মাঝেমধ্যেই আমাকে শুনতে হয় যে বিজ্ঞানীদের সামাজিক সমস্যা নিয়ে আরেকটু ভাবনাচিন্তা করা উচিত। বিশেষ করে, সমাজে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কি প্রভাব পড়তে পারে, সেই ব্যাপারে দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। আমার মতো অন্যান্য বিজ্ঞানীদেরও হয়তো এই কথাটা শুনতে হয়েছে। ভাবনাটা এরকম যে বিজ্ঞানীরা যদি একটিবার তাদের লঘু সমস্যাগুলোকে ছেড়ে সমাজের গুরুতর সমস্যাগুলো নিয়ে মাথা ঘামায় তাহলে অভূতপূর্ব সাফল্য অপেক্ষা করে রয়েছে।
আমরা বিজ্ঞানীরা যে এইসব সমস্যা নিয়ে একদম মাথা ঘামাই না, তা নয়। কিন্তু কখনোই পুরোদমে লেগে থাকি না। এর কয়েকটা কারণ আছে। প্রথমত আমরা কোনো জাদুমন্ত্র জানিনা যে সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামালেই তার সমাধান বেরোবে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক সমস্যাগুলো বৈজ্ঞানিক সমস্যার থেকে অনেক বেশি প্যাঁচালো। যতবার এগুলোকে বাগে আনার চেষ্টা হয়েছে, খুব বেশিদূর এগোনো যায়নি।
আমার মনে হয়, অবৈজ্ঞানিক সমস্যা নিয়ে ভাবতে বসলে একজন বিজ্ঞানীর আর পাশের বাড়ির ছোকরার কোনো তফাৎ থাকে না। সামাজিক সমস্যা নিয়ে মুখ খুললে দুজনকেই সমান আনাড়ি লাগে। সমাজে বিজ্ঞানের গুরুত্বের প্রশ্নটাও যেহেতু মোটেই বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন নয়, সেই নিয়ে কিছু বলতে গিয়ে আমি হয়তো নিজেই নিজের কথা প্রমাণ করবো।
যাইহোক, বিজ্ঞানের একটা দানের সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। বিজ্ঞানের দৌলতে হাজারো জিনিস বানাতে পারি আমরা, করতে পারি অনেক কিছু। অবশ্যই সবটা বিজ্ঞানের কৃতিত্ব নয়। যখন বৈজ্ঞানিক সৃষ্টি কোনো ভালো কাজে লাগাই, সেটা আমাদের মূল্যবোধেরও পরিচয় দেয়। বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ভালোমন্দ দুয়েই লাগতে পারে কিন্তু কিভাবে তার ব্যবহার হবে, সেই নির্দেশাবলী বিজ্ঞান দেয় না। তার ক্ষমতাকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে সমাজের কল্যাণ হবেই কিন্তু অপপ্রয়োগে উল্টোটাও হতে পারে।
এটা মানবজাতির একটা সমস্যা। একবার হনোলুলু-তে বেড়াতে গিয়ে এই সমস্যাটাকে প্রকাশ করার একটা উপায় শিখেছিলাম। এক বৌদ্ধ মন্দিরে অধ্যক্ষমশাই যাত্রীদের বৌদ্ধধর্ম নিয়ে একটু ভূমিকা দিচ্ছিলেন। শেষে বললেন যে এমন একটি কথা বলতে চলেছেন যা কেউ কখনো ভুলতে পারবে না। আমি ভুলিওনি। বৌদ্ধধর্মেরই একটা প্রবাদ:
“সবার কাছেই স্বর্গের চাবিকাঠি দেওয়া আছে কিন্তু ওই চাবিতে নরকের দুয়ারও খোলে।”
তাহলে আর স্বর্গের চাবিকাঠি পেয়ে কি লাভ হলো? লাভ আছে। যদিও কোনটা স্বর্গের দরজা, কোনটা নরকের, সেটা না জানলে ওই চাবিটা ব্যবহার করা বিপজ্জনক, তাই বলে চাবিটার মূল্য তো অস্বীকার করা যায়না। ওটা না থাকলে স্বর্গে ঢুকবো কিকরে?
পথনির্দেশ যতই থাকুক, চাবি না থাকলে কিছুই হবে না। তাই যদিও বিজ্ঞানের হাত ধরে সমাজে চূড়ান্ত সর্বনাশ এসেছে, তবু তাকে ফেলা যায়না কারণ বিজ্ঞানের হাত ধরে অন্তত কিছু একটা করার সম্ভাবনা থাকে।
বিজ্ঞানের আরেকটা অবদান হলো মস্তিষ্কচর্চার সুযোগ। কিছু লোক বিজ্ঞান পড়ে, তার থেকে শিখে কিংবা সেই নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে অপার আনন্দলাভ করে। আবার কিছু লোকে হাতেকলমে বিজ্ঞানচর্চা করে সেই আনন্দের খোঁজ পায়। এই মস্তিষ্কচর্চার ব্যাপারটাকে কিন্তু হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অথচ বিজ্ঞানের সামাজিক প্রভাব নিয়ে যারা বিজ্ঞানীদের আরো সচেতন হতে বলে, তাদের এই দিকটা নিয়ে ভাবতে খুব একটা দেখিনা।
এই ব্যক্তিগত সন্তুষ্টির কি গোটা সমাজের জন্য কোনো মূল্য আছে? একদমই নেই। কিন্তু এখানে সমাজের কেন প্রয়োজন, সেকথাও ভাবতে হবে। শেষমেশ সমাজ কি সকলের ব্যক্তিগত উপভোগের জন্য একটা জটিল আয়োজন নয়? তাই যদি হয়, তাহলে বিজ্ঞানচর্চার আনন্দ আর পাঁচটা উপভোগ্য বস্তুর থেকে কোনো অংশে কম নয়।
তবে এখানেই শেষ নয়। বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টার ফলে মানবজাতির যে দৃষ্টিভঙ্গী তৈরী হয়েছে, সেটাকেও কোনোভাবে আড়াল করতে চাই না। পুরাকালের কবি কিংবা দূরদর্শী যা কল্পনাও করতে পারতো না, আজকে সেসব আমরা অনায়াসে ভাবতে পারি। আমরা দেখেছি যে প্রকৃতির কাছে আমাদের কল্পনাশক্তি কতটা তুচ্ছ। ভেবে দেখুন, কোনটা বেশি আশ্চর্যের: একটা তলহীন সমুদ্রে সাঁতার কাটছে একটা কচ্ছপ, তার উপর একটা হাতি, তার পিঠে রয়েছি আমরা1, নাকি একটা অজানা আকর্ষণের বলে কয়েক কোটি বছর ধরে ঘুরতে থাকা একটা গোলকের সাথে আমরা সেঁটে আছি, তাও আবার অর্ধেকজন হেঁটমুণ্ড হয়ে ঝুলে?
এই বিষয়টা নিয়ে আমি একান্তে অনেক ভেবেছি। সেইসব ভাবনার কথা বলতে গিয়ে হয়তো এমন কথার পুনরাবৃত্তি করছি যা আপনারাও নিশ্চয় ভেবেছেন। ভাবতে পেরেছেন কারণ আপনাদের সেইসব তথ্য জানা আছে যা অতীত মানুষের কাছে ছিল না।
এই যেমন ধরুন, আমি যখন সমুদ্রতীরে যাই, সেখানে দাঁড়িয়ে ভাবতে শুরু করি।
সামনে বহমান ঢেউ, অণুর পাহাড়, যে যার নিজের কাজেই মত্ত, পরস্পরের থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন, অথচ সবাই মিলে একসাথে একটাই সাদা ফেনা তৈরি করছে।
বছরের পর বছর ধরে, যখন কোন দৃষ্টি তাকে স্পর্শ করেনি, সময়ের আপন বহমানতায় সে তীরে এসে আজকের মতই আছড়ে পড়েছে। কার জন্য, কিসের জন্য? একটা মৃত গ্রহে যেখানে প্রাণের সম্ভাবনা অনিশ্চিত।
বিরামহীন, শক্তি তাড়িত, সূর্যের আদরে লালিত, শূন্যের মাঝে এই সৃষ্টি। বিন্দু বিন্দু জুড়ে সমুদ্রের এই মহাগর্জন।
সমুদ্রগর্ভে একই অণু থরে থরে সাজানো, এর মধ্যে থেকেই নতুন জটিলতর অণুর সৃষ্টি হয়। ক্রমে এরা নিজেদের আদলে আরো অণু তৈরী করে, শুরু হয় একটি নতুন নৃত্য।
ক্রমে বাড়ে আয়তন, জটিলতা। আসে প্রাণের স্পন্দন, পরমাণুর ঢিবি, ডিএনএ, প্রোটিন, নাচের কারুশিল্প হয় আরো সূক্ষ্মতর।
হামাগুড়ি দিতে দিতে তারা আসে ডাঙায়। দুপায়ে ভর করে দাঁড়ায়, সচেতন পরমাণুর ঝুলি, কৌতুহলী দৃষ্টি মেলে।
শেষে তারা দাঁড়ায় এসে সমুদ্রের তীরে, নিজের বিস্ময় নিয়েই বিস্মিত হয়, তাদের একজন আমি, এক বিশ্ব পরমাণু নিয়ে গড়া অথচ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মাঝে একটা পরমাণুরই সামিল।
সর্বসেরা অ্যাডভেঞ্চার
এই রোমাঞ্চ, প্রকৃতির বিশালতার সম্মুখে এই বিস্ময়, এটা বারে বারে আসে যখন কোনো সমস্যার তলদেশে আমরা পৌঁছতে পারি। যত জানতে পারি, রহস্য তত ঘনীভূত হয়, হাতছানি দিয়ে আরো ভিতরে টানে। হতাশার সম্ভাবনাকে ভ্রূক্ষেপ না করে হাসিমুখে বুক ফুলিয়ে মাঠে নামি। তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখি কোথায় কি অভাবনীয় অদ্ভুত বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে। জাগে নতুন প্রশ্ন, নতুন রহস্য। এ এক অ্যাডভেঞ্চার নয়তো কি?
এরকম ঐশ্বরিক অভিজ্ঞতা বিজ্ঞান না জানলে চট করে আসে না। আমাদের কবিরা এই নিয়ে লেখে না। আমাদের শিল্পীরা এই রোমাঞ্চকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা না। এরকমটা কেন হয়, আমি বুঝি না। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে ছবি আমরা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে জানতে পেরেছি, সেটা কি তাদের অনুপ্রেরণা যোগায় না? বিজ্ঞানের দুর্মূল্য উপহারের কথা চারণকবিদের মুখে মুখে ফেরে না। তাই আপনাদের পোড়া কপাল যে কাব্য কিম্বা গানের পরিবর্তে সান্ধ্য লেকচারে তার কথা শুনতে হয়। নাহ, এখনো এই যুগটাকে বিজ্ঞানের যুগ বলার সময় আসেনি।
এর একটা কারণ হতে পারে, আপনাকে এই ছন্দটা পড়তে শিখতে হবে, সেই শিক্ষার অভাবে একে চিনতে পারছেন না। ধরুন, একটা বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে এরকম কিছু একটা লেখা হলো: “একটা ইঁদুরের মস্তিষ্কের সেরেব্রাম অঞ্চলে তেজস্ক্রিয় ফসফরাস-এর পরিমাণ দু সপ্তাহে অর্ধেক হয়ে যায়।” এই কথাগুলোর মানে কি?
এর মানে হলো, একটা ইঁদুরের মস্তিষ্কে দু’সপ্তাহ আগে যে ফসফরাস ছিল (বা আপনার আমার মস্তিষ্কে ছিল), সেগুলো আজকে আর নেই2। মস্তিষ্কের পরমাণুগুলো প্রতিনিয়ত পাল্টে ফেলা হচ্ছে।
তাহলে মস্তিষ্কটা আসলে কি, পরমাণুদের মাধ্যমে চেতনা আসে কোত্থেকে? সত্যিই আশ্চর্যের! গত সপ্তাহে যে আলু খেয়েছিলাম, সেটা কোনোভাবে মনে রাখছে এক বছর আগে আমার মাথায় কি ঘুরছিলো। যে মাথাটার আর কিছুই আজ অবশিষ্ট নেই।
অর্থাৎ, যখন বৈজ্ঞানিকরা আবিষ্কার করেন কতক্ষণে মস্তিষ্কের পরমাণুগুলো বদলি হয়ে যায়, সে খবরটাকে এইভাবে পড়তে হবে। লক্ষ্য করতে হবে যে আমার আমিত্বটা শুধুই পরমাণুর একটা সজ্জা, তার মধ্যের পরমাণুগুলোর কোনো স্থায়িত্ব নেই। একটু আগে যে নৃত্যেভঙ্গিমার কথা বললাম, এ স্রেফ তাই। পরমাণুগুলো মস্তিষ্কে আসে, তাদের নৃত্য সেরে বেরিয়ে যায়। নতুন পরমাণু কিন্তু নৃত্যের ছন্দটা একই থেকে যায়।
আইডিয়ার চমক
তবে খবরের কাগজে লেখা থাকে এইরকমভাবে: “অমুক বিজ্ঞানী বললেন যে এই আবিষ্কার ক্যান্সার চিকিৎসায় কাজে লাগতে পারে।” এইসব কাগজের একটা আইডিয়ার ব্যবহার নিয়েই যত মাতামাতি, আইডিয়াটা নিয়ে নয়। সেটা যে আসলে কি বলছে, প্রায় কারোরই চোখে পড়ে না। কয়েকজন ছাত্র বাদে। একজন ছাত্র শিশু অবস্থায় এরকম একটা আইডিয়া ধরতে পারলে ওইখানেই একজন বিজ্ঞানী তৈরী হয়ে যায়। যতই বলি না কেন টিভি দেখে দেখে চিন্তাশক্তির বারোটা বাজছে, এইসব আইডিয়া মগজের ফাঁকফোকল দিয়ে ঠিকই গলে যায়। ধোঁয়াটে অবস্থায় হলেও শিশুরা তার সারবস্তু আয়ত্ত্ব করতে পারে আর সেটা হলেই আপনি ভবিষ্যতের একজন বিজ্ঞানীকে পেয়ে গেলেন। বিশ্ববিদ্যালয় অব্দি আসতে বড্ড দেরি হয়ে যায়, তাই ছোটবেলা থেকেই এইসব আইডিয়া তাদের বোঝাতে হবে3।
এবার আমি বিজ্ঞানের আরেকটা অবদানের কথা বলতে চাই। এটা কিছুটা পরোক্ষ তবে খুব বেশী নয়। অজ্ঞতা, সন্দেহ আর অনিশ্চয়তা, একজন বিজ্ঞানী এই তিনটে অবস্থার সাথে খুবই পরিচিত। এইটে খুব জরুরি বলে আমি মনে করি। একজন বিজ্ঞানী যখন উত্তর জানে না, সে অজ্ঞ, যখন একটা উত্তরের আভাস পাচ্ছে, সে অনিশ্চিত আর যখন মোটামুটি উত্তরের ব্যাপারে সুনিশ্চিত, তখনও তার মনে দানা বেঁধে আছে সন্দেহ। আমরা বিজ্ঞানীরা বুঝেছি যে এগোতে হলে এই অজ্ঞতাকে স্বীকার করতে হবে, এই সন্দেহের জন্য জায়গা রাখতে হবে। একইরকমভাবে, আজকের প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানে যে কথাগুলো বলা আছে, তার সবটা নিয়ে সমান নিশ্চয়তা প্রকাশ করা যায়না। কিছু একদমই অনিশ্চিত, কিছু প্রায় নিশ্চিতভাবেই ঠিক, কিন্তু কোনটাই প্রশ্নের আওতার বাইরে নয়।
এই অনিশ্চয়তার সাথে আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে। আমরা ধরেই নিয়েছি যে সবটা নিশ্চিতভাবে না জেনেও দিব্যি চলাফেরা করা যায়, এর মধ্যে কোনো স্ববিরোধ নেই। কিন্তু আমি জানি না সবাই এটা বোঝে কিনা। আমাদের এই সন্দেহ করার স্বাধীনতা এসেছে বিজ্ঞানের শুরুর দিনগুলো থেকে যখন কর্তৃপক্ষের সাথে সমানে যুঝতে হতো। সে বড়ো গভীর সংগ্রাম ছিল। আর কিছুই চাই না, শুধু প্রশ্ন করতে চাই, এই নিশ্চয়তা থেকে বেরোতে চাই। সেদিনের সেই সংগ্রামের কথা ভুলে গেলে চলবে না। তাহলে যা অর্জন করেছি, সেটাই হয়তো খোয়াতে বসবো। যাতে সেটা না হয়, সেখানেই সমাজের প্রতি আমাদের দায়িত্ব।
যখন ভাবি মানুষের মধ্যে সম্ভাবনা কত আর আসলে কি করতে পেরেছে, মনখারাপ হয়ে যায়। বারবার মনে হয় কত বেশি কিছু করতে পারতাম। অতীতের মানুষ তাদের রাতের দুঃস্বপ্নের মধ্যে ভবিষ্যতের আশা খুঁজে পেত। আমরা তাদের সেই ভবিষ্যৎ। তাদের আশা মাঝেমধ্যে ছাপিয়ে গেছি বটে তবে বেশিরভাগই স্বপ্ন রয়ে গেছে। আজকে আমরা যা আশা করে বসে আছি, তার সিংহভাগই বিগত দিনেও আশা করে ছিলাম।
ভালোমন্দের শিক্ষা
একদা ভাবা হতো যে মানুষের মধ্যে সম্ভাবনাগুলো সাকার হয়নি কারণ বেশিরভাগ মানুষই অশিক্ষিত। কিন্তু সর্বশিক্ষা অভিযান সফল হলেই কি সবাই এক একজন ভলতেয়ার তৈরী হবে? কুশিক্ষাও তো দেওয়া যায় একই মাধ্যমে। শিক্ষার ক্ষমতা যতই হোক, তাকে ভালোমন্দ দুদিকেই পরিচালনা করা যায়।
তারপর একসময় ভাবা হলো সর্বত্র যোগাযোগ স্থাপন করতে পারলে লোকে আরো বেশি বুঝতে শিখবে। কিন্তু এই ভাবনাতেও গণ্ডগোল আছে: যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে তো কাঠি করা যায়, তাদের দাবিয়েও ফেলা যায়। যে কথাগুলো এই মাধ্যমে পাচার করা হচ্ছে, তা সত্যি মিথ্যে দুইই হতে পারে। তাই যোগাযোগব্যবস্থাও এমন একটা বাহন যাকে ভালোমন্দ দুদিকেই চালানো যায়।
ফলিত বিজ্ঞানগুলোর থেকে আশা ছিল তারা অন্তত মানুষকে দৈনন্দীন জীবনের ঝুটঝামেলা থেকে মুক্ত করবে। যেমন, ওষুধে অসুখ সারে। এখানে তো সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। অথচ দেখুন গিয়ে, কিছু লোক ভয়ানক মন দিয়ে এই ফলিত বিজ্ঞানেরই ইস্তামাল করছে মহামারী কিংবা মারণবিষ বানাতে। কালকের যুদ্ধে এগুলোকে ছাড়া হবে।
যুদ্ধের কথাতেই আসা যাক। যুদ্ধ কেউ চায় না। সবার স্বপ্ন শান্তি। শান্তি বজায় থাকলে তবেই মানুষের পূর্ণ বিকাশ ঘটবে। কিন্তু কে বলতে পারে যে ভবিষ্যতে আমাদের মনে হবে না, এই শান্তিও ভালো মন্দ দুইই হতে পারে। হয়তো মানুষ তার শান্তিপূর্ণ জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে মদ্যপানের দিকে ঝুঁকবে। তখন হয়তো মদ্যপানের সমস্যাটা হবে সেই একটা সমস্যা যেটা পার হলেই মানুষ তার সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারবে।
অথচ বিশ্বজুড়ে শান্তি, মদ্যপান থেকে বিরত থাকা, দৈনন্দীন জীবনের আরাম, যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা, আদর্শবাদীদের স্বপ্ন, সবই এক একটা সাংঘাতিক ক্ষমতা।
এবং এরকম ক্ষমতা আমাদের কাছে পূর্বপুরুষদের থেকে অনেক বেশি রয়েছে। হয়তো এর ব্যবহার করে আমরা কিছু উন্নতিও করেছি। কিন্তু এলোপাথাড়ি হাতড়ে হাতড়ে যেটুকু করেছি, তার থেকে অনেক, অনেক বেশি করার কথা ছিল।
এরকমটা কেন হলো? নিজেদের জয় করতে পারলাম না কেন?
কারণ ক্ষমতা যতই থাকুক, তাকে ব্যবহার করার উপায় সাথে সাথে আসেনা। যেমন ধরুন, প্রকৃতির আচরণ নিয়ে আমরা যত জেনেছি, ততই মনে হয়েছে তার মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নেই। বিজ্ঞান এই উদ্দেশ্যবিহীনতা থেকে উদ্ধার করতে আসেনি। ভালোমন্দ নিয়ে সে সরাসরি কিছুই শেখায় না।
সর্বকালেই মানুষ জীবনের অর্থ খুঁজতে হয়রান হয়েছে। তাদের মনে হয়েছে, শুধু যদি একটা অর্থ বা দিশা দেওয়া যেত আমাদের কাজকর্মগুলোকে, তাহলেই মনুষ্যজাতির মধ্যে নিহিত সম্ভাবনাগুলোর বাঁধ ভেঙ্গে যেত। তাই এই প্রশ্নের অনেক উত্তরও এসেছে। কিন্তু সে উত্তর নানারকমের। যারা একটা বিশেষ উত্তরে বিশ্বাস করে, তারা আতঙ্কিত হয় আরেক দলের কাজকর্ম দেখে। অন্য দলের বিশ্বাসীরা মনুষ্যজাতির সব সম্ভাবনাকে একটা মিথ্যে অন্ধকূপে ঠেলে দিচ্ছে যে! সত্যি কথা বলতে কি, অন্ধ বিশ্বাসের বশে মানুষ যে ভয়াবহ সর্বনাশ করতে পারে, সেটা দেখেই হয়তো দার্শনিকরা মানুষের অসীম ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছেন। এবার খালি সঠিক পথটা দেখানোর অপেক্ষা।
কি সেই পথ? এই বিপুল আয়োজনের মানেই বা কি? কেন আছি, সেই রহস্যের কোনো সমাধান দেওয়া যায় কি?
আজ অব্দি যা জেনেছি যদি তাকে খতিয়ে দেখি — প্রাচীনকালের লোকেরা যা জানতো, যা তারা জানতো না অথচ আমরা আজ জানি — তাহলে একটা কথাই খোলাখুলি স্বীকার করতে হয়: আমরা ওপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর এখনো জানি না।
কিন্তু জানি না, এই কথাটা স্বীকার করেই হয়তো আমরা সেই সঠিক পথটা খুঁজে পেয়েছি।
এটা নতুন কথা বলছি না। যুক্তিবাদী সভ্যতার এটাই মূলমন্ত্র। এই দর্শনের হাত ধরেই আমাদের গণতন্ত্র এসেছে। যখন লোকে বুঝলো যে কোনো ব্যক্তিবিশেষ সরকার চালাতে জানে না, তখন এমন একটা ব্যবস্থা তৈরী হলো যাতে নতুন চিন্তাধারার জন্য সুযোগ তৈরী হতে পারে, সেগুলোকে কাজে লাগানো যেতে পারে, আবার প্রয়োজনে ছুঁড়ে ফেলে অন্য কোনো চিন্তাধারাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। একদম যাকে বলে ট্রায়াল এন্ড এরর সিস্টেম। এটা সম্ভব হলো কারণ ওই অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিজ্ঞানের সাফল্যের কিছুটা আভাস পাওয়া যাচ্ছিলো। সমাজব্যবস্থা নিয়ে যারা ভাবনাচিন্তা করেন, তারা বুঝতে পারছিলেন যে সব জেনেশুনে বসে না থেকে সম্ভাবনার রাজত্বে পাড়ি দিলে লাভ বই ক্ষতি হবে না। সন্দেহপ্রকাশ এবং আলোচনার মাধ্যমেই অজানাতে উত্তরণ সম্ভব। যদি এমন সমস্যার সমাধান করতে চাই যা আগে করিনি, তাহলে সম্ভাবনার দরজাগুলো তো খোলা রাখতেই হবে।
বিজ্ঞানীদের দায়িত্ব
এখনো আমরা মনুষ্যজাতির জন্মলগ্নেই আছি। তাই আমরা যে অনেক সমস্যা নিয়ে লড়াই করছি, সেটা স্বাভাবিক। আরো কত হাজার হাজার বছর আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। আমাদের উচিত যতটুকু সম্ভব করা, যতটা সম্ভব শেখা, গতকালের সমাধানগুলোকে একটু ঘষেমেজে পরের প্রজন্মকে চালান করে দেওয়া। কিন্তু ভবিষ্যতের মানুষকে ভাবনাচিন্তার স্বাধীনতা দিতে যেন না ভুলি, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। মনুষ্যজাতির কৈশোরে আমরা এমন ভুল করতে পারি যা আমাদের বিকাশকে অনেকদিনের জন্য আটকে দেবে। তার মধ্যে একটা ভুল হলো এখনই সব উত্তর জানার দাবি করা। এখন বয়েসই বা কত আমাদের! এখনই যদি সব আলোচনা সমালোচনা থামিয়ে দি, যদি বলি: “ব্যাস, এইখানেই শেষ! মানবজাতিকে উদ্ধার করলাম!”, তাহলে তো ভবিষ্যতের মানুষকে আমরা অনেকদিনের জন্য আমাদের তৈরী কয়েদে বন্দি করে দেবো। যে কয়েদ আমাদের সীমিত কল্পনাশক্তির দ্বারা আবদ্ধ। এরকমটা তো আগেও কতবার হয়েছে।
তাই বিজ্ঞানী হিসেবে আমাদের অবশ্য কর্তব্য এই অজ্ঞতার দর্শনকে মাথায় রেখে, চিন্তার স্বাধীনতাকে প্রচার করা। এইটা শেখানো যে মনে প্রশ্ন এলে তাকে ভয় পেতে নেই, বরং হাসিমুখে খোলাখুলি আলোচনা উচিত। এই চিন্তার স্বাধীনতাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাঁচিয়ে রাখাই আমাদের লক্ষ্য।
টিকা:
- এখানে ফাইনম্যান পুরাণের মহাজাগতিক কচ্ছপ বা কসমিক টার্টল-এর কথা বলছেন। বিভিন্ন সভ্যতার পুরাণে মহাবিশ্বের বাহক এই কচ্ছপকে দেখা যায়।
- ১৯৫৩ সালে স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশন-এর এক গবেষণায় রেডিও আইসোটোপ-এর সাহায্যে দেখানো হয়েছিল যে এক বছরের মধ্যে দেহের ৯৮ শতাংশ পরমাণু পাল্টে যায়। ফাইনম্যান সেই গবেষণার কথাই বলছেন।
- ফাইনম্যান পরবর্তীকালে বলেছেন: “আমি এখন বলবো যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে আসতে দেরি হয়ে যায়, তবু তাদের পক্ষে বিজ্ঞানের স্বাদ পাওয়া একেবারে অসম্ভব নয়।”
ক্যালিফর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি-র অনুমোদনে ফাইনম্যান-এর এই লেখাটি প্রকাশিত হচ্ছে। অনুবাদ করেছে ‘বিজ্ঞান’ টীম-এর স্বেচ্ছাসেবকরা (অমলেশ রায় ও অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়)।
Nicely presented.