পৃথিবীতে জীবন সৃষ্টি কিছু মহাজাগতিক অ্যাক্সিডেন্টের পরিণতি
আমরা হয়তো অনেকেই জানি না যে এই পৃথিবী তথা ব্রহ্মাণ্ডে জীবনের অস্তিত্বের মূলে রয়েছে কিছু মহাজাগতিক দুর্ঘটনা বা সমাপতন (coincidence)। এই ঘটনাগুলোর পরিণতিতে তৈরি হয়েছে একটা গোল্ডিলক্স স্থান যা জীবনের অস্তিত্বের জন্য একেবারে সঠিক। একটুও কম বা বেশি নয়।
যেমন, পৃথিবীর তাপমাত্রা সঠিক হওয়ার ফলে তৈরী হয়েছে জল নামক তরল এবং সার্বজনীন দ্রাবক যার মধ্যে ডিএনএ এবং অন্যান্য অণুদের বিক্রিয়ার ফলে তৈরি হয় জীবন। আবার পৃথিবীর সঠিক মাধ্যাকর্ষণ বলের কারণে ভূপৃষ্ঠে আটকে রয়েছে বায়ুমণ্ডল এবং এই বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন আর কার্বন ডাইঅক্সাইড-এর অনুপাত জীবনকে বজায় রাখার জন্য অনুকূল। এছাড়া বায়ুমণ্ডল উল্কা এবং ক্ষতিকারক রশ্মি থেকেও আমাদের রক্ষা করে।
চাঁদেরও কিন্তু একটা বিশেষ ভূমিকা আছে এই পৃথিবীকে স্থিতাবস্থায় রাখার এবং জীবনকে ধরে রাখার পিছনে। চাঁদ না থাকলে ২৪ ঘন্টার পরিবর্তে ৪ ঘন্টায় দিনরাত হতো। চাঁদের জন্য হয় জোয়ার ভাটা যা জীবমণ্ডলের বিবর্তনকে সাহায্য করে।
এছাড়া পৃথিবীর অক্ষ সামান্য হেলে আছে বলে জীবমণ্ডলে বৈচিত্র্য দেখা যায়। আমাদের সৌরজগৎ অবস্থিত আকাশগঙ্গা ছায়াপথের সর্পিল বাহুর সন্নিকটে, অর্থাৎ ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে। কেন্দ্রের কাছাকাছি অঞ্চলে তারা নক্ষত্রদের ভিড় বেশি এবং মহাজাগতিক রশ্মিও প্রচুর। সৌরজগৎ কেন্দ্র থেকে দূরে থাকার ফলে মহাজাগতিক সংঘর্ষ এবং রশ্মির থেকে সুরক্ষিত। তাই এই পৃথিবী লক্ষ লক্ষ বছর ধরে স্থিতাবস্থায় আছে এবং এখানে ডিএনএ সৃষ্টি ও বিবর্তনের সুযোগ হয়েছে।
পারমাণবিক বল কমবেশী হলে
এতো গেলো আমাদের পৃথিবীর কথা। দেখা যাক ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির নিরিখে কি কি মহাজাগতিক সমাপতন বা দুর্ঘটনা ঘটেছিলো যার কারণে এই ব্রহ্মাণ্ডে জীবনের অস্তিত্ব বর্তমান।
প্রোটন এবং নিউট্রনের কথাই ধরা যাক। যদি প্রোটনের ভর নিউট্রনের ভরের থেকে ১% বেশি হতো, তাহলে সব প্রোটন নিউট্রনে পরিবর্তিত হয়ে যেত। কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন তৈরী হতো না, তাদের দ্বারা গঠিত ডিএনএ-ও তৈরি হতোনা, পৃথিবীতে প্রাণেরও সৃষ্টি হতো না। প্রোটনের জীবনসময় যেহেতু খুব দীর্ঘ, ডিএনএ-ও তাই খুব স্থায়ী।
নিউক্লিয়ার বল (nuclear force) অত্যন্ত শক্তিশালী। সেই কারণে পরমাণু বিক্রিয়ার অন্তর্বর্তী ধাপে তৈরি হতে পারে 3He-র মতো পরমাণু। এই 3He পরমাণুর মাধ্যমেই শেষ পর্যন্ত তৈরি হয় অন্যান্য ভারী মৌলের পরমাণু যারা তৈরি করেছে তারা নক্ষত্রদের তথা এই পৃথিবীকে, যে পৃথিবীর ওপর তৈরি হয়েছে জীবন। পারমাণবিক বল যদি সামান্য কম হতো তাহলে কোনো 3He তৈরি হতো না। তৈরি হতো না অন্যান্য মৌলগুলিও, আসতো না কোনো তারা নক্ষত্রও। অন্যদিকে, পারমাণবিক বল যদি সামান্য বেশি হতো, তারাদের জ্বালানি তাড়াতাড়ি জ্বলে শেষ হয়ে যেত। বিবর্তন ঘটার সময় পেতোনা এবং জীবন সৃষ্টি হতোনা।
দুর্বল বল কমবেশী হলে
এবার দেখা যাক, জীবন সৃষ্টির পিছনে নিউক্লিয়াস এর দুর্বল বলের (weak force) ভূমিকা কি। নিউট্রন-প্রোটনের রূপান্তরের পিছনে এই দুর্বল বলটি কাজ করে। সৃষ্টির গোড়ায় নিউট্রন প্রোটনের অনুপাত নির্ভর করে এই দুর্বল বলের পরিমাণের ওপর। নিউট্রন-প্রোটনের অনুপাত ঠিক করে হাইড্রোজেন (p) এবং 4He এর পরিমাণ কতটা হবে। এবং হাইড্রোজেন ও 4He হচ্ছে অন্যান্য মৌল তৈরির মূল উপাদান। দুর্বল বলটি যদি সামান্য কম বা বেশি হতো, 4He এর উৎপাদন অন্যরকম হতো। ফলে জীবন সৃষ্টির মূল মৌল কার্বন-১২ (12C) তৈরি বিঘ্নিত হতো এবং এটা জীবন সৃষ্টির অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতো । যে পরিমাণ 12C এই ব্রহ্মাণ্ডে তৈরি হয়েছে তা জীবন সৃষ্টির জন্য একেবারে ঠিক ঠিক।
এইরকম অনেক মহাজাগতিক সমাপতন ঘটেছে। জীবন সৃষ্টির ভৌতিক ধ্রূবকগুলি (physical constants) খুবই সংকীর্ণ পরিসরের মধ্যে অবস্থান করে যার সামান্য কম বেশি হলে জীবন সৃষ্টিই হতোনা। এই গোল্ডিলক্স অবস্থানকে খুব সুন্দর উপমা দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী হাগ রোস, – ‘যেন ঝড় এসে একটা আবর্জনার স্তূপকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে তৈরি করলো একটা আস্ত নিখুঁত বোইং ৭৪৭ এরোপ্লেন’ ৷
নৃতাত্ত্বিক নীতি (anthropic principle)
12C নিউক্লিয়াসের শক্তিস্তর সম্পর্কে বিস্তারে যাবার আগে উপরে উল্লিখিত সমাপতনগুলির বিষয়ে একটু আলোচনা করা যাক৷ যে কোনো গবেষণা যদি জীবন বা জীবনের অস্তিত্বকে ঘিরে হয়, তাহলে সেটা একটা অন্য মাত্রা পায়৷
যুগ যুগ ধরে মানুষ এক রহস্যের উত্তর খুঁজছে – এই ব্রহ্মাণ্ডের কোটি কোটি সৌরজগতের মধ্যে এক কোণে অবস্থিত এই সাধারণ মাপের সৌরজগতে কি করে জীবন সৃষ্টি হল আর কিভাবেই বা হল মানুষের মত বিবেকসম্পন্ন বুদ্ধিমান জীব। সাধারণভাবে প্রশ্ন জাগে এই ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে মানুষের কি কোনো বিশেষ সম্পর্ক আছে অথবা ব্রহ্মাণ্ড কি জানত আমরা আসছি! এই ব্রহ্মাণ্ডের ভৌতিক ধ্রূবকগুলির মান জীবনের জন্য এতটাই সঠিক যে অনেক বিজ্ঞানী ভাবলেন এই সৃষ্টির মধ্যে দৈব প্রভাব আছে। এক কণাবিজ্ঞানীর এই বিশ্বাস এতটাই গভীর ছিল, তিনি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে ইংল্যান্ডের গির্জার যাজক হয়ে গেলেন। ব্রহ্মাণ্ড এবং মানুষের এই সম্পর্কের কথা মাথায় রেখে পদার্থবিদ ব্রান্ডন কার্টার(1) ১৯৭৪ সালে নৃতাত্ত্বিক নীতি বা Anthropic Principle-এর প্রস্তাব দেন। পরে এই নীতির দুটি সংস্করণ সূত্রবদ্ধ করেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী জন ব্যারো এবং ফ্রাঙ্ক টিপ্লার(2):
- দুর্বল নৃতাত্ত্বিক নীতিঃ এই ব্রহ্মাণ্ডের ভৌতিক ধ্রূবকগুলি (physical constants) সব সম্ভাব্য মানের হয়না; সেই মানগুলিই নির্দিষ্ট বা স্থির হবে যার জন্য কার্বন-ভিত্তিক জীবন সৃষ্টি হবে এবং ব্রহ্মাণ্ডের বয়স যথেষ্ট হবে যাতে বিবর্তন ঘটতে পারে।
- শক্তিশালী নৃতাত্ত্বিক নীতিঃ এই ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত ধর্ম এমনই যে ব্রহ্মাণ্ডের ইতিহাসের কোন এক সময়ে জীবনের আবির্ভাব অবশ্যম্ভাবি।
নীতির দ্বিতীয় সংস্করণটা প্রথমটার থেকে বেশি শক্তিশালী কারণ সেটা প্রায় এরকম বলে যে কোনো একভাবে জীবনকে আসতেই হতো। প্রথম সংস্করণটা তুলনায় দুর্বল। শুধু এটুকুই বলে যে যেহেতু এই ব্রহ্মাণ্ডে জীবন সৃষ্টি হয়েছে, তাই অনেকরকম সম্ভাব্য ধর্মের মধ্যে এই ব্রহ্মাণ্ডের ধর্মগুলো এমনই যা জীবনের জন্য অনুকূল। দুটো সংস্করণ প্রায় একই কথা বলছে, তবে দুর্বল সংস্করণটা অনেক বেশি স্বাভাবিক তাই মানতে কম আপত্তি হওয়ার কথা।
সাধারণভাবে অনেক বিজ্ঞানী এই মতামতকে গুরুত্বসহকারে নেননি। কারণ, এই নীতিটির ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা নেই, এটিকে পরীক্ষা করার উপায়ও নেই। নতুন কোন তত্ত্বও পাওয়া যায়না এর থেকে।
তবে একটি গুরুত্ত্বপুর্ণ বিষয় এই নীতিটি বুঝতে সাহায্য করেছে। তার নাম মহাজাগতিক ধ্রূবক ধাঁধা (cosmological constant paradox)। এটি একশো বছরের বেশী সময়ের এক অমীমাংসিত সমস্যা। উত্তর অজানা। পদার্থবিদ্যার বর্তমান তত্ত্বের এ এক অক্ষমতা। হয়ত ভবিষ্যতে নতুন কোন তত্ত্ব এর সমাধান সূত্র বের করবে। তবে, নৃতাত্ত্বিক নীতি অনুসরণ করে দেখা গেছে(3) তত্ত্ব এবং তথ্যের যে অস্বাভাবিক অসামঞ্জস্য ছিল, তা অনেক পরিমাণে কমেছে। ‘শূন্যস্থান শক্তি ঘনত্ব’ (vacuum energy density), যা সরাসরি মহাজাগতিক ধ্রূবক-এর সঙ্গে যুক্ত, তার তাত্ত্বিক মান আর পরিমাপের মানের মধ্যে তফাত অকল্পনীয় (১০১২০)। এই অস্বাভাবিক তফাৎকে ১০২-তে কমানো গেছে নৃতাত্ত্বিক নীতিকে অস্ত্র করে। এখানে যে স্বতঃসিদ্ধ ব্যাবহার করা হয়েছে তা হল, কার্বন-ভিত্তিক জীবনের অস্তিত্ব থাকতে গেলে ব্রহ্মাণ্ডের বয়স এখনকার মতই হওয়া উচিত, অর্থাৎ প্রায় ১৪০০ কোটি বছর।
কার্বন-ভিত্তিক জীবনের জন্য প্রয়োজন যথেষ্ট পরিমাণের কার্বন অথবা অন্যভাবে বললে C:O (কার্বন বনাম অক্সিজেন) এর সঠিক অনুপাত। অনুপাতটা এর থেকে কম হলে এই পৃথিবী ভশ্মে পরিণত হত আর বেশি হলে একটি কার্বন পিন্ড তৈরি হত। সেই সঠিক অনুপাতটা আছে বলেই আমি এই লেখাটা লিখতে পারলাম আর পাঠক সেটা পড়তে পারছে। এই সঠিক পরিমাণের কার্বন তৈরীর অন্যতম কারণ হচ্ছে 12C নিউক্লিয়াসের ৭.৬৫ MeV শক্তিস্তর। এটাই সেই বিখ্যাত ‘হয়েল স্টেট’ যার ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন ব্রিটিশ পদার্থবিদ ফ্রেড হয়েল। অনেকে এটাকে বলেন ‘জীবনের শক্তিস্তর ‘।
ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পরের কিছু মুহূর্ত
আমরা এই শক্তিস্তর নিয়ে বিশদে আলোচনা করবো। তার আগে দেখে নেওয়া যাক বিগ ব্যাং-এর পর নানারকম মৌল সৃষ্টির ইতিহাস। বিগ ব্যাং-এর এক মিলিসেকেন্ডের মধ্যে কোয়ার্ক কণারা যুক্ত হয়ে তৈরি হলো নিউট্রন আর প্রোটন। এই সময় ব্রহ্মান্ডের তাপমাত্রা ছিল এক লক্ষ কোটি কেলভিন (~১০১২ K)। নিউট্রনের ভর প্রোটনের থেকে বেশি হওয়ার ফলে নিউট্রন প্রোটনে রূপান্তরিত হয়। তাই এই সময় প্রোটন-এর পরিমাণ নিউট্রন এর থেকে প্রায় সাতগুণ বেশি ছিল। বিগ ব্যাং এর কয়েক মিনিট এর মধ্যে যে বিক্রিয়াগুলি ঘটেছিলো সেগুলি ছবি-১ এ দেখানো হলো। মৌল তৈরির মূল উপাদান 4He কিন্তু সহজে তৈরি হয়নি প্রথমদিকে। তার কারণ ডিউটেরিয়াম (2H) তৈরির ‘বাধা পরিস্থিতি’। সেটা কি? আমরা জানি একটি প্রোটন ও একটি নিউট্রন দ্বারা তৈরি 2H এর বাঁধন শক্তি খুবই কম এবং ব্রহ্মান্ডের উচ্চ তাপমাত্রায় তা ভেঙে যায়।
2H + 2H = 3H + p 3He + 2H = 4He + p
3H + 2H = 4He +n 3He + 4He = 7Be + γ
3H + 4He = 7Li + γ 7Be + n = 7Li + p
ছবি-১ : বিগ ব্যাং এর কয়েক মিনিট এর মধ্যে যে মৌলগুলি তৈরি হয়েছিল ।
সময়ের সঙ্গে ব্রহ্মান্ডের আয়তন বাড়ছে এবং তাপমাত্রা কমছে । যখন তাপমাত্রা কমে একশো কোটি ডিগ্রির (~১০৯ K) কাছাকাছি পৌছালো, 2H স্থিতিশীল হলো, তখন উপরের বিক্রিয়াগুলি ঘটতে শুরু করলো। তিন মিনিট এর মধ্যে ব্রহ্মান্ডের তাপমাত্রা (দুটি নিউক্লিয়াস এর একীকরণ তাপমাত্রার নিচে) কমলো এবং নিউট্রনের পরিমাণও কমে গেলো এবং থেমে গেলো মৌলসৃষ্টি। এই সময় ব্রহ্মান্ডের মৌলগঠন ছিল ~৭৫% 1H, ~২৫% 4He, এবং সামান্য পরিমাণে 2H, 3He এবং 7Li ।
12C কিভাবে তৈরী হতে পারে
তাহলে কার্বন তথা ভারী মৌলদের সৃষ্টি হলো কি করে ? ভারী মৌলরা তৈরি হলো তারাদের ভিতরে । মহাকর্ষ বলের জন্য হাইড্রোজেন এবং 4He একত্রিত হতে শুরু করলো এবং তারাদের সৃষ্টি হলো। ওজন বাড়ার সঙ্গে মহাকর্ষ বলও বাড়লো এবং ঘনত্ব বাড়লো, সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রাও বাড়লো। শুরু হলো ভারী মৌলদের সৃষ্টি । এখানেও ‘বাধা পরিস্থিতি’ তৈরি হলো। ভরসংখ্যা ৫ এবং ৮ এর কোনো স্থায়ী মৌল প্রকৃতিতে নেই । যারা তৈরি হতে পারে যথাক্রমে (4He+p) এবং (4He+4He) বিক্রিয়ায়। তাহলে এই মৌলদেরকে ডিঙিয়ে 4He থেকে 12C হওয়ার পথটি কি ? এই নিয়ে চর্চা শুরু সেই ১৯৩০ সাল থেকে(4-6)। জ্যোতির্বিজ্ঞানী, তাত্ত্বিক ও পরীক্ষমূলক পারমাণবিক পদার্থবিদ সকলেই 12C নিউক্লিয়াস-এর সৃষ্টি রহস্য নিয়ে ব্যস্ত আজও(7) ।
12C র রহস্য উদ্ঘাটনে যে তিনজন বিজ্ঞানীর নাম উল্লেখযোগ্য(8) তাদের মধ্যে একজন হলেন ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্যার ফ্রেড হয়েল। উনি ব্রহ্মান্ডের মৌলসৃষ্টির ওপর কাজ করেছেন এবং ব্রহ্মান্ডের স্থির অবস্থা (steady state) তত্ত্বের প্রবক্তাও ছিলেন। অথচ তিনিই আবার বিগ ব্যাং শব্দটির উদ্ভাবক (যেটা steady state এর সাথে যায়না)। দ্বিতীয় জন হলেন অস্ট্রিয়ার বংশোদ্ভূত এডউইন সালপেটার। তিনি ছিলেন নামকরা তাত্ত্বিক জ্যোতির্পদার্থবিদ। আর তৃতীয়জন হলেন আমেরিকার বিখ্যাত পরমাণু পদার্থবিদ উইলিয়াম আলফ্রেড ফাউলার।
এটা নিশ্চিত যে 12C তৈরি হয়েছে তারাদের অভ্যন্তরে যেখানে তাপমাত্রা কোটি ডিগ্রি এবং 4He র ঘনত্ব প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে প্রায় এক লক্ষ গ্রাম। এইরকম অবস্থাতেই তিনটি 4He কণা জুড়ে 12C হতে পারে । ১৯৫২ সালে প্রায় একই সময়ে সালপেটার (9) এবং এস্তোনিয়ান – আইরিশ জন্মোদ্ভূত এর্নস্ট ওপিক (10) বললেন 12C তৈরি হয় দুই ধাপে:
4He+4He = 8Be (Q= -95 keV)
8Be+4He = 12C (Q=7.36 MeV) প্রথম বিক্রিয়াটি ঘটার জন্য ন্যূনতম ৯৫ keV শক্তি প্রয়োজন । তারাদের তাপমাত্রা অধিক হওয়ার জন্য 4He কণার গতিশক্তি পর্যাপ্ত এবং ন্যূনতম শক্তি সহজেই উপলব্ধ হয়। বিক্রিয়া শক্তি ( Q) হচ্ছে বিক্রিয়ক এবং উৎপাদিত পরমাণুদের ভরের তফাৎ বা অন্যভাবে বলা যায়, তাদের বন্ধন শক্তির তফাৎ। দ্বিতীয় বিক্রিয়াটি ঘটতে হলে তৃতীয় 4He কণাটি ধাক্কা মারা পর্যন্ত 8Be কে জীবিত থাকতে হবে।
সালপেটার দেখালেন লাল দানব তারার ভিতর 12C তৈরি হওয়া সম্ভব। এই বিক্রিয়ার ন্যূনতম শক্তি ৭.৩৬ MeV উৎপাদিত 12C নিউক্লিয়াসের মধ্যেই থেকে যায় এবং 12C নিউক্লিয়াস তার উত্তেজিত শক্তিস্তরে অবস্থান করে। বিভিন্ন পরীক্ষায় পাওয়া আলফা এবং গামা রশ্মির বর্ণালীকে বিশ্লেষণ করে সালপেটার দেখালেন 12C নিউক্লিয়াসের ৭.৬৮ MeV তে একটা অধীর শক্তিস্তর আছে যা দুটি গামা রশ্মি ছেড়ে 12C ভূমিস্তরে পরিণত হয় । সালপেটার তারাদের তাপমাত্রা এবং ঘনত্ব ধরে হিসাব করলেন কতটা 12C তৈরি হতে পারে । দেখা গেলো সেটা খুবই কম এবং সেই 12C- র প্রায় সবটাই 4He এর সঙ্গে বিক্রিয়ায় 16O, 20Ne এ পরিণত হয়ে যাবে :
12C+4He = 16O + γ (Q=7.16 MeV)
16O+4He = 20Ne + γ (Q=4.7 MeV)
এই হিসাব অনুযায়ী ব্রহ্মাণ্ডে কার্বন থাকছে না এবং সেইজন্য কার্বন ভিত্তিক জীবনের কোনো অস্তিত্ব থাকাও উচিত নয়।
12C নিউক্লিয়াসের ৭.৬৫ MeV তে অনুরণন স্তর
১৯৫৪ সালে হয়েল সালপেটারের গণনার সূত্র ধরে নতুন করে ভাবতে শুরু করলেন । তিনি কার্বন তৈরি হওয়ার হার এবং কার্বনের 16O-এ পরিণত হয়ে যাবার হার হিসাব করে ভবিষ্যদ্বাণী(11) করলেন 12C নিউক্লিয়াসের ৭.৬৫ MeV তে একটা শক্তিস্তর আছে যা একটি অনুরণন স্তর (resonance state)।
হয়েল এর নিজের কথায়ঃ “সালপেটারের 3α বিক্রিয়ার ওপর গবেষণার কাজ প্রকাশিত হবার পর আমি নতুন করে ভাবতে শুরু করলাম কার্বন তৈরীর সমস্যা নিয়ে। হিসাব করে দেখলাম, কার্বন প্রায় তৈরী হচ্ছেনা, যা হচ্ছে তা আবার অক্সিজেনে রুপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। তাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, কার্বন নিউক্লিয়াসের ভূমিস্তরের ওপর ৭.৬৫ MeV তে যদি একটি শক্তিস্তর থাকে তাহলে তার অনুরণনের জন্য কার্বনের উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব।”
রেজোন্যান্স (resonance) বা অনুরণন সম্পর্কে একটু আলোচনা করা যাক। অনুরণন একটি প্রক্রিয়া যাতে কোনো একটি পদ্ধতির ব্যাপকতা বিশেষ কারণে হঠাৎ করে বৃদ্ধি পায়।
ব্যবহারিক জীবনে এর উদাহরণ অনেক। যেমন, বাদ্যযন্ত্রের সুরকরণ। অনুরণন হলেই স্বনশুল-এর সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রের তার একই কম্পাঙ্কে বেজে ওঠে। রেডিওর বোতাম ঘোরাতে ঘোরাতে যখন গ্রাহক বর্তনীর কম্পাঙ্কের সঙ্গে আগত বেতার তরঙ্গের কম্পাঙ্কের অনুরণন ঘটে, আমরা সেই বেতারকেন্দ্র পরিষ্কারভাবে শুনতে পাই। মাইক্রোওয়েভ ওভেনে কাঁচ বা প্লাস্টিকের পাত্র গরম হয়না কিন্তু খাবার গরম হয়।
এছাড়া আমরা জানি বিভিন্ন অনুরণন বর্ণালীবীক্ষণ পদ্ধত । যেমন, MRI, মোয়েসবার বর্ণালীবীক্ষন, রামন বর্ণালীবীক্ষন, অনুরণন লেসার আয়োনিকরণ ইত্যাদি। এইসব বর্ণালীবীক্ষণের ক্ষেত্রে বস্তুর মধ্যে যে পরমাণু বা অণু আছে, তাদের খন্ডিকৃত(quantized) শক্তিস্তরের তফাতের সঙ্গে যদি বহিরাগত বিকিরণের কম্পাঙ্ক মিলে যায়, বিকিরণের শোষণের পরিমাণ হঠাৎ করে ভীষণভাবে বৃদ্ধি পায়।
ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে পরমাণু বিক্রিয়ায় 12C তৈরি হওয়ার সময়। 8Be এর জীবন সময় খুবই কম (১০-১৬ sec); এই সময়ের মধ্যেই আর একটি 4He কণা এসে 8Be কে ধাক্কা মারে এবং 12C তার ৭.৬৫ MeV শক্তিস্তরে পৌঁছায়। এই শক্তিস্তরটি তৈরি হয় (4He + 8Be) এবং 12C এর বাঁধন শক্তির তফাৎ (৭.৩৬ MeV) থেকে এবং বাড়তি ~০.৩ MeV আসে 4He এবং 8Be র গতিশক্তি থেকে যা তৈরি হয় তারাদের কয়েক কোটি ডিগ্রি তাপমাত্রার জন্য। পরমাণু বিক্রিয়ার পরিভাষায় রেজোন্যান্স বা অনুরণনের জন্য বিক্রিয়ার ক্রস-সেকশন বা সম্ভাব্যতা বেড়ে যায় অনেক গুন । 12C তৈরির ক্ষেত্রে স্বাভাবিকের থেকে তা প্রায় লক্ষগুণ বেশি। 16O নিউক্লিয়াসে পরিবর্তিত হবার পরও পর্যাপ্ত পরিমাণে 12C থেকে যায় এবং C:O অনুপাত এই ব্রহ্মাণ্ডে কার্বন ভিত্তিক জীবন সৃষ্টির জন্য একেবারে সঠিক।
এখানে উল্লেখযোগ্য, 16O নিউক্লিয়াসেরও ৭.১০ MeV তে একটি শক্তিস্তর আছে । (4He + 12C) বিক্রিয়ায় উদ্ভূত শক্তি ৭.১৬ MeV যা ৭.১০ MeV-র থেকে বেশি । সেজন্য 16O অনুরণন পদ্ধতিতে তৈরি হবে না এবং তাই 16O র পরিমাণ সীমিত। হয়েল এই ৭.৬৫ MeV স্তরের ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন তার গণনার মাধ্যমে। তখনও কিন্তু এই শক্তিস্তরের কোনো পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। জ্যোতির্বিজ্ঞানের লেখক মার্কাস চৌন বলেন, “এটা এক ভয়ানক ভবিষ্যদ্বাণী।”
উপসংহার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা ম্যানহাট্টন প্রকল্প শুরু করে এবং সেখানে অনেক পরীক্ষামূলক পদার্থবিদ্যার অসাধারণ উন্নয়ন ঘটে। তার সুফল আমেরিকার বিভিন্ন ল্যাব-এ ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৫৩ সালে হয়েল ক্যালটেক গিয়েছিলেন দর্শনার্থী হয়ে। সেখানে উইলিয়াম ফাউলার এর সঙ্গে আলোচনা করেন । ফাউলার প্রথমে হয়েল এর কথায় কর্ণপাত করেননি । অনেক অনুরোধের পর ফাউলার এবং তার গবেষক দল পরীক্ষা করেন এবং হয়েল যে সঠিক তা প্রমাণিত হয়(12)। ফাউলার পরবর্তীকালে হয়েলের ব্যাপারে তার স্বীকারোক্তিতে বলেন, “আমি খুব সন্দেহবাদী ছিলাম এবং ভাবতে পারিনি হয়েলের মতো একজন স্থিতাবস্থা-জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং তাত্ত্বিক পদার্থবিদ কার্বন-১২ নিউক্লিয়াস সম্পর্কে অনুসন্ধান করবে …।”
১৯৮৩ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল প্রাইজ পেলেন ফাউলার এই সংক্রান্ত কাজের জন্য । তার সঙ্গে পেলেন সুব্রামনিয়ান চন্দ্রশেখর। হয়েল নোবেল প্রাইজ পাননি। সে আর এক কাহিনী । ১৯৯৭ সালে হয়েল এবং সালপেটার পেলেন ক্রাফোর্ড প্রাইজ এই 3α বিক্রিয়ার জন্য। এই বিক্রিয়ার নাম ‘সালপেটার বিক্রিয়া’ আর শক্তিস্তরের নাম হলো ‘হয়েল স্তর’ ।
বিগ ব্যাং-এর প্রবক্তা এবং বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও তাত্ত্বিক পদার্থবিদ জর্জ গ্যামো হয়েল সম্পর্কে যে বিদগ্ধ এবং সরস মন্তব্য করেছেন তা উল্লেখযোগ্য(13) :
সৃষ্টির শুরুতে ঈশ্বর তৈরী করলেন বিকিরণ এবং আদি পদার্থ যার না ছিল আকৃতি না ছিল কোন সংখ্যা। প্রোটন বা নিউট্রন কণারা পাগলের মতো ছোটাছুটি করছিল।
এবং ঈশ্বর বললেন, “ভর-২ তৈরী হোক”। ভর-২ তৈরী হল। এবং ঈশ্বর দেখলেন ডিউটেরিয়াম, এবং সেটা একটা শুভ-সৃষ্টি ।
এবং ঈশ্বর বললেন, “ভর-৩ তৈরী হোক”। ভর-৩ তৈরী হল। এবং ঈশ্বর দেখলেন ট্রিশিয়াম, এবং সেটাও হল একটা শুভ-সৃষ্টি ।
এবং ঈশ্বর পরপর সব সংখ্যা ধরে ডাকলেন। পৌঁছে গেলেন ইউরেনিয়াম-পরবর্তি মৌল পর্যন্ত। তারপর উনি নিজের কাজের দিকে ফিরে তাকালেন, দেখলেন, সৃষ্টির কাজ সঠিক হয়নি। উত্তেজনার মধ্যে ভর ৫ ডাকতে ভুলে গেছেন এবং স্বাভাবিকভাবে কোন ভারি মৌল তৈরী হয়নি।
ঈশ্বর হতাশ হলেন এবং চাইলেন ব্রহ্মান্ডের সঙ্কোচন হোক আর সবকিছু গোড়া থেকে শুরু করা যাক্। ঈশ্বরের মনে হলো এই সৃষ্টিকর্ম পুনরায় করা বড়ই একঘেঁয়ে হয়ে যাবে। যেহেতু সর্বশক্তিমান, উনি স্থির করলেন ভারি মৌল তৈরীটা বেশ কঠিনভাবে করা যাক্।
ঈশ্বর তাই বললেন, “হয়েল এর আবির্ভাব হোক্”। হয়েল এলেন। ঈশ্বর তাকে দেখে বললেন, “তুমি যেমন করে খুশি ভারি মৌল তৈরী করতে পারো।”
হয়েল ঠিক করলেন, তারা-নক্ষত্রদের মধ্যে এই ভারি মৌলদের তৈরি করবেন এবং সেসব সুপারনোভা বিস্ফোরণের দ্বারা চারিদিকে ছড়িয়ে দেবেন। এটা করার সময় হয়েল দেখলেন, ঈশ্বর ভর সংখ্যা ৫ ডাকতে ভুলে না গেলে মৌলদের প্রাচুর্য্য (abundance) একই থাকছে, যা আদি পদার্থ থেকে পরমাণু-সংশ্লেষে (nucleosynthesis) পাওয়া যায়।
সেইজন্য ঈশ্বরের সাহায্য নিয়ে উপরিউক্ত পথে ভারী মৌলগুলি তৈরী করলেন। কিন্তু সেই পথ এতই জটিল হলো, যার সদুত্তর খুঁজে, না পেলেন ঈশ্বর, না পেলেন হয়েল, না অন্য আর কেউ।
প্রচ্ছদের ছবি: বনানী মণ্ডল
প্রতীক পরিচিতি:
- MeV – Million electron volts,
- keV – kilo electron volts,
- p – প্রোটন,
- n – নিউট্রন,
- 2H – ডিউটেরিয়াম,
- γ — গামা রশ্মি,
- 3He – হীলিয়াম্-৩,
- 4He – হীলিয়াম্-৪ বা আলফা কণা (α),
- 7Be – বেরিলিয়াম -৭,
- 7Li – লিথিয়াম-৭,
- 8Be – বেরিলিয়াম -৮,
- 12C – কার্বন-১২,
- 16O – অক্সিজেন-১৬,
- 20Ne – নিয়ন -২০
(NX: N= ভরসংখ্যা বা নিউক্লিয়াসে প্রোটন এবং নিউট্রন এর সংখ্যার যোগফল ; X – মৌলের প্রতীক)
উৎসাহী পাঠকদের জন্য:
- Brandon Carter, “Large number coincidences and the anthropic principle in cosmology,” in Confrontation of Cosmological Theories with Observation, M. S. Longair, ed., Reidel, Dordrecht, Netherlands, 1974
- John D. Barrow and Frank J. Tipler, The Anthropic Cosmological Principle, Oxford University Press, New York, 1986.
- Steven Weinberg, Phys. Rev. Lett. 59 (1987) 2607
- Lewis, G.N., Livingston,M.S., & Lawrence, E.O., PRL, 44, 55, (1933)
- Lawrence, E.O., McMillan, E., & Henderson, M.C., Phys. Rev, 47, 273, (1935)
- Terrell, J., Phys. Rev., 80, 1076, (1950)
- D Dell’Aquila et.al. IOP Conf. Series: Journal of Physics: Conf. Series 876 (2017) 012006
- G. Shaviv ,Acta Polytechnica CTU Proceedings 2(1): 311–320, 2015
- E. E. Salpeter, Astrophys. J. 115, 326 (1952)
- E.J. Opik, Proc. Roy. Irish Acad. A54, 49 (1951); Mem. soc. roy. sci. Liege 14, 131 (1953)
- F. Hoyle, Astrophys J. Suppl. 1. , 121 (1954)
- Cook, C.W., Fowler, W.A., Lauritsen, C.C. & Lauritsen, T., Phys. Rev., 107, 508, (1957) doi:10.1103/PhysRev.107.508 13. ‘The Goldilocks Enigma’ by Paul Davies, Houghton Mifflin Company 2007