আজকের প্রশ্ন
পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানীরা, মানে যাদের আমরা এক্সপেরিমেন্টালিস্ট বলি আর কী, তারা এক জিনিস হাজার বার মাপে কেন? একবারই তো ভালো করে, মন দিয়ে, মাপলেই হয়! একই জিনিস বার বার মেপে কাঁড়ি কাঁড়ি ডেটা দিয়ে হার্ড ড্রাইভ ভর্তি করে লাভ কী?
উত্তর
একই পরিমাপ বারবার নেওয়া অর্থাৎ পরিসংখ্যান বা statistics (স্ট্যাটিস্টিক্স) নেওয়ার পিছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে, একটি অন্যতম কারণ হল পরিমাপের ত্রুটি বা error (এরর) সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া। এরর মানে কিন্তু এই না, যে পরীক্ষাটা করতে গিয়ে আমরা ভুল করেছি! আমরা যা-ই মাপি, তার কিন্তু একটা না একটা এরর থাকে! কোন পরীক্ষামূলক রাশির এরর না জানলে আমাদের জানাটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। সোহম ক্লাসে পড়েছে যে একটা বস্তুর কতটা তল মেঝের সাথে লেগে আছে, তার উপর ঘর্ষণবল (friction) নির্ভর করে না। সে এটা যাচাই করতে একটা পরীক্ষা করবে ভাবলো। একটা ইঁট নিল।
সোহম ভাবলো, ক্লাসে পড়া জিনিসটা যদি ঠিক হয়, তাহলে ইঁটটাকে ওই চওড়া তলের উপর রাখলেও যা ঘর্ষণ বল হবে, সরু কোনো তলের উপর রাখলেও তাই হবে। ও ইঁটের সাথে একটা স্প্রিং তুলা লাগিয়ে দিয়ে, তাই দিয়ে মাপলো কতটা জোরে টানলে ইঁটটা চলতে শুরু করছে। সেই বলটাই হবে সবথেকে বেশি সম্ভব ঘর্ষণবল। ইঁটটাকে যে তলের উপরই রাখা হোক না কেন, এই সর্বাধিক ঘর্ষণবলটা একই আসবে।
কিন্তু মেপে দেখে, ওমা, চওড়া তলের উপর রাখলে আসছে ২.৬ নিউটন। আর সরু তলে ২.০ নিউটন। তাহলে তো দুটো আলাদা! ক্লাসে কি তাহলে ভুল বলছে? না কী, মাপতে গিয়ে কোন ভুল হচ্ছে?
মুশকিল হলো, সোহম মেপেছিল একবারই। এই যে মাপগুলো সে পেল, তার এরর কী, তা জানে না সে। অর্থাৎ, ২.৬ নিউটনটা যে ২.৬ নিউটন-ই, সে ব্যাপারে কোনো নিশ্চিন্তি নেই। হতেই পারে, বার কয়েক মাপলে ও হয়তো দেখতো যে চওড়া তলে গড় মাপ ২.৬-এর নিচে আর সরু তলে পরিমাপ-টা ২.০-র উপরে।
কেন বারবার মাপলে আলাদা উত্তর পেতে পারে সোহম? অনেক কারণ থাকতে পারে। যেমন, ঠিক যে মুহূর্তে ইঁটটা চলতে শুরু করছে, সেই মুহূর্তে স্প্রিং তুলায় কত বল দেখাচ্ছে, তা দেখতে একটু এদিক ওদিক হতে পারে। কখনো হয়তো সে ইঁট চলতে শুরু করার এক মুহূর্ত আগে বলটা মাপছে, কখনো এক মুহূর্ত পরে। আবার হতেই পারে যে সোহম স্প্রিং তুলার স্কেলের কোন দাগের উপর কাঁটাটা আছে, তা দেখতে গিয়ে একটু ভুল করছে। একাধিকবার পরীক্ষা করার মাধ্যমে সোহম বুঝতে পারবে যে সে কতটা Precision বা সূক্ষ্মতার সাথে মাপতে পেরেছে।
সোহম কীভাবে এরর কমাতে পারে যন্ত্রপাতি না পালটে? এখানেই অনেকবার মাপা, যাকে আমরা বলি অনেক ডেটা নেওয়া, তার সার্থকতা। যত বেশী ডেটা নেবে, তত তার precision বাড়তে থাকে। পরিসংখ্যানের অঙ্ক কষে মোটামুটিভাবে দেখানো যায় যে যদি একই রাশি K বার মাপা হয়, তাহলে গড় মানের এরর কমতে থাকে 1/sqrt(K-1) হিসাবে। যেমন, সোহম যদি চারবার পরীক্ষা করে এই সংখ্যাগুলো পেত মোটা তলের ক্ষেত্রে (নিউটন-এ বললে):
২.২, ২.৬, ২.৪, ২.৪
তাহলে, এই বলগুলোর গড় হত ২.৪ নিউটন। এরপর গড়ের চারিদিকে মানগুলোর বিস্তৃতি বা standard deviation মাপতে হতো এবং সেটাকে sqrt(K-1) বা ৩-এর বর্গমূল দিয়ে ভাগ করতে হতো (কেন, সেই ব্যাখ্যায় এখানে যাচ্ছি না)। এরর পাওয়া যেত ০.১ নিউটন। অর্থাৎ, বলটা আসলে ২.৪ ± ০.১ নিউটন।
আর সরু তলের ক্ষেত্রে যদি চারবার পরীক্ষা করে পেত (নিউটন-এ বললে):
২.০, ২.২, ২.০, ২.০
তাহলে গড় হতো ২.০ আর এরর হতো ০.১ নিউটন-এর কম। যেহেতু বলটাই মাপা যায় ০.১ নিউটন ধাপে, তাই ০.১ নিউটনকেই এক্ষেত্রে এরর ধরা যায়। অর্থাৎ, বলটা আসলে ২.০ ± ০.১ নিউটন।
এবার সে সিদ্ধান্তে আসতে পারত যে গড় ঘর্ষণ বল এই দুই তলের ক্ষেত্রে একই না আলাদা। প্রশ্ন আসবে, তাহলে কি একই জিনিস অনেক বার মেপে এরর প্রায় শূন্য করে দেওয়া যায়? উপরের অঙ্কটাতেই উত্তরটা আছে। সেটা হলো – সবসময় না। যেমন, সোহমের যন্ত্রের একটা ক্ষুদ্রতম ধাপ আছে, যার নিচে সে মাপতে পারে না। এই ক্ষুদ্রতম মাপকে যন্ত্রের রিসোলিউশন (resolution) বলে। হতে পারে, তার তুলা যন্ত্রের যে স্কেল তাতে ০.১ নিউটন অন্তর দাগ টানা আছে। হয়তো দুটো দাগের মধ্যে চোখের আন্দাজে বড়জোর ০.০৩ নিউটনের মত মাপা যায়। তাহলে, বারবার পরীক্ষা করে হিসেব করা এরর এই যন্ত্রের রেজোলিউশানের কাছাকাছি চলে এলে আর বেশী খেটে লাভ নেই!