বহুদূত জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্ম
একটিমাত্র মহাজাগতিক ঘটনা। তাকে নিয়েই লেখা হলো অসংখ্য গবেষণাপত্র, তাও মাত্র দু’মাসের মধ্যে। বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার জ্যোতির্বিজ্ঞানী অবদান রাখলেন এসব গবেষণায়। এমন কাণ্ড জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে আগে কখনো বোধহয় হয়নি। কী সেই ঘটনা? কী তার মাহাত্ম্য? ঘটনাটি হলো মহাকাশে দুটি নিউট্রন তারার সংঘর্ষ আর তাদের মিলন। এর মাহাত্ম্য হলো, এই প্রথম বিজ্ঞানীরা একইসঙ্গে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ আর মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সাহায্যে আবিষ্কার করলেন একটি মহাজাগতিক ঘটনা। আর সেইসঙ্গে জন্ম নিলো জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটি নতুন শাখা: মাল্টি-মেসেঞ্জার অ্যাস্ট্রোনমি (multi-messenger astronomy) বা বহুদূত জ্যোতির্বিজ্ঞান। আর এই জন্মের দিনটি, অর্থাৎ ২০১৭ সালের ১৭ই অগস্ট বিজ্ঞানের ইতিহাসে লাল হরফে লেখা রইলো।
জানালা কেন?
শুরু করা যাক প্রথম থেকেই। আপনার কি মনে হয় দূরবীন দিয়ে আকাশ দেখে দেখে সময় কাটানো আর ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো, দুই সমান? তাহলে মনে করুন, আপনি আছেন একটি ঘরের মধ্যে, যার বাইরেটা সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা নেই। ঘরের একমাত্র দরজাটি তালাবন্ধ আর চাবি আপনার কাছে নেই। একটি জানলা আছে ঘরে। সেটি বন্ধ কিন্তু খোলা যায়। প্রশ্ন হলো, আপনি কি জানালাটি খুলবেন? আমি জানি যে আপনি খুলবেন। আর খুলতে যদি বেশ কষ্ট করতে হয়? তাহলেও আপনি খুলবেন।
যদি জিজ্ঞেস করি কেন? আপনি অবাক হয়ে বলবেন: এর আবার কারণ কী দেবো? এটাই তো স্বাভাবিক! বাইরে কী আছে দেখবো না? ব্যাস, অমনি আপনি মেনে নিলেন দূরবীন দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণের যৌক্তিকতা।
আমরা সত্যিই ভূপৃষ্ঠে, বলা যায় একটা ঘরের মধ্যে আমৃত্যু বন্দী। দরজায় তালা, বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। কিন্তু জানালা একটা আছে। দৃশ্যমান আলো। মানে যে আলোয় আমরা খালি চোখে দেখতে পাই। তাই যুগ যুগ ধরে আমাদের পূর্বসূরিরা আকাশের দিকে তাকিয়েছেন, আকাশ চেনার চেষ্টা করেছেন, তারাদের সাহায্যে সময়ের হিসেব করেছেন, দিকনির্ণয় করেছেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান বোধহয় প্রাচীনতম বিজ্ঞান। দূরবীন ছিল না এককালে। তাতে কী? খালি চোখে আর অন্য যন্ত্রপাতির সাহায্যে তারাদের অবস্থান, গ্রহদের অবস্থান, কালকে একই সময় তারা কোথায় থাকবে, এইসবই জেনেছে মানুষ। এমনই একটি যন্ত্র সেক্সট্যান্ট (sextant), যার সাহায্যে দুটি বস্তুর মধ্যে কৌণিক দূরত্ব মাপা যায়।
দৃশ্যমান আলোর জানালা
তবে গ্যালিলিও গালিলি যখন সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে একটি দূরবীন দিয়ে নভঃবস্তুদের দেখতে শুরু করলেন, আর যা দেখলেন সেইসব তথ্য লিখে রাখতে শুরু করলেন, তখনই বলা যায় মহাবিশ্বের প্রথম জানালা ভালো করে খুললো। এ ছিল দৃশ্যমান আলোর জানালা। আর এইসঙ্গে সূচনা হলো আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের।
কী দেখলেন গ্যালিলিও? দেখলেন চাঁদের পাহাড়, শনির বলয়, বৃহস্পতি গ্রহের চারিদিকে ঘূর্ণায়মান চাঁদ, আরো কতসব আশ্চর্য জিনিস। এও কি সম্ভব যে আকাশের স্বর্গীয় সব বস্তুতে থাকতে পারে খুঁত (পাহাড় আর গহ্বর)? পৃথিবীকে ছেড়ে বৃহস্পতির চারিদিকে কেন ঘুরবে কোনো নভঃবস্তু? কিন্তু জানালা দিয়ে তো আমরা তাই দেখলাম।
ব্যাস, শুরু হয়ে গেল অনুসন্ধান। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর লোকেদের অভাব কোনো কালেই হয়নি। তাদেরই একজন ছিলেন টাইকো ব্রাহে। ইনি অবশ্য আগেই, দূরবীন ছাড়াই, গ্রহনক্ষত্রের গতিবিধি সম্পর্কে অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। আর মূলত সেইসব তথ্য ব্যবহার করে তাঁরই এক সহকর্মী, জোহান কেপলার, আবিষ্কার করলেন গ্রহদের গতিবিধির নিয়ম। কিন্তু কেন গ্রহগুলি এইসব নিয়ম মেনে চলে তা কিন্তু তখনো বোঝা যায়নি। পরবর্তীকালে বিজ্ঞানী আইসাক নিউটন গাণিতিকভাবে কেপলারের পর্যবেক্ষণজনিত সূত্রগুলি প্রমাণ করেন। তিনি দেখান যে প্রকৃতিতে বস্তুর গতিবিধি আর তাদের পারস্পরিক মহাকর্ষীয় আকর্ষণের কতগুলি সাধারণ নিয়ম আছে যা পার্থিব বস্তু আর মহাজাগতিক বস্তুদের ক্ষেত্রে একইরকমভাবে খাটে।
মানবজাতির ইতিহাসে এ এক অসামান্য আবিষ্কার। এর ফলে মহাজাগতিক বস্তুগুলি আর আমাদের বুদ্ধির অগম্য রইলো না, কুসংস্কার আর মনগড়া ধারণা পিছিয়ে গেল অনেক দূরে, পৃথিবীর বাইরের এক বিশাল জগৎ এসে গেল আমাদের জ্ঞানের পরিধির মধ্যে আর এক অসীম সম্ভাবনার দরজা খুলে মানুষের মনন আর ধীশক্তি প্রথম এই ছোট গ্রহের বাইরে পা রাখলো।
জানালা বড় হতে শুরু করলো। অর্থাৎ বড়, আরো বড়, দূরবীন তৈরী হতে লাগলো। দূরবীন যত বড় হবে তত একটি নভঃবস্তু থেকে বেশি আলো সংগ্রহ করতে পারবে আর তত ভালো করে নভঃবস্তুটিকে দেখা আর বোঝা যাবে। অবশেষে ১৯১৭ সালে আমেরিকা-র ক্যালিফোর্নিয়া-র পাসাডেনা শহরের বাইরে উইলসন পাহাড়ের উপর বসানো হলো আড়াই মিটার ব্যাসের একটি দূরবীন। পরবর্তী বত্রিশ বছর ধরে এটিই ছিল বিশ্বের বৃহত্তম দূরবীন। আর এই দূরবীন দিয়েই বিজ্ঞানী এডউইন হাবল আবিষ্কার করলেন এই মহাবিশ্ব! এই সময়ে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল যে আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথ বা Milky Way-ই মহাবিশ্ব। হাবল এমন অনেক নক্ষত্রজগৎ আবিষ্কার করলেন যা আকাশগঙ্গা-র অনেক বাইরে। আর মানুষের মনন আর ধীশক্তি আরেকবার পা বাড়ালো সীমা থেকে অসীমের দিকে।
আরো জানালার সম্ভাবনা
আমরা এখনো পর্যন্ত যে মহাবিশ্বকে জানি, তা তো মোটামুটিভাবে আবিষ্কার হলো প্রথম জানালা দিয়েই। কিন্তু এই একটি জানালা, তাকে যতই বড় করা হোক না কেন, তা কিন্তু এই মহাবিশ্বকে সম্পূর্ণভাবে জানা বা বোঝার পক্ষে মোটেই যথেষ্ট নয়। কিন্তু অন্য জানালাগুলি কী?
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে-র অসংখ্য পরীক্ষানিরীক্ষার ফলে তড়িৎ-চুম্বকীয় বিদ্যার কতগুলি সূত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল এই সূত্রগুলি থেকে গাণিতিকভাবে দেখান যে দৃশ্যমান আলো প্রকৃতপক্ষে এক ধরণের তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ। আসলে এই তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মান যদি একটি নির্দিষ্ট ব্যাপ্তির মধ্যে থাকে তবেই তাকে আমরা খালি চোখে দেখতে পাই। কিন্তু কী হবে যদি এই তরঙ্গদৈর্ঘ্য সেই ব্যাপ্তির বাইরে, অর্থাৎ দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের থেকে কম বা বেশি হয়? যদি তরঙ্গদৈর্ঘ্য ক্রমাগত কমতে থাকে, তাহলে আমরা পাবো শক্তিশালী, আরো শক্তিশালী রশ্মিসমূহ, যেমন আল্ট্রা-ভায়োলেট বা অতিবেগুনি রশ্মি, এক্স-রে আর গামা-রে। আর যদি তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি হতে থাকে তবে আমরা পাবো ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আর রেডিও তরঙ্গ।
এইসব রশ্মিগুলো একে একে আবিষ্কৃত হয়। উইলিয়াম হার্শেল আবিষ্কার করেন অবলোহিত তরঙ্গ, উইলহেম রন্টজেন আবিষ্কার করেন এক্স-রে। বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন যে তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের দৈর্ঘ্যের ব্যাপ্তি বিশাল। রেডিওতে তরঙ্গদৈর্ঘ্য হতে পারে বড় বড় বাড়ির আকারের মতো। আবার গামা রশ্মিতে তা হতে পারে পরমাণুর কেন্দ্রকের মতো, যা কিনা এক মিটার-এর এক কোটি ভাগেরও দশ কোটি ভাগের এক ভাগ! আর এই অকল্পনীয় ব্যাপ্তির একটা ছোট্ট অংশ অধিকার করে আছে দৃশ্যমান আলো, যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য জীবাণুদের আকারের মতো। তাহলে এ কি সম্ভব যে শুধু দৃশ্যমান আলো দিয়েই মহাবিশ্বকে জানা আর বোঝা যাবে আর তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের বাকি অংশের কোনো ভূমিকাই থাকবে না?
রেডিও জানালা
না, একথা বিজ্ঞানীরা মেনে নিতে পারেননি, আর তাতেই খুলতে লাগলো একের পর এক জানালা। স্বাভাবিকভাবেই প্রথম জানালাটি খুললো রেডিও তরঙ্গদৈর্ঘ্যে। কেন? কারণ রেডিও দিয়ে বহুদূরে যোগাযোগ করা যায়। তাই শুধু গবেষণাগারের মধ্যে এই তরঙ্গ-সংক্রান্ত কাজ সীমিত নয় আর ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর বাইরেও এর একটা উপযোগিতা আছে।
ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই যেসব বিজ্ঞানীরা রেডিও তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা করেছিলেন তাদের কেউ কেউ সূর্য থেকেও রেডিও তরঙ্গ খুঁজেছিলেন। কিন্তু কেউই সফল হননি। এদিকে ১৯৩০-র দশকের প্রথমদিকে ইঞ্জিনিয়ার কার্ল জানস্কি একটি কোম্পানির হয়ে রেডিও-র সাহায্যে অতলান্তিক মহাসাগরের এপার থেকে ওপারে যোগাযোগের উপরে গবেষণা করছিলেন। মহাকাশ থেকে রেডিও তরঙ্গ খুঁজে পাওয়ার কথা তিনি ভাবেনও নি। কিন্তু সেইটাই পেলেন তিনি। পেতে লাগলেন একটি অদ্ভুত সিগন্যাল যা বেড়ে উঠছিলো ঠিক ২৩ ঘন্টা ৫৬ মিনিট পর পর। প্রথমে তিনি ভাবলেন, এ হলো সূর্য থেকে আসা রেডিও তরঙ্গ। তাঁর অ্যানটেনা-টি একটি নির্দিষ্ট দিক থেকেই মূলত রেডিও তরঙ্গ ধরতে পারে। দিনে একবার যখন সূর্য সেই নির্দিষ্ট দিকে আসে, তখনি তার অ্যানটেনা হয়তো সূর্যের রেডিও তরঙ্গ ধরছে, এরকমই প্রথমে ভেবেছিলেন তিনি। কিন্তু তাহলে ২৩ ঘন্টা ৫৬ মিনিট পর পর রেডিও সিগন্যাল বেড়ে উঠছে কেন? ২৪ ঘন্টা পর পর নয় কেন? বহুদূরের প্রায় স্থির হয়ে থাকা তারার সাপেক্ষে পৃথিবী ২৩ ঘন্টা ৫৬ মিনিটে একবার নিজের অক্ষের চারিদিকে ঘুরে আসে, ২৪ ঘন্টায় একবার নয় [১]। তাই বহুদূরের থেকে আসা কোনো রেডিও সিগন্যাল ২৩ ঘন্টা ৫৬ মিনিটেই একবার তাঁর অ্যানটেনা-য় বিশেষভাবে ধরা পড়ার কথা। অর্থাৎ তার সিগন্যাল-টি নিশ্চয় আসছে বহুদূরের কোনো জগৎ থেকে। শেষে বোঝা গেল সিগন্যাল-টি আসছে আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের সবচেয়ে ঘন অংশ থেকে। আমরা এখন জানি যে সেখানে বসে আছে একটি রাক্ষুসে কৃষ্ণগহ্বর। আর জানস্কি-র এই আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে খুললো মহাবিশ্বের রেডিও জানালা।
তবে এর মধ্যে বেজে উঠলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। যুদ্ধ ধ্বংস ডেকে আনে। মহাজগৎকে জানার প্রচেষ্টা স্তব্ধ করে দেয়। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর অর্থ, সময় বা সুযোগ কারোরই থাকে না। তবে যুদ্ধের দরকারে রেডিও প্রযুক্তির বেশ উন্নতি হলো। ফলস্বরূপ, যুদ্ধের পরেই রেডিও জ্যোতির্বিজ্ঞানের বেশ রমরমা শুরু হলো। রেডিও জানালা দিয়ে আমরা মহাবিশ্বকে নতুন চোখে দেখলাম, নতুনভাবে বুঝলাম আর আবিষ্কার হলো নতুন ধরণের সব নভঃবস্তু। যেমন, নিউট্রন-তারা, যার কথা আমরা এই লেখার প্রথমেই বলেছি, যা কিনা বহুদূত জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্ম দিতে সাহায্য করলো, তাও আবিষ্কৃত হলো এই রেডিও তরঙ্গের সাহায্যেই। এই নিউট্রন-তারাগুলি অতি আশ্চর্য বস্তু, এদের ভর সূর্যের ভরের থেকেও বেশি, কিন্তু আকারে এরা একটি শহরের মতো। আর তাই তাদের ঘনত্ব এতো বেশি যে নিউট্রন তারার এক পেয়ালা বস্তুর ভর এভারেস্ট শৃঙ্গকেও হার মানিয়ে দিতে পারে।
সত্যি বলতে কি দৃশ্যমান আলো দিয়ে আমরা মহাবিশ্বের বিস্তার, উপাদান আর রহস্যের বেশ কিছুটা আবিষ্কার করলেও তা ছিল বাংলা প্রবচন ‘অন্ধের হস্তিদর্শন’-এর মতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে নতুন নতুন জানালা খোলা আর সেই জানালাগুলি ক্রমাগত বড় করার প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে আমরা মহাবিশ্ব সম্পর্কে এতো নতুন নতুন জিনিস জানতে পেরেছি যে তার তুলনায় এই যুদ্ধের আগে পর্যন্ত্ আমাদের হাজার হাজার বছরের জ্ঞানকে শুধু ভিত-ই বলা চলে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ হিসেবে যদি কোনো সময়কে অভিহিত করা যায় তবে সেই সময় এখনই। আমি এখানে শুধু তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গে আরেকটা জানালা খোলার কথা বলবো।
এক্স-রে জানালা
রিকার্ডো জিয়াকোনি আর তার সহকর্মীদের একটি যন্ত্র যখন ১৯৬২ সালে সৌরমণ্ডলের বাইরের একটি বস্তু থেকে এক্স-রে খুঁজে পেলো, তখনি খুললো মহাবিশ্বের এক্স-রে জানালা। এই বস্তুটি হলো একটি যুগ্ম-তারা, যার একটি হলো নিউট্রন-তারা। লক্ষ্য করুন, বহুদূত জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতো এক্স-রে জ্যোতির্বিজ্ঞানেরও জন্ম হলো নিউট্রন তারার হাত ধরেই। এক্ষেত্রে সঙ্গী তারাটি থেকে গ্যাস ভীষণ বেগে নিউট্রন তারার উপর পড়ছে। ফলে সেই গ্যাস-এর তাপমাত্রা হয়ে যাচ্ছে দশলক্ষ সেলসিয়াস-এরও বেশি, আর তাই সেই গ্যাস বিকিরণ করছে এক্স-রে। তবে এই মহাজাগতিক এক্স-রে আবিষ্কারের জন্য জিয়াকোনি-কে তার যন্ত্রটিকে পাঠাতে হয়েছিল বায়ুমণ্ডলের উপরে, রকেট-এর সাহায্যে। কারণ মহাজাগতিক এক্স-রে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ভেদ করে আসতে পারেনা, পারলে আমাদের অস্তিত্ব থাকতো না।
আর কী কী দূত?
তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গই কিন্তু একমাত্র দূত নয়, যা দূর মহাবিশ্বের খবর আমাদের কাছে বয়ে আনে। ‘কসমিক রে’ নামে অতি শক্তিশালী নানা ধরণের কণাও আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে। এছাড়া রয়েছে অতি হালকা কিন্তু অত্যন্ত দ্রুতগতি নিউট্রিনো কণা যা প্রায় সবকিছুই ভেদ করে চলে যায় আর তাই তাদের খুঁজে পাওয়াও কঠিন। এইসব কণারাও কিন্তু মহাবিশ্বের একেকটি জানালা। তবে এই জানালাগুলির পুরো সদ্ব্যবহার এখনো শুরু করা যায়নি [২]।
মহাকর্ষীয় তরঙ্গের জানালা
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন ঘোষণা করলেন তাঁর নতুন মহাকর্ষীয় তত্ত্ব। তিনি বললেন যে বস্তুর মহাকর্ষের প্রভাবে স্থানকাল বেঁকে যায়, দুমড়ে যায়। আর কী আশ্চর্য, মহাকাশ পর্যবেক্ষণ-জনিত তথ্যগুলিও তাঁর এই অদ্ভুত তত্ত্বকে সমর্থন করলো। এখন প্রশ্ন হলো, একটি অত্যন্ত ঘন ও ভারী মহাজাগতিক বস্তুর বিশেষ গতির ফলে এই স্থানকালে এমন তরঙ্গের সৃষ্টি হতে পারে কিনা, যা মহাবিশ্বের দূর প্রান্ত থেকে আমাদের কাছে পৌঁছতে পারে।
উত্তর হলো, হ্যাঁ, পারে। কয়েক দশকের তাত্ত্বিক আর প্রযুক্তিগত গভীর গবেষণার ফলস্বরূপ ২০১৫ সালে আবিষ্কৃত হলো এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ [৩]। গবেষণায় প্রমাণিত হলো যে এই তরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছিল বহুদূরের দুটি কৃষ্ণগহ্বরের মিলনের ফলে। আর সেইসঙ্গে খুলে গেলো মহাবিশ্বের একটি নতুন জানালা। তবে স্বাভাবিকভাবেই কোনো আলো দেখা গেলো না এই মিলন থেকে কারণ দুটি কৃষ্ণগহ্বরের মিলনে সাধারণভাবে কোনো তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরিত হওয়ার কথা নয়। এইভাবে দেখার একটা ছোট্ট মুশকিল হলো যে একটা নতুন-পরিচয়-হওয়া দূতের খবর কতটা নির্ভরশীল তা আপনি ঠিক জানেন না। হয়তো এই দূত বলছে এক, আর আপনি বুঝছেন আরেক। এ যেন আপনি চোখ বুজে থাকতে থাকতে হঠাৎ মুখে তাপ অনুভব করলেন আর ভাবলেন রোদ এসে পড়লো আপনার মুখে। কিন্তু তাতো না-ও হতে পারে, পাশে হিটার চালানো হতে পারে। চোখ খুললেই আপনি জানবেন। অর্থাৎ মহাকর্ষীয় তরঙ্গের জানালা যে ঠিক খবর দিচ্ছে সেবিষয়ে যথার্থভাবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য একটা মহাজাগতিক ঘটনা একইসাথে মহাকর্ষীয় আর তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের দ্বারা দেখতে পাওয়া প্রয়োজন!
এই চোখ খোলা গেল ২০১৭ সালের ১৭ই অগাস্ট যখন দূর মহাবিশ্বের দুটি নিউট্রন তারার মিলন আমরা প্রত্যক্ষ করলাম শুধু মহাকর্ষীয় তরঙ্গের জানালা দিয়েই নয়, তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের বিভিন্ন জানালা দিয়েও। সম্পূর্ণ দুই ধরণের দূত একই সঙ্গে জানান দিলো এই অসামান্য মহাজাগতিক ঘটনার আর খুলে গেলো এক বহুদূত জানালা। অসামান্য ঘটনা কেন? কারণ এই ঘটনা থেকে আমরা জানতে পারলাম অনেক কিছু, যার প্রমাণ পাওয়া যায় মাত্র দু’মাসে লেখা অসংখ্য গবেষণাপত্র থেকে। আমরা জানলাম যে মহাবিশ্বের ভারী মৌলিক পদার্থগুলি এইরকম নিউট্রন তারাদের মধ্যে সংঘর্ষ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। আর তাই আপনার হাতের সোনার আংটি আর গলার সোনার হারের উপাদান অতীতের দুটি নিউট্রন তারার সংঘর্ষের ফলশ্রুতি।
টীকা :
[১] যে সময় অন্তর সূর্য দিনের আকাশে নিজের সর্বোচ্চ অবস্থানে ফিরে আসে তাকে এক সৌর দিন বলে। এক সৌর দিন = ২৪ ঘন্টা। এই সময় টা পৃথিবী নিজের অক্ষের চারিপাশে এক পাক ঘুরতে যত সময় নেয় তার থেকে মিনিট চারেক বেশি। এর কারণ পৃথিবী নিজের অক্ষের চারিপাশে এক পাক ঘুরতে ঘুরতে সূর্যের চারিপাশে নিজের কক্ষপথেও ১ ডিগ্রী মতো এগিয়ে যায়। এই এক্সট্রা সরণের জন্য সূর্যকে মাথার ওপর ফিরিয়ে আনতে পৃথিবীকে এক চরকিপাকের পরও আর একটুখানি পাক খেতে হয়। এতেই চার মিনিট বেশি সময় যায়। বিস্তারিত জানতে এখানে দেখুন।
[২] মিউয়ন কণা-র সাহায্যে সাম্প্রতিক এক আশ্চর্য আবিষ্কারের কথা জানতে ‘বিজ্ঞান’-এ প্রকাশিত এই লেখাটি পড়ুন: https://bigyan.org.in/2018/08/24/great-pyramid-muon-tomography/ ।
[৩] মহাকর্ষীয় তরঙ্গের আবিষ্কার নিয়ে বিশদে জানতে ‘বিজ্ঞান’-এ প্রকাশিত এই লেখাটি পড়ুন: https://bigyan.org.in/2016/05/23/gravitational-wave-detection-ligo_1/ ।