-১-
নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র আমাদের বলে কোনো একটা বস্তুর (আরেকটি বস্তুর ওপর) মহাকর্ষ বল তাদের দূরত্ব -এর বর্গের ব্যাস্তানুপাতিক:
অর্থাৎ দূরত্ব যত বাড়ে, বল তত কমতে থাকে, কিন্তু কখনোই শূন্য হয়ে যায় না। তা সত্ত্বেও পাঠ্যবইয়ে অনেক সময় লেখা থাকে যে একটা নির্দিষ্ট দূরত্বের পর এই বলের মান এতটাই কমে যায় যে তাকে শূন্য ধরা যায়। কিন্তু ওই নির্দিষ্ট দূরত্বটা ঠিক কত? মহাকর্ষ বল ঠিক যতটা কম হলে তাকে শূন্য ধরা যায় তারও কি একটা নির্দিষ্ট মান আছে? এই প্রবন্ধে একটা ছোট্ট পরীক্ষা আর কিছু সহজ গণনার দ্বারা আমরা এই প্রশ্নগুলো অনুসন্ধান করার চেষ্টা করবো।
শুরু করার আগে প্রশ্নটা আরেকবার বলি: কতটা দূরত্বে গেলে মহাকর্ষ বলকে শূন্য ধরা যায়? এই প্রশ্নটা যদি কেউ করে, তাকে প্রথমে পাল্টা প্রশ্ন করতে হবে: বাপু তুমি কি করছো যার জন্য মহাকর্ষ বলকে ধরা না ধরার প্রশ্ন আসছে? কিসের অঙ্ক করছো? এটা জানা জরুরি কারণ পৃথিবীর চারিদিকে চাঁদের গতিবিধি আর বৃহস্পতির চারিদিকে তার উপগ্রহ ইউরোপা-র গতিবিধি, এই দুটো অঙ্ক কষতে গেলে অবশ্যই আলাদা জিনিস ধরতে হবে।
ধরা যাক, আমি আপাতত পৃথিবী নিয়েই ভাবছি আর একটা খুব সহজ অঙ্ক কষছি। দাঁড়ানো অবস্থায় একটা কমলালেবু আমার মাথার কাছে নিয়ে এসে ছেড়ে দিলাম। লেবুটা মাটিতে পড়তে কতটা সময় নেবে? এই অঙ্কটা কষতে গেলে পৃথিবীর মহাকর্ষকে অবশ্যই ধরতে হবে। প্রশ্ন হলো, চাঁদের মহাকর্ষও ধরতে হবে কি? সেই তদন্তটাই করা যাক।
লেবুটা মাটিতে পড়তে কতটা সময় নেবে, এই প্রশ্নের উত্তর দুভাবে দেওয়া যায়। প্রথমতঃ আমি বাবাকে বলতে পারি স্মার্টফোনের ক্যামেরায় আমার লেবু ফেলার একটা ভিডিও তুলতে। তারপর একটা ভিডিও প্লেয়ার অ্যাপ (যেমন VLC) ব্যবহার করে ভিডিও ফাইলটার যে ফ্রেমে লেবু হাত থেকে ছাড়া পেলো আর যে ফ্রেমে লেবু মাটি স্পর্শ করলো তাদের মধ্যে সময়ের ব্যবধান মেপে ফেলতে পারি। এই দ্বিতীয় ধাপটা আমি নিজে যেভাবে করেছিলাম তার বিস্তারিত বিবরণ লেখার নিচে দেখো। (আরেকটা ছোট্ট কথা এই ফাঁকে বলে রাখি। ধরে নিচ্ছি এই সময়ের ব্যবধানটা আমরা মাপতে পারলাম সেকেন্ডের এক দশমিক স্থান পর্যন্ত। এটা কেন গুরুত্বপূর্ণ একটু পর বোঝা যাবে।)
দ্বিতীয়তঃ আমি নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র আর দ্বিতীয় গতিসূত্র ব্যবহার করে সময়টা কষে বার করার চেষ্টা করতে পারি। ঠিকমতো করতে পারলে দুটোর মান সমান হওয়া উচিত, তাই তো? আপাততঃ বাবা রান্নাঘরে, তাই আমরা অঙ্কটা কষার চেষ্টা করি। পৃথিবী লেবুকে অভিকর্ষ বলের দ্বারা নিচের দিকে টানছে, তাই সে নিচে পড়ে। ধরি, লেবুর ভর , পৃথিবীর ভর , এবং পৃথিবীর ব্যাসার্ধ । তাহলে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র অনুযায়ী এই বলের পরিমাণ:
বলের পরিমাণ যখন জানা গেলো, আমরা নিউটনের দ্বিতীয় গতিসূত্র ব্যবহার করে লেবুর ত্বরণ গণনা করতে পারি:
মজার ব্যাপার লক্ষ্য করো: ত্বরণ কিন্তু লেবুর ভর -এর ওপর নির্ভর-ই করে না! অর্থাৎ, লেবুই ফেলি কি ওষুধের বড়ি কি পাথরের চাঁই, এই ত্বরণের মান একই হওয়া উচিত। এই সমীকরণে সার্বজনীন মহাকর্ষ ধ্রুবক = 6.67 x 10-11 m3 kg-1 s2, = 5.97 x 1024 kg, এবং = 6.37 x 106 m বসিয়ে পাই:
আচ্ছা এখানে g-এর মান দশমিকের পর দুটো কি তিনটে স্থান পর্যন্ত গণনা করলাম না কেন? তার কারণ আমি এই ব্যবহার করে যে সময়টা কষে বার করব, সেটা বাবা আমায় যে সময়টা বলবে তার সাথে তুলনা করার জন্য দশমিকের পর একটা অঙ্কই যথেষ্ট। কারণ আগে বলেছি ভিডিও থেকে সময় বের করতে গিয়ে আমি সেকেন্ডের এক দশাংশ পর্যন্তই মাপতে পেরেছি। উদাহরণস্বরূপ, আমার গণনায় সময় যদি বেরোয় 0.78 s, তার 8 অংকটি আমার পরীক্ষার প্রসঙ্গে অর্থহীন। কারণ সেটা 8 না হয়ে 6 কি 7 হলেও ভিডিও থেকে সময় মাপার পদ্ধতিতে সেটা কতদূর সঠিক বুঝতে পারবো না। সুতরাং সেক্ষেত্রে দশমিক বিন্দুর পর প্রথম স্থান পর্যন্ত আসন্ন মান হিসেবে আমরা লিখতে পারি 0.78 s ≈ 0.8 s.
এবার এই ত্বরণের থেকে বার করতে হবে কতটা সময় লাগলো পড়তে। তবেই হাতে-কলমে পরীক্ষা থেকে মাপা সময়ের সাথে তুলনা করে দেখা যাবে মিলছে কিনা। ধরা যাক আমার উচ্চতা = 5 foot = 1.5 m, আর এই দূরত্ব অতিক্রম করতে লেবু সময় নেয়। তাহলে:
বাবার রান্না শেষ হলে লেবু ফেলার ভিডিও তুলে তার থেকে সময় মাপা হলো। মিলেও গেলো!
[বাবা, মা, মাসি, পিসি কাউকে একটা ধরে আর একটা স্মার্টফোন জোগাড় করে এই খেলাটা তোমরাও খেলতে পারো। খালি মনে রেখো যে উচ্চতা থেকে লেবু বা টেনিস বল বা ওষুধের বড়ি ফেলছো সেটাকে উপরের সমীকরণে -এর জায়গায় বসিয়ে -এর মান গণনা করে নিতে হবে।]
–২–
এবার প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশে আসা যাক। খালি পৃথিবী না, চাঁদও তো লেবুকে অভিকর্ষ বলে নিজের দিকে টানছিলো। আমাদের অঙ্কে সেই আকর্ষণ বল ধরতে হবে কি? হিসেব করে দেখা যাক চাঁদের আকর্ষণের জন্যে লেবুর ত্বরণ () কত হবে। আগের পরিচ্ছেদের গণনা এখানেও খাটবে। অর্থাৎ,
এক্ষেত্রে চাঁদের ভর এবং পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব .
প্রথমেই এর একটা নিখুঁত মান নির্ণয় না করে এটা দেখা যাক যে মোটের ওপর কি -এর তুলনায় খুব ছোট (), নাকি খুব বড়ো (), নাকি মোটামুটি ওরা একে ওপরের কাছাকাছি ()? [এই তিনটের কোনটা ঠিক আন্দাজ করতে পারো ?] চট করে একটা “মোটের-ওপর” গণনা করার জন্যে আমরা , , এবং এর সঠিক মানগুলোর জায়গায় তাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী 10 এর ঘাত ব্যবহার করতে পারি[1] :
এই মানগুলো সমীকরণে বসিয়ে পাই:
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে আমাদের এই ছোট্ট পরীক্ষার প্রসঙ্গে চাঁদ পৃথিবী থেকে এতটাই দূরে আছে যে তার অভিকর্ষকে শূন্য ভাবা যায়। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে যে এটা প্রসঙ্গনির্ভর সত্য। যদি আমার স্কুলে এমন কোনো যন্ত্র থাকে যা দশমিকের চতুর্থ স্থান পর্যন্ত t মাপতে পারে, তখন কিন্তু চাঁদের অভিকর্ষকে শূন্য ভাবা যাবে না! কারণ ওই এর তফাতও তখন ধরা পড়বে।
তাহলে দাঁড়ালো এই যে, কোন বস্তুটার মহাকর্ষ বল ধরবো আর কোনটাকে শূন্য বলে ধরে নেব, সেটা নির্ভর করছে কোন পরীক্ষার ফলাফলের সাথে অঙ্ক মেলাচ্ছি আর কতটা সূক্ষ্মভাবে সেই পরীক্ষাটা করা যাচ্ছে। যদি কোনো বস্তুর মহাকর্ষ ধরার জন্য উত্তরে এমন তফাৎ হয় যেটা আমার যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষাতে ধরাই পড়বে না, তাহলে সেই বস্তুর মহাকর্ষ ধরে লাভ নেই, পারতপক্ষে তাকে শূন্যই বলা চলে। যেমন, আমার অঙ্কটাতে স্টপওয়াচ যদি দশমিক সংখ্যা অব্দি মাপতে পারে, তখন লেবু ফেলার অঙ্কটাতে চাঁদের মহাকর্ষকে শূন্য বলা চলে।
তাই বলে, “নির্দিষ্ট দূরত্বের পর একটা বস্তুর মহাকর্ষ শূন্য হয়ে যায়”, এটা বলার কোনো মানে হয়না। বড়োজোর বলা যেতে পারে, “নির্দিষ্ট দূরত্বের পর একটা বস্তুর মহাকর্ষ থাকে ঠিকই কিন্তু সেটা ধরলে অঙ্কের উত্তরে যে তফাৎ হয়, সেটা যৎসামান্য। সেই যৎসামান্য তফাৎ যদি মাপতে না পারি আমার যন্ত্রে, তাহলে বস্তুটার মহাকর্ষ ধরে লাভ নেই।” অনেকসময় আলোচনার সুবিধের জন্য সহজ করে বলা হয় কিছু কথা। “মহাকর্ষ শূন্য হয়ে যায়” এই কথাটাও সেরকমভাবে বলা। কিন্তু এই সহজ করে বলার ফলে মাথায় একটা ভুল ধারণা রয়ে যেতে পারে যার ফলে ক্ষেত্রবিশেষে সমস্যা হতে পারে। যেমন, সূক্ষ্ম সময় মাপার যন্ত্র থাকলে চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ না ধরলে তখন কিন্তু সমস্যা হবে।
[1] এই ধরণের চটজলদি গণনা বিজ্ঞান গবেষণার একটা বড় হাতিয়ার। একে বিজ্ঞানীরা back-of-envalope calculation বা খামের উল্টোপিঠে গণনা বলে থাকেন।
ভিডিও ফাইল থেকে সময় কিভাবে মাপলাম
পরীক্ষাটা করতে আমি লেবুর বদলে টেনিস বল ব্যবহার করেছিলাম। তোমরা যেকোনো অভঙ্গুর বস্তুপিন্ড ব্যবহার করতে পারো।
- আমার বন্ধুকে বললাম তার স্মার্টফোনের ক্যামেরায় আমার বল ফেলার ভিডিও তুলতে। এটাও বলে দিলাম যে ভিডিওতে বলসমেত আমার হাত আর মাটির যেখানে বলটা পড়বে এই দুটোই যেন দেখা যায়। ভিডিও ফাইলটা উপরে দেখো। বলটা এখানে ৫ ফুট উচ্চতা থেকে ছাড়া হয়েছে। ভিডিও তোলার আগে এই উচ্চতাটা টেপ দিয়ে শুরুতে মেপে নিয়েছিলাম।
- ভিডিও ফাইলটা স্মার্টফোন থেকে আমার কম্পিউটারে ট্রান্সফার করলাম।
- কম্পিউটারে VLC প্লেয়ারে ভিডিওটা খুললাম।
- কিবোর্ডের E বোতাম টিপে টিপে VLC-তে খোলা ভিডিওটার একটা একটা করে ফ্রেম এগোনো যায়। এইভাবে ফ্রেম এগিয়ে এগিয়ে দেখলাম প্রথম এক সেকেন্ডে 30 টা ফ্রেম আছে। অর্থাৎ দুটো ফ্রেমের মধ্যে সময়ের ব্যবধান গড়ে 1/30 সেকেন্ড।
- বলটা আমার হাত থেকে যখন ছাড়া পেলো, সেইখান থেকে শুরু করে E বোতাম টিপে টিপে একেকটা করে ফ্রেম এগোলাম। গুণে গুণে 17 টা ফ্রেম এগোনোর পর বলটা মাটি ছুঁলো। তাহলে বলটা ফুট পড়তে সময় নিলো t = 17/30 সেকেন্ড = 0.6 সেকেন্ড।
আরেকটা জিনিস: পরীক্ষাটা একবার করলে নানা কারণে মাপের একটু ভুলচুক হতেই পারে। সেটা কাটাতে পরীক্ষাটা বেশ কয়েকবার করে সবকটা মানের গড় নেওয়া উচিত। এটা শুধু এই পরীক্ষা নয়, বিজ্ঞানের যেকোনো পরীক্ষার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।