শুরুর সময়
জানুয়ারী 2020, শীতের সকাল। জার্মানীর মাইনজ শহর, সেই মাইনজ, যেখানে গুটেনবার্গ 1440 সালে তাঁর প্রথম ছাপাখানা তৈরী করে গোটা পৃথিবীকে বদলে দিয়েছিলেন। আর পাঁচটা ছুটির দিনের মতই দিনটা শুরু হয়েছে। এক কাপ কফি হাতে ব্রেকফাস্ট টেবিলে অনেকটা দেহাতী হিন্দুস্তানী দেখতে এক ভদ্রলোক হুমড়ি খেয়ে পড়ে গোগ্রাসে একটা লেখা পড়ছেন। বিশ্ব বিখ্যাত মেডিক্যাল জার্নাল ল্যানসেট এ চীনদেশের এক নতুন ভাইরাস নিয়ে একটা প্রবন্ধ বেরিয়েছে আগের দিনই। সেখানে দেখা যাচ্ছে কীভাবে এই ভাইরাস একজন মানুষ থেকে আর একজন মানুষে সংক্রামিত হচ্ছে। কখনো কখনো যিনি সংক্রামিত হচ্ছেন, তিনি জানতেও পারছেন না, কারণ তার মধ্যে সংক্রমণের তেমন লক্ষণ ফুটে উঠছে না। এই জায়গাটা পড়েই ভদ্রলোক উত্তেজিত ভাবে তার স্ত্রীকে ডেকে উঠলেন।
কফি কাপেই জুড়িয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানী দম্পতি নিবিষ্ট মনে বার বার প্রবন্ধটি পড়ে চলেছেন।
তখনও বিশ্ব জুড়ে করোনা ভাইরাসের দাপাদাপি শুরু হয় নি। ঘটনাকাল ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশনের প্যান্ডেমিক ঘোষণারও দুমাস আগে। লকডাউন, N95/KN95 মাস্ক, কোয়ারিন্টিন, ইত্যাদি শব্দগুলো আমজনতার কাছে প্রায় অজানা। চীনের উহান প্রদেশ থেকে অজানা জ্বর সংক্রান্ত কিছু উদ্বেগজনক খবর বেরোতে শুরু করলেও, তার যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব হতে পারে, বা সেটা যে গোটা পৃথিবী জুড়ে অভূতপূর্ব উথালপাথাল তৈরী করতে পারে, তা কারও কষ্টকল্পিত ভাবনাতেও আসে নি।
ভুল বললাম, এ ভাবনা এসেছিল কয়েকজন দূরদর্শী বিজ্ঞানীর মনে। তাঁদের মধ্যে একজন জার্মানির মাইনজ শহরের সেই ডাক্তার গবেষক উগুর শাহীন। প্রথম দর্শনে হয়তো আর পাঁচ জনের মত, সাধারণ কেউ মনে হবে। কিন্তু উগুর শাহীনের জীবন গল্পকথাকেও হার মানায়। ডঃ শাহীন ল্যানসেট এর প্রবন্ধটি পড়েই বুঝতে পেরেছিলেন কী হতে চলেছে; বুঝতে পেরেছিলেন যে ভাইরাস লক্ষণহীন ভাবে সংক্রামিত হতে পারে, তার গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া শুধু সময়ের অপেক্ষা [1]। গোটা পৃথিবী জুড়ে এক সাংঘাতিক মহামারীর মারণলীলার টাইম বোমার মত বিস্ফোরণ শুধু এক সময়ের অপেক্ষা!
আদতে তাঁদের বাবা মা তুরস্কের মানুষ, মধ্যপ্রাচ্যের সেই দেশ, যার সীমানার একদিকে যুদ্ধবিক্ষত সিরিয়া, মাঝে অশান্ত ইরাক আর অন্যদিকে ইরান। কামাল আতাতুর্কের দেশের গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলি অনেক আগেই অস্তমিত। উগুরের জন্ম তুরস্কতেই। যখন তার মাত্র চার বছর বয়স তখন উগুরের মা তাকে নিয়ে চলে আসেন জার্মানিতে। সেই উগুর শাহীন, যিনি সেই যাত্রার পঞ্চাশ বছর পর প্রথম অনুমোদিত করোনা ভাইরাসের টিকা তৈরীর অন্যতম পথিকৃৎ হয়ে পৃথিবীতে নতুন আশার আলো দেখাবেন।
আসলে বিজ্ঞান বোধ হয় এইরকমই। বিজ্ঞানকে স্থান, কাল বা দেশের সীমানাতে বেঁধে রাখা যায় না। বিজ্ঞানী যে দেশেই থাকুন না কেন, তাঁর আবিষ্কারের সুফল ভোগ করে গোটা পৃথিবী। যেমন জোনাস সাল্ক , আমেরিকার এই প্রাতঃস্মরণীয় বিজ্ঞানী পোলিও রোগের টিকা আবিষ্কার করেন নিউইয়র্কে বসে, আর সেই পোলিওর টিকা ব্যবহার করে ভারতবর্ষের মত জনবহুলদেশও পোলিও মুক্ত হয়। পৃথিবী জুড়ে কোটি কোটি বাচ্চা সুস্থ জীবন নিয়ে বাঁচতে পারে। সব দেশের মত এযাত্রাতেও তুরস্কের কিছু কূপমণ্ডূক হইচই জুড়ে দিয়েছে কেন তাঁরা তুরস্ক ছেড়ে জার্মানি গিয়ে উঠেছিলেন, তাঁরা ঠিক ঠিক ‘দেশপ্রেমিক’ নন। কিন্তু কে জানে, হয়ত তা না করলে সুযোগের অভাবে এই প্রতিভার সঠিক বিকাশ হত না, আর শুধু তুরস্ক নয় গোটা পৃথিবীই তাঁর এই আবিষ্কার থেকে হয়তো বঞ্চিত হত!
যাই হোক, ফিরে আসি ভাইরাস এর টিকা আবিষ্কারের গোড়ার কথায়। পোলিওর টিকা আবিষ্কার করতে জোনাস সাল্ক এর লেগেছিলো প্রায় দশ বছর। দ্রুততম টিকা তৈরী হয়েছিল মাম্পস্ এর ক্ষেত্রে। সেই টিকা তৈরী করতে মরিস হিলম্যানের লেগেছিল প্রায় চার বছর। তাই স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন আসে কোন জাদুমন্ত্রের জোরে BioNTech এর উগুর শাহীন, Moderna-র ও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার বিজ্ঞানীরা প্রায় আট মাসের মধ্যেই কোভিড – 19 (SARS-CoV-2) ভাইরাস এর টিকা তৈরী করে আমেরিকার আহার্য ও ঔষধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা Food and Drug Administration(FDA) বা ইংল্যান্ডের নিয়ন্ত্রক সংস্থা Medicines and Healthcare products Regulatory Agency (MHRA) -র অনুমোদন করিয়ে নিতে পারলেন। আর তৈরী করে ফেলতে পারলেও এই টিকাগুলি নেওয়া নিরাপদ তো?
আবার চলে আসা যাক মাইনজ শহরে। জানুয়ারির শীতের শনিবার সকালে তৃপ্তির ধুমায়িত কফির কাপ ছেড়ে উগুর তাঁর সাইকেল নিয়ে পড়িমরি করে দৌড় লাগালেন তাঁর রিসার্চ ল্যাবে। যথেষ্ট উপার্জন স্বত্বেও তিনি গাড়ি ব্যবহার করেন না, এমনকি তাঁর নিজস্ব ড্রাইভিং লাইসেন্সও নেই [1]। তড়িঘড়ি পৌঁছলেন তাঁর নিজস্ব কোম্পানীর, BioNTech এর গবেষণাগারে যা তিনি তিলতিল করে তৈরী করেছেন নিজের পরিশ্রম ও অধ্যবসায় দিয়ে। পেশায় ডাক্তার হলেও, উগুর আর তাঁর ডাক্তার স্ত্রী ওজলেম তুরেসির বরাবরের ঝোঁক নতুন ওষুধ আবিষ্কারের দিকে। দিনের পর দিন তাঁরা দেখেছেন কীভাবে ক্যান্সার রোগীরা কার্যকরী ওষুধের অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আর ডাক্তার হয়েও অসহায়ের মত দেখা ছাড়া তাঁদের কিছুই করার থাকে না। ততদিনে নিজেদের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে তাঁরা তৈরী করে ফেলেছেন একটি ওষুধ কোম্পানি, যেখানে তাঁরা অন্যরকম উপায়ে ক্যান্সার প্রতিষেধক টিকা তৈরী করবেন, যাতে আর কোন রোগী ওষুধের অভাবে ক্যান্সারে মারা না যান। এই নতুন প্রযুক্তির নাম mRNA বা messengar RNA প্রযুক্তি।
জানুয়ারী 2020 এর আগে BioNTechএর গবেষণা পুরোদমে চলছিল mRNA-র সাহায্যে ক্যান্সার ওষুধ তৈরীর কাজে। কয়েক বছর আগে তারা ত্বকের ক্যান্সারের টিকা BNT122 ও তৈরী করে ফেলেছে। BioNTechএর দুবছর পর তৈরী Moderna, বা CareVac -র মত আরও পুরোনো কয়েকটি কোম্পানিও mRNA প্লাটফর্ম নিয়ে জোর কদমে গবেষণা করছে। এই পটভূমিতে ল্যানসেট এর কোভিড- 19 নিয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ এবং উগুর শাহীনের পড়িমরি করে ল্যাবে ছোটা।
করোনা ভাইরাসের যে টিকাগুলি সবচেয়ে দ্রুত তৈরী করা গিয়েছে, তার মধ্যে একটা হচ্ছে এই mRNA পদ্ধতিতে তৈরী টিকা, যা নেক্সট জেনারেশন টিকাগুলির মধ্যে অন্যতম (চিত্র 3)।
নেক্সট জেনারেশন টিকা
1) mRNA প্লাটফর্ম
আমরা জানি যে প্রোটিন শরীরের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বস্তুগুলির মধ্যে একটি। কোষের নিউক্লিয়াসের মধ্যে থাকা জিন প্রোটিন তৈরীর নির্দেশ দেয় আর নিউক্লিয়াসের বাইরে থাকা রাইবোজোম জিনের নির্দেশ অনুযায়ী সেই প্রোটিন তৈরী করে।
কিন্তু নিউক্লিয়াস থেকে রাইবোজোম পর্যন্ত জিনের এই নির্দেশ পৌঁছে দিয়ে আসবে কে?
ঠিক এই কাজটি-ই করে mRNA । mRNA জিনের কাছ থেকে যে প্রোটিন তৈরী করতে হবে তার কোড নকল করে রাইবোজোমকে দিয়ে আসে। রাইবোজোম তখন সেই কোড পড়ে নির্দেশিত প্রোটিনটি উৎপাদন করে [2]। (জিন, DNA, RNA ও প্রোটিন তৈরীর বিষয়ে আরো বিশদে জানতে চাইলে এই লেখার শেষে পরিশিষ্ট দেখতে পার)। এখন যদি mRNA তে কারসাজি করে ভাইরাসের গায়ে যে প্রোটিন থাকে রাইবোজোমকে সেই প্রোটিন তৈরীর নির্দেশ পাঠানো যায়, তাহলে কোষ ধরে নেবে যে আমাদের শরীরে সেই প্রোটিন সমেত জীবাণু ঢুকেছে। আর তার ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে উঠে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি তৈরী করতে শুরু করবে। সুতরাং শরীরের মধ্যে ক্ষতিকর আসল ভাইরাস না ঢুকিয়েও mRNA কে ব্যবহার করে রোগ প্রতিরোধক টিকা তৈরী করা যেতে পারে।
ঠিক এই পদ্ধতি ব্যবহার করেই করোনা ভাইরাসের প্রথম অনুমোদিত টিকা তৈরী করেন BioNTech এবং Moderna-র বিজ্ঞানীরা।
উহান প্রদেশে করোনার প্রাদুর্ভাবের পরেপরেই খুব দ্রুত চৈনিক গবেষকেরা কোভিড-19 ভাইরাসের জিনোম প্রকাশ করে জনসাধারণের জন্য উম্মুক্ত করে দেন। চৈনিক বিজ্ঞানীদের এই তৎপরতাও এত দ্রুত জেনেটিক ভ্যাকসিন তৈরী করে ফেলতে পারার অন্যতম কারণ।
জেনেটিক সিকোয়েন্স প্রকাশিত হওয়া মাত্র নাওয়া খাওয়া ভুলে বিজ্ঞানীরা কোভিড-19 এর জিন সিকোয়েন্স পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে ফেলেন! প্রয়োজনীয় প্রোটিনের কোডটাকেও শনাক্ত করে ফেলেন। করোনা ভাইরাস দেখতে অনেকটা কদম ফুলের মতো, একটা গোল বলের উপর যেন সারি সারি আঁকশি লাগানো। এই আঁকশি গুলিই S-প্রোটিন, বা স্পাইক প্রোটিন (চিত্র 4)।
করোনা ভাইরাস যখন শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে তখন এই আঁকশি গুলোর সাহায্যেই ভাইরাস কোষের মেমব্রেনের সঙ্গে আটকে থাকে ও শরীরের ক্ষতি করতে শুরু করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে গোটা ভাইরাসটি শরীরের জন্য ক্ষতিকর, আলাদাভাবে এই S-প্রোটিনটি নয়।
বিজ্ঞানীরা ফন্দি আঁটলেন যে কোভিড-19 এর জিনোম পরীক্ষা করে যদি স্পাইক প্রোটিন তৈরির সংকেত ধরে ফেলা যায়, তাহলে শরীরের মধ্যে গোটা ভাইরাসটা না ঢুকিয়ে সিনথেটিক (ল্যাবে তৈরী করা) মেসেঞ্জার RNA -র সাহায্যে শুধু স্পাইক প্রোটিনটাকেই কোষের মধ্যে তৈরী করে ফেলা যেতে পারে। আর তাহলেই তো কেল্লা ফতে ! তখন কোষ ধরে নেবে যে আসল ভাইরাস ঢুকে পড়েছে আর শরীরে করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি তৈরী হতে থাকবে।
তন্ময় হয়ে কোভিড-19 এর জেনেটিক সিকোয়েন্স দেখতে দেখতে তাঁরা ধরেও ফেললেন কোভিড-19 এর স্পাইক প্রোটিন তৈরীর রহস্য। এই ভাবে তাঁরা কয়েকদিনের মধ্যেই কম্পিউটারে তৈরী করে ফেললেন বেশ কয়েকটা mRNA ভ্যাকসিন ডিজাইন, যারা মানুষের শরীরে কোষের মধ্যে গিয়ে কোষকে স্পাইক প্রোটিন তৈরী করার সংকেত দিতে পারে, সেই স্পাইক প্রোটিন, যার সাহায্যে আসল করোনা ভাইরাস কোষের দেওয়ালে গেঁড়ে বসে। এই ডিজাইনগুলির মধ্যে একটাও যদি কার্যকরী হয়, আর কোষ সত্যি সত্যিই বিষক্রিয়া ছাড়া যদি এই S-protein (বা তার নানা অংশ, সেটা পুরো S -প্রোটিন হতে পারে বা যে অংশ receptor এর সঙ্গে bind করে সেই অংশ) তৈরী করতে শুরু করতে পারে, তাহলে আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা শরীরে স্পাইক প্রোটিনওয়ালা ক্ষতিকারক জীবাণু ঢুকেছে মনে করে সঙ্গে সঙ্গে শরীরে করোনা প্রতিরোধক অ্যান্টিবডি তৈরী করতে শুরু করবে।
এ যেন একঢিলে দুই পাখি মারা ! প্রথমত জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংএর সাহায্যে আমাদের শরীরের কোষকেই অ্যান্টিজেন তৈরির কারখানা বানানো, আর দ্বিতীয়ত চালাকি করে কোষকে বেওকুফ বানিয়ে বোঝানো যে শরীরে আসল জীবাণু ঢুকেছে এবং ‘Aal izz not well’, যাতে তারা তড়িঘড়ি প্রতিষেধক অ্যান্টিবডি তৈরী করতে শুরু করে, ও শরীর আসল জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়! সাধারণত টিকার উপযোগী অনেকগুলি mRNA ভ্যাকসিন ডিজাইনের সবকটাই S প্রোটিন (বা তার নানা অংশ) তৈরী করে কিন্তু neutralizing antibody তৈরী করতে পারে কিনা আর পারলেও toxicity কোনটার কম সেটা দেখে সবচেয়ে ভালো ডিজাইনটিকে বেছে নেওয়া হয়। ঠিক এভাবেই mRNA ব্যবহার করে SARS-CoV-2 ভাইরাসের টিকা তৈরী করা হয়েছে।
অথচ শুরুর দিকের পথচলা এত সহজ ছিল না। বিলিয়ন ডলার ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হওয়ার আগে mRNA প্রযুক্তিকে কেউই খুব একটা গুরুত্ব দেয় নি। নিরাপদে শরীরের immune system কে শান্ত রেখে mRNA পদ্ধতিকে ব্যবহার করার অন্যতম পথিকৃৎ হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভুত বিজ্ঞানী প্রফেসর ক্যাটালিন কারিকোর কাছে এই পথ ছিল কানাগলির সমান [3,4]। ঢোকার রাস্তা শুধু পিচ্ছিলই ছিল না, সামনে এগোনোর পথও ছিল রুদ্ধ। প্রথম দিকে রোগের বিরুদ্ধে তাঁর mRNAর শক্তিকে কাজে লাগানোর প্রয়াস সকলেই বাঁকা চোখে দেখত। তাঁর প্রচেষ্টা সরকারি অর্থ সাহায্য থেকেও বঞ্চিত ছিল। ঝুঁকিপূর্ণ গবেষণা এবং সাফল্য নিশ্চিত না হওয়ায় কর্পোরেট ফান্ডিংও ছিল অধরা। প্রথম দিকে একের পর এক গবেষণার জন্য তাঁর ফান্ডিং এর আবেদন প্রত্যাখ্যাত হতে থাকে। সহকর্মীদের কাছ থেকেও প্রয়োজনীয় সমর্থন পাওয়া যায় না। অবশেষে 1995 সালে ছবছর নিরন্তর চেষ্টা এবং প্রত্যাখানের পর আরো বড় আঘাত আসে। যথেষ্ট গবেষণা ও পর্যাপ্ত ফান্ডিং না আনতে পাড়ার কারণে পেনসিলভেনিয়া উনিভার্সিটির চাকরিতে তাঁকে নিজস্ব পদমর্যাদা থেকে সরিয়ে নিচের পদে নামিয়ে দেওয়া হয়! এইরকম অবমাননাকর ও হতাশাজনক ঘটনার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রায় সব সাধারণ মানুষই ভেঙে পড়ে । কিন্তু ক্যাটালিন কারিকো অন্য ধাতুতে তৈরী। নিজের প্রস্তাবিত mRNA প্রযুক্তির কার্যকারিতার উপর অগাধ বিশ্বাস ছিল তাঁর। বিশ্বাস ছিল সাফল্য একদিন আসবেই। শুরু হয় দাঁতে দাঁত চেপে আরো আরো পরীক্ষা, আরো রাত জাগা, আবারও ফান্ডিং এর জন্য আবেদন!
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফান্ডিং আবেদন প্রত্যাখ্যানের প্রধান কারণ ছিল mRNA প্রবেশ করানোর পর কোষের অতি সক্রিয়তা। সিনথেটিক mRNA কোষের মধ্যে ঢোকানোর পর কোষ সম্পূর্ণ mRNA স্ট্র্যান্ডটাকেই বহিরাগত জীবাণু বলে ধরে নিচ্ছিল এবং সেটিকে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লাগছিল। এর ফলে শরীরের সম্পূর্ণ প্রতিরোধ ব্যবস্থাটিই উথাল পাথাল হয়ে যাচ্ছিল, এবং mRNA প্রযুক্তি তার কার্যকারিতা হারাচ্ছিল। স্বাভাবিকভাবেই তৎকালীন বিশেষজ্ঞরা এই পদ্ধতির খুব বেশি উপযোগিতা দেখতে পাচ্ছিলেন না।
প্রায় দশ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করার পর ডঃ কারিকো এবং তাঁর সহকর্মী ডঃ ওয়াইজম্যান 2005 সাল নাগাদ এই সমস্যার সমাধান পেলেন [5]। mRNAর প্রতিটি স্ট্র্যান্ড নিউক্লিওটাইড নামে চারটি আণবিক বিল্ডিং ব্লক দিয়ে তৈরী। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের পর ওনারা দেখলেন যে সিনথেটিক mRNAর একটি বিল্ডিং ব্লক সমস্ত রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থাপনাকে ওলটপালট করে দিচ্ছে। ডঃ কারিকো এবং ডঃ ওয়াইজম্যান এই সমস্যারও সমাধান করলেন। ওনারা ওই গোলমেলে বিল্ডিং ব্লকটিকে প্রতিস্থাপিত করলেন অন্য একটি নিরীহ অণু দিয়ে। এবং ইউরেকা ! এই মডিফায়েড নিউক্লিওটাইডওয়ালা mRNA গুলি আর শরীরের মধ্যে উথালপাথাল প্রতিরোধ প্রতিক্রিয়া তৈরী করল না ! অনেকের মতে এই সমাধানই mRNA গবেষণার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত খুলে দিল, হয়তো বা অদূর ভবিষ্যতে ডঃ কারিকো এবং ডঃ ওয়াইজম্যান-কে চিকিৎসাবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কারের দাবিদারও করে তুলল।
কিন্তু এরপরও একটা সমস্যা থেকেই গেল। দেখা গেল বাইরে থেকে RNA শরীরের কোষে ঢোকানো ভীষণ কঠিন কাজ। শতকোটি বছরের বিবর্তনে আমাদের শরীর শিখেছে কীভাবে বাহ্যিক RNA চটজলদি ধ্বংস করা যায়। তার ওপর এতগুলো নেগেটিভ চার্জ থাকার জন্য RNA নিজে থেকে কোষের মধ্যে ঢুকতেও চায় না। ততদিনে পিটার কালিসের মত বিজ্ঞানীরা দেখিয়ে দিয়েছেন যে কিছু কিছু ভঙ্গুর ওষুধ কণাকে লিপিড ন্যানোপার্টিকেল দিয়ে আস্তরণ দিয়ে দিলে সহজেই তাদেরকে স্থিতিশীল করে ফেলে কোষের মধ্যে চালান করে দেওয়া যায় [6]। কীভাবে লিপিড ন্যানোপার্টিকেলের মাধ্যমে mRNA কোষের মধ্যে নিরাপদে ঢুকিয়ে প্রোটিন তৈরী করা যায় তাও ততদিনে বিজ্ঞানীরা জেনে গেছেন। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা প্রতিটা mRNA কে লিপিড বা ফ্যাটের ন্যানোপার্টিকলের একটা পোঁচ দিয়ে একটা আস্তরণে ঢেকে দিলেন যাতে পুরো mRNA টি ফ্যাটের আস্তরণের মধ্যে সংরক্ষিত থাকে। এই আস্তরণ মডিফায়েড mRNA কে অনেক স্থিতিশীল করে তুলল যাতে সেটি শরীরের মধ্যে সময়োপযোগী অ্যান্টিবডি তৈরী করতে পারে। এভাবেই mRNA প্রযুক্তিতে প্রথম করোনা ভাইরাসের টিকা তৈরী হল। এটিই পৃথিবীতে প্রথম অনুমোদিত নেক্সট জেন ভ্যাকসিন। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে কীভাবে BioNTech/Pfizer বা Moderna-র বিজ্ঞানীরা রোগীর শরীরে পুরোনো পদ্ধতির টিকার মত ক্ষতিকর রোগজীবাণু না ঢুকিয়েও mRNA পদ্ধতিতে কোরোনার টিকা কয়েক মাসের মধ্যেই তৈরী করে ফেলতে পারলেন। শুধু তাই নয়, এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতের জন্য খুব দ্রুত আরো নতুন নতুন মারণ রোগের ওষুধ তৈরীর দিগন্ত খুলে দিল [7-9]।
2) ভাইরাল ভেক্টর প্লাটফর্ম
নেক্সট জেনেরেশন টিকার মধ্যে অন্যটি হচ্ছে ভাইরাল ভেক্টর ব্যবহার করে তৈরী করোনার টিকা, যা তৈরী করেছে অক্সফোর্ড উনিভার্সিটির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে অ্যাস্ট্রাজেনেকা কোম্পানি। প্রসঙ্গত মনের মধ্যে এই প্রশ্ন উঠতেই পারে যে তাহলে BioNTech/Pfizer বা Modernaর টিকার সঙ্গে Oxford-Astrazenecaর টিকার পার্থক্যটা ঠিক কোথায়?
যেখানে BioNTech/Pfizer বা Moderna-র টিকা সিনথেটিক mRNA নিউক্লিক অ্যাসিডকে সরাসরি কোষের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি তৈরী করে, সেখানে Oxford-Astrazeneca কোষের মধ্যে স্পাইক প্রোটিনের কোড সমেত আস্ত একটা DNA কেই ঢুকিয়ে দেয়। এই DNA ঢোকানোর জন্য সাহায্য নেওয়া হয় অন্য প্রজাতির একটা নিরীহ ভাইরাস এর, যেটি SARS টাইপ ভাইরাস নয়। এই ভাবে জেনেটিক পদার্থ যখন অন্য একটি নিষ্ক্রিয় ভাইরাসের সাহায্যে কোষের মধ্যে ঢুকিয়ে টিকা তৈরী করা হয়, তখন সেই পদ্ধতিকে ভাইরাল ভেক্টর প্লাটফর্ম বা প্রযুক্তি বলে। এক্ষেত্রে করোনা ভাইরাসের টিকা তৈরী করতে Oxford-Astrazeneca-র বিজ্ঞানীরা মানুষের জন্য আপাত নিরীহ এক ভাইরাস ব্যবহার করেছেন যা শিম্পাঞ্জির সর্দি হওয়ার জন্য দায়ী হলেও মানুষের ক্ষতি করে না। এই ভাইরাসের নাম অ্যাডেনোভাইরাস। মলিক্যুলার বায়োলজিস্টরা এই ধরণের নিষ্ক্রিয় ভাইরাসদের ভেক্টর বা জেনেটিক কুলি বলে থাকেন। এই অ্যাডেনোভাইরাস শিম্পাঞ্জিদের ঠান্ডা লাগার ভাইরাস হলেও মানুষের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ। এই ধরণের ভাইরাসকে অনেক ক্ষেত্রেই জেনেটিক মালপত্র কোষের মধ্যে চালান করার কাজে লাগানো হয়, অনেকটা রেল স্টেশনে মালবাহকদের মত। এই নিষ্ক্রিয় ভাইরাসদের কাজ শুধু জেনেটিক কোডটাকে ট্যাঁকে গুঁজে কোষের মধ্যে দিয়ে আসা। ব্যাস, তা হলেই তার কাজ শেষ। Oxford-Astrazeneca-র বিজ্ঞানীরা এক্ষেত্রে SARS-CoV-2 ভাইরাস এর স্পাইক প্রোটিনের DNA অ্যাডেনোভাইরাস এর মধ্যে পুরে শরীরের মধ্যে ইঞ্জেক্ট করেছিলেন (উপরের চিত্র ৭ ছবিটা দেখ, আর আরো জানতে [10,11] নম্বর রেফারেন্সগুলি দেখ)। তার পরের গল্পটা একই। অর্থাৎ এই স্পাইক প্রোটিনের DNA কোষকে স্পাইক প্রোটিন তৈরী করতে উদ্বুদ্ধ করে, এবং সেই স্পাইক প্রোটিন তৈরী হতেই শরীর রে রে করে অ্যান্টিবডি তৈরী করতে শুরু করে।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে BioNTech/Pfizer বা Modernaর টিকা এবং Oxford-Astrazenecaর টিকা সবকটাই DNA অথবা RNA ব্যবহার করে শরীরের কোষকেই স্পাইক প্রোটিন তৈরীর কারখানা হিসাবে ব্যবহার করে। সবকটাই নেক্সট জেনারেশন ভ্যাকসিন।
কিন্তু BioNTech/Pfizer বা Moderna-র টিকা RNA ভিত্তিক, আর Oxford-Astrazenecaর টিকা ভাইরাল ভেক্টর ভিত্তিক, যেখানে DNA কে অ্যাডেনোভাইরাসের সাহায্যে কোষের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। BioNTech/Pfizer বা Moderna-র টিকা mRNA কে কোষের সাইটোপ্লাজমে পাঠায়, আর Oxford-Astrazenecaর টিকা DNA কে কোষের নিউক্লিয়াস-এর ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়।
আর যে পার্থক্যগুলো আছে তা হল কার্যকারিতায়। BioNTech/Pfizer বা Moderna-র টিকা যেখানে 95% এরও বেশি কার্যকরী, সেখানে Oxford-Astrazeneca-র টিকা 70% ক্ষেত্রে কার্যকরী। যদিও Oxford-Astrazeneca টিকার এই খামতি পুষিয়ে যায় অন্য জায়গায়। দামের দিক থেকে Oxford-Astrazeneca-র টিকা অনেকটাই সস্তা অন্য দুটোর থেকে। টিকা সংরক্ষণ করার জন্য Oxford-Astrazeneca-র টিকার বাকি দুটোর মত অতি ঠান্ডা পরিকাঠামোর দরকার পরে না, যা উন্নয়নশীল ও গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলির কাছে আশীর্বাদস্বরূপ। এখানে আর একটা তথ্য দিয়ে রাখা ভালো যে আর একটি বড় ওষুধ কোম্পানিও (Johnson & Johnson) অ্যাডেনোভাইরাস ভিত্তিক ভাইরাল ভেক্টর টিকা তৈরী করছে, যদিও তারা শিম্পাঞ্জী নয়, মানুষের সাধারণ ঠান্ডা লাগার জন্য দায়ী তুলনামূলক নিরীহ অ্যাডেনোভাইরাস ব্যবহার করছে। এ ছাড়াও আরো কিছু টিকার খবর জানা গিয়েছে যেমন ভারতবর্ষে তৈরী কোভ্যাকসিন বা কোভিশিল্ড (যেটি আসলে Oxford-Astrazeneca-র টিকার দেশীয় সংস্করণ), চীনদেশের তৈরী সিনোভ্যাক বা রাশিয়ার তৈরী স্পুৎনিক। কিন্তু বাকি টিকাগুলির তুলনামূলক আলোচনা করার মত পর্যাপ্ত তথ্য এই মুহূর্তে আমাদের হাতে নেই।
প্রচলিত টিকা পদ্ধতির সঙ্গে নেক্সট জেন টিকার পার্থক্য
আমরা দেখলাম যে নেক্সট জেন টিকাতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং -এর মাধ্যমে শরীরের কোষকেই অ্যান্টিজেন (এক্ষেত্রে S -প্রোটিন) তৈরীর কারখানা হিসাবে ব্যবহার করা হয়। বাইরে থেকে কোন আসল রোগের জীবাণু শরীরের মধ্যে ঢোকাতে হয় না [3-7]।
প্রচলিত টিকা তৈরীর ক্ষেত্রে কিন্তু কোনো রোগের মৃত বা দুর্বল কিছু আসল রোগজীবাণু শরীরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে অ্যান্টিবডি তৈরী করানো হয়। এক্ষেত্রে প্রথমে কিছু জীবাণু নিয়ে হাঁসমুরগীর ডিমের মধ্যে বা অন্য কোন জীবকোষের মধ্যে ঢুকিয়ে তাদের বংশবৃদ্ধি করানো হয়। যেহেতু সেগুলি আসল মারণরোগের জীবাণু, এই পদ্ধতির সময় অত্যন্ত সতর্কতা এবং বিভিন্ন প্রোটোকল মেনে চলতে হয়, যা যথেষ্ট খরচ ও সময়সাপেক্ষ। কল্পনা কর, পৃথিবীজুড়ে করোনা ভাইরাসের কয়েকশ কোটি টিকা তৈরীর জন্য যদি আমাদের প্রচলিত পদ্ধতিতে টিকা তৈরী করতে হত, তাহলে কী অবিশ্বাস্য বিশাল মাপের পরিকাঠামো এবং তার আনুষঙ্গিক সুরক্ষা প্রোটোকল তৈরী করতে হত! কিন্তু নেক্সটজেন টিকায় এসব কিছুই করতে হয় নি, কারণ এতে আসল ভাইরাস ব্যবহারই করা হয় নি, শুধু S-প্রোটিন তৈরীর জেনেটিক কোড ব্যবহার করা হয়েছে।। যাই হোক এর পরের ধাপে আসে ইঁদুর বা অন্য স্তন্যপায়ী জীবের উপর টিকার কার্যকারিতার পরীক্ষা নিরীক্ষা। সাধারণত এই পরীক্ষা এবং তার ফল বিশ্লেষণ, কতখানি ভাইরাস শরীরের মধ্যে গেলে শরীর নিতে পারবে, শরীরের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে কিনা, না হলেও আদৌ কার্যকরী অ্যান্টিবডি তৈরী হবে কি না, অ্যান্টিবডি তৈরী হলেও কোন মাত্রা সবচেয়ে উপযোগী, এই ধরণের হাজারো প্রশ্নের উত্তর পেতে পেতে বহু বছর লেগে যায়। টিকা তৈরীর প্রচলিত ধাপগুলো সম্বন্ধে জানতে বিজ্ঞান পত্রিকার এই লেখাটি পড় [12] ।
এত তাড়াতাড়ি কী ভাবে তৈরী করা এবং অনুমোদন পাওয়া সম্ভব হল?
আমরা আগেই দেখেছি যে নেক্সট জেন টিকার ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি তৈরী করতে বাইরে থেকে শরীরের মধ্যে কোন রোগজীবাণু ঢোকাতে হয় না, বরঞ্চ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে প্রোটিনের কোড সমেত DNA বা mRNA তৈরী করে কোষের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে সুচতুরভাবে শরীরের কোষকে অ্যান্টিবডি তৈরীর কারখানা হিসাবে ব্যবহার করা হয় । উল্টোদিকে প্রথাগতভাবে ভাইরাসের টিকা তৈরীর প্রথম ধাপে, যেমন উদাহরণস্বরূপ ইন্ফ্লুয়েঞ্জার টিকার ক্ষেত্রে, ফুটবে ফুটবে করছে এইরকম ডিমের মধ্যে আসল জীবাণু ইঞ্জেক্ট করে দেওয়া হয়। তারপর অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে জীবাণুর বৃদ্ধিসাধন করা হয়। এইভাবে জীবাণুর বৃদ্ধিসাধন অত্যন্ত জরুরি, যাতে অনেক সংখ্যক দুর্বল বা মৃত ভাইরাস তৈরী করা যায়। এইভাবে নিষ্ক্রিয় ভাইরাস তৈরী করে পরবর্তীকালে তা শরীরের মধ্যে ঢুকিয়ে অ্যান্টিবডি তৈরী করা হয়। কিন্তু এই পদ্ধতিতে আনুপাতিক হারে টিকার উৎপাদন বাড়ানো (scaling-up) অনেক সময় সাপেক্ষ। নেক্সট জেন ভাইরাসে এই ধাপটা সম্পূর্ণভাবে এড়ানো যায় এবং স্কেল-আপও অনেক সহজে এবং দ্রুত করা যায়।
প্রথাগত টিকার ক্ষেত্রে প্রোটিনের ক্ষণভঙ্গুর প্রকৃতি বোঝা এবং তা নিয়ন্ত্রণ করা, কোন প্রোটিন অ্যান্টিজেন হিসাবে সবচেয়ে কার্যকারী, কোনটার বিষক্রিয়া (toxicity) কম, ইত্যাদি বুঝতেই বহু সময় চলে যায়। আবার এই ভাবে টিকা তৈরী হয়ে গেলেও, ভাইরাস যদি mutate করে, তাহলে এই পরিবর্তিত ভাইরাসের টিকা তৈরী করতে সমস্ত ধাপ গুলো প্রথম থেকে আবার কেঁচেগণ্ডূষ করতে হয়। উদাহরণ স্বরূপ এখনই করোনা ভাইরাসের নতুন নতুন স্ট্রেনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত এই নতুন স্ট্রেনগুলিতে S – প্রোটিনের গঠনে বড়রকম পরিবর্তন না করছে আমরা আশা করতেই পারি যে নেক্সট জেন টিকাগুলি নতুন স্ট্রেনগুলোর ক্ষেত্রেও কাজ করবে (যদিও এটা সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে গেলে আরো পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ দরকার) । যদি এই টিকা কাজ নাও করে, বিজ্ঞানীরা কম্পিউটারে বসে কয়েক দিনের মধ্যেই নতুন ভ্যাকসিন ডিজাইন করে ফেলতে পারবেন, যেটা প্রথাগত ভাবে এত তাড়াতাড়ি কোন ভাবেই সম্ভব নয়।
তদুপরি কোভিড-19 ভাইরাসের ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা ভাগ্যবান, কারণ SARS-CoV-2 ভাইরাস গঠনমূলক ভাবে SARS-CoV-1 অথবা MERS ভাইরাসের খুব কাছাকাছি। তাই বিজ্ঞানীদের SARS-CoV-2 বা কোভিড-19 ভাইরাস বা তার প্রোটিনের গঠন সম্বন্ধে আগে থেকেই অনেকটাই ধারণা ছিল। তাই প্রিক্লিনিক্যাল বিচারের সময়েও অনেকটা সময় বাঁচানো গিয়েছে। এর পর আসে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, বা মানুষের শরীরের উপর পরীক্ষা। প্রথাগতভাবে যেখানে এক দফার ট্রায়াল শেষ হওয়ার ও পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য বিশ্লেষণের পরে দ্বিতীয় বা তৎপরবর্তী ট্রায়ালে যাওয়া হয়, সেখানে করোনার টিকার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দফার ট্রায়াল সমান্তরাল ভাবে ও অত্যন্ত দ্রুত করা হয়েছে (নিচের চিত্র ৮ ছবিটা দেখ)। এক্ষেত্রে অনেককটি দেশ তাদের সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, একসঙ্গে এবং সমান্তরাল ভাবে প্রচুর মানুষের উপর ট্রায়াল হয়েছে, যা টিকা তৈরীর ইতিহাসে অভূতপূর্ব। তদুপরি বিভিন্ন দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সমস্ত দিক খাতিয়ে দেখে জরুরি ভিত্তিতে টিকা ব্যবহারের ছাড়পত্র দিয়েছে, যার ফলে এতো দ্রুত করোনা ভাইরাসের টিকা তৈরী করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। তবে এই ভ্যাকসিনগুলো কতদিন পর্যন্ত কার্যকরী থাকবে বা এদের দীর্ঘমেয়াদী কোন সাইড এফেক্ট আছে কিনা তা জানতে আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় নেই।
পরিশেষে এটা হয়তো বলাই যায় যে বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব সাফল্য, কিছু মানুষের অদম্য প্রচেষ্টা এবং হার না মানা মনোভাব, বিশ্বজুড়ে বিরাট মাপে হিউমান ট্রায়াল এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান, কোরোনার টিকা তৈরীতে সম্পূর্ণ নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার এবং অভূতপূর্ব তৎপরতা পৃথিবীকে নতুন আশার আলোর দিশা দেখালো।
আশা করাই যায় যে এই ভয়ঙ্কর মহামারীর এটাই শেষের শুরু [14]!
পরিশিষ্ট
এখন যারা আরো তলিয়ে দেখতে চায়, তাদের জন্য জিন, DNA এবং RNA-র গঠন এবং তাদের কাজগুলো একটু দেখে নেওয়া যাক। আমরা জানি যে আমাদের শারীরিক এবং চারিত্রিক বৈশিষ্টের অনেকটাই নির্ভর করে আমাদের জিনের উপর। এই জিন আমাদের DNA-র একটা অংশ। হৃতিক রোশন বা ঐশ্বর্য রাইয়ের চোখের রঙের সঙ্গে রবিঠাকুরের কৃষ্ণকলির কালো হরিণ চোখের রঙের কাব্যিক পার্থক্য অনেক হলেও, বৈজ্ঞানিক কারণ কিন্তু সেই জিন।
সে না হয় বোঝা গেল, কিন্তু জিন বা DNA কিভাবে এই রং নিয়ন্ত্রণ করে?
এর পুরোটাই হয় প্রোটিন তৈরীর মাধ্যমে। চোখ, চুল বা গায়ের রং নির্ধারণ করে যে রঞ্জক পদার্থগুলি সেগুলি আসলে এক এক ধরণের প্রোটিন। DNA কোষের রাইবোজোমকে নির্দেশ পাঠায় কী ধরণের প্রোটিন কত পরিমানে তৈরী করতে হবে, আর কোষের মধ্যে থাকা রাইবোজোম সেই নির্দেশ অনুযায়ী প্রোটিন সংশ্লেষ করে। কিন্তু DNA অধিকাংশ ক্ষেত্রে তো বসে থাকে কোষের নিউক্লিয়াসের মধ্যে, আর রাইবোজোম থাকে নিউক্লিয়াসের বাইরে সাইটোপ্লাজমে! সেক্ষেত্রে DNA -র এই নির্দেশ নিউক্লিয়াস থেকে রাইবোজোম পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসবে কে?
এইখানেই RNA -র কারিকুরি শুরু। RNA বা রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড, সমস্ত জীবকোষে উপস্থিত একটি নিউক্লিক অ্যাসিড। প্রসঙ্গত কার্বোহাইড্রেট, লিপিড আর প্রোটিনের মতো নিউক্লিক অ্যাসিডও আমাদের শরীরে উপস্থিত বাইওমলিকিউলগুলির মধ্যে অন্যতম। DNA যেমন ডাবল হেলিক্স, দুটো স্ট্র্যান্ড দিয়ে তৈরী, RNAতে সে জায়গায় একটি মাত্র স্ট্র্যান্ড। DNA -র মত RNA -ও যে বিল্ডিং ব্লক দিয়ে তৈরী হয় সেগুলি কে বলে নিউক্লিওটাইড। প্রতিটা নিউক্লিওটাইড একটা সুগার, একটা ফসফেট আর একটা নাইট্রোজেন সমন্বিত বেস, এই তিনটি অংশ দিয়ে তৈরী। ফসফেট ছাড়া নিউক্লিওটাইডের পোশাকি নাম নিউক্লিওসাইড।
কোষের মধ্যে সাধারণত তিন ধরণের RNA থাকে: 1) mRNA বা মেসেঞ্জার RNA, 2) rRNA বা ribosomal RNA যা প্রোটিন তৈরীর কারখানা রাইবোজোমের একটা বড় উপাদান, এবং 3) tRNA বা ট্রান্সফার RNA, যা রাইবোজোমকে অ্যামিনো অ্যাসিড সরবরাহ করে, যে অ্যামিনো অ্যাসিড আদতে প্রতিটি প্রোটিনের বিল্ডিং ব্লক। এর মধ্যে mRNA এর প্রধান ভূমিকাটি হল কোষে প্রোটিন সংশ্লেষ নিয়ন্ত্রণের জন্য DNA -র নির্দেশ নিউক্লিয়াস থেকে রাইবোজোম পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসা। rRNA আর tRNA তারপর সেই নির্দেশ অনুযায়ী DNA নির্দেশিত প্রোটিনটি তৈরী করে।
কোষের মধ্যে যখন কোন প্রোটিন তৈরী করার দরকার পরে তখন জিনের মধ্যে সেই প্রোটিনের কোডটি ‘সক্রিয়’ হয়ে ওঠে। অর্থাৎ তখন RNA পলিমার তৈরীর এনজাইম এসে DNA-র প্রোটিন সিকোয়েন্সের প্রতিলিপিটি RNA -তে তৈরী করে। এই প্রিতিলিপিত RNA টিই মেসেঞ্জার RNA বা mRNA । RNA -র এই প্রতিলিপিতে DNA-র সিকোয়েন্সের একই তথ্য থাকে, যদিও mRNA অণুতে T বেসগুলি U বেস দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনও DNA কোডিং স্ট্র্যান্ডের সিকোয়েন্স AATACGC থাকে তবে সংশ্লিষ্ট mRNA-র অনুক্রম হয়ে যায় AAUACGC। এই পদ্ধতির নাম ‘ট্রান্সক্রিপশন’ ।
একবার mRNA তৈরী হয়ে গেলে, এটি নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে এসে রাইবোজোমের সাথে যুক্ত হয়। রাইবোজোম তখন mRNA -র সংকেত অনুযায়ী অ্যামিনো অ্যাসিড জুড়ে জুড়ে প্রয়োজনীয় প্রোটিনটি তৈরী করতে পারে। রাইবোজোম mRNA -র সিকোয়েন্সটি নিয়ে তিনটে নিউক্লিওটাইডের এক একটা গ্রুপ তৈরী করে। এই গ্রুপ গুলোর নামই ‘কোডন’ । প্রতিটি tRNA এরপর একেকটি কোডন অনুযায়ী অ্যামিনো অ্যাসিড একটার সঙ্গে আর একটা জুড়ে দিতে থাকে, যতক্ষণ না পর্যন্ত জিন নির্দেশিত প্রোটিনটি তৈরী হয়। এই পুরো পদ্ধতিটির নাম ট্রান্সলেশন।
সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ট্রান্সক্রিপশন পদ্ধতিতে প্রথমে জিন থেকে প্রোটিনের কোড কপি করে নেয় mRNA । আর তার পর রাইবোজোম mRNA থেকে সেই কোডটি পড়ে tRNA-র সাহায্যে ট্রান্সলেশন পদ্ধতিতে প্রোটিনটি তৈরী করে। প্রোটিন সংশ্লেষ নিয়ে আরো জানতে এই ভিডিও টা দেখ [2].
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
প্রযোজনীয় তথ্য দিয়ে সাহায্য করার জন্য লেখক ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির ডঃ অর্ণব রুদ্রের কাছে কৃতজ্ঞ।
Cover image collage: Bijaybrata Jyoti
তথ্যসূত্র
[1] The Journal. – The Creator of the Record-Setting Covid Vaccine
[2]https://www.youtube.com/watch?v=oefAI2x2CQM
[3] https://www.ft.com/content/6633221e-3b28-4a15-b02d-958854644c79
[4] The story of mRNA: From a loose idea to a tool that may help curb Covid
[3] Sahin, Ugur, Katalin Karikó, and Özlem Türeci. “mRNA-based therapeutics—developing a new class of drugs.” Nature reviews Drug discovery 13.10 (2014): 759-780.
[4] Dolgin, Elie. “Unlocking the potential of vaccines built on messenger RNA.” Nature 574.7778 (2019): S10-S12.
[5] Karikó, Katalin, et al. “Suppression of RNA recognition by Toll-like receptors: the impact of nucleoside modification and the evolutionary origin of RNA.” Immunity 23.2 (2005): 165-175.
[6] Allen, Theresa M., and Pieter R. Cullis. “Drug delivery systems: entering the mainstream.” Science 303.5665 (2004): 1818-1822.
[7] The story of mRNA: From a loose idea to a tool that may help curb Covid
[8]How do mRNA coronavirus vaccines work? Science with Sam explains, New Scientist.
[9] Ball, Philip. “The lightning-fast quest for COVID vaccines-and what it means for other diseases.” Nature 589, 16-18 (2021).
[10] https://www.youtube.com/watch?v=KMc3vL_MIeo&feature=youtu.be
[11] https://www.nytimes.com/interactive/2020/health/oxford-astrazeneca-covid-19-vaccine.html
[12] https://bigyan.org.in/2020/12/04/usefulness-limitations-of-corona-vaccine/
[13] Krammer, Florian. “SARS-CoV-2 vaccines in development.” Nature 586.7830 (2020): 516-527.
[14] https://www.bbc.com/news/health-55040635