হিংস্র মহাবিশ্ব
স্টিফেন হকিং বলেছিলেন, “মহাবিশ্ব একটি হিংস্র জায়গা। নক্ষত্রগুলো গ্রহসমূহকে গ্রাস করে, মহাকাশ জুড়ে অতিকায় নবজ্যোতিষ্কগুলো প্রাণঘাতী রশ্মি ত্যাগ করে, কৃষ্ণগহ্বরগুলো একে অন্যের সাথে ধাক্কা খায় এবং গ্রহাণুগুলো প্রতি সেকেন্ডে শত শত মাইল বেগে চারিদিকে ধাবিত হয়।”
অবশ্যই, মহাবিশ্বের এইসব ঘটনাবলির ফলে আমাদের আরো সতর্ক থাকতে হবে। পৃথিবীতে মানুষের বিলুপ্তি ঠেকাতে প্রযুক্তিগতভাবে তৈরী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। বিশেষ করে অন্য গ্রহে বসবাসের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি ও কারিগরি ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। একটি গ্রহাণুর সংঘর্ষের বিরুদ্ধে আমাদের আর কোনো প্রতিরক্ষা নেই।
সর্বশেষ এইরকম বড় সংঘর্ষ হয়েছিলো প্রায় ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে। মনে করা হয় যে সেটি ডাইনোসর প্রজাতিকে মেরে ফেলেছিলো, এবং এটি যে আবার ঘটবে না, তার কোনো কারণ নেই। এটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী নয়, এটি পদার্থবিজ্ঞান এবং সম্ভাবনার সূত্রাবলি দ্বারা নিশ্চিত।
উদ্বিগ্ন বিজ্ঞানীমহল
গ্রহাণু পৃথিবীতে আছড়ে পড়ার আশঙ্কায় মগ্ন বিজ্ঞানীমহল। শঙ্কা যে আগে ছিল না তা নয়। প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে এখন প্রতিদিন চারটে গ্রহাণু আবিষ্কার হয়। এখনো পর্যন্ত প্রায় ১৯,০০০ মহাজাগতিক বস্তু চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে, যেগুলি খাতায়-কলমে পৃথিবীর জন্য বিপদ বয়ে আনতে পারে ৷ সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।
মহাকাশযান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্পেস এক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এলন মাস্ক ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন – বিশাল এক গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত হেনে মানব সভ্যতা নিশ্চিহ্ন করে দেবে, আর আমাদের হাতে তা ঠেকানোর কোনো উপায় নেই। যদিও তাঁর এই উক্তিকে অনেক মহাকাশ বিজ্ঞানী স্বীকার করেন না।
তবে ইতিহাসের সাক্ষী আছে এমন অনেক ঘটনা। ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে এক উল্কাপিণ্ডের আঘাতে বিলুপ্ত হয়ে যায় ডাইনোসর প্রজাতি। ১৯০৮ সালের ৩০ জুন রাশিয়ার সাইবেরিয়ার গহন জঙ্গলে বিশাল এক গ্রহাণু আঘাত করেছিল, যার ফলে ৭৭০ বর্গকিলোমিটার বন পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এরকম আরেকটি বড় গ্রহাণু রাশিয়ার চেলিয়াবিংক্স-এর বায়ুমণ্ডলে ঢুকে পড়েছিল। তবে এটি পৃথিবীতে আছড়ে পড়ার আগেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের ফলে এটি সূর্যের চেয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, আর তারই উত্তাপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল প্রায় ৭ হাজার ইমারত, আহত হয়েছিল সহস্রাধিক মানুষ। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে একটি বড় গ্রহাণু আমাদের পৃথিবীকে আঘাত করলে কি পরিমাণ ধ্বংসলীলা করবে।
বর্তমানে বিজ্ঞানীরা বলছেন গ্রহাণুর আঘাতে সৃষ্ট পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্রেটার (crater) বা গহ্বর তারা খুঁজে পেয়েছেন মধ্য অস্ট্রেলিয়াতে। তারা জানান ৩০০ মিলিয়ন বছর আগে ওয়ারবারটন অঞ্চলে জোড়া-গ্রহাণুর আঘাতে এরকম বিশাল গর্তের জন্ম হয়েছে। নতুন আবিষ্কৃত এই ক্রেটার-এর ব্যাস প্রায় ৪০০ কিলোমিটার। দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্রেদফোর্ট ক্রেটার-এর চেয়ে ১০০ কিলোমিটার বড় এটি। ভূবিজ্ঞানী গ্লিক্সন এবং তার দল এখনও জায়গাটা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। খুব শীঘ্রই তারা আরও নতুন তথ্য দিতে পারবেন বলে আশা করছেন। সুতরাং এলন মাস্কের ভবিষ্যদ্বাণী খুব অযৌক্তিক নয়।
ধাবমান ঘাতক
প্রতিদিনই পৃথিবীর দিকে অসংখ্য গ্রহাণু ধেয়ে আসে। তার বেশিরভাগই বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণে ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু, এমন কিছু বৃহৎ গ্রহাণু আছে, যা বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণে জ্বলে শেষ হতে পারে না, ফলে সেগুলি পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ে। তাদের তীব্র গতিশীল পতনের ফলে ভূপৃষ্ঠে বিশাল গহ্বরও তৈরি হয়ে যায়। আরো বড় গ্রহাণু হলে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পও হতে পারে। এই জন্য বিজ্ঞানীরা চোখকান খাড়া রাখেন এইসব বিশাল গ্রহাণুর জন্য। প্রতি মুহূর্তেই নজর রাখতে হয় কোনো গ্রহাণু পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছে কি-না। এর জন্য নাসা দ্বিগুণ সচেতনতা অবলম্বন করছে। নাসা এখন এ ব্যাপারে অনেক সচেতন। ভাবা হয়, নাসা যদি তাদের কার্যক্রম যথাযথভাবে অব্যাহত রাখে তাহলে মহাপ্রলয় হয়তো এতো ভয়ঙ্কর হবে না।
বিজ্ঞানীদের মতে বর্তমানে দু’হাজার ‘পোটেনশিয়ালি হ্যাজারডাস অ্যাস্টরয়েডস’ (পি এইচ এ) রয়েছে। যেমন, মিসরীয় বিশৃঙ্খলার দেবতা অ্যাপোপহিসের (Apophis) নামে নামকরণ করা একটি গ্রহাণু বিপজ্জনকভাবে পৃথিবীর খুব কাছ দিয়ে অতিক্রম করবে। ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১৯ হাজার মাইল থেকে পাশ কাটিয়ে যাবে এই গ্রহাণুটি। ২০২৯ সালের ১৩ই এপ্রিল আকাশজুড়ে উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠবে। বর্তমানে ধীরে ধীরে গ্রহাণুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। একসময় উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো একে দেখা যাবে। ১,০৮০ ফুট প্রশস্ত গ্রহাণুটির কারণে পৃথিবীতে ক্ষতির আশঙ্কা যদিও কম। উল্টে কিছু লাভও হতে পারে। নাসা-র জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরির গবেষক মেরিনা ব্রজোভিক বলেন, ২০২৯ সালে পৃথিবীর সন্নিকটে গ্রহাণু চলে আসার ঘটনা বিজ্ঞানের জন্য দারুণ একটি সুযোগ। অপটিক্যাল ও রাডার টেলিস্কোপ দিয়ে এটি পর্যালোচনা করা হবে। পৃথিবীর কাছ দিয়ে এত বড় আকারের গ্রহাণু অতিক্রম করার ঘটনা দুর্লভ। বিজ্ঞানীদের অভিমত, অ্যাপোপহিসের পৃথিবীতে প্রভাব ফেলার আশঙ্কা সামান্য।
২১৩৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর গ্রহাণু ‘বেনু’ (Bennu) পৃথিবী ঘেঁষে বেরিয়ে যাবে। কোনোভাবেই একে থামানো যাচ্ছে না। এমনটিই জানিয়েছে নাসা। এটি পৃথিবীতে আঘাত হানলে ‘ভয়াবহ’ ক্ষতির আশঙ্কাও করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘বেনু’ ক্রমাগত পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছে। এর আকার যুক্তরাষ্ট্রের ‘এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং’-এর চেয়েও বড়। এর কার্যক্ষমতা ১,২০০ মেগাটন। ‘বেনু’ হিরোশিমা বোমের চেয়ে ৮০ হাজার গুণ বেশি ক্ষতি করতে সক্ষম। নাসা-র বিজ্ঞানীরা বলছেন, গ্রহাণু ‘বেনু’কে প্রতিরোধে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিও ব্যর্থ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে পারমাণবিক বিস্ফোরণ সর্বোত্কৃষ্ট উপায় হতে পারে।
‘বেনু’ ছাড়াও সম্ভাব্য পৃথিবী-অভিমুখী গ্রহাণুর গতিপথ পরিবর্তনের উপায় উদ্ভাবনের চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। এ জন্য ‘হ্যামার’ (HAMMER) নামে একটি মহাকাশযান তৈরির পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এই যানটির উদ্দেশ্য পৃথিবীমুখী গ্রহাণুর অভিমুখ ঘুরিয়ে দেওয়া। তবে এটি বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। পদার্থবিজ্ঞানী ডেভিড ডিয়ারবোন-এর কথায়, ‘যদি কোনো গ্রহাণু ছোট হয় এবং যথাসময়ে এর আগমনের কথা জানা যায় তবে মহাকাশযান ব্যবহার করে একে প্রতিরোধ করা সম্ভব। তবে যথেষ্ট সময় হাতে না থাকলে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ছাড়া আর পথ থাকবে না।’
পৃথিবীর প্রতিরোধ
পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা গ্রহাণুপুঞ্জ কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়, এই নিয়ে একটি বিস্তৃত প্রতিরক্ষা কৌশল পকিল্পনা প্রকাশ করেছে নাসা। নাসা-র গবেষকেরা বলেন, নিয়ার আর্থ অবজেক্ট বা এন ই ও-গুলো সাধারণত পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। ১৯৯৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৫৫৬টি ঘটনা নাসা পর্যবেক্ষণ করেছেন। গবেষকরা প্ল্যানেটারি ডিফেন্স কো-অর্ডিনেশন অফিস (পি ডি সি ও) নামের একটি কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন, যাঁর মাধ্যমে মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলো পৃথিবীর আশপাশে থাকা নিয়ার আর্থ অবজেক্টস-গুলোর ওপর নজরদারি করবে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার এই প্রকল্পের নাম দিয়েছেন “ন্যাশনাল নিয়ার-আর্থ অবজেক্ট প্রিপেয়ার্ডনেস স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান।” নাসা এবং ফেডারেল ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সী (ফেমা) এই প্রকল্পটির উপর আগামী ১০ বছর ধরে কাজ করবে। বিজ্ঞানীরা মূলত বিশেষ পাঁচটি উদ্দেশ্যে কাজ করছেন।
প্রথম উদ্দেশ্য পৃথিবীর নিকটবর্তী গ্রহাণু সনাক্তকরণ, ট্র্যাকিং এবং চরিত্র বিশ্লেষণ করা, বর্তমানের অনিশ্চয়তাকে কম করা। নাসা গ্রহাণুগুলিকে বিশ্লেষণ করার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে অনেক অবজারভেটরি তৈরি করেছে। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা রাজ্যের টুসন-এ ক্যাটালিনা স্কাই সার্ভে, হাওয়াই-এ অবস্থিত প্যান-স্টারর্স১ (Pan-STARRS1) টেলিস্কোপ, ইত্যাদি ইত্যাদি আরও অনেক বিভিন্ন দেশে গ্রহাণু পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে। বেশ কয়েকটি মহাকাশ মিশনও গ্রহাণু পর্যবেক্ষণ করেছে। নিয়ার শূমেকার (NEAR Shoemaker) মহাকাশযানটি ২০০১ সালে পৃথিবীর নিকটবর্তী একটি গ্রহাণু ইরোসে অবতরণ করে। তারপরে, মহাকাশযানটি ২০১১ সালে গ্রহাণু বেল্টে ভ্রমণ করে এবং সেখানে দ্বিতীয় বৃহত্তম বস্তু ভেস্তা-র কক্ষপথ অধ্যয়ন করে। ভেস্তা এত বড় যে এটি একটি ছোট গ্রহের মতো। ২০১২ সালে ভেস্তা ছেড়ে দিয়ে গ্রহাণু বেল্টের সবচেয়ে বড় বস্তু, বামন গ্রহ সেরেসের চারপাশে কক্ষপথে চলে যায়।
২০১৬ সালে নাসা বেন্নু (Bennu) নামে পৃথিবীর নিকটবর্তী একটি গ্রহাণু অধ্যয়ন করতে এবং গ্রহাণুর নমুনা আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার জন্য ওসাইরিস-রেক্স (OSIRIS-REx) মহাকাশযান চালু করেছিল। ২০১৮ সালে ওসাইরিস-রেক্স বেন্নুর চারপাশে কক্ষপথে যায়। বেন্নু হ’ল মহাকাশযান দ্বারা প্রদক্ষিণ করা সর্বকালের সবচেয়ে ছোট বস্তু। ওসাইরিস-রেক্স বেন্নুর পৃষ্ঠতল অধ্যয়ন করে দু’বছর ব্যয় করবে, একটি নমুনা নেওয়ার জন্য সবচেয়ে ভাল জায়গা খুঁজছে।
দ্বিতীয় উদ্দেশ্য, নিয়ার আর্থ অবজেক্টস বিশ্লেষণ, ভবিষ্যদ্বাণী এবং তথ্য একত্রিকরণ। এই সম্পর্কীয় সমস্থ তথ্য পৃথিবীর সমস্ত সংস্থাকে পূর্বাভাস দেবে-কোন গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত হানবে এবং কখন ও কোথায় আগত গ্রহাণুটি আঘাত হানতে পারে। ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট টিমস “ফেমা” তৎক্ষণাৎ এই তথ্যের ভিত্তিতে কি করা যায় স্থির করবে। বিভিন্ন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ও সরকারকে নিয়ে জরুরি মুহূর্তে বিশেষ ব্যবস্থা নেবে এবং পৃথিবীর ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে জানাবে। গ্রহাণুর আকার ও পৃথিবীতে এর প্রভাব বিবেচনা করে পৃথিবীকে সুরক্ষিত করার দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে গ্রহাণুর গতিপথ ঘুরিয়ে দেওয়ার প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মতো প্রকল্প। নাসা-র গবেষকেরা জানিয়েছেন, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির সঙ্গে মিলে তাঁরা গ্রহাণুর গতিপথ ঘুরিয়ে দেওয়ার প্রযুক্তির ধারণা নিয়ে কাজ করছেন। এই মিশন পরিচালনার জন্য অর্থ বরাদ্দ পাওয়ার চেষ্টা করছে নাসা।
তৃতীয় উদ্দেশ্য, পৃথিবীর দিকে কোনো বড় আকারের মহাজাগতিক বস্তু এগিয়ে এলে, তাকে অন্য পথে সরিয়ে দেওয়ার জন্য নাসাকে নতুন উপায় বার করতে বলা হয়েছে। এই উদ্দেশ্যে “ডবল অ্যাস্টেরয়েড রিডিরেক্শন টেস্ট” ( ডার্ট ) মিশন তৈরি হয়েছে। জরুরি অবস্থা দেখা দিলে বিজ্ঞানীরা সংঘাত এড়াতে গ্রহাণুর গতিপথ পরিবর্তন করতে চান ৷ কয়েক টন ওজনের মহাকাশযান যাতে সেই কঠিন কাজ করতে পারে এমনটাই তাঁদের লক্ষ্য ৷ এমন যানের ভর তুলনামূলক ভাবে সামান্য হলেও সেটি গ্রহাণুর সঙ্গে অভিকর্ষের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে ৷ ফলে গ্রহাণুর গতিপথ কিছুটা হলেও বদলে যেতে পারে ৷
দক্ষিণ জাপানের ওসুমি দ্বীপের তানেগাশিমা মহাকাশ কেন্দ্র থেকে ‘এইচ টু এ’ উৎক্ষেপণ ব্যবস্থায় ২০১৪ সালের ৩ ডিসেম্বর ‘হায়াবুসা ২’ উৎক্ষেপণ করা হয়। ২০১৮ সালের ২৭ জুন সেটা এসে পৌঁছায় গ্রহাণু রিয়ুগুর কাছে। শুরু হয় গবেষণার কাজ। ‘হায়াবুসা ২’-এর গোটা চারেক রোভার রয়েছে। ঠিক হয়েছে এরাই গ্রহাণুর চার জায়গায় নেমে নমুনা সংগ্রহ করবে, ছবি তুলবে। গ্রহাণুর উপর সফলভাবে আনম্যান্ড বা যন্ত্রচালিত রোভার নামাল জাপান। হায়াবুসা-২ মহাকাশযান থেকে পৃথক হওয়ার পর সফলভাবে অবতরণ করেছে মহাকাশ অভিযানকারী রোবট বা রোভার দুটি। মিনার্ভা-টু নামের সেই দুটি রোভারই এখনও পর্যন্ত বিশ্বের প্রথম রোভার যা কোনও গ্রহাণুর উপর নামল।
সেই বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, দুটি রোভারই ভালো অবস্থায় আছে এবং অবতরণের কিছু সময় পর থেকেই সেগুলি পৃথিবীতে ব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন তথ্য এবং ছবি পাঠিয়েছে। একটি হীরক খণ্ডের মতো দেখতে রিয়ুগু গ্রহাণুতে প্রচুর খনিজ পদার্থ রয়েছে, যা কয়েক কোটি বছর আগে তৈরি হওয়া আমাদের সৌরমণ্ডলের উৎপত্তি সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারবে। সেই তথ্য এবং ছবি নিয়ে ইতিমধ্যে পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং গবেষণাও শুরু করে দিয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। জাপানি ভাষায় ‘হায়াবুসা’ মানে বাজপাখি আর ‘ রিয়ুগু’ হল জলের তলায় ড্রাগন রাজপ্রাসাদ। জাপানি উপকথায় জেলে উরাশিমা তারো সেই প্রাসাদ থেকে জাদুবাক্স নিয়ে আসে। ‘হায়াবুসা ২’-এর সাফল্য থেকে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত যে প্রয়োজনে ভবিষ্যতে তারা গ্রহাণুর উপর আঘাত আনতে পারবে অথবা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গতিপথ পরিবর্তন করতে পারবে।
মারণাত্মক মহাকাশযানের সাহায্যে গ্রহাণুর উপর আঘাত হানতে হবে এই উদ্দেশ্যে ২০২০ সালে নাসা এক পরীক্ষামূলক মহড়ার পরিকল্পনা করেছে৷ এটি চতুর্থ উদ্দেশ্য। ইউরোপীয় ও মার্কিন মহাকাশ সংস্থা ‘ডিডিমস’ (Didymos) ও ‘ডিডিমুন’ (Didymoon) নামের যমজ দুই গ্রহাণুর উপর হামলা চালাতে চলেছে৷ এই অভিযানের লক্ষ্য একটি মহাকাশযান গ্রহাণুর গোটা প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করবে এবং নমুনা সংগ্রহ করবে ৷ ৩৩০ কিলোগ্রাম ওজনের দ্বিতীয় একটি যান ‘ডিডিমুন’ গ্রহাণুর উপর হামলা চালাবে ৷ এ যেন মহাশূন্যে বিলিয়ার্ড খেলা !
এর ফলে দুই গ্রহাণুর গতিপথে কতটা পরিবর্তন ঘটবে? জার্মানির ফ্রাইবুর্গ শহরে অ্যার্নস্ট-মাখ ইনস্টিটিউটের গবেষকরা এক হাই-স্পিড কামানের সাহায্যে মহাকাশে গোলা নিক্ষেপের পদ্ধতির সিমুলেশন বা নকল করছেন ৷ এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেলেপাথরের উপর কামান দাগা হচ্ছে ৷ মহাকাশের মতো এ ক্ষেত্রেও সেকেন্ডে প্রায় ১০,০০০ কিলোমিটার গতিতে আঘাত হানা হচ্ছে ৷ বিস্ফোরিত পাথরের ধাক্কায় মারাত্মক সেই পালটা আঘাতের মাত্রা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে উঠছে ৷ প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানী ফ্রাংক শেফার বলেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে স্যাটেলাইটের আঘাতে স্পষ্টভাবে মোমেন্টাম ট্রান্সফার দেখা যাচ্ছে ৷ অন্যদিকে গ্রহাণুর নিজস্ব উপাদানের কারণে বাড়তি মোমেন্টাম ট্রান্সফার ঘটছে ৷ বিস্ফোরণের ফলে টুকরোগুলি আঘাতকারীর দিকে ধেয়ে যাচ্ছে ৷ এটা অনেকটা জেট ইঞ্জিনের মতো পেছনে ভর বার করে সামনে গতি বাড়ানোর মতো দৃষ্টান্ত ৷”
তবে এই প্রক্রিয়ায় শুধু অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের শক্ত বস্তুকে কক্ষচ্যুত করা সম্ভব। কিন্তু কোনো গ্রহাণুর মধ্যে অসংখ্য ছিদ্র থাকলে বা সেটির আকার বিশাল বড় হলে আঘাতের ইমপ্যাক্ট বা প্রভাব দুর্বল হয়ে যাবে ৷ গতিপথ পরিবর্তনের জন্য সবসময়ে হাতে বেশি সময় থাকবে না ৷ জার্মান এয়ারোস্পেস সেন্টারের অ্যালান হ্যারিস মনে করেন, ‘‘ পৃথিবীর দিকে কোনো বড় আকারের মহাজাগতিক বস্তু এগিয়ে এলে এবং খুব দেরিতে তা টের পেলে আমাদের সর্বশেষ হাতিয়ার সম্বল করতে হবে৷ অর্থাৎ পারমাণবিক বোমা প্রয়োগ করতে হবে ৷ তবে ভাগ্য খুব খারাপ হলে ‘শটগান এফেক্ট’ দেখা যেতে পারে ৷ তখন বিস্ফোরণের ফলে গ্রহাণুটি ভেঙে চৌচির হবে এবং তার অসংখ্য টুকরো পৃথিবীর দিকে ধেয়ে যাবে ৷ তার পরিণতি মারাত্মক হতে পারে ৷” আমরা কি এমন আঘাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে পারি? অ্যালান হ্যারিস ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘নিওশিল্ড’ নামের প্রকল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ৷ এই মুহূর্তে এমন ‘গ্লোবাল কিলার’-এর হুমকি না থাকলেও তাঁর নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী প্রতিরক্ষার কৌশল সৃষ্টির কাজে ব্যস্ত৷
পঞ্চম এবং শেষ উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে- এমন একটি পরিকল্পনা নিয়ে আসতে যা কার্যকর হবে যদি একটি বড় গ্রহাণু পৃথিবীর উপর আঘাত হানে-বা যদি কোনও সতর্কীকরণ ছাড়াই পৃথিবী বিধ্বস্ত হয়। এই রকম গ্রহাণু জরুরী পরিস্থিতিতে ফেমার ভূমিকা হবে প্রত্যেককে সর্তকতা জারি করা।
বিবর্ণ নীল বিন্দু
আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা মহাকাশে শক্তিশালী টেলিস্কোপ সংযুক্ত মহাকাশযান ভয়েজার-১ প্রেরণ করেছিল সৌরজগতের গ্রহ-নক্ষত্রের নিখুঁত ছবি পাওয়ার জন্য। ছয়শ কোটি কি. মি. দূর থেকে পৃথিবী গ্রহের একটি দুর্লভ ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছে। এই বিশাল মহাবিশ্বে পৃথিবীর অবস্থান যে কত ক্ষুদ্র তা প্রমাণিত হয়েছে। সেই ছবিতে পৃথিবীকে মনে হচ্ছে একটি বিবর্ণ নীল বিন্দুর মতো। মহাবিশ্বে বিন্দুসম এই গ্রহটি বর্তমানে ভয়াবহ রকমের অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে।
প্রচ্ছদের ছবি: NASA-DART Mission. NASA website. Artists’ imagination for future defence system.