিমি কোথায় পাওয়া যাবে? নীল তিমি যে সাইজের, তাকে একুয়ারিয়ামে ধরে রাখা যায় না। অনেক জায়গাতে Whale Watch হয়, যেখানে দূর থেকে এই প্রাণীটাকে দেখা যায়। যেহেতু এরা আদতে স্তন্যপায়ী প্রাণী (mammals), মাছ নয়, এদের জলের উপরে আসতে হয় শ্বাস নিতে। একটা Whale Watch টুর-এ গেলে সেই সময় দূর থেকে তাদের দেখা যায়। তবে সাধারণত তাদের বিশাল দেহের একটা অংশই তখন বাইরে বেরোয়। তারা যে ঠিক কত বড়, সেইটা ঠাহর করা যায় না।
তার জন্য যেতে হবে মিউজিয়াম-এ। গেলাম আমরা ‘বিজ্ঞান’-এর কিছু সদস্য। এখানে দুটো মিউজিয়ামের কথা বলা হয়েছে। প্রথমটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, দ্বিতীয়টা তার উত্তরের প্রতিবেশী দেশ কানাডাতে।
Moby Dick-এর শহরে (New Bedford Whaling Museum)
১৮৫১-এ লেখা “মোবি ডিক” (Moby Dick) বইটাতে আধপাগলা ক্যাপ্টেন আহাব অভিযানে বেরিয়েছিল একটা সাদা তিমির উপর প্রতিশোধ নিতে। আগের যাত্রায় হাঁটুর নিচ থেকে তার পায়ের বাকিটা সেই তিমি খেয়ে দিয়েছিল যে! প্রতিশোধ-অভিযান শুরু হয় আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের নিউ বেডফোর্ড (New Bedford) শহর থেকে।
লেখক হারমান মেলিভিল-এর যথেষ্ট কারণ ছিল কাহিনীটাকে নিউ বেডফোর্ড-এ ফেলার। এক সময় তিমি শিকারের কেন্দ্রস্থল ছিল এই শহরটা। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধেককে তিমি শিকারের স্বর্ণযুগ বলা হয়। সেই সময়ে গোটা শহরটা দাঁড়িয়ে ছিল এই একটা ব্যবসার উপর। তিমি শিকার করে তার গাবদা চর্বি (blubber) থেকে তেল বার করে সেই তেল মেশিনে দেওয়া হতো কিম্বা আলো জ্বালতে ব্যবহার করা হতো (তখনো কেরোসিন-পেট্রোলিয়াম বার হয়নি)। একেকটা দীর্ঘমেয়াদী অভিযান বেরোতো তিমি শিকারে, শিকার করে জাহাজেই তার থেকে তেল বার করতো, এবং কাঁড়ি কাঁড়ি পিপে ভর্তি তেল নিয়ে ফিরে আসতো।
নিউ বেডফোর্ড ওয়েলিং মিউজিয়াম-এর দোতলায় সেইসব দিনের চিহ্ন রয়েছে। যেমন এই তিমিশিকারী জাহাজের (whaler) মডেলটা:
রয়েছে হারপুন (harpoon) সহ তিমি শিকারের নানা সরঞ্জাম। এবং দেওয়াল জুড়ে তিমি শিকারের নানা বীভৎস বিবরণ, হাতে-আঁকা ছবি সহ।
কিন্তু একতলাটা যেন সেইসব দিনের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। তিমি শিকার করে কি পাওয়া যাবে, তার পরিবর্তে প্রাণীগুলোকে বোঝার চেষ্টা রয়েছে। বিভিন্ন প্রকারের তিমি-জাতীয় জলচর স্তন্যপায়ী প্রাণীদের (cetacean) বিবরণ রয়েছে। তারা এখনো কেন সঙ্কটে, সেই নিয়ে আলোচনাও রয়েছে।
কিন্তু মিউজিয়ামটার সবথেকে বড় আকর্ষণ দেখা যায় দরজা দিয়ে ঢুকেই। তিনটে তিমির কঙ্কাল রয়েছে: একটা নীল তিমি (blue whale), একটা উত্তর অতলান্তিক রাইট তিমি (North Atlantic right whale) আর একটা হাম্পব্যাক তিমি (humpack whale)। নীল তিমিটা শিশু, আন্দাজ চার থেকে ছ বছর বয়েস, তবু সাইজ তার ৬৬ ফিট। ৬৬ ফিট! একজন রোগাপাতলা মানুষের উচ্চতা ৬ ফিট হলে তাকে ঢ্যাঙা বলা চলে। এটার সাইজ প্রায় তার এগারো গুণ! Panoramic ছবি না নিলে মিউজিয়ামের মধ্যে দাঁড়িয়ে গোটা ক্যামেরাতে ছবি আসে না। নিচের ছবিটা নেওয়া হলো দোতলা থেকে কঙ্কালের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে:
অন্য তিমিগুলো অপেক্ষাকৃত ছোট। যেমন নিচের হাম্পব্যাক তিমিটা। ওটার বয়েস তিন বছর, সাইজ ৩৭ ফিট।
আর দোতলাতে আছে একটা স্পার্ম ওয়েল (sperm whale)। পাশে একটা মানুষের কঙ্কাল বসিয়ে দেখানো হয়েছে মানুষটা কত ছোট:
একতলার তিনটে তিমিই মারা গেছিল কোনো না কোনো জাহাজের সাথে ধাক্কা লেগে। একটা তিমির পেটে একটা বাচ্চা ছিল, যেটা নিজেও এখন কঙ্কাল হয়ে আছে। তিমি শিকার প্রায় বন্ধ হয়ে গেলেও এইরকম অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু কিন্তু হয়েই চলেছে।
Big Blue-এর সন্ধান (Beaty Biodiversity Museum)
প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ কলম্বিয়া (UBC) -র সাজানো ক্যাম্পাস। এখানেই রয়েছে পরিবেশ জাদুঘর/সংগ্রহশালা, বিটি বায়োডাইভার্সিটি মিউজিয়াম (Beaty Biodiversity Museum)। রস এবং ট্রিশা বিটির নামাঙ্কিত এই সংগ্রহশালা তৈরী হয় ২০১০ সালে। ২০,০০০ বর্গফুট জুড়ে এখানে প্রায় ২০ লক্ষ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। নানারকমের সামুদ্রিক অমেরুদন্ডী প্রাণী, মাছ, জীবাশ্ম এবং পশুপাখির সংগ্রহ আমাদের গ্রহের জীববৈচিত্র্যের একটি অনন্য উদাহরণ।
ওপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে সংগ্রহশালার প্রধান আকর্ষণ একটি নীল তিমির কঙ্কাল। নীল তিমি পৃথিবীর বৃহত্তম প্রাণী। ১৯৮৭ সালে কানাডার প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ডের সৈকতে প্রায় ৮০ ফুট লম্বা এই কঙ্কালটি ভেসে আসে।
কঙ্কালটিকে প্রাথমিক ভাবে কবর দেওয়া হয়েছিল। কুড়ি বছর বাদে ড: অ্যান্ড্রু ট্রাইটস-এর নেতৃত্বে একটি দল কঙ্কালটিকে UBC-তে স্থানান্তরিত করে এবং দু’বছরের চেষ্টায় পুরো নমুনাটিকে জোড়া লাগান।
সারা পৃথিবীতে এরকম মাত্র একুশটি নমুনা রয়েছে। সংগ্রহশালার কর্মীরা এর নাম দিয়েছেন ‘Big Blue’।
তিমি সংরক্ষণ
বাণিজ্যিক কারণে তিমি শিকার সেই ১৯৮৬ থেকে নিষিদ্ধ। তবুও তিমি মরে। মাছ ধরার লাইনে আটকে, জাহাজে ধাক্কা লেগে কিম্বা মহাসাগরের প্লাস্টিক আবর্জনা গিলে। তিমির অনেক প্রজাতিই এখন বিপন্নের তালিকায়।
তবে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ প্রাণী নীল তিমির দুর্দশা একটু কমেছে। তিমি শিকার বন্ধ হওয়ার পর তারা ধীরে ধীরে ফিরছে (২০২০-তে ২৫০০০ মতো থাকতে পারে এমন আন্দাজ করা হচ্ছে [১])। যদিও এখনো তারা বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় রয়েছে, তবু আশার আলো দেখা যাচ্ছে। এমন জায়গা, যেখানে এককালে নীল তিমি ছিল এবং শিকার করে করে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছিল, সেখানেও তারা ফিরে আসছে [২]।
অতএব, সংরক্ষণ কাজ করে। পরবর্তী প্রজন্ম যাতে এই সংরক্ষণে আরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়, তাদের পৃথিবীর জীববৈচিত্রের সাথে অল্পবয়সে পরিচয় করাতে পারলে ভালো। তিমি হারিয়ে গেলে ঠিক কি হারাবো, সেটা একটা তিমির সাইজ না দেখলে আন্দাজ করা যায় না। এদের দেখলে মনে হয়: “এরাও পৃথিবীতে আমাদের সাথে ছিল (থুড়ি, এখনো আছে, বালাই ষাট)। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ প্রাণী এরা [৩], খাদ্য শৃঙ্খলে এদের উপর কেউ নেই। কিন্তু মানুষ তার অফুরন্ত প্রয়োজন মেটাতে এই প্রাণীটাকে শিকার করতে করতে প্রায় বিলুপ্তির কাছাকাছি নিয়ে গেল।”
সেই অনুভূতিটা তখনই আসবে যদি এদের সাথে চাক্ষুষ পরিচয় করা যায়। সেটা করতে গেলে কিন্তু মিউজিয়ামে না গিয়ে উপায় নেই।
প্রচ্ছদের ছবি : Pexels, বাকি ছবি: লেখক
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
এই লেখাটিতে ছবি ব্যবহার করার অনুমতির জন্য New Bedford Whaling Museum-এর কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই। লেখাটি আংশিক টাইপ করতে সাহায্য করেছেন কাঁথি-র পারমিতা গিরি।
তথ্যসূত্র ও অন্যান্য টুকিটাকি:
[১] WWF: Blue Whale
[২] South Georgia blue whales five decades after the end of whaling
[৩] নীল তিমি শুধু বর্তমান প্রাণিজগতে সর্ববৃহৎ নয়, সেই প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসরদের ধরলেও সবথেকে বড় (অন্তত যত ডাইনসোরের কথা জানা গেছে, সেগুলোকে ধরলে)।