করোনাভাইরাস-কে ঠেকিয়ে রাখার মতো মাস্ক কি বাড়িতে বানানো সম্ভব? একেবারে N95 মাস্ক না হলেও খুব কাছাকাছি যাওয়া যায় কিন্তু!
বিজ্ঞান মনস্কতা মানে বিজ্ঞানের কতগুলি তথ্য জানা নয়, বা কয়েক পংক্তি জটিল অংক কষতে পারা নয়। বিজ্ঞান মানে যুক্তিসঙ্গত ভাবনা, অজানাকে জানার চেষ্টা আর বোঝা, আর তার অঙ্গাঙ্গি ভাবে আসে সামাজিক এবং নৈতিক দায়িত্ব।
খবরের কাগজ, ইন্টারনেট বা টিভির দৌলতে আমরা সবাই এখন জেনে গিয়েছি যে বিশ্বজোড়া করোনা ভাইরাসের তাণ্ডবে হাসপাতাল, ডাক্তারখানা বা নার্সিংহোমগুলো বেনজির চাপের মধ্যে আছে। এখন আশু প্রয়োজন একদিকে অসংখ্য মুমূর্ষু রোগীদের রোগ নির্ধারণ আর নিরাময়ের চেষ্টা করা, আর অন্যদিকে যারা এই কাজের দায়িত্বে সেই স্বাস্থ্যকর্মীরা যাতে আক্রান্ত না হন সেটা নিশ্চিত করা। অথচ চারিদিকে মাস্ক ও অন্যান্য ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের অভাব। হাসপাতালগুলির এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের যখন খুব প্রয়োজন তখন সকলেই ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের অভাবের কারণে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে। আমাদের প্রত্যেকেরই কোনো আত্মীয় স্বজন, বা ফ্রন্ট-লাইনে কাজ করা বন্ধু রয়েছে এবং আমরা কেবল অলস হয়ে বসে থাকতে পারি না। সুতরাং, এই মুহূর্তে জগতের সৃষ্টি রহস্যভেদের জটিল তত্ত্বে বুঁদ হয়ে থাকা বিজ্ঞানী থেকে স্মার্ট ফোনের ডিজাইন করতেই বেশি স্বচ্ছন্দ ইঞ্জিনিয়ার থেকে গৃহবধূ , বা ছোট ব্যবসায়ী, সকলেই এই আকালে ঝাঁপিয়ে পড়েছে – যে যেভাবে পারেন, সেইভাবে সাহায্য করতে। এই সমবেত বিজ্ঞান সম্মত প্রচেষ্টা থাকলে অনেক বিষম সংকটেরও অনেক সহজ সমাধান পাওয়া সম্ভব। এবং এটাই প্রকৃত বিজ্ঞানমনস্কতার প্রতিফলন।
এরকমই এক সমবেত প্রচেষ্টার ফল খুব সহজে মাস্ক হোল্ডার (ধারক) তৈরী। মাস্ক হোল্ডার অর্থাৎ মাস্কটাকে মুখে নিশ্ছিদ্রভাবে আটকে রাখার ব্যবস্থা। আমরা এখন অনেকেই বাতাসবাহিত রোগের সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য সুরক্ষামূলক মাস্ক ব্যবহার করছি। আমেরিকান সোসাইটি ফর টেস্টিং অ্যান্ড মেটেরিয়ালস (ASTM), ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ অকুপেশনাল সেফটি এন্ড হেলথ (NIOSH), এবং রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (CDC) মানদণ্ড বলে যে করোনা ভাইরাস (COVID- 19) থেকে সুরক্ষিত থাকতে হলে N95 গোত্রের বিশেষ মাস্ক দরকার। এই মাস্কের বিশেষত্ব শুধুমাত্র ৯৫% বাতাসবাহিত কণাকে ছেঁকে ফেলতে পারাই নয়। এই মাস্ক এমন ভালোভাবে নাক মুখের সঙ্গে এঁটে বসে থাকে যে কোনো ফাঁক ফোঁকর থাকে না আর কোনো জীবাণু বা কণা নাক বা মুখের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না। অনেক বাড়িতে তৈরী মাস্ক বা সাধারণ সার্জিকাল মাস্ক অনেকাংশে বাতাসবাহিত কণাকে ছেঁকে ফেলতে পারলেও নাকমুখের সঙ্গে মাস্কের ফাঁক ফোঁকরগুলো বন্ধ করতে পারে না। তাই তারা সাধারণ সর্দিকাশি বা ধুলোময়লা বা ধোঁয়ার জন্য কার্যকারী হলেও করোনা ভাইরাসের মতো মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগের ক্ষেত্রে এতো কার্যকরী হয় না।
এখানেই আসরে নামলেন বিশ্ববিখ্যাত ফোন ও কম্পিউটার কোম্পানি অ্যাপেলের কয়েকজন প্রাক্তন ইঞ্জিনিয়ার এবং ডিজাইনার। MIT, Cornell উনিভার্সিটি-র মতো নামজাদা প্রতিষ্ঠান থেকে পাস্ করে বেরোনো এই প্রযুক্তিবিদেরা লেগে পড়লেন কি করে সহজে নাকমুখের সঙ্গে মাস্কের ফাঁক ফোঁকরগুলো বন্ধ করা যায় ও কিভাবে সেটা তৈরী করা সাধারণের আয়ত্তের মধ্যে আনা যায়। ওনারা দেখালেন যে তিনটে সামান্য রবার ব্যান্ড ব্যবহার করেই এই সমস্যার সমাধান করা যায়। শুধু তাই-ই নয় সার্জিকাল মাস্কের মতো সহজলভ্য মাস্ক দিয়েও N95 মাস্কের কাছাকাছি মানের leak proof মাস্ক বানানো যায়।
উপাদান
৩টি রাবার ব্যান্ড
১ এএসটিএম স্তরের সার্জিক্যাল মাস্ক, অথবা সাধারণ ব্যবহারের জন্য যে কোনো বাড়িতে তৈরী মোটা মাস্ক, বা নিদেন পক্ষে দু/তিন ভাজ করা বড় ঘন বুনোটের রুমাল। যদি মাস্ক না থাকে, তাহলে একেবারে পুরোনো গেঞ্জি বা টি-শার্ট থেকেও শুরু করা যায়। একেবারে শেষের সেকশন-টাতে দেখুন।
পদ্ধতি
নিচের ভিডিও লিংকটা দেখলে পুরো পদ্ধতিটা বুঝতে পারবেন:
মাস্কের ব্যবহার ও পরবর্তী সংস্করণ
বিজ্ঞান পত্রিকার সুপারিশে মেরিল্যান্ডে সালিসবারির দম্পতি ডঃ বিশ্বজিৎ ঘোষ এবং তাঁর স্ত্রী শ্রদ্ধা যাদব এই পদ্ধতিতে বানানো মাস্ক হোল্ডার পরীক্ষা করে দেখেন (নিচের ছবি দ্রষ্টব্য) । যদিও এই রবার ব্যান্ড মাস্ক ফাঁক ফোঁকর সিল করতে অনেকটাই কার্যকরী, তাদের প্রতিক্রিয়া থেকে দুটো অসুবিধার কথা আমরা জানতে পারি।
১) এই রবার ব্যান্ড অনেক ক্ষন ধরে পরে থাকলে কানের পেছনের অংশে অনেক চাপ পরে ও কান ব্যাথা করতে থাকে; ও
২) নাকের উপরের অংশে সামান্য হলেও এখনো কিছু লিকেজের সম্ভাবনা থাকে। প্রথম সমস্যার একটি সমাধান সুপারিশ করেন শ্রীমতি যাদব। তিনি রবার ব্যান্ড দুটি কানের পিছনে না আটকে দুটো বোতামের সাহায্যে মাথার পেছনে আটকে দেন। তার ফলে আর কানের পেছনে চাপ পরে না।
কোনো ক্ষেত্রে সেটাও যদি সম্ভব না হয় তাহলে বিজ্ঞান পত্রিকার সদস্যরা আর একটি বিকল্প প্রস্তাব করেন। এই প্রস্তাব অনুযায়ী তিনটি রবার ব্যান্ডের বদলে আমরা পাঁচটি রবার ব্যান্ড নিয়ে কাজ করতে পারি। সেক্ষেত্রে মাথার পেছনে দুটো রবারব্যান্ডকে একটা জেমস ক্লিপ বা অন্য কোনো ক্লিপ দিয়েও আটকে দেওয়া যায় (নিচের ছবি দ্রষ্টব্য )।
দ্বিতীয় সমস্যা হলো নাকের উপরের দিকে লিক হওয়ার সম্ভাবনা। এর সমাধান করা যেতে পারে নাকের উপরের অংশে একটা ছোট চুলের কাঁটার মতো কিছু দিয়ে নাকের সঙ্গে মাস্কটা টাইট করে আটকে রেখে। সাধারণত N95 ধরণের মাস্কে একটা নরম ধাতব পাত থাকে, অনেকটা ফাইল ফোল্ডারে তিন ফুটোওলা কাগজ আটকে রাখতে যে রকম নরম ধাতব পাত ব্যবহার করা হয়, অনেকটা সেই রকম (নিচের ছবি দ্রষ্টব্য)। মাস্ক পড়ে এই ধাতব পাতটাকে দুআঙ্গুল দিয়ে চিপে নাকের সঙ্গে ফিট করে আটকে দেওয়া হয়।
একটা কথা এখানে মনে রাখা ভালো। এই সহজ পদ্ধতিতে তৈরী মাস্ক শুধু মাত্র করোনা ভাইরাসের জন্যই নয়, অন্য সময়েও ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন ধর স্কুল বা কলেজ-এ যাওয়ার সময় বা বাসে করে কোথাও যাচ্ছ, খুব ধুলো আর ধোঁয়া, বা সর্দি কাশি হয়েছে, আর তুমি চাওনা যে তোমার থেকে অন্য কারোর শরীরে জীবাণু ছড়াক। সেক্ষেত্রে চটজলদি পকেট থেকে একটা রুমাল আর তিনটে রবার ব্যান্ড বের করে তৎক্ষণাৎ তুমি তোমার নিজের মাস্ক বানিয়ে নিতে পারবে। সেক্ষেত্রে যেমন অন্য ছোঁয়াচে জীবাণু তোমার নাক বা মুখে ঢুকতে পারবে না, তেমনি তোমার থেকেও অন্য কেউ রোগ জীবাণু অবাঞ্ছিত উপহার পাওয়া থেকে রক্ষা পাবে।
গোড়া থেকে মাস্ক তৈরী
এতক্ষণ মাস্ক ধরে রাখার জন্য মাস্ক হোল্ডার-এর কথা বলা হচ্ছিলো। যদি একদম গোড়া থেকে মাস্ক বানাতে চান, তাহলে এইভাবে বানানো যেতে পারে। (এই অংশটি COVID Gyan থেকে সংগৃহিত)
Fig 1
একটা গেঞ্জি বা টি শার্ট নিন। একটা থেকেই দুটো মাস্ক বানাতে পারবেন।
Fig 2
১১ইঞ্চি X ৯ ইঞ্চি মাপের একটা আয়তক্ষেত্রের কাপড় কেটে নিন, সাথে কাটুন বাঁধার জন্য দুটো দড়ি।
Fig 3
আয়তক্ষেত্রের মতো কাপড়টা মাঝামাঝি ভাঁজ করুন।
Fig4
উপর আর নিচেটা আরও একটুখানি করে ভাঁজ করুন এবং চার কোণে দড়ি ঢোকানোর জন্য সামান্য কাপড় কেটে নিন।
Fig 5
দড়ি গুলো একদিক দিয়ে ঢুকিয়ে অন্যদিক দিয়ে বের করে নিন।
Fig 6
নিজের মতো করে একটু মাস্কটা টেনে টুনে ঠিক করে নিন।
Fig 7
ছবিতে যেমন আছে তেমন ভাবে মাস্কটা পরুন। প্রথমে উপরের দড়িটা বাঁধুন, নিচেরটা বাঁধুন তার পরে।
Fig 8
মাস্কটা ঠিক এমন ভাবে পরুন যাতে চারপাশে ফাঁক না থেকে যায়।
(অবশ্যই এক্ষেত্রে উপরে দেওয়া মাস্ক হোল্ডার বানিয়ে ব্যবহার করতে পারেন।)
কয়েকটা নিয়ম মনে রাখবেন:
(১) মাস্ক একবার ব্যবহার করে ফেললে সেটাকে না ধুয়ে এবং জীবাণু মুক্ত না করে পরবেন না। আমরা বলবো একাধিক মাস্ক বানিয়ে রাখতে, এতে সুবিধে একটাই যে একটা যখন ধুয়ে শুকোবেন অন্যটা তখন পরতে পারবেন। মাস্ক যদি ভিজে ভিজে লাগে তাহলে সেটা পাল্টে অন্য পরিষ্কার মাস্কটা পরুন।
(২) মাস্কের বাইরের দিকটা কক্ষনো হাত দেবেন না। প্রথমে নিচের দড়ির বাঁধনটা খুলুন আর শেষে উপরেরটা।
(৩) মাস্ক খুলে ফেলার পর সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার পর মাস্কটা গরম সাবান জলে ভালো করে ধুয়ে ফেলুন এবং রোদে শুকিয়ে নিন অথবা ব্যবহার করার আগে গরম ইস্ত্রি করে নিন।
তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার
১) মূল উদ্ভাবন সম্বন্ধে এখন থেকে জানতে পারবে : https://www.fixthemask.com/make-it
২) মেরিল্যান্ড পেনিনসুলা রিজিওনাল মেডিকেল সেন্টারের ডাক্তার বিশ্বজিৎ ঘোষ এবং তাঁর স্ত্রী ফার্মাসিস্ট ও entrepreneur শ্রদ্ধা ঘোষ।
৩) বাড়িতে মাস্ক বানানোর পদ্ধতি : https://www.cdc.gov/coronavirus/2019-ncov/prevent-getting-sick/diy-cloth-face-coverings.html
৪) বিভিন্ন মাস্কের কার্যকারিতা: https://journals.plos.org/plosone/article?id=10.1371/journal.pone.0002618
৫) সার্জিকাল মাস্ক কি করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকরী? : https://www.nature.com/articles/s41591-020-0843-2
nice