গত পর্বে দেখেছি আমাদের প্রচলিত কম্পিউটারের মধ্যে ট্রানজিস্টারগুলো ছোটো করতে করতে এখন এমন পর্যায়ে এসেছে যে আর ছোটো করা প্রায় অসম্ভব। খুব ছোটো সার্কিটের ধারকত্ব বা capacitance-এর সমস্যার জন্য কম্পিউটারকে আরও গতিশীল করাও বিশাল সমস্যা। মুশকিল আসান করতে পারে আলো দিয়ে তৈরী সার্কিট! আলোক-কণা বা ফোটনের ভর নেই। এরা একে অপরকে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ করে না। সুতরাং, ফোটনের ধারকত্ব সমস্যাও নেই। ফোটনিক্সের মাধ্যমে তাই ইলেকট্রনিক্সের থেকে অনেক বেশী ব্যান্ডউইথের আদান প্রদান করা যায় আর অনেক দ্রুত কম্পিউটারও বানানো যেতে পারে। এই পর্বে ফোটনিক্সের ইতিহাস, সম্ভাবনা ও অন্তরায় নিয়ে জানব। আর, জানব এই গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানচর্চায় ভারতীয় বিজ্ঞানীদের অবদান কী?
ফোটোনিক্সের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস [১-৪]
ফোটোনিক্সের সূচনা ঠিক কবে এবং কোথায় তা বলা খুব শক্ত। ১৮৬৫ সালে ম্যাক্সওয়েলের ইলেকট্রোম্যাগনেটিক সূত্র-প্রকাশ, ১৯০০ সালে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ সংক্রান্ত কোয়ান্টাম থিয়োরির প্রবর্তন নাকি ১৯০৫ এ আইনস্টাইনের ফোটো-ইলেকট্রিক এফেক্ট আবিষ্কার, কোন ঘটনাটাকে ফোটোনিক্স-এর সূচনা বলা যায়, তা তর্কসাপেক্ষ।
তবে ১৯৬০-এ থিয়োডর মেইম্যান-এর সেমিকন্ডাক্টিং লেসার আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে ফোটোনিক্সের মূল ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। অবশ্য ঘরে ঘরে ফোটোনিক-টেকনোলজি প্রথম পোঁছায় বিজ্ঞানী নরীন্দর সিংহ কাপানী এবং চার্লস কাও-এর যুগান্তকারী আবিষ্কার, অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে। তবে এই প্রযুক্তিটা তো কম্যুনিকেশন বা যোগাযোগব্যবস্থার জগতে। কারেন্টের বদলে আলো ব্যবহার করে কম্পিউটারে ইলেকট্রনিক চিপের বদলে ফোটনিক চিপ, এই ধারণার প্রণয়ন খুব বেশীদিন আগেকার নয়, বড়জোর বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে। বলা চলে তারপর থেকেই ইলেকট্রনিক বা সিলিকন ইন্ডাস্ট্রির অগ্রগতিকে ফোটোনিক ইন্ডাস্ট্রি ছায়ার মতন অনুসরণ করে চলেছে কারণ ফোটোনিক ডিভাইস এবং ইলেকট্রনিক ডিভাইস উভয়েই মূলত একই টেকনোলজির (CMOS টেকনোলজি) মাধ্যমে বানানো হয়ে থাকে। একবিংশ শতাব্দীর সূচনায় গ্রাফিনের আবিষ্কার, লিথোগ্রাফি, ন্যানোটেকনোলজি এবং ত্রিমাত্রিক (3D) ন্যানো-প্রিন্টিং টেকনোলজির (চিত্র ১) সমূহ অগ্রগতি ফোটোনিক টেকনোলজিকে এক অনন্য মাত্রা দিতে চলেছে [৫, ৬]।
সম্ভাবনা এবং অন্তরায়
আগেই বলেছি, ফোটন ভরহীন, আধানবিহীন এক ধরণের বোসন কণা। তাই দুটো ফোটনকণা একে অপরকে সাধারণভাবে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ করে না। অর্থাৎ, তাদের মধ্যে কোনোরকম আন্তঃক্রিয়া (interaction) হয়না। আবার অন্য কণা বা বল দ্বারাও সহজে এদের প্রভাবিত করা যায় না।
এর সুবিধা অনেক। প্রথমত, ধারকত্বের সমস্যা এই জন্যেই আলোর ক্ষেত্রে খাটে না। আলোককণাকে ধরে রাখবে কীভাবে? দ্বিতীয়ত, একই কারণে ফাইবার অপটিক্কম্যুনিকেশন লিঙ্কে অনভিপ্রেত নয়েজ ইলেকট্রনিক কম্যুনিকেশন লিঙ্কের থেকে অনেক কম। ফাইবার লিঙ্কের স্পিডও বেশী। আজকের যুগের ইন্টারনেট পরিষেবা পুরোপুরি ফাইবার অপটিক্সের উপর নির্ভরশীল এবং ইন্টারনেট হাব থেকে তথ্য আলোয় এনকোড করে সমুদ্রের তলায় বিস্তৃত অপটিক্যাল ফাইবারের সাহায্যে ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় (চিত্র ২)।
কিন্তু ফোটনকণারা নিজেদের মধ্যে আন্তঃক্রিয়া করে না – এই ঘটনার অসুবিধাও বিস্তর। সহজে প্রভাবিত হয়না বলে ফোটনকে নিয়ন্ত্রণ করাও যে সহজ নয়। দেখা গেছে পুরো সার্কিটটাই অপটিক্যাল করা গেলে তার স্পিড প্রায় ১০০ টেরা- হার্ৎজ অবধিও হতে পারে [১০, ১১]। কিন্তু ‘অল্ অপটিক্যাল কন্ট্রোল’ এখনও খুব প্রাথমিক পর্যায়ে।
অগত্যা ইলেকট্রনিক স্যুইচ ব্যবহার করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফোটনকে কন্ট্রোল করা হয়, অথবা সার্কিটের শুধুমাত্র বিশেষ কিছু অংশ যেগুলি খুব মন্থর সেসব জায়গায় ফোটোনিক সার্কিট ব্যবহার করা হয়। আজকের কম্পিউটারের প্রসেসর স্পিড বাড়ানো গেলেও ইন্টারকানেক্ট অর্থাৎ ইলেক্ট্রনিক তারগুলোতে কারেন্ট ধারকত্বের কারণে খুব ধীরে যাতায়াত করে। তাই একে বলে ‘ইন্টারকানেক্ট বটল্-নেক’ (চিত্র ৩ (ক)) [১২]।
এই সমস্যার সমাধানে তাই প্রাথমিকভাবে কম্পিউটারে শুধু ইলেকট্রনিক ইন্টারকানেক্ট-গুলোকে ফোটোনিক ইন্টারকানেক্ট দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার কথা ভাবা হচ্ছে। ফলত, গোটা সার্কিটের সর্বোচ্চ স্পিড সেই ইলেকট্রনিক প্রসেসরের সর্বোচ্চ স্পিড দ্বারা নির্ধারিত হয়, যা কিনা তুলনায় কম। তবু এটাও একটা বিশাল পদক্ষেপ। একে বলে ‘ইলেকট্রনিক-ফোটোনিক হাইব্রিড টেকনোলজি’। কম্পিউটার চলবে আধা আলোয়, আধা কারেন্ট-এ। এই ধরণের প্রযুক্তিতে তথ্যের আদানপ্রদান কারেন্ট থেকে আলোয় রূপান্তরিত করে ইলেকট্রো-অপটিক্মড্যুলেটর। সুইচ/অপটিক্যাল-ট্রানজিস্টার, বা মড্যুলেটর হিসাবে ছোটো ছোটো লাইট ইন্টারফেরোমিটার বা রেসোনেটর (অনুনাদক) যেমন, ম্যাক-জ়েন্ডার ইন্টারফেরোমিটার, মাইক্রোরিং রেসোনেটর ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় (চিত্র ৩ (খ)-(গ))। চিত্র ৩ (গ)-তে ফোটোনিক চিপের উপর একটা রিং দেখা যাচ্ছে। রিঙটিতে যতক্ষণ বাইরে থেকে ৫ ভোল্ট (ডেটা ‘১’) দেওয়া হয় ততক্ষণ রেসোনেন্স হয় না। ফলে লেসার রশ্মি সটান গিয়ে আউটপুট পোর্ট থেকে নির্গত হয়। আবার, তামার তারে কোনো ভোল্টেজ বা ডেটা না দিলে রিং-এ রেসোনেন্স হয় ফলে লেসার রশ্মি রিং এর মধ্যে আবদ্ধ হয়ে ঘুরতে থাকে। অতএব আউটপুট ‘০’ হয়। সুতরাং এইভাবে খুব সহজেই অপটিক্যাল সুইচ বানানো যায় [১১]।
তবুও ভবিষ্যত উজ্জ্বলঃ কোয়ান্টাম কম্পিউটার, নিউরাল নেটওয়ার্ক এবং ফোটোনিক্স
বিশ্ববরেণ্য নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ফাইনম্যান নব্বই এর দশকে দেখান, পদার্থের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণু-পরমাণু যে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অদ্ভূতুড়ে নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ, সেই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের শক্তিকে আহরণ করে অর্থাৎ কোয়ান্টাম টেকনোলজির মাধ্যমে বানানো যায় অসীম ক্ষমতাশালী কোয়ান্টাম কম্পিউটার এবং কোয়ান্টাম ইন্টারনেট। আজকের যুগের সাধারণ (ক্লাসিকাল) ইলেকট্রনিক কম্পিউটার যে কোনো পাসওয়ার্ড বা কোড হ্যাক করতে যদি লক্ষ-কোটি বছর সময় নেয়, কোয়ান্টাম কম্পিউটার সেই কাজ করতে পারবে নিমেষে। এছাড়াও কোয়ান্টাম কম্যুনিকেশন লিঙ্ক হবে সম্পূর্ণ হ্যাক-প্রুফ। অতএব কোনো দেশ যদি এই কোয়ান্টাম প্রযুক্তি গোপনে কুক্ষিগত করে ফেলে, বাকি দেশগুলোর জাতীয় সুরক্ষার পক্ষে তা অত্যন্ত চিন্তার বিষয়। সেই দেশ চাইলেই নিজে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত থেকে মেঘনাদের মতন দূর্ভেদ্য মেঘের আড়াল থেকে আক্রমণ শানিয়ে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে অন্য দেশের স্বাভাবিক জনজীবন। এ যেন এক ঢিলে দুই-পাখি।
এতদিন সুপারকন্ডাক্টিং পদার্থ ব্যবহার করে কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানানো খুব সম্ভাবনাময় মনে হয়েছিল। গুগলের সিকামোর প্রসেসর-এর কথা নিশ্চয় শুনেছেন। এই প্রসেসর কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানানোর লক্ষ্যে এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। সমস্যা হল, এই ধরণের সুপারকন্ডাক্টিং পদার্থ দিয়ে তৈরী প্রসেসর শুধু অতিশীতল উষ্ণতায় কাজ করে, অতএব একেবারেই সাধারণ মানুষের ব্যবহারোপযোগী নয়। বিজ্ঞানীরা তাই মূলত তিনটি কারণে কোয়ান্টাম কম্পিউটার বা কোয়ান্টাম কম্যুনিকেশন লিঙ্ক তৈরী করতে ফোটোনিক টেকনোলজি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করার কথা ভাবতে শুরু করেছিলেন [৭, ৮]। তা হোলোঃ (১) ফোটনের উপর নয়েজের প্রভাব সীমিত, (২) নয়েজের প্রভাব কম বলে, অতিশীতল উষ্ণতা নিষ্প্রয়োজন, ঘরের তাপমাত্রাতেই (২৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড) কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানানো সম্ভব, (৩) উন্নত মানের ফোটোনিক সার্কিট বাজারে এসে গেছে যা কোয়ান্টাম প্রযুক্তিতে সরাসরি ব্যবহার করা যেতে পারে। খুব সম্প্রতি গুগলের সিকামোর প্রসেসরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে পারে এরকম ‘কোয়ান্টাম ফোটোনিক প্রসেসর’-ও এসে গেছে বলে শোনা যাচ্ছে [৯]।
এদিকে আজকের যুগের কম্পিউটার নিজে থেকে ভেবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ। আমরা যা নির্দেশ দিই, তা-ই পালন করে মাত্র। এর নিজস্ব কোনো বুদ্ধি নেই। গবেষণা চলছে এমন এক ধরণের বিচক্ষণ কম্পিউটার বানানোর যা মানুষের মতন নিজে থেকে ভাবতে সক্ষম। মানুষের ব্রেন এর মতন করে বানানো হচ্ছে এদের প্রসেসর। এইসব কম্পিউটারের সার্কিটে থাকবে ব্রেনের স্নায়ুকোষ বা নিউরোন সদৃশ কোটি কোটি কানেকশন কিম্বা নিউরাল নেটওয়ার্ক। এই সার্কিটগুলো কম্পিউটারকে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নানা ইনপুট দিলে কী আউটপুট অথবা ফলাফল আসবে তার গুণাগুণ বিচার করে ভাবতে শেখাবে কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল [১৩]! ইলেকট্রনিক সার্কিটের থেকে ফোটোনিক সার্কিটে শক্তির অপচয় অনেক কম বলে এই ধরণের নিউরো-মর্ফিক কম্পিউটার পরিচালনার জন্য যে ফোটোনিক টেকনোলজি ব্যবহার করা হবে তা সহজেই অনুমেয়। তাই ‘deep learning’ বা ‘machine learning’-এর ভবিষ্যতও হয়তো ফোটোনিক্সেই নিহিত।
ফোটোনিক্সের অন্যান্য ব্যবহারঃ চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং গ্রীন ম্যুভমেন্ট
ফোটোনিক্স যে শুধুমাত্র কম্পিউটার তৈরী করার কাজে বা যোগাযোগ ব্যবস্থাতে ব্যবহৃত হয় তা নয়। চোখের চিকিৎসা থেকে বিভিন্ন রোগ যেমন ক্যান্সার নির্ণয়ে এর ভূমিকা আছে। এছাড়াও ফোটোনিক সেন্সর এতটাই সূক্ষ্ম পরিমাপ করার ক্ষমতা রাখে যে রক্তে ক্ষতিকারক অতিক্ষুদ্র ব্যাক্টেরিয়া বা ভাইরাসের উপস্থিতি পর্যন্ত শনাক্ত করতে পারে [১৪]। সুতরাং কোভিড-১৯ পরবর্তী দুনিয়ায় ফোটোনিক সেন্সর বহুলব্যবহৃত হতে চলেছে। উন্নতমানের সোলার সেল তৈরী করতেও আজকাল ফোটোনিক সার্কিট ব্যবহার করা হচ্ছে যা দূষণমুক্ত সবুজ পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় [১৫]।
বিশ্বে এবং ভারতে ফোটোনিক্স
নতুন যুগের কম্পিউটারে ইলেকট্রনিক্সের বদলে ফোটোনিক্স আসতে চলেছে অনুধাবন করে বড় বড় কোম্পানিগুলি যেমন ইন্টেল, আই. বি. এম., অ্যাপল ইত্যাদি কয়েক দশক ধরেই পুরোদমে ফোটোনিক্সের গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছে। এছাড়াও আছে থোরল্যাবস, নিউপোর্ট, মেনলো, ফিনিসার, নেভিটার, লাইকা যারা লেসার, অপটিক্যাল বেঞ্চ, অপটিক্যাল লেন্স, মাইক্রোস্কোপ, আল্ট্রা-স্পিড ক্যামেরা, এবং ফিল্টার বানায়। টেলিকম্যুনিকেশনে অগ্রগণ্য কোম্পানি যেমন সিস্কো, বা জাপানের এন টি টি কম্যুনিকেশনস ফাইবার অপটিক্ টেকনোলজি সংক্রান্ত গবেষণায় অনেক অর্থ বরাদ্দ করছে। এরই সঙ্গে আবার বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে বিশ্বজুড়ে ছোটো-বড় আরও প্রায় কয়েকশ কোম্পানি (লিস্ট আমার ওয়েবসাইটে প্রদত্ত [১৬]) কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে।
ইন্ডাস্ট্রির পাশাপাশি আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড, জার্মানী, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, চিন, জাপান, তাইওয়ান, সাউথ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি যেকোনো উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়েই এখন ফোটোনিক্স নিয়মিত কোর্স এবং গবেষণার অন্তঃর্ভূক্ত। ভারতে প্রথমসারির গবেষণাকেন্দ্র যেমন আইসার (IISER), নাইসার (NISER), টি. আই. এফ. আর. (TIFR), রমন রিসার্চ ইন্সটিটিউট (RRI), সি. এস. আই. আর. (CSIR) (CGCRI – কেন্দ্রীয় কাঁচ ও সেরামিক গবেষণা সংস্থা) বসু বিজ্ঞান মন্দির, হরিশ চন্দ্র রিসার্চ ইন্সটিটিউট (HRI) এবং প্রযুক্তিকেন্দ্র যেমন আই. আই. টি. (IIT), বা এন. আই. টি. (NIT) গুলোতেও বর্তমানে ফোটোনিক্স নিয়ে রিসার্চ করার সুযোগ হয়েছে [১৭]। সঙ্গে রয়েছে কিছু ননপ্রফিট অরগ্যানাইজেশন যেমন Optical Society of America (OSA), IEEE, SPIE, Optical Society of India (OSI), American Physical Society (APS) ইত্যাদি যারা প্রতিবছর পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন সেমিনার, কনফারেন্স বা অন্যান্য মনোগ্রাহী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের ফোটোনিক্স নিয়ে গবেষণার কাজে প্রবল উৎসাহ প্রদান করে চলেছে [১৮-২০]।
ভারতীয় বিজ্ঞানী এবং ফোটোনিক্স
আলোকবিজ্ঞানে এবং ফোটোনিক্সে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের অবদান উল্লেখ না করলে ‘ভারতে ফোটোনিক্স’ নিয়ে আলোচনাটি অসম্পূর্ণই থেকে যায় (চিত্র ৪)। ভারতীয় বিজ্ঞানী সি. ভি. রামন যেমন রামন-এফেক্ট আবিষ্কার করে ১৯৩০ সালে নোবেল-প্রাইজ পান। বাঙালী বিজ্ঞানী সত্যেন বসু আইন্স্টাইনের সঙ্গে যুগ্মভাবে বোসন কণার ধর্ম সর্বপ্রথম ব্যাখ্যা করেন। ফোটন কণিকা একপ্রকার বোসন কণিকা।
এছাড়াও বিজ্ঞানী নরীন্দর সিংহ কাপানীকে ফাইবার অপটিক্সের জনক বলে আখ্যা দেওয়া হয়। প্রফেসর ই. সি. জি. সুদর্শনের আবার কোয়ান্টাম অপটিক্সে অবদান অনস্বীকার্য। এছাড়াও আছেন মণি ভৌমিক (লাসিক eye-অপারেশন), বিজ্ঞানী অজয় ঘটক (ফাইবার অপটিক্স), দিলীপ ভাওলকর (লেসার অপটিক্স), চন্দ্র কুমার পটেল (কার্বন-ডাই-অক্সাইড লেসারের আবিষ্কার), প্রফেসর বিশ্বনাথ মুখার্জি, ও প্রফেসর অনুরাগ শর্মা (অপটিক্যাল কম্যুনিকেশন এবং নেটওয়ার্কিং), গোবিন্দ আগ্রাওয়াল (নন্লিনিয়ার অপটিক্স), গিরীশ আগরওয়াল এবং রূপমঞ্জরী ঘোষ (কোয়ান্টাম অপটিক্স), প্রমুখ। এদের ভূমিকা আলোকবিজ্ঞানের জগতে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আরও কিছু তথ্যঃ গত বিশ বছরে ফোটোনিক্স সংক্রান্ত গবেষণায় নোবেল প্রাইজের পরিসংখ্যান
পরাধীন ভারতবর্ষের অবিস্মরণীয় এবং দুর্লভ প্রতিভা আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু বা পরবর্তীকালে নরীন্দর সিংহ কাপানী, এবং ই. সি. জি. সুদর্শন কেন নোবেল প্রাইজ পেলেন না সে বিতর্কে আজ যাব না। তবে সবশেষে পরিবেশন করবো এক মজার তথ্য [২১]। পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল প্রাইজ পেতে চাইলে কিন্তু ফোটোনিক্স নিয়ে গবেষণার পথ বেছে নেওয়াই সর্বোৎকৃষ্ট উপায়! অন্তত গত কুড়ি বছরের পরিসংখ্যান তো তাই বলে।
২০১৮ তে আল্ট্রা-ফাস্ট লেসারের আবিষ্কার করার জন্য নোবেল পান ডনা স্ট্রিকল্যান্ড এবং অন্যান্যরা। ২০১৪ তে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় কয়েক দশক আগে আবিষ্কৃত নীল LED এর জন্য। এছাড়া ২০০৯ তে ফাইবার অপ্টিক টেকনোলজিতে (বিজ্ঞানী চার্লস কাও) এবং সিসিডি ফোটো সেন্সর আবিষ্কার করে (বয়েল ও স্মিথ), ২০০৫ এ কোয়ান্টাম অপটিক্সে (গ্লবার), অপটিক্যাল ফ্রিকোয়েন্সি কম্ব (প্রফেসর থিয়োডর হ্যন্স, জন হল), এবং ২০০০ সালে অপ্টো-ইলেকট্রনিক সার্কিট সংক্রান্ত গবেষণায় নোবেল প্রাইজ আসে। আরও চিত্তাকর্ষক ব্যাপার হলো বাকি নোবেল বিজয়ীরাও কোনো না কোনো ভাবে ফোটোনিক্সের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। যেমন ধরুন, লেসার কুলিং-এর সাহায্যে পরমাণুকে অতিশীতল তাপমাত্রায় বন্দি করে ফেলার উপায় বাতলে নোবেল পান বিখ্যাত বিজ্ঞানী এবং লেখক ক্লুড-কোহ্ন-তনুডজি (Claude Cohen-Tannoudji) (উল্লেখ্য যে ওনার লেখা কোয়ান্টামের পাঠ্যবইটি বিখ্যাত), উইলিয়াম ফিলিপ্স, স্টিভেন চু (১৯৯৭), এবং উলফ্গ্যাং কেটারলী, এরিক কর্নেল, ও কার্ল ওয়াইম্যান (২০০১)। ২০১২ সালে ডেভিড ওয়াইনল্যান্ড আর সার্জ হারোশ নোবেল পুরস্কার পান যথাক্রমে লেজার দিয়ে পরমাণুকে এবং পরমাণু দিয়ে ফোটনকে প্রভাবিত করার পদ্ধতি আবিষ্কার করে। এমনকি ২০১৭-তে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আবিষ্কারের জন্য নোবেল আসে কিন্তু লেসার সেন্সিং টেকনোলজির উপর ভরসা রেখেই। আবার ২০১০ সালে আন্দ্রে গিম গ্রাফিন আবিষ্কার করেন যা ফোটোনিক টেকনোলজিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে।
সুতরাং প্রযুক্তির জগতে বিপ্লব আনতে চলেছে ফোটোনিক্স। বলা যেতেই পারে যে ইলেকট্রনিক যুগের জয়যাত্রা ব্যাহত হওয়া অবশ্যম্ভবী এবং নতুন যুগের আলোকবর্তিকা আলোকবিজ্ঞানের হাতেই।
শিরোনামের ছবি – অপটিক্যাল ফাইবার। উৎস – https://www.pxfuel.com/en/free-photo-oozao
সূত্র (References):
[১] https://www.osa.org/en-us/history/milestones/centennial_book/
[২] https://www.light2015.org/Home/WhyLightMatters/Connecting-the-World.html
[৩] https://www.technologist.eu/a-brief-history-of-photonics/
[৪] https://www.photonics.com/LinearChart.aspx?ChartID=3
[৫] https://www.nanoscribe.com/en/
[৬] S. Bag, R. Haldar, M. Wan, S. K. Varshney, “Fabrication and Performance Analysis of Mach-Zehnder Interferomter Couplerd Polymer Microring Resonator with Microfluidic Channel for Refractive-index Sensing,” Frontiers in Optics and Laser Science (FiO/LS), Washington DC, USA, Paper ID: FW6C.3.
[৭] J. L. O’brien, A. Furusawa, and J. Vučković, “Photonic quantum technologies,” Nature Photonics, vol. 3, no. 12, pp. 687-695, 2009.
[৮] J. Carolan et al., “Universal linear optics,” Science, vol. 349, no. 6249, pp. 711-716, 2015.
[৯] Han-Sen Zhong et al., “Quantum computational advantage using photonics,” Science , recently published on December 3, 2020 (সদ্য প্রকাশিত).
[১০] R. G. H. van Uden et al., “Ultra-high density spatial division multiplexing with a few-mode multicore fiber,” Nature Photonics, vol. 8, pp. 865-870, 2014.
[১১] Q. Xu and M. Lipson, “All-optical logic based on silicon micro-ring resonators,” Opt. Express, vol. 15, no. 3, pp. 924-929, 2007.
[১২] A. Alduino and M. Paniccia, “Interconnects: Wiring electronics with light,” Nature Photonics, vol. 1, no. 3, pp. 153-155, 2007.
[১৩] P. R. Prucnal, and B. J. Shastri, Neuromorphic Photonics, CRC Press, 2017.
[১৪] F. Vollmer, S. Arnold, and D. Keng, “Single virus detection from the reactive shift of a whispering-gallery mode,” Proceedings of National Academy of Sciences, vol. 105, no. 52, pp. 20701-20704, 2008.
[১৫] M. L. Brongersma, Y. Cui, S. Fan, “Light management for photovoltaics using high-index nanostructures,” Nature Materials, vol. 13, no. 5, pp. 451-460, 2014.
[১৬] https://sites.google.com/view/raktim-haldar/resources/photonic-industries?authuser=0
[১৭] B. Pal, “Photonics in India,” Nature Photonics, vol. 5, no 8, pp. 440-443, 2011.
[১৮] https://www.photonicssociety.org/.
[১৯] https://www.osa.org/en-us/home/.
[২০] https://physics.aps.org/ [২১] https://www.osa.org/en-us/about_osa/osa_nobel_laureates/