“প্রথম” রোগী
১৯০১ সাল। শীতকাল। ক্রিসমাসের এখনো কিছু দেরী আছে। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে মনোবিদ ডাঃ অ্যালইস অ্যালজাইমার সদ্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগিনীর সাথে কথা বলছেন।
আপনার নাম ? অগুস্তে।
আপনার পদবি ? অগুস্তে।
আপনার স্বামীর নাম ? মনে হয় অগুস্তে।
আপনার স্বামীর কথা বলছিলাম। ও হ্যাঁ, আমার স্বামী।
আপনি কি বিবাহিত? হ্যাঁ, অগুস্তের সঙ্গে….
রোগিণীর বয়স তখন একান্ন বছর। গত কয়েক বছর ধরেই তিনি নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। স্মৃতি পথভ্রান্ত, তার সঙ্গে ঘুমের সমস্যা, সন্দেহবাতিক, অমূলক ভয় – এইসব উপসর্গ নিয়ে অগুস্তের পরিবার ব্যতিব্যস্ত। এসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে শ্রুতিবিভ্রম—ফাঁকা ঘরেও মানুষজনের কণ্ঠস্বর শুনতে পান অগুস্তে—চেঁচাতে শুরু করেন ভয়ে। অগত্যা তাকে ভর্তি করা হয় ফ্রাঙ্কফুর্টের মানসিক হাসপাতালে [১]।
মানসিক হাসপাতালের বিছানাতেই জীবনের শেষ পাঁচটা বছর কাটান অগুস্তে। ১৯০৬ সালে শরীরের ক্ষত থেকে রক্তে সংক্রমণ ছড়িয়ে রোগিণী যখন ঢলে পড়লেন মৃত্যুশয্যায় তখন তার কষ্ট অনুভব করার ক্ষমতাটুকুও নিঃশেষিত। ততদিনে ডাঃ অ্যালজাইমার জার্মানির অন্য শহরে কাজে যোগ দিয়েছেন। সারাদিন রোগীর চিকিৎসা, ছাত্র পড়ানো আর প্রশাসনিক কাজ সামলে গবেষণার সময় পান সামান্যই। তিনটি শিশু সন্তান রেখে স্ত্রী গত হয়েছেন অল্প বয়সে। এত সব কিছুর মধ্যেও তিনি ভুলে যাননি তাঁর পুরনো রোগিণীর কথা। ১৯০৬ সালে অগুস্তের মৃত্যুসংবাদ পৌঁছলো তাঁর কাছে। বিজ্ঞানের স্বার্থে অগুস্তের মস্তিষ্ক দান করেছিল তার পরিবার। অণুবীক্ষণের নীচে সেই মস্তিষ্কের রহস্য সন্ধানে ব্রতী হলেন অ্যালজাইমার এবং তাঁর সহকর্মীরা।
মাথার কোষে জট
কী দেখতে পেয়েছিলেন অ্যালজাইমার? তাঁর সমসাময়িক অন্য একজন বিজ্ঞানী ম্যাক্স বিয়েলচোস্কি ততদিনে আবিষ্কার করেছেন এমন এক রঞ্জনপদ্ধতি (Staining) যা দিয়ে মস্তিষ্কের কোষগুলো স্পষ্টভাবে দেখা যায়। বিয়েলচোস্কির পদ্ধতি ব্যবহার করেই অগুস্তের মস্তিষ্কের কোষগুলো পর্যবেক্ষণ করেছিলেন অ্যালজাইমার। তিনি দেখতে পেলেন মস্তিষ্কে ছড়িয়ে রয়েছে অস্বাভাবিক এক ধরণের পদার্থ যা কোষের ভেতরে জটের মতো চেহারা নিয়েছে (tangles) আর কোষের বাইরে পাতের মতো (plaques)। আজও এই রোগটা সনাক্ত করতে এই দুটো চিহ্ন ব্যবহার করা হয়।
অত্যন্ত উৎসাহের সাথে নিজের কাজের কথা সবাইকে জানাবেন বলে ঠিক করলেন তিনি। ১৯০৬ সালে মনোবিদদের সম্মেলনে নিজের গবেষণাপত্র পাঠ করলেন অ্যালজাইমার। কিন্তু শ্রোতাদের মনে দাগ কাটতে পারলেন না। তাঁর বক্তৃতার পরে কেউ কোনও প্রশ্নও করলেন না। সেইসময় সাইকো-অ্যানালিসিস-এর রমরমা চলছিল। মনের গভীর অবচেতন থেকে চিন্তাভাবনাকে টেনে হিঁচড়ে বার করে আনা যায়, আরিব্বাস! সেই নিয়েই মেতে ছিল জনসাধারণ। তার মধ্যে কোন একজন রোগীর কোষে কি একটা দেখা গেছে, তার কোনো আকর্ষণই ছিল না। বিংশ শতাব্দীর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার তাই অবহেলার অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেল।
বিজ্ঞানচর্চা বলতে আমাদের মানসলোকে ভেসে ওঠে গবেষণাগারে মগ্ন একাকী এক বিজ্ঞানীর সাধনার চিত্র। কিন্তু বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাস শুধুমাত্র মেধার জয়যাত্রা নয়, ব্যক্তি মানুষের অদম্য সাহস আর ইচ্ছাশক্তির কাহিনীও বটে। গ্যালিলিও থেকে ব্রুনো, সুভাষ মুখোপাধ্যায় থেকে ওয়ারেন মারশাল—কত যে বিজ্ঞানীকে মুখোমুখি হতে হয়েছে সামাজিক অবহেলা আর অবজ্ঞার তার হিসেব কেউ লিখে রাখেনি। অনেকে আপোষ না করে প্রাণ দিয়েছেন, কেউ কেউ ডুবে গেছেন ব্যক্তিগত অন্ধকারে। কিন্তু তাঁদের সাধনার ফল যুগকে অতিক্রম করে হয়েছে কালজয়ী।
অ্যালজাইমারও দমে যাবার পাত্র ছিলেন না। তিনি চোখকান খোলা রাখলেন যদি আরো স্মৃতির অসুখে আক্রান্ত রোগীদের মস্তিস্ককোষের মধ্যে সেই তালগোল পাকানো জট কিংবা সেইরকম পাত খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯০৯ সালে একইরকম আরও তিনজন রোগীর বিষয়ে তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হল। তাঁর অগ্রজ সহকর্মী এমিল ক্রেপলিন তার কাজে বরাবরই উৎসাহী ছিলেন। তাঁর মনোবিজ্ঞানের ওপর বিখ্যাত গ্রন্থে ডাঃ অ্যালজাইমার বর্ণিত অসুখের বিষয়ে একটি অধ্যায় সংযোজন করলেন আর এই অসুখের নামকরণ করলেন– অ্যালজাইমারস ডিজিজ। সবশেষে ১৯১১ সালে জোসেফ নামে আর একজন রোগীর বৃত্তান্ত নিয়ে অ্যালজাইমার একটি গবেষণাপত্র রচনা করেন। তার মস্তিস্কে সেই জট পাওয়া না গেলেও একই রকম পাত পাওয়া গেল। অ্যালজাইমার সেটাকে একটা ভিন্ন অসুখ হিসেবে চিহ্নিত করলেও পরবর্তীকালে আমরা জানতে পারি সেটা তার নিজের বর্ণিত অসুখের একটি ভিন্ন পর্যায় মাত্র।
১৯১৫ সালে মাত্র একান্ন বছর বয়সে অ্যালজাইমার গত হন। তারপর দীর্ঘ পাঁচ দশকের জন্যে তাঁর অসামান্য অবদান বিস্মৃতির অন্ধকারে ডুবে ছিল। মনে করা হত অ্যালজাইমারস ডিজিজ বাস্তবে অত্যন্ত বিরল একটি অসুখ, কাজেই এই রোগ নিয়ে গবেষণায় বিশেষ কেউ আগ্রহী হলেন না।
গবেষণায় নতুন জোয়ার
অ্যালজাইমার যখন গবেষণারত ছিলেন জীবকোষের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াগুলো সম্পর্কে অনুসন্ধান করার মতো প্রযুক্তিও জানা ছিল না। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে যে পাতগুলো (plaque) অ্যালজাইমার দেখেছিলেন সেগুলো কী ভাবে তৈরি হচ্ছে তা জানার জন্যে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে অনেক বছর। আশির দশকে বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন অ্যামায়লয়েড বিটা (Amyloid β) নামে এক রকমের পদার্থ এই পাতগুলোর মূল উপাদান। ততদিনে এও জানা গেছে যে অ্যামায়লয়েড অন্যান্য অনেক অসুখের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
ধীরে ধীরে বিজ্ঞানীদের মধ্যে অ্যালজাইমারস ডিজিজ সম্পর্কে গবেষণার আগ্রহ বাড়তে থাকে। পাশ্চাত্য দেশগুলিতে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় অ্যালজাইমারস ডিজিজ এখন আর কোনও বিরল রোগ নয়, বরং অসংখ্য মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত [২]। যেহেতু অ্যালজাইমারস ডিজিজ খুব ধীর গতিতে বাড়ে, আক্রান্ত হবার পর রোগীরাও বেঁচে থাকেন বেশ কিছু বছর। সেইসাথে তাদের চিকিৎসার খরচও বেড়ে চলে দ্রুতগতিতে। অতএব এর একটা বিহিত করার দরকার পড়লো। জোরকদমে শুরু হলো গবেষণা। আর গবেষণায় গতি বাড়ায় চিকিৎসা বিজ্ঞান অল্প দিনেই অনেকটা পথ এগিয়ে যেতে সমর্থ হল।
১৯৯২ সালে বিজ্ঞানী জন হারডি এবং অন্যান্যরা অ্যামাইলয়েড সংক্রান্ত তত্ত্ব প্রকাশ করলেন [৩]। যে প্রশ্নটা তখনো অজানা ছিল, সেটা হলো, অ্যালজাইমারস-এর উৎপত্তি হয় কোত্থেকে। ওই জটগুলো আগে হয়, না অ্যামাইলয়েড-সমৃদ্ধ পাতগুলো না অন্যকিছু। এটা জানা জরুরি কারণ উৎস জানলে গোড়াতেই একে থামিয়ে দেওয়া যাবে। ১৯৯২-র ওই গবেষণাপত্রে বলা হলো যে অ্যামাইলয়েড বিটা-ই যত নষ্টের গোড়া এবং দেখানো যায় যে অ্যালজাইমারস-এর সবকটা উপসর্গ এই অত্যন্ত ক্ষতিকর পেপটাইড-এর হাত ধরেই আসে। কিন্তু জিনিসটা যখন এতই ক্ষতিকর, দেহে এর উৎপত্তি হয় কিভাবে, সেই প্রশ্নেরও উত্তর দেওয়া প্রয়োজন।
রোগের ঘাঁটি
গবেষকদের দেওয়া উত্তরটা বুঝতে ছোটবেলার রসায়নে একবার ঢুঁ মারতে হবে। আমরা শিখেছিলাম যে প্রোটিন, পেপটাইড, এগুলো আসলে অ্যামিনো অ্যাসিড-এর ইয়া লম্বা লম্বা চেন। আর অ্যামিনো অ্যাসিড হলো সেইসব জৈব (organic) যৌগ যাতে একদিকে আছে একটা অ্যামাইন (-NH2) গ্রুপ আর অন্যদিকে আছে একটা কার্বক্সিল (-COOH) গ্রুপ। এদের অনেকগুলোকে পেপটাইড বন্ধনের মাধ্যমে জুড়লে তৈরি হয় ওই চেনগুলো। যেরকম এইটা:
অ্যামাইলয়েড বিটা-ও তেমনি একটা পেপটাইড। এগুলো এতটাই লম্বা হয় আর পাকিয়ে যায় (folding) যে উপরের ছবির মতো রাসায়নিক গঠনটা দেখানো কঠিন। এই হলো ছবিতে অ্যামাইলয়েড বিটা। কল্পনা করে নিন, ওই ফিতে-টা আসলে উপরের যৌগের মতোই ছোট ছোট অ্যামিনো অ্যাসিড জুড়ে তৈরি।
দেহে যদি এমন কোনো প্রোটিন থাকে যার লম্বা চেন-টা ভাঙ্গলে অ্যামাইলয়েড বিটা-র অপেক্ষাকৃত ছোট চেন-টা বেরিয়ে আসে, তাহলেই বোঝা যাবে কোত্থেকে আসে সেই ক্ষতিকর অ্যামাইলয়েড বিটা নামক পেপটাইড। গবেষকরা সেই প্রোটিন-এরই খোঁজ দিলেন।
তাঁরা বিভিন্ন পূর্ব গবেষণাকে একত্র করে দেখালেন যে অ্যামাইলয়েড প্রিকারসর প্রোটিন (APP) নামে এক ধরণের প্রোটিন ভাঙ্গলে তৈরি হতে পারে অ্যামাইলয়েড বিটা পদার্থটি। মানবদেহের ২১ নম্বর ক্রোমোজমে রয়েছে APP নামে একটি জিন। APP জিন থেকে কোষের ভিতর তৈরি হয় APP প্রোটিন, যা অ্যামায়লয়েডের পূর্বসুরি। এই প্রোটিন যে সে ভাবে ভাঙ্গলে চলবে না। এমন জায়গায় সেই প্রোটিন-এর মধ্যে কোপ মারতে হবে যে অ্যামাইলয়েড বিটা-র চেন-টা অক্ষত বেরিয়ে আসে। স্বাভাবিক অবস্থায় প্রোটিনটা যেভাবে ভাঙ্গে, তাতে অ্যামাইলয়েড বিটা-র মাঝে কোপ পরে।
কিন্তু দেখা গেলো, এমন কিছু পন্থা (pathway) আছে যাতে অক্ষত অ্যামাইলয়েড বিটা বেরিয়ে আসতে পারে। সাধারণত আলফা এবং গামা সিক্রেটেজ ( secretase) দুটি উৎসেচক APP প্রোটিনকে ভেঙে ফেলে। এর ফলে যে ধরণের অ্যামায়লয়েড তৈরি হয় তা কোষের পক্ষে ক্ষতিকর নয়। কিন্তু অ্যালজাইমারস রোগের ক্ষেত্রে গামা-র জায়গা নেয় বিটা-সিক্রেটেজ। বিটা সিক্রেটেজ-এর হাতে পড়ে প্রোটিন ভেঙ্গে তৈরি হতে পারে ৪২ টি অ্যামিনো-এসিড-লম্বা অ্যামাইলয়েড। এই অ্যামায়লয়েড যাকে বিজ্ঞানীরা এ বিটা ৪২ বলে জানেন তা স্নায়ুকোষের চারদিকে জমা হতে শুরু করে। শুধু তাই নয়, খুব সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে এ বিটা ৪২ একবার তৈরি হতে শুরু করলে তা স্বাভাবিক অ্যামায়লয়েডের গঠনকে প্রভাবিত করে ক্ষতিকর অ্যামায়লয়েডে পরিণত করতে পারে। এই অ্যামাইলয়েড সহজে দ্রবীভূত হয়না এবং তাই স্নায়ুকোষের পক্ষে ক্ষতিকর। বহু বছর ধরে এরা স্নায়ুকোষের মধ্যে জমা হতে থাকে এবং শেষে কোষটির মৃত্যু ঘটে।
রোগের কার্যপ্রণালী
অ্যামাইলয়েড বিটা যদি রোগের উৎস হয়, তাহলে বাকি উপসর্গগুলো কিভাবে হয়, সেটাও ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। যেমন, ড: অ্যালজাইমার বর্ণিত কোষের মধ্যে জট বা neurofibrillary tangle। তারও ব্যাখ্যা পাওয়া গেল।
অ্যামাইলয়েডের দোসর হল টাউ নামের আর এক প্রোটিন। স্বাভাবিক স্নায়ুকোষের কাঠামো রক্ষণাবেক্ষণে সাহায্য করে এই প্রোটিন। স্নায়ুকোষের চেহারাটা অনেকটা এইরকম: একদিকে কোষের মূল অংশটা যেটা মূলত অন্যান্য কোষের মতো, কিন্তু তার থেকে বেরিয়ে থাকে একটা লম্বা চোঙ্গামতো জিনিস যেটা কোষের নানান সিগন্যাল বাইরে নিয়ে যায়। তাকে বলে অ্যাক্সন। এই চোঙ্গার মতো অ্যাক্সন-এর কাঠামোটাকে দাঁড় করিয়ে রাখে টাউ প্রোটিন। কিন্তু অ্যালজাইমারস ডিজিজে টাউ প্রোটিন তার নিজের স্বাভাবিক কাজ করতে পারে না। তারা অ্যাক্সন-এর দেয়াল থেকে সরে এসে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে। ভেঙ্গে পড়ে স্নায়ুকোষের দেয়াল, আর অন্যদিকে তৈরি হয় টাউ প্রোটিন-এর জট (যে জট-টা দেখেছিলেন ড: অ্যালজাইমার)। হয়তো বা স্নায়ুকোষের সিগন্যাল-এ বাধাও পড়ে। নিচের ছবিটা দেখুন। টাউ প্রোটিন-এর নিজেদের মধ্যে জড়াজড়ি করার পেছনেও অ্যামাইলয়েড বিটা-র হাত থাকতে পারে, এমনই দাবি করলো ১৯৯২-এর গবেষণাপত্রটি।
এ তো গেল অ্যালজাইমারস ডিজিজ-এর রাসায়নিক প্রক্রিয়া। মস্তিস্কে কিভাবে রোগটা ছড়ায় সেটাও গবেষণার আরেকটা বিষয়। শেষ পর্যায়ে রোগটা ধরা সোজা কিন্তু যখন রোগটা পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েনি, তখন মস্তিস্ক কিরকম দেখতে হয়, সেটাও বোঝা প্রয়োজন। জার্মান গবেষক হাইকো ব্রাক এবং এভা ব্রাক একটি গবেষণাপত্রে প্রমাণ করলেন কী ভাবে ধাপে ধাপে অ্যালজাইমারস ডিজিজ ছড়িয়ে পড়ে মস্তিষ্কে [৪]। মস্তিষ্কের দুধারে থাকে টেম্পোরাল লোব। টেম্পোরাল লোবের অংশ ট্র্যান্সএন্টোরাইনাল কর্টেক্সে টাউ প্রোটিনের জট সবার আগে জমতে শুরু করে। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে হিপ্পোক্যাম্পাস এবং অন্যত্র।
হিপ্পোক্যাম্পাস আর তার সংলগ্ন মস্তিষ্কের অংশগুলি সবার আগে আক্রান্ত হয় বলে অ্যালজাইমারস ডিজিজের অধিকাংশ রোগীর প্রাথমিক লক্ষণ হয় স্মৃতির দুর্বলতা। আমাদের যে কোনও অভিজ্ঞতা বা সে সংক্রান্ত তথ্য প্রথমে সঞ্চিত থাকে হিপ্পোক্যাম্পাসে। এটা হল স্বল্পমেয়াদী স্মৃতির ভাণ্ডার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর একটা অংশ মস্তিষ্ক অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যায় আর এভাবেই আমরা বহু বছরের পুরনো ঘটনার কথা মনে রাখতে পারি। অ্যালজাইমারস ডিজিজের প্রাথমিক স্তরে স্বল্পমেয়াদী স্মৃতির (short term memory) দুর্বলতাই প্রথমে আমাদের নজরে আসে।
অ্যালজাইমারস ডিজিজের রহস্য কিন্তু এখানেই শেষ হল না। বিজ্ঞানীরা মনে করলেন অ্যামাইলয়েড আর টাউ –এই দুধরণের প্রোটিন যদি মস্তিষ্ক থেকে সরিয়ে দেওয়া যায় তাহলে হয়তো অসুখের গতিও থমকে যাবে। অ্যামাইলয়েডের বিরুদ্ধে তৈরি করা হল একাধিক এন্টিবডি। অনেক আশা নিয়ে রোগীদের ওপর তা পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগও করা হল। কিন্তু দেখা গেল তাতে মস্তিষ্কে অ্যামাইলয়েডের পরিমাণ কমলেও তাতে রোগীদের বিশেষ উপকার হল না। সবার কপালে তাই নতুন করে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল। তবে কি নেপথ্যে রয়েছে অন্য কোনও অপরাধী? এখনও সেই রহস্যময় অপরাধীর অনুসন্ধান চলছে পুরোদমে। আশা আছে এই অনুসন্ধানের কাজে উৎসাহী পাঠকেরা সহযাত্রী হবে আগামী দিনে।
তথ্যসূত্র ও অন্যান্য টুকিটাকি:
[১] অ্যালজাইমার-এর সেই প্রথম রোগীর কথা বিশদে এখানে পড়ুন: https://alzheimer.neurology.ucla.edu/pubs/alzheimerLancet.pdf
[২] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Alzheimer’s Association-এর ২০১৯-এর রিপোর্ট বলে যে এই মুহূর্তে দেশে আনুমানিক ৫৮ লক্ষ অ্যালজাইমারস রোগী রয়েছে। ৬৫-র ঊর্ধ্বে গেলে দশজনের একজন এই রোগের শিকার।
[৩] Alzheimer’s Disease: The Amyloid Cascade Hypothesis, J.A. Hardy, G.A. Higgins, Science, 256, 184-185।
[৪] Neuropathological staging of Alzheimer-related changes, H. Braak, E. Braak, Acta Neuropathologica,82, 239-259।
Sundar kahlo. Onek kichu janlam
Dr.Kallol Mukherjee