পোকা, নাকি মাকড়?
শৌভনিক সেনগুপ্ত (চন্দননগর, হুগলি)
তোমরা হয়তো কেউ কেউ নালসো পিঁপড়ে (Weaver ant) দেখে বা তাদের কথা শুনে থাকবে l বড় বড় গাছের পাতাগুলিকে নিজেদেরই শূককীট নিঃসৃত রেশম সুতোর মত নির্যাস দিয়ে একসাথে জুড়ে তারা চমৎকার বাসা তৈরি করে। আচ্ছা, ছবিতে দেখো, ওটা যেন নালসো পিঁপড়েই মনে হচ্ছে, না? কিন্তু ভালো করে দেখলে লক্ষ্য করবে, ওর একদিকে চারটি পা দেখা যাচ্ছে, তাহলে দুদিকেই তাই, মানে মোট চার জোড়া পা।
অথচ পিঁপড়ে সহ সব ‘Insect’ শ্রেণীর প্রাণীদের মাত্র তিন জোড়া পা থাকে আর চার জোড়া পা দেখা যায় ‘Arachnid’ মানে মাকড়সা জাতীয় প্রাণীদের। আসলে এটি এক প্রজাতির (Myrmaplata plataleoides) লাফানো মাকড়সা যা নালসো পিঁপড়ের অনুকরণ করে থাকে। প্রাণীজগতে এই ধরণের অনুকরণ (mimicry) অনেক সময়েই দেখা যায়। এক্ষেত্রে মাকড়সাটির এই কাজ তাকে খাদক প্রাণীদের হাত থেকে রক্ষা করে কারণ নালসো পিঁপড়ের স্বাদ ও কামড়ের জন্য অনেক প্রাণীই তাদের এড়িয়ে চলে। অন্যদিকে পিঁপড়ের বাসার আশেপাশেই পাতায় ফাঁদ পেতে তারা নিজেদের মতো শিকার ধরে।
ছবিতে মাথার সামনে লম্বা দাঁড়ার মত অংশটি দেখেছো? সাধারণ মাকড়সার মুখের কাছে ছোট আকৃতির chelicerae অঙ্গটি এই প্রজাতির পুরুষ মাকড়সার ক্ষেত্রে এরকম আকার নেয়, যা তারা লড়াইয়ের কাজে ব্যবহার করে। পুরুষ মাকড়সাদের এই আকৃতি দেখে মনে হয় যেন একটি মুখ্য শ্রমিক পিঁপড়ে অন্য একটি গৌণ শ্রমিককে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে, যা বাসায় খুবই সাধারণ ঘটনা। অন্যদিকে, স্ত্রী মাকড়সাদের এই অঙ্গটি ছোট হয় এবং তারা পুরোপুরি একটি পিঁপড়ের অনুকরণ করে। দুজনের ক্ষেত্রেই দেহের নানা অংশের মাপও পরিবর্তিত হয়ে পিঁপড়ের মত আকার ধারণ করেছে। শুধুমাত্র দৈহিক মিলই নয়, এই ধরণের কিছু কিছু প্রজাতির মাকড়সা জীবনহানির আশঙ্কা ছাড়া লাফায়ও না এবং সামনের পা জোড়া, যেটা পিঁপড়েদের থাকে না, সেটাকে বারংবার আন্দোলিত করে পিঁপড়ের শুঁড়ের মত চরিত্র দেওয়ার চেষ্টা করে। প্রকৃতির বহু প্রাণীর কাণ্ডকারখানা দেখলে সত্যিই অবাক হতে হয়।
(শৌভনিক-কে আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম – ছবিটা কোথায় তোলা হয়েছে? আর কী করে হঠাৎ সন্দেহ হলো যে এটা পিঁপড়ে নয়? শৌভনিক-এর উত্তর: ছবিটা আমি তুলেছিলাম উত্তরবঙ্গ বেড়াতে গিয়ে লাটাগুড়ির একটা হোটেলে। জঙ্গল বা বাগানে নয়, হোটেলের বারান্দায় ছিল এটা। আর পিঁপড়ের বাসা খুব সম্ভবতঃ পাশের জঙ্গলেই ছিল।
এক্ষেত্রে সন্দেহটা শুরুতে হয়েছিল লম্বা chelicerae টা দেখে। স্ত্রী মাকড়সা হলে হয়তো এক ঝলক দেখে আলাদা করে চিনতে পারতাম না আর ছবিও তোলা হত না। Mimicry এর কথা জানলেও নির্দিষ্ট এই অনুকরণটার বিষয়ে আমার অতোটা জানা ছিল না। তাই প্রথমেই প্রজাতি শনাক্ত না করলেও ছবি তোলার পর ওই লম্বা দাঁড়া আর বিশেষতঃ একদিকে চার পায়ের আভাস দেখে এটা যে পিঁপড়ে নয় সেটা ভাবতে শুরু করি। পরে ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করে ব্যাপারটা সম্পর্কে আরো বিশদে জানতে পারি।)
মিথ্যা মাথা
সুপর্ণা গিরি (কাশিমপুর, পূর্ব মেদিনীপুর)
কি আশ্চর্য! প্রজাপতিটির দুটো মাথা নাকি! প্রথম দেখে একটু অবাকই হয়েছিলাম।একটু কাছাকাছি যেতেই বুঝতে পারলাম না,এটা আসলে “মিথ্যা মাথা”। অবাক লাগছে তাইনা? আসলে “মিথ্যা মাথা” বা “false head” হচ্ছে, সিলভারলাইন নামক প্রজাপতির আত্মরক্ষার কৌশল। বিজ্ঞানসম্মত নাম- Cigaritis vulcanus।
শিকারী পাখি ও জীবজন্তুদের ভ্রমিত করার জন্য এদের পশ্চাদ্ভাগে একটি false eye রয়েছে যার এক বা একাধিক ‘লেজ’ রয়েছে যা এন্টেনার মতাে দেখায়। ফলে শিকারী জীবরা এটাকেই মাথা ভেবে ভুল করে ফেলে যেমনটা প্রথমে আমিও ভেবেছিলাম।। (ছবিটি আমার বাড়িতে তােলা)
The joy of creation in the dead
রূপক পাল (কোন্নগর, হুগলি)
১৮৪৪ সালে বিজ্ঞানী ভিনসেঞ্চ কোলারের প্রথম পর্যবেক্ষণে প্রাণীবিদ্যার পতঙ্গতালিকায় ঢুকে পড়া এই Amata bicincta হল একপ্রকারের মথ।
Amata বর্গের এই মথ ভারতবর্ষের মূলত উত্তর-পশ্চিম হিমালয়, সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশেও দেখা যায়। এদের কালো রঙের ডানাদ্বয়ে ৯ টি করে সাদা সাদা ছোপ থাকে বলে এদেরকে 9-Spotted Moth বলা হয়। পুরুষ মথটি স্ত্রী মথের থেকে আকারে ছোটো এবং রোগা-পাতলা হয় (ছবিতে স্পষ্ট)।
আপাতদৃষ্টিতে, ছবিটিকে বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য মনে নাও হতে পারে এবং এও মনে হতে পারে যে, এমন ছবি ইন্টারনেটে খুঁজলে হাজারটা পাওয়া যায়। কিন্তু, প্রতিযোগিতাটি যেহেতু প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের এবং তা থেকে শিক্ষণীয় জিনিস খুঁজে বের করার; তাই নিজের তোলা এই ছবিগুলি থেকে আমার দুটি উপলব্ধি এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম—
- নতুন প্রাণ সৃষ্টির একদম প্রাথমিক পর্যায়ে, মিলনরত মথদ্বয় বেছে নিয়েছে একটি কেটে ফেলা মৃত সুপারি গাছের (Betel Tree) গুঁড়িকে। অর্থাৎ, প্রাণহীন মৃত সুপারি গাছের গুঁড়িও পরোক্ষভাবে হয়ে উঠেছে অন্যের “অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার” মূল অবলম্বন। এতে বোঝা যায় যে, প্রকৃতিসৃষ্ট যেকোনো জিনিসেরই গুরুত্ব অপরিসীম এবং মৃত্যুর পরেও তাঁর গুরুত্ব এতটুকুও কমেনা। মানুষ বিষয়টি উপলব্ধি করতে না পারলেও প্রকৃতিসৃষ্ট অন্য জীবেরা যে তা করতে পারে তার উল্লেখযোগ্য প্রমাণ হল এই ছবিগুলি।
- মস্ত বাগানের এককোনায় নিজেদের জৈবিকক্রিয়ায় ব্যস্ত থাকা ক্ষুদ্র প্রজাতির এই মথদ্বয় জীববিদ্যার ছাত্রের চোখে ধরা পড়লেও, অনেকসময় নিজেদের ক্ষুদ্রতার কারণে সাধারণ মানুষের চোখ এড়িয়ে যায় ফলে মানুষের পায়ের প্রতিটি পদক্ষেপেই হয়তো ধ্বংস হয় এমনই হাজার হাজার ক্ষুদ্র প্রাণের অস্তিত্ব। তাই এই ছবিগুলি থেকে আরো একটি শিক্ষণীয় বিষয় হল, সর্বদা চলাফেরার সময় প্রতিটি পদক্ষেপই দেখে ফেলা উচিত যাতে আমাদের পায়ের তলায় অন্য প্রাণীর জীবন সংশয় না ঘটে। কারণ, প্রকৃতিসৃষ্ট এই পৃথিবীতে “All Lives matter”।
(এই তিনটে ছবি ও লেখা ছাড়াও আরো অনেক সুন্দর লেখা আমরা পেয়েছি। তার মধ্যে পূর্ব বর্ধমানের শিমুলিয়ার কস্তুরী হাজরা, ঝাড়গ্রামের রঘুনাথপুরের সপ্ততি ব্যানার্জী ও অশোকনগরের অঙ্গনা মজুমদারের লেখাগুলো বিশেষভাবে আমাদের ভালো লেগেছে।)