স্টিফেন হকিং-এর লেখা বইটির দৌলতে “সময়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস” (A brief history of time) নামটির সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। এই প্রবন্ধের প্রথম পর্বে আমি “সময় গণনার” ইতিহাস সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব, যেটা “পরম সময়”-এর (absolute time) ইতিহাসের থেকে আলাদা। সময় এমন একটা বিষয় যেটা মানুষের হাতের নাগালের বাইরে। পরম সময় কখনোই মাপা যায়না কিন্তু সময় গণনা একটা সম্পূর্ণ যান্ত্রিক ব্যাপার। যন্ত্রের সাহায্যে দুটো ঘটনার মধ্যে সময়ের পার্থক্য মাপা যায়। সময় গণনার অভ্যাসটা আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনার অনেক আগে থেকেই ছিল। কিন্তু খোদ সময়ের শুরু তো একেবারে আমাদের এই বিশ্বসংসারের জন্মলগ্ন থেকে অর্থাৎ বিগ ব্যাং থেকে। সুতরাং সেই ভাবে দেখতে গেলে সময়ের ইতিহাসের কাছে সময় গণনার ইতিহাসকে একেবারে সদ্যজাত শিশুই বলা চলে।
সময় গণনার প্রয়োজন কেন পড়ল
সময় মাপা এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় যান্ত্রিক উপকরণ তৈরিকে হরোলজি (Horology) (সময় দেখা এবং ঘড়ি-নির্মাণবিদ্যা) বলা হয়। সময় মাপতে মূলত চাই একটা ঘটনা যেটার নির্ভরযোগ্যভাবে পুনরাবৃত্তি হয়। আনুমানিক প্রায় তিরিশ হাজার বছর আগে মানুষ এরকমই একটা ঘটনা খুঁজে পায় চাঁদের বিভিন্ন দশার মধ্যে (২৯.৫ দিনে পৃথিবীর পূর্ণ প্রদক্ষীণ করার ফলে চাঁদের একই দশার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়)। চাঁদের বিভিন্ন দশা দেখে থাকলেও তাই দিয়ে যে সময় মাপা যায় (lunar time), সেই ধারণা মানুষের শুরুতেই হয়নি। সেটা এসেছে আরো অনেক পরে যখন সময় গণনার প্রয়োজন হয়েছে। প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে যত দিন গেছে, সময়কে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতরভাবে গণনার প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে সময় গণনার প্রযুক্তিরও উন্নতি হয়েছে। এককালে যেখানে সময় মাপতে সূর্যঘড়ির ব্যবহার হতো, এখন সেখানে সময় মাপতে লেসার-এর প্রয়োগ করে পরমাণুকে পরমশূন্য তাপমাত্রার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। আজকের অত্যাধুনিক পারমাণবিক ঘড়ি (atomic clock) মানুষের তৈরি যাবতীয় যন্ত্রের মধ্যে অন্যতম সূক্ষ্ম একটি পরিমাপযন্ত্র। সময় পরিমাপের সূক্ষ্মতা এক অভূতপূর্ব স্থানে পৌঁছে গিয়েছে।
সময় গণনার বিভিন্ন পদ্ধতি এবং তাদের উৎস নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমে এই প্রশ্নটা মাথায় আসে: মানুষের আদৌ সময় গণনার প্রয়োজন হ’ল কেন? এর অনেকগুলো কারণ পড়েছি। আমার ব্যক্তিগত পছন্দের কারণটা হলো, বিভিন্ন ধর্মস্থানে সূর্যচন্দ্রের অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে দিনের নির্দিষ্ট সময়ে প্রার্থনার ঘন্টা বাজানোর জন্য একটা সময় গণনার যন্ত্রের প্রয়োজন পড়েছিল। এটা অবশ্য অনেক সম্ভাবনার মধ্যে একটা, যদিও অনেকগুলো সূত্রে এর কথা বলা হয়েছে। যাইহোক, মূল বক্তব্য হলো, সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের সাপেক্ষে দিনেরবেলা কতদূর গড়ালো, সেইটে মাপা প্রথম জরুরি হয়ে পড়েছিল। আস্তে আস্তে মানুষ এটাও বুঝলো যে সময় মাপতে পারলে ঋতু নির্ণয় করা যায় কারণ ঋতু অনুযায়ী দিনের দৈর্ঘ্য পাল্টায় (অবশ্যই জ্যোতির্বিদ্যার নানা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেও ঋতু নির্ণয় সম্ভব)। ঋতু নির্ণয় করতে পারলে চাষবাসে প্রচুর লাভ।
প্রাচীন ইজিপ্টে সূর্যঘড়ি ব্যবহার করা হত দিনেরবেলা সময় মাপতে। সেই সঙ্গে অন্যান্য সভ্যতা যেমন পারস্য, গ্রিক, রোমানদের মধ্যেও সূর্যঘড়ির ব্যবহার দেখা গেছে। কয়েক হাজার বছর ধরে, একেবারে উনবিংশ শতাব্দীর গোড়া অব্দি, সূর্যঘড়ির সময় মাপা আরো নিখুঁত হয়েছে।
ভারতে সময় গণনার ইতিহাস
যেসব সূর্যঘড়ির চিহ্ন এখনো ভারতবর্ষে পাওয়া যায়, তার মধ্যে একটা হলো কোনারকের সূর্য মন্দিরে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তৈরি একটা সূর্যঘড়ি। তারপর রয়েছে অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজা জয় সিং-এর তৈরি জয়পুরের যন্তর-মন্তর। যন্তর-মন্তর-এর সূর্যঘড়িটা সেইসময় পৃথিবীর সবথেকে বড় সূর্যঘড়ি ছিল। পরবর্তীকালে রাজা জয় সিং দিল্লী, বেনারস, মথুরা এবং উজ্জয়নেও এরকম সূর্যঘড়ি তৈরি করেন। এইসব যন্তর-মন্তরে সূর্যঘড়ি ছাড়াও আরও অনেক রকমের জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার আধুনিক যন্ত্র রয়েছে। (এপ্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার যে আমাদের দেশে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা অনেক উন্নত দেশের থেকেও পুরোনো এবং আজও জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণার বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমার উন্নত দেশিগুলোর থেকে এগিয়ে আছি।) জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার সূত্রে গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান নির্ণয় করতে গিয়ে দেখা গেল যে সেই অবস্থান সারাবছর এক থাকছে না। অবস্থানের এই পরিবর্তনকে সুনিশ্চিত করতে সময় গণনার দরকার পড়ল। অতএব সময় গণনার প্রয়োজন কিছুটা এসেছে জ্যোতির্বিজ্ঞানের থেকেও।
এইসব পুরোনো সূর্যঘড়িগুলোর তুলনায় আধুনিক এবং বেশি সঠিক সূর্যঘড়ি রয়েছে আইআইটি রূড়কি এবং আমি যেখানে কাজ করি, সেই পুনে-র IUCAA-তেও (ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রনমি এন্ড অ্যাস্ট্রফিজিক্স)। এই সমস্ত সূর্যঘড়ির ছবি চিত্র-১-এ দেখানো হয়েছে। এগুলো ছাড়াও আমার জানার বাইরে হয়তো ভারতবর্ষের আরো অনেক সূর্যঘড়ি আছে।
সেভাবে দেখলে কয়েক দশক আগে অব্দিও সূর্যঘড়ির ব্যবহার আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল। আমার মনে আছে, আশির দশকের শেষের দিকে আমার ঠাকুমা আমাদের বর্ধমানের বাড়ির বাগানে একটা টগর গাছের ছায়া দেখে সময় বলে দিতে পারতেন। এটাও একরকম সূর্যঘড়ি বইকি! সূর্যের অবস্থানের ভিত্তিতে ছায়ার দৈর্ঘ্য দেখে সময় বলার প্রথা কিন্তু বেশিদিন আগের কথা নয়।
সূর্যঘড়ির কিছু সমস্যা
সূর্যঘড়ি দিয়ে বছরের বিভিন্ন সময়ে নির্ভুল সময় মাপতে গেলে কিন্তু কিছুটা খাটতে হবে। পৃথিবীর অক্ষাংশ ২৩.৫ ডিগ্রি হেলে থাকার ফলে সারা বছর ধরে দিন-রাত্রির দৈর্ঘ্য বাড়ে-কমে। একই কারণে ঋতু পরিবর্তনও হয়। তাই গ্রীষ্মকালে যে ছায়া দেখে একটা সময় বলা যায়, শীতকালে সেই ছায়াই আরো আগেভাগে দেখা যায়। তাছাড়া সূর্যঘড়িগুলোকে অক্ষাংশ-নির্ভর (latitude-dependant) বানাতে হয় কারণ পৃথিবীর অক্ষাংশ বাড়ার সাথে সাথে সূর্যের উচ্চতাও (altitude) কমে।
এই ব্যাপারগুলো যদি ধরাও হয়, তাহলেও কিছু সমস্যা থেকে যায়। যেমন, পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষ নিজেই ২৬,০০০ বছরে একটা বৃত্ত পূর্ণ করে কিম্বা আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মতো প্রাকৃতিক কারণেও সামান্য পরিবর্তিত হয়। সুতরাং নানান কারণে শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও একেবারে নির্ভুল সূর্যঘড়ি বানানো সম্ভব নয়। যত সময় যাবে, সেই ঘড়ির পরিমাপে গলদও বাড়তে থাকবে।
বাতিঘড়ি, জলঘড়ি, বালুঘড়ি
সূর্যঘড়ি ছাড়াও চীনের মানুষ একধরণের তৈল-প্রদীপ-নির্ভর ঘড়ি ব্যবহার করত। এই ঘড়িতে পাত্রে কতটা তেল বেঁচে আছে, তার ভিত্তিতে সময় বলা হতো। হয়তো এগুলোর মূল ব্যবহার ছিল ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, যাতে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা যায়। কিন্তু পরবর্তীকালে সাধারণ মানুষও এর ব্যবহার শুরু করে। তৈল-প্রদীপ ঘড়ির একটা পরিমার্জিত সংস্করণ হ’ল মোমবাতি ঘড়ি, যেখানে মোমবাতিতে কিছু দাগ দেওয়া থাকে এবং পুড়ে যাওয়ার সাথে সাথে সেই দাগগুলোর সাহায্যে সময়ের পরিমাপ করা যায়।
কিন্তু এইধরণের ঘড়ি সঠিক সময় দেবে এবং প্রত্যেকটা বাতিই একই সময় দেবে, এমনটা আশা করা উচিত না। বাতির সলতে কত তাড়াতাড়ি পুড়ে যাচ্ছে, সেটা নির্ভর করে বাতি কি দিয়ে তৈরি, কিরকম পরিবেশে জ্বালানো হয়েছে, দাগ দেওয়াতে কতটা ভুলচুক হয়েছে, এই সবকিছুর উপর।
ইজিপ্সিয়রা আবার একধরণের জলঘড়ির আবিষ্কার করে। সেখানে একটা খালি কলসির গায়ে দাগ দেওয়া থাকে এবং কেন্দ্রে একটা ছোট্ট ফুটো করা থাকে। তারপর কলসিটাকে একটা জলপূর্ণ পাত্রে রেখে দেওয়া হয়। জল আস্তে আস্তে কলসিতে প্রবেশ করতে থাকে এবং যতক্ষণ না কলসি ভর্তি হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত দাগগুলো থেকে সময়ের একটা হিসেব পাওয়া যায়। প্রাচীন ভারতীয় সিন্ধু সভ্যতায় এই ধরণের জলঘড়ি ব্যবহার করা হতো। দ্রাবিড়ীয় ভাষায় একে বলা হতো “ঘটিকা যন্ত্র” (সাদা ভাষায় ‘ঘড়ি’)। এই ধরণের ঘড়ি বলিউড ছবি ‘মহেঞ্জদরো’-তেও দেখানো হয়েছে।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বালুঘড়ি (hour glass) খুব জনপ্রিয় হয়েছিল, বিশেষত সমুদ্রযাত্রায় নাবিকদের কাছে। এইধরণের ঘড়িতে কোন তরল বা সূক্ষ্ম বালির মত কণা ব্যবহার করা হতো। মধ্যযুগে আরও সূক্ষ্মভাবে সময় নির্ধারণকারী ঘড়ির উদ্ভব হয়, যেমন ক্লক্কা (“clocca”, ল্যাটিন ভাষায় clock বা ঘড়ি)। এরকম একটা ঘড়ি ইতালির একটি চার্চের দেওয়ালে আজও টাঙানো আছে বলে শুনেছি।
পেন্ডুলাম ঘড়ি
১৬৫৭ সালে ক্রিস্টিয়ান হাইগেন্স পেন্ডুলাম ঘড়ির আবিষ্কার করেন। পেন্ডুলাম ব্যবহারের ফলে ঘড়ি আরো অনেক নিখুঁত সময় দিতে শুরু করে। এবং নাবিকদের প্রয়োজনে এই ঘড়ি উন্নততর হতে থাকে।
এই প্রসঙ্গে ব্রিটেনের জন হ্যারিসন-এর নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। পেশায় ছুতোর মিস্ত্রি, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তিনি এমন ঘড়ি বানালেন যার সময় পরিমাপে ভুল ছিল আগের সব ঘড়ির তুলনায় অনেক কম। দ্রাঘিমাংশ (longitude) মাপতে পারা তখন একটা বড়সড় চ্যালেঞ্জ ছিল। জন হ্যারিসন এই চ্যালেঞ্জ-এর উত্তরে ক্রোনোমিটার (chronometer) নামক একটা যন্ত্র বানালেন যেটা একটা বিশেষ জায়গার সময়, এক্ষেত্রে গ্রীনিচ মিন টাইম (Greenwich Mean Time), যেকোনো জায়গায় বলে দিতে পারে। দ্রাঘিমাংশ নির্ণয় করতে এটাই দরকার ছিল। দুপুরবেলা সূর্য যখন ঠিক মাথার উপরে, সেইসময়ে ক্রোনোমিটার-এ গ্রীনিচ মিন টাইম থেকে একজন নাবিক বলে দিতে পারতো কোন দ্রাঘিমাংশে সে অবস্থিত।
হ্যারিসনের এই ঘড়িতে গোটা দিনে বড়োজোর তিন সেকেন্ড এদিকওদিক হতো। তাই তাঁর এই আবিষ্কার দূর সমুদ্রযাত্রায় একটা যুগান্তকারী বিপ্লব এনে দিয়েছিল। এবং একারণে তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে প্রভূত পুরস্কার অর্জন করেন, যদিও ওনাকে এই পুরস্কার পেতে অমানুষিক বেগ পেতে হয়েছিল।
সময় পরিমাপের মানদণ্ড স্থাপন
চিত্র-২-এ আমরা দেখতে পাচ্ছি গত 700 বছরে ঘড়ির সময় পরিমাপ কত নিখুঁত হয়েছে [১]। এই চিত্রের উলম্ব অক্ষটিতে (y-axis) দেখানো হয়েছে, কতটা সময় গেলে পর ঘড়িতে এক সেকেন্ডের ভুল হয়। পাঠকের সুবিধার জন্য বলি, ১০৭ সেকেন্ড ভুল হলে ঘড়িতে আনুমানিক এক বছরে এক সেকেন্ড মতো ভুল হয়ে যাবে। ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, যত ঘড়ির আধুনিকীকরণ হয়েছে, তত এই এক সেকেন্ডের ভুলের জন্য সময়ের ব্যবধান অনেক বেড়ে গেছে।
শুধু সময়ের সাথে সাথে পরিমাপে ভুল নয়, আরো একটা সমস্যা ছিল। ঘড়িগুলো চলতো নিজস্ব নিয়মে, তাদের মধ্যে কোনো সংযোগ ছিল না। আন্তর্জাতিক স্তরে তো দূরের কথা, জাতীয় স্তরেও কোনো একটা বিশেষ ঘড়িকে মানদণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করে বাকি ঘড়িগুলোকে মিলিয়ে নেওয়ার কোনো প্রচেষ্টা ছিল না। তাই, ভিন্ন জায়গায় সময় পরিমাপের ভিন্ন নিয়ম চলতো।
উদাহরণস্বরূপ, প্রাচীন ভারতে “নিমেষ” ছিল সময়ের সবথেকে ছোট একক। এই এককটাকে ভাবা হতো চোখের এক পলক ফেলার সমান, অর্থাৎ ০.২১৩৩ সেকেন্ড। ক্রমানুসারে বৃহত্তর এককগুলো হল কাস্থ = ১৫ নিমেষ, কাল = ৩০ কাস্থ, মুহূর্ত = ৩০ কাল, অহোরাত্রম = ৩০ মূহুর্ত = ১ দিন, মাস = ৩০ অহোরাত্রম, ঋতু = ২ মাস, সামবাৎসারা = ৬ ঋতু = ১ বছর। সূর্যসিদ্ধান্ত, বেদ এবং অন্যান্য বইতে এই এককগুলোর উল্লেখ আছে, এবং আজও আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঋতু, মুহূর্ত বা মুহরাত এগুলোর ব্যবহার করে থাকি। এই এককগুলোর ভিত্তি যেহেতু ব্যক্তিসাপেক্ষ, তাই এই ধরণের এককের সাহায্যে নিখুঁত মানদণ্ড স্থাপন করা (standardization) সম্ভব নয়।
জাতীয় স্তরে সময়ের মানদণ্ড স্থাপনের দরকার পড়ল রেল তথা অন্যান্য পরিবহন ব্যবস্থার প্রয়োজনে। আন্তর্জাতিক স্তরে এই প্রয়োজন অনুভূত হলো আরো অনেক পরে। বিভিন্ন দেশে যখন পশ্চিমী দেশগুলো উপনিবেশ শুরু করলো, তখন একটা সর্বজনীন একক মেনে সময় জানা জরুরি হয়ে উঠলো। উদাহরণস্বরূপ, ১৮৪৭ সাল থেকে ব্রিটেনে রেলগাড়ি তথা স্টেশনের সময়ের জন্য গ্রীনিচের রয়্যাল অবসারভেটরির দেওয়া সময়কে ব্যবহার করা শুরু হয়। এক এক করে স্টেশনগুলো এই সময়টা মেনে চলতে শুরু করে, নিজেদের মধ্যে সামঞ্জস্য আনতে (synchronization)। ১৮৫৫ সাল থেকে এই সময়টা টেলিগ্রাফ সিগনাল মারফত সর্বত্র প্রচার করা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে ব্রিটেনের প্রায় সমস্ত ঘড়ির সময় গ্রীনিচ মিন টাইম-এর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং ১৮৮০ সাল থেকে এই সময়টা দেশের সরকারী সময় হিসাবে স্বিকৃতি লাভ করে। এখনো এটা গ্রীনিচ মিন টাইম বা জিএমটি নামে খ্যাত।
পেন্ডুলাম ঘড়ির পরবর্তী যুগ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন উন্নত প্রযুক্তির আবির্ভাবের সাথে সাথে, বিশেষত আন্তর্মহাদেশীয় কৌশলগত পথ নির্দেশক যোগাযোগ ব্যবস্থা (navigation) ও সম্প্রচারের (broadcasting) কারণে, নির্ভুল সময় গণনা, তার নিখুঁত প্রচার এবং সঠিক কম্পাঙ্কে বেতার-তরঙ্গ (রেডিও-ফ্রিকোয়েন্সি) পাঠানোর প্রয়োজন রাতারাতি বেড়ে গেল। বিজ্ঞানীরা একটা বিশেষ দোলকের (oscillator) সন্ধান করতে শুরু করলেন যার দোলনকাল দিয়ে আরো নিখুঁতভাবে সময় মাপা যাবে এবং যার উপর পৃথিবীর ঘূর্ণনের কোন প্রভাব থাকবে না।
১৯৪৫ সালে ইসিডোর আইসাক রাবি (Isidor Isaac Rabi) NMR-এর (Nuclear magnetic resonance) সাহায্যে সময় মাপার প্রস্তাব দেন। এই পদ্ধতিতে পরমাণুগুলোকে দোলক (oscillator) হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। ইতিমধ্যে কিন্তু প্রফেসর রাবি NMR–এর সাহায্যে পরমাণুর চৌম্বক ভ্রামক (magnetic moment) এবং পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ঘূর্ণনের (nuclear spin) মধ্যেকার সম্পর্ক স্থাপনের জন্য নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ম্যানহাটন প্রোজেক্টেও কাজ করেছেন।
রাবি-র প্রস্তাবিত ধারণা অনুযায়ী তখনকার ন্যাশান্যাল বুরো অফ স্ট্যান্ডার্ড (NBS) ১৯৪৯ সালে অ্যামোনিয়ার শোষণ রেখার (ammonia absorption line) উপর ভিত্তি করে প্রথম পারমাণবিক ঘড়ি তৈরি করে। প্রথম প্রজন্মের পারমাণবিক ঘড়ি এক সেকেন্ডের ১০১০ ভাগ অবধি নির্ভুল সময় গণনা করতে পারত, অর্থাৎ ১০০০ বছরে তার মাত্র এক সেকেন্ড বিচ্যুতি হয়। পারমাণবিক ঘড়ি প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা পরবর্তী পর্বে করা হয়েছে।
দ্রাঘিমাংশ অনুযায়ী পৃথিবীর চব্বিশ ভাগ
১৮৫৮ সালে ইতালীর গণিতজ্ঞ কুইরিকো ফিলোপান্তি (Quirico Filopanti) প্রথম দ্রাঘিমাংশভিত্তিক দিনের (longitudinal days) ধারণা দেন। এই ধারণা অনুযায়ী পৃথিবীকে চব্বিশটা ফালিতে বিভক্ত করা হয়, একেকটা ফালিকে বলে টাইম জোন (time zone)। দ্রাঘিমাংশ ০°০’০’’ এবং অক্ষাংশ ৫১°২৮’৩৮” উত্তরে অবস্থিত গ্রীনিচকে কেন্দ্র মেনে পূর্ব বা পশ্চিমে ১৫ ডিগ্রী দ্রাঘিমা রেখার পার্থক্যে গেলে একটা টাইম জোন থেকে পরেরটাতে যাওয়া হবে। এবং সময়ের পার্থক্য হবে +১ ঘন্টা (পূর্বে গেলে) বা -১ ঘণ্টা (পশ্চিমে গেলে)। উদাহরণস্বরূপ গ্রীনিচকেই ধরা যায়। গ্রীনিচ যেহেতু একেবারে একটা টাইম জোন-এর সীমান্তে, তাই তার পূর্ব দিকে দিনের সময় পশ্চিমের তুলনায় এক ঘন্টা এগিয়ে থাকবে। বা, আমি বর্ধমানের ছেলে বর্তমানে পুনেতে থাকি। এই দুটি জায়গার মধ্যে দ্রাঘিমাংশের পার্থক্য ১৫ ডিগ্রী এবং পুনে পশ্চিমে অবস্থিত। তাই সূত্র অনুযায়ী, পুনেতে বর্ধমানের তুলনায় এক ঘন্টা বাদে সূর্য উদয় হবে এবং অস্ত যাবে।
১৮৮৪ সালে ইন্টারন্যাশানাল মেরিডিয়ান কনফারেন্স-এ এই টাইম জোন-এর প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ০°০’০’’ দ্রাঘিমাংশতে রাত্রি ১২:০০:০০টা-কে ০০:০০:০০ GMT ধরে সেই টাইম জোন-এর পুরোটাতেই দিনের শুরু করা হয়। GMT-কে মানদণ্ড ধরে এটাই প্রথম আন্তর্জাতিক সময় স্থাপন করার চেষ্টা। চিত্র-৩-এ বর্তমান টাইম জোন-গুলোকে দেখানো হয়েছে। লক্ষ্যণীয় যে এই টাইম জোন-এর সীমান্তগুলো কিন্তু শুধুমাত্র দ্রাঘিমাংশ মেনে চলে না। বাস্তবে কোন অঞ্চলে এক সময় থাকলে সুবিধে হবে, সেই ব্যাপারটাও ধরা হয়। এই টাইম জোন-এর বিভাগকে কোঅর্ডিনেটেড ইউনিভার্সাল টাইম (Coordinated Universal Time) বা UTC বলা হয়।
ভারতের টাইম জোন
উত্তরে সুবিশাল হিমালয় এবং দক্ষিণে ডেকান মালভূমি (Deccan platueau) নিয়ে গঠিত ভারত বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম দেশ। তার আয়তন ৩২,৮৭,২৬৩ বর্গ কিলোমিটার। ভারতের মূল ভূখণ্ড দ্রাঘিমাংশ ৮°৪’২৮” উঃ থেকে ৩৭°১৭’৫৩” উঃ (৩,২১৪ কিমি) এবং অক্ষাংশ ৬৮°৭’৫৩” পূ থেকে ৯৭°২৪’৪৭” পূ (২,৯৩৩ কিমি) অব্দি বিস্তৃত। জনসংখ্যা প্রায় ১৩০ কোটি। দ্রাঘিমাংশের বিস্তার প্রায় ৩০° হওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণ ভারতবর্ষ একটাই টাইম জোন পালন করে। এই টাইম জোন-এর সময়, যাকে বলে ভারতীয় মানক সময় (Indian standard time : IST), UTC-র থেকে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা এগিয়ে, অর্থাৎ UTC+৫:৩০।
ভারতীয় স্ট্যান্ডার্ড সময় ৮২.৫° পূ দ্রাঘিমাংশের সময় অনুসারে স্থির করা হয়েছে। এই দ্রাঘিমাংশটা উত্তর প্রদেশের শঙ্করগড় ফোর্ট, মিরজাপুরের (২৫.১৫° উ, ৮২.৫৮° পূ) কাছাকাছি দিয়ে যায় (চিত্র-৪ দ্রষ্টব্য)।
১৮৮৪-তে সাব্যস্ত দ্রাঘিমাংশ-ভিত্তিক টাইম জোন-গুলো ধরলে কিন্তু ভারতের মধ্যে দিয়ে দুটো সীমাসূচক দ্রাঘিমাংশ চলে যায়, যথা, ৭৫° পূ (যেটা মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়নের উপর দিয়ে গেছে) এবং ৯০° পূ (যেটা অসমের অভয়াপুরি দিয়ে গেছে)। কিন্তু এই দ্রাঘিমাংশগুলোর কোনোটাকেই ব্যবহার করা হয়না ভারতীয় সময়ের জন্য।
ইতিহাসে ফেরত গেলে, চতুর্দশ শতাব্দীর ‘সূর্য সিদ্ধান্ত’-এ উল্লেখ আছে যে ভারতের প্রধান মধ্যাহ্নরেখা (Prime Meridian) অবন্তি (২৩°১০’৫৮” উ, ৭৫°৪৫’৩৮” পূ, বর্তমান নাম উজ্জয়ন) এবং রোহিতাক-এর (২৮°৫৪’ উ, ৭৫°৩৮, পূ, বর্তমান নাম রোহতাক) উপর দিয়ে গেছে এবং এই রেখার উপর সময়কেই ভারতের মানক সময় (standard time) ধরা হয়। এরপরের সময় পরিমাপের প্রচেষ্টা দেখা যায় ১৭৩৩-এ, যখন মহারাজা সোয়াই জয় সিং জয়পুরে সূর্যের অবস্থানের ভিত্তিতে নিখুঁত সময় গণনার কাজে যন্তর মন্তর মানমন্দির স্থাপন করেন।
ব্রিটিশদের শাসনকালে ১৮৮৪-তে GMT আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত হবার পর ভারতকে দুটো টাইম জোন-এ বিভক্ত করা হয়। একটা হ’ল বম্বে (এখন মুম্বাই) এবং অন্যটা ক্যালকাটা (এখন কোলকাতা), যারা যথাক্রমে UTC+৪:৫১ এবং UTC+৫:৫৪তে অবস্থিত। এই দুটো টাইম জোন আন্তর্জাতিক সময় রেখা (international time line) মেনেই নিজেদের মধ্যে মোটামুটি এক ঘন্টার সময় ব্যবধানে অবস্থিত (চিত্র-৪)। ভারতের পূর্ব এবং পশ্চিম দিকের সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের মধ্যে সাধারণত ২ ঘণ্টার ফারাক থাকে। সুতরাং পুরো দেশকে এক ঘণ্টার সময়ের ব্যবধানে দুটি সময় অঞ্চলে ভাগ করা একদিক থেকে যেমন বিজ্ঞানসম্মত, তেমনি মানব কর্মদক্ষতা বাড়াতেও সাহায্য করে [২]।
কিন্তু ১৯০৪ সালে রেলব্যবস্থা শুরুর সাথে সাথে দুটো গুরুত্বপূর্ণ জায়গার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের সময় বিভ্রান্তি দেখা দিলো। ফলস্বরূপ রেলওয়ে পুরো দেশের জন্য একটা আলাদা টাইম জোন ব্যবহার করতে শুরু করলো, যা মাদ্রাজ (এখন চেন্নাই) টাইম জোন বা UTC+৫:২১ দ্বারা চিহ্নিত হয়। সেসময় জনসাধারণের কাছে এটা রেলওয়ে স্ট্যান্ডার্ড টাইম নামেই পরিচিত ছিল। অনেকগুলো টাইম জোন সামলাতে গিয়ে শেষকালে যাতে রেল দুর্ঘটনার মুখোমুখি না হতে হয়, তাই এই ব্যবস্থা। যদিও স্থানীয় সময়ের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটা সময় মেনে চলাও মোটেই সুবিধের ছিল না। সেইসঙ্গে বঙ্গোপসাগরের উপর আন্দামান এবং নিকোবার দ্বীপপুঞ্জ আবার একটা আলাদা টাইম জোন-এ অন্তর্ভুক্ত ছিল। আবার ১৯৫১ সালের প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্ট অনুযায়ী অসমের চা বাগানের কর্মীরা তাদের নিজেদের জন্য একটা টাইম জোন স্থির করে, তার নাম দেয় “চা বাগান সময়” (Tea garden time)। ভারতীয় টাইম জোন-এর তুলনায় এটা ১ ঘণ্টা এগিয়ে। এর উদ্দেশ্য ছিল সেখানকার মানুষের কর্মদক্ষতা বাড়ানো এবং বৈদ্যুতিক শক্তির অপচয় কম করা। এখনও উত্তর-পূর্ব ভারতের বেশ কিছু স্থানে এই “চা বাগান সময়” বেশ প্রচলিত।
ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে থাকাকালীনই ৮২.৫°-কে মধ্য মধ্যাহ্নরেখা (Central meridian) হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। তবে ১৯৪৭-এর পয়লা সেপ্টেম্বর থেকে প্রথম এটাকে সরকারীভাবে কার্যকর করা হয়। IST চালু হবার পরেও মুম্বাইতে ও কোলকাতায় যথাক্রমে ১৯৪৮ ও ১৯৫৫ অবধি তাদের স্থানীয় সময় বোম্বে সময় ও ক্যালকাটা সময় চলেছে। বর্তমানে গোটা দেশ জুড়ে একটাই সময়ব্যবস্থা (IST) চালু আছে (চিত্র ৪)। পার্লামেন্ট-এর নিদের্শ অনুসারে দিল্লীর ন্যাশানাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরি [৩] আমাদের দেশের IST রক্ষণাবেক্ষণের এবং দেশব্যাপী প্রচারের দায়িত্বে নিযুক্ত আছে।
(লেখাটি মূল ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছে ‘বিজ্ঞান’ টীম-এর অমলেশ রায় ও অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়। )
কভার ইমেজ: https://www.pexels.com/
টীকা :
[1] “A brief history of time measurement”, Leo Rogers, University of Cambridge (2011). url – nrich.maths.org/6070.
“From sundials to atomic clocks understanding time and frequency”, James Jespersen and Jane Fitz-Randolp, NIST Publication (1999).
[2] “Necessity of ‘two time zones: IST-I (UTC + 5 : 30 h) and IST-II (UTC + 6 : 30 h)’ in India and its implementation” Lakhi Sharma et al., Current Science 115, 1252 (2018).
[3] NPL, New Delhi website – http://www.nplindia.in