“বিজ্ঞানের সম্পূর্ণ শিক্ষার জন্যে পারিভাষিকের প্রয়োজন আছে। কিন্তু পারিভাষিক চর্ব্যজাতের জিনিস। দাঁত-ওঠার পরে সেটা পথ্য।” — বিশ্বপরিচয়, রবীন্দ্রনাথ।
পারিভাষিক বর্জন করে বিজ্ঞান নিয়ে লেখা বিশ্বপরিচয়-এর প্রবন্ধগুলি বিশ্বকবির প্রতিভা ও অধ্যবসায়-এর এক অনন্যসাধারণ পরিচয়। শুরুতেই একথাটির উল্লেখের কারণ ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়াদের নিয়ে লেখা এই সামান্য প্রবন্ধটি লিখতে গিয়ে পরিভাষিক বর্জনের দুরহ ভার সমূহভাবে উপলব্ধি করছি। কথ্য ভাষায় যাকে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া বলে। শুধু এইটুকু বলে লেখা শুরু করি যে যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি।
গোড়ার কথা
সব জীবের দেহ এক বা একাধিক কোষ দিয়ে তৈরী। যেসব বৈশিষ্ট্যগুলো গোটা জীবটাকে জড়বস্তুর থেকে আলাদা করে (যেমন বিপাক, বৃদ্ধি, প্রজনন) তার অনেকগুলোই এক-একটা ছোট্ট কোষেরও বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ একটা কোষকে পৃথকভাবে জীবিত বলা যায়। এই কারণেই জীববিজ্ঞানের মূল তত্ত্বগুলো বোঝার একটা প্রধান উপায় হলো একটা কোষের মধ্যে উঁকি মেরে তার গঠন ও ভেতরের ক্রিয়াকর্ম পর্যবেক্ষণ করা।
জীবকোষ মূলত দুধরণের। প্রাণী ও উদ্ভিদের মতো আধুনিক জীবের (অর্থাৎ যারা বিবর্তনের ধারায় অপেক্ষাকৃত পরে এসেছে) কোষ বেশ সুচারুভাবে তৈরি। তার মধ্যিখানে থাকে পর্দাবেষ্টিত নিউক্লিয়াস, যার ভেতরকার ক্রোমোসোমে কোষের সমস্ত জেনেটিক তথ্য ঠাসা থাকে। কোষের গঠন ও ক্রিয়া সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে এই জেনেটিক তথ্য। নিউক্লিয়াসের বাইরে থাকে জেলির মতো সাইটোসল, তাতে ভেসে থাকে কুচি কুচি মাইটোকন্ড্রিয়া, রাইবোসোম, গলগি বডি-র মতো কোষের বাকি অংশগুলো। এই ধরণের কোষ-সমৃদ্ধ জীবকে ইউক্যারিওট বলে।
কিন্তু ব্যাকটেরিয়া-র মতো আদিম জীবের কোষের গঠন এতো সুন্দর নয়। একটা ব্যাকটেরিয়ার কোষের ভেতরটা দেখে মনে হয় কেউ যেন ক্রোমোসোম আর বাকি সব মালমসলা একসাথে একটা থলের মধ্যে পুরে দিয়েছে। কিন্তু এই আপাত বিশেষত্বহীনতার আড়ালে ব্যাকটেরিয়া-র কোষেও যেসব জটিল জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়া ঘটে চলেছে বিজ্ঞানীরা ইদানিং তার আভাস পেতে শুরু করেছেন। জানা গেছে জেনেটিক তথ্য থেকে প্রোটিন নির্মাণের ধাপগুলো। …
গালিভার এবং লিলিপুট
ব্যাকটেরিয়া বলতেই আমাদের মাথায় আসে ক্ষুদ্র জীবাণু। কিন্তু শুধু ‘ক্ষুদ্র’ বললেই হয় না, কিসের তুলনায় ক্ষুদ্র সেটা বোঝা দরকার। যেমন, মানবদেহের একটা কোষ মানবদেহের তুলনায় আকারে ১০১২ গুন্ ছোটো কিন্তু ব্যাক্টেরিওলজিস্টদের সবচেয়ে পরিচিত ই. কোলাই(E. coli) কোষের তুলনায় ১,০০০ গুণ বড় হতে পারে। শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়া-র জগতেই আকারের বিস্তর ফারাক দেখা যায়। এমন ব্যাকটেরিয়া-ও দেখা গেছে যাদের ক্ষুদ্র বললে বাকি ব্যাকটেরিয়াদের জন্য ক্ষুদ্র বিশেষণটা আর প্রযোজ্য থাকে না। এর একটা উদাহরণ হলো আক্রমাটিয়াম অক্সালিফেরাম (Achromatium oxaliferum) [১]। অনেকটা হ্যারি পটার জগতের কোনো এক ম্যাজিকমন্ত্রের মতো শুনতে এই ব্যাকটেরিয়াটি গড়ে ১৫০ মাইক্রন পর্যন্ত লম্বা এবং ৩০ মাইক্রন পর্যন্ত চওড়া হয় (১ মাইক্রন = ১ মাইক্রোমিটার বা ১ মিটারের ১০৬ ভাগের এক ভাগ ) [২]। ‘আক্রমাটিয়াম’-ই এই গল্পের গালিভার। আমাদের চেনা প্রায় সমস্ত ব্যাকটেরিয়াই এর তুলনায় লিলিপুট। তুলনাটা সম্পূর্ণ করতে সবচেয়ে পরিচিত ব্যাকটেরিয়া ই. কোলাই-এর পরিমাপটা এখানে বলি: দৈর্ঘ্যে ৩ মাইক্রন আর প্রস্থে ১ মাইক্রন। বাকিদের মধ্যে বেশিরভাগ চেনা ব্যাকটেরিয়াই আকারে এই ই. কোলাই-এর খুব কাছাকাছি [৩]।
ক্ষুদ্র ই. কোলাই এবং সুবৃহৎ আক্রমাটিয়াম অক্সালিফেরাম-এর মধ্যে আকার-আয়তন ছাড়াও বিস্তর ফারাক রয়েছে। সেই ফারাকগুলির কিছু হয়তো এসেছে আকারগত পার্থক্য থেকেই। তেমনি কিছু বিভেদ, এবং সেই বিভেদের অন্তর্নিহিত কারণ নিয়েই এই লেখা।
লিলিপুটরা কেন লিলিপুট ?
প্রথমেই যে প্রশ্নটা আমাদের মনে আসে, বেশিরভাগ ব্যাকটেরিয়ার ই. কোলাই-এর মতো ক্ষুদ্র হওয়ার পিছনে কোনো কারণ আছে কি? মূল কারণ হলো পরিবহন। ‘পরিবহন’ বলতে আমরা এখানে বুঝবো কোষের বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্তরকমের তথ্য ও উপকরণ-এর পরিবহন। আধুনিক ইউক্যারিওট কোষদের মতো ‘উন্নত’ পরিবহন ব্যবস্থা না থাকায় [৪], ব্যাকটেরিয়ার ভিতরে জেনেটিক তথ্য (প্রোটিন, আরএনএ, ইত্যাদি) থেকে শুরু করে দৈনন্দিন কাজকর্মের জন্য প্রয়োজন যাবতীয় ‘মেটাবোলাইটস’-দের পরিবহন হয় ব্যাপন বা ডিফিউশন (diffusion) পদ্ধতির উপর নির্ভর করে। এই পদ্ধতিটা খুবই সাদামাঠা। এক জায়গায় কোনো এক অণুর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেড়ে গেলে তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হয় চারিদিকে ছড়িয়ে পড়া।
ব্যাপন-নির্ভর পরিবহন যেমন সাদামাঠা তেমনি মন্থর। কতটা মন্থর তার একটা হিসেব দেওয়া যায়। এইভাবে পরিবহনের জন্য যে সময় লাগে, তা দূরত্বের দ্বিতীয় মাত্রার সাথে সমানুপাতিক। অর্থাৎ, ১ মাইক্রন পথ অতিক্রম করতে যদি ১ সেকেন্ড সময় লাগে, তাহলে ২ মাইক্রন যেতে সময় লাগবে (২)২ = ৪ সেকেন্ড। দূরত্বের সাথে সময় কি রাতারাতি বেড়ে যায়, সেটা বুঝতে নিচের ছবিটা দেখো।
তাই দ্রুত তথ্য পরিবহনের জন্য ব্যাকটেরিয়াদের ক্ষুদ্র হওয়া অত্যন্ত জরুরি। ব্যাকটেরিয়ারা আকারে খুব বেশি বড় হলে, কোষের মধ্যেকার একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে জেনেটিক তথ্য কিংবা মেটাবোলাইটসদের পৌঁছতে অনেক সময় লেগে যাবে। কিন্তু শুধু ক্ষুদ্র আকারই দ্রুত তথ্য পরিবহনের জন্য যথেষ্ট নয়।
সুপাররেসল্যুশন মাইক্রোস্কোপ
ব্যাকটেরিয়া কোষের মধ্যেকার সংগঠনও তথ্য পরিবহনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, অর্থাৎ জেনেটিক তথ্যের কথাই ধরা যাক। আমরা জানি, যাবতীয় জেনেটিক তথ্য DNA থেকে RNA হয়ে প্রোটিনে পৌঁছায়। কিন্তু ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে ঠিক কিভাবে সেই জেনেটিক তথ্য পরিবহন হয়? ঠিক কিভাবেই বা জেনেটিক তথ্য পরিবহনের কান্ডারিরা কোষের মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে? জানার জন্য আমাদের উঁকি দিতে হবে ব্যাকটেরিয়া কোষের মধ্যে।
কিন্তু এতো ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়ার মধ্যেকার সংগঠন খুঁটিয়ে দেখা মোটেই মুখের কথা নয়। সাধারণ অনুবীক্ষণ যন্ত্রে ব্যবহৃত “দৃশ্যমান” আলোকরশ্মির দীর্ঘ দৈর্ঘ্যের জন্য মোটামুটি ২০০ ন্যানোমিটার-এর চেয়ে ছোট কোন কণার গঠনগত বিশেষত্ব বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয় ( ১ ন্যানোমিটার = ১০-৯ মিটার )। আলোর ডিফ্র্যাকশন বা অপবর্তনের জন্যে সেইসব বিশেষত্বগুলো হারিয়ে যায়। তাই সাধারণ অনুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে একটা গোটা ব্যাকটেরিয়া দেখা সম্ভব হলেও, তার ভিতরের গঠন-সজ্জা দেখা সম্ভব নয়। এই সমস্যার সমাধান হলো ২০০৬ সালে। বিজ্ঞানী এরিক বেটজিগ ফ্লুরোসেণ্ট অণুর সাহায্যে আবিষ্কার করলেন এমন এক মাইক্রোস্কোপ, যাতে ১০ ন্যানোমিটার ফারাকের দুটি বস্তুকে আলাদা করে দেখা সম্ভব হলো। তারই নাম ‘সুপাররেসল্যুশন মাইক্রোস্কোপ’। এইখানে জানিয়ে রাখি, বিজ্ঞানী এরিক বেটজিগ এবং স্টেফান হেল-কে সুপাররেসল্যুশন মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কারের জন্য ২০১৪ সালে রসায়ন বিভাগে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়।
লিলিপুটদের অন্দরমহল
এই গল্পে আমার ছোট্ট একটা ভূমিকা রয়েছে। ২০০৯ সালে ইউনিভার্সিটি অফ উইসকনসিন ম্যাডিসন-এর প্রফেসর জেমস ওআইশার-এর ল্যাব-এ আমি এইরকমই একটা ‘সুপাররেসল্যুশন মাইক্রোস্কোপ’ তৈরী করার চেষ্টা করছিলাম। তখনও বাজারে ‘সুপাররেসল্যুশন মাইক্রোস্কোপ’ তৈরী করা চালু হয়নি, তাই সুপাররেসল্যুশন মাইক্রোস্কোপি করতে ইচ্ছুক সমস্ত বিজ্ঞানীকেই তাদের নিজেদের ল্যাবে নিজস্ব একটা মাইক্রোস্কোপ তৈরী করতে হত। সেইসময় আমার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল এই মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে কিছু ক্যান্সার কোষের ভিতরকার সজ্জা দেখা। কিন্তু ভাগ্যের ফেরেই হোক, বা ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়াদের নিয়ে আমার কৌতুহলের কারণেই হোক, এক বছর পর মাইক্রোস্কোপটি তৈরী হতেই আমি ব্যাকটেরিয়ার অন্দরমহলে দেখতে শুরু করলাম। এর পর প্রায় চার বছর আমি ব্যাকটেরিয়ার মধ্যেকার সজ্জা নিয়ে গবেষণা করেছি।
আমার গবেষণার কাজ ছিল ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে জেনেটিক তথ্য পরিবহনের বন্দোবস্ত ঠিক কিরকম তা পর্যবেক্ষণ করা। আমরা জানি, জেনেটিক তথ্য পরিবহন হয় দুই ধাপে৫।
- প্রথম ধাপকে বলে ট্রান্সক্রিপশন (transcription), যার মাধ্যমে আরএনএ পলিমারেস (RNA Polymerase) নামক এনজাইম DNA থেকে RNA তৈরী করে।
- এর পরের ধাপ হলো, ট্রান্সলেশন (translation), যার মাধ্যমে রাইবোজোম নামক জটিল আণবিক যন্ত্র এই আরএনএ থেকে প্রোটিন তৈরী করে।
আমাদের উদ্দেশ্য ছিল কোষের মধ্যে কোথায় এবং কিভাবে এই আরএনএ পলিমারেস এবং রাইবোজোম সাজানো রয়েছে তা জানা। আশাটা এইরকম যে আরএনএ পলিমারেস এবং রাইবোজোম-এর সজ্জার কথা জানলে আমরা তথ্য পরিবহনের দুটো ধাপ কিভাবে সম্পন্ন হচ্ছে, তার একটা ছবি পেয়ে যাবো। এই কাজের জন্য আমরা ব্যবহার করেছিলাম একটা বিশেষ ব্যাকটেরিয়া, আমাদের সবার পরিচিত ই. কোলাই। তবে যেহেতু তা সর্বজনবিদিত ‘Model Organism’, তাই আমি এখন থেকে আমাদের পর্যবেক্ষণগুলোকে ব্যাকটেরিয়াদের জন্য সাধারণভাবে সত্যি ধরে নিয়ে আলোচনা করবো।
ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে একটা সুপাররেসল্যুশন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে উঁকি মেরে আমরা দেখলাম যে জেনেটিক তথ্যপরিবহনের ব্যবস্থাটি খুব সুচারু ভাবে গোছানো [৫]। ব্যাকটেরিয়ার কোষ-রসের আপাত বিশেষত্বের অভাব থেকেই ব্যাকটেরিয়াকে বলা হয় “ Bag of Enzymes”, অর্থাৎ কিনা উৎসেচক দিয়ে ভর্ত্তি একটা থলে। আমরা দেখলাম যে তা একেবারেই সত্যি নয়।
অন্দরমহলের সজ্জা
প্রথমে বলা যাক জেনেটিক তথ্যের উৎসের কথা। ব্যাকটেরিয়া কোষের মধ্যে একদম শিড়দাঁড়া-বরাবর থাকে যাবতীয় জেনেটিক তথ্যের ভান্ডার, অর্থাৎ ক্রোমোসোম। ক্রোমোসোমাল ডিএনএ অনেকটা একটা প্রলম্বিত পিন্ডের মতো কোষের সাইটোপ্লাজম এর মধ্যে ভেসে থাকে। উন্নত ইউক্যারিওটিক কোষের মতো ব্যাকটেরিয়া ক্রোমোসোমের কোনো সজ্জাবিন্যাস না থাকায় এবং ক্রোমোসোম পর্দাবেষ্টিত না থাকায়, একে নিউক্লিয়াস এর বদলে নিউক্লিওয়েড বলে। প্রায় নিউক্লিয়াস-ই কিন্তু নিউক্লিয়াস নয়।
সুপাররেসল্যুশন মাইক্রোস্কোপে আমরা দেখলাম কোষের মধ্যে আরএনএ পলিমারেস সজ্জিত রয়েছে কোষের কেন্দ্রের নিকটবর্তী নিউক্লিওয়েড-এর গায়ে। এখানে ‘গায়ে’ কথাটা একটু জোর দিয়ে বলছি। নিউক্লিওয়েড-এর ভেতরে না থেকে, বেশিরভাগ সক্রিয় আরএনএ পলিমারেস নিউক্লিওয়েডের পরিধি বরাবর বিস্তৃত। অপরপক্ষে রাইবোজোমরা ছড়িয়ে রয়েছে নিউক্লিওয়েড আর কোষপর্দার মাঝামাঝি জায়গায় [৫]। নিচের ছবিটা দেখলেই তথ্য পরিবহনের পথটা স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রথমে নিউক্লিওয়েড-এর গা ঘেঁষে ট্রান্সক্রিপশন, তারপর নিউক্লিওয়েড আর কোষপর্দার মাঝামাঝি জায়গায় ট্রান্সলেশন।
ইউক্যারিওটিক কোষের মতো নিউক্লিয়ার পর্দা না থাকা সত্ত্বেও ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে জেনেটিক তথ্য পরিবহনের এই দুই ধাপ-এর মধ্যে স্থানভেদ বেশ চমকিত করেছিল আমাদের, এবং সম্ভবত অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া-অনুরাগীদেরও। তার কারণ প্রচলিত ধারণা ছিল যে এই দুই ধাপ সবসময় একসাথে হয়, যাকে কো-ট্রান্সক্রিপশনাল ট্রান্সলেশন (cotranscriptional translation) বলে [৬]। আমাদের গবেষণা দেখালো যে ট্রান্সলেশন সবসময় ট্রান্সক্রিপশন-এর সাথে হয় না।
এমন সজ্জার কারণ কি ?
এর থেকে বোঝা গেলো যে ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে জেনেটিক তথ্য পরিবহনের দুই ধাপ ঘটে দুই জায়গায়। কিন্তু এমনটা ঘটার কারণ কি? বা এইভাবে ভাবা যেতে পারে, এমনটা হলে ব্যাকটেরিয়ার কি সুবিধে হয় ? বিবর্তনের ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে যে কোনো সুনির্দিষ্ট সুবিধা অর্জন ব্যতীত কোনো বৈশিষ্টই দীর্ঘ সময়কাল ধরে স্থায়ী হতে পারে না, বিবর্তনধারায় লুপ্ত হয়ে যায়। এই প্রশ্নের উত্তরে এককথায় বলা যায় যে, জেনেটিক তথ্য পরিবহনের দুই ধাপ দুটো জায়গায় সংগঠিত হওয়ার সুবিধে হলো ধাপদুটোর দ্রুততা বৃদ্ধি।
তথ্য পরিবহনের প্রথম ধাপের দ্রুততার জন্য প্রয়োজন আরএনএ পলিমারেস-এর খুব তাড়াতাড়ি নিউক্লিওয়েড-এর মধ্যে ছড়িয়ে থাকা প্রয়োজনীয় ‘জিন’ খুঁজে বার করা এবং তা থেকে আরএনএ তৈরী করা। ঠিক একই ভাবে দ্বিতীয় ধাপের দ্রুততার জন্য প্রয়োজন এমন এক ব্যবস্থা যাতে রাইবোজোমরা খুব তাড়াতাড়ি RNA-গুলোকে খুঁজে বার করতে পারে, এবং তা থেকে প্রোটিন তৈরি করতে পারে। দুই ধাপের প্রতিটাতেই ‘Rate-limiting Step’, অর্থাৎ তথ্য পরিবহনের হার আটকে দেয় এই খুঁজে বার করার পদ্ধতি। এই খুঁজে বার করার সুবিধে করে দিতে পারলে তথ্য পরিবহনকে দ্রুততর করা যায়। এটি সম্ভবত ব্যাকটেরিয়া-র অন্দরমহলের সজ্জার কারণ। তথ্য-পরিবহনের ধাপ দুটো দুই জায়গায় হওয়ায়, এই খুঁজে বের করাটা আরো দ্রুত হয়।
এই ব্যাপারটাকে আরেকটু তলিয়ে ভাবা যাক। ধাপদুটো আলাদা আলাদা স্থানে না হয়ে, কোষের সমস্ত অন্দরমহল জুড়ে হলে, আরএনএ পলিমারেস এবং রাইবোজোম উভয়কেই তাদের লক্ষ্যবস্তু, যথাক্রমে জিন এবং RNA-কে সারা কোষময় খুঁজতে হতো। আর খোঁজার পদ্ধতিটা যথারীতি ব্যাপন-নির্ভর। ব্যাপন-নির্ভর পরিবহনের সময় কিভাবে দূরত্বের সাথে খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে চলে, তা আমরা আগেই আলোচনা করেছি। এথেকে খুব সহজেই ধারণা করা যায় যে, কোষের সম্পূর্ণ অন্দরমহল জুড়ে খোঁজার চেয়ে তার একটা নির্দিষ্ট অংশে খোঁজা অনেক বেশি সহজ।
তাই আরএনএ পলিমারেস ‘জিন’ খোঁজে কোষের অর্ধেক জুড়ে থাকা নিউক্লিওয়েড-এর গায়ে। ট্রান্সক্রিপশন এর পর RNA তৈরী হয়ে কোষের বাকি অর্ধেক অংশে ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে রাইবোজোমদের পক্ষ্যে দ্রুত সেই RNA-গুলোকে খুঁজে প্রোটিন সংশ্লেষ করা সম্ভব হয়। অযথা নিউক্লিওয়েড-এর মধ্যে খুঁজে সময় নষ্ট করতে হয় না।
সব লিলিপুট কি একরকম ?
আগেই বলেছি আমাদের বেশিরভাগ চেনা ব্যাকটেরিয়াই আকারে এই ‘ই. কোলাই’-এর খুব কাছাকাছি। খুব বেশি হলে ৫ গুন ছোট কি বড়। এর কারণ বেশিরভাগ ব্যাকটেরিয়া যাদের একটার বেশি ক্রোমোসোম নেই, তাদের পক্ষে খুব বেশি বড় হওয়া কঠিন। ডিফিউশন-নির্ভর পদ্ধতিতে তথ্য পরিবহন খুব মন্থর হয়ে গিয়ে কোষের যাবতীয় কাজকর্মকে গতিহীন করে তুলবে। কোষের বৃদ্ধি এবং বিভাজন-এর হার কমে যাবে এবং তাতে সেই জীবটা বিবর্তনের ধারায় বাকিদের চেয়ে পিছিয়ে পড়বে এবং ক্রমশ লুপ্ত হয়ে যাবে।
জেনেটিক তথ্য পরিবহনের দুই ধাপ দুটো আলাদা স্থানে হওয়াটা অন্যান্য ব্যাকটেরিয়াদের মধ্যেও পর্যবেক্ষিত হয়েছে। যেমন গ্রাম-পজিটিভ (Gram Positive) ব্যাকটেরিয়া ব্যাসিলাস সাটিলিস (Bacillus subtilis)-এর মধ্যেও দেখা গিয়েছে ট্রান্সক্রিপশন এবং ট্রান্সলেশন আলাদা আলাদা জায়গায় সম্পন্ন হয় [৭]। গ্রাম-নেগেটিভ ই. কোলাই এবং গ্রাম-পজিটিভ ব্যাসিলাস সাটিলিস বিবর্তনের সময়ধারায় একে ওপরের থেকে শতকোটি বছর দূরে। সুতরাং একথা মোটামুটি জোর দিয়েই বলা যায় যে, সাধারণ ব্যাকটেরিয়া, যারা এই গল্পের লিলিপুটরা, তাদের সকলের মধ্যেই জেনেটিক তথ্যপ্রবাহের দুই ধাপ কোষের দুই জায়গায় সম্পন্ন হয়। জেনেটিক তথ্য কোষের কেন্দ্রে নিউক্লিওয়েড থেকে বাইরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ছোট আকার আর সুচারুভাবে গোছানো ব্যাকটেরিয়া-র অন্দরমহল, এই দুইয়ের সম্মিলিত উপস্থিতিতে তথ্য পরিবহন যথাযথ সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয়।
তাই, ব্যাকটেরিয়া-র লিলিপুট জগতে এক গালিভার-এর আবির্ভাব আশ্চর্যের বইকি! প্রথমেই তথ্য পরিবহনের প্রশ্নটার একটা উত্তর খোঁজার দরকার হয়ে পড়লো। যারা সাইজে ছোট নয়, তাদের মধ্যে ব্যাপন-নির্ভর তথ্য পরিবহন তো বেশিদূর যেতে পারেনা। সেই গল্প পরের পর্বে।
তথ্যসূত্র ও অন্যান্য টুকিটাকি:
[১] আক্রমাটিয়াম অক্সালিফেরাম: ১৮৯৩ সালে রাশিয়ান বিজ্ঞানী ভ্লাদিমির শেওয়াকফ অণুবীক্ষণ যন্ত্রে প্রথমবার এই ব্যাকটেরিয়াটিকে পর্যবেক্ষণ করার সময়, এর মধ্যে ক্যালসাইট ক্রিস্টাল গুলিকে ক্যালসিয়াম অক্সালেট বলে ভুল করেন, এবং সেই অক্সালেট থেকেই অক্সালিফেরাম নামের উৎপত্তি।
[২] A Lakeside Tale, Small Things Considered, by Christoph Weigel
[৩] ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়াদেরও খোঁজ পাওয়া গিয়েছে, যেমন নানোআর্কিয়াম ইকুইটান্স, যারা কিনা আকারে ই. কোলাই-এর ১০০ ভাগের একভাগ।
[৪] ইউক্যারিওট কোষে পরিবহন খুব উন্নত মানের। মলিকুলার মোটোর্স্ নামের একধরণের প্রোটিন এবং ভেসিকল দিয়ে কোষের বিভিন্ন অংশে খুব দ্রুত প্রোটিন, আরএনএ, ডিএনএ, এবং অন্যান্য মেটাবোলাইটস পৌঁছে যায়।
[৫] Superresolution imaging of ribosomes and RNA polymerase in live Escherichia coli cells: Somenath Bakshi, Albert Siryaporn, Mark Goulian, James C. Weisshaar
[৬] ব্যাকটেরিয়ায় জিনগত তথ্যের আদান-প্রদান (প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব)
[৭] Compartmentalization of transcription and translation in Bacillus subtilis: Peter J. Lewis, Shail D. Thaker, and Jeffrey Errington