একটা সমাজের কথা ভাবা যাক – যেখানে মানুষমাত্রেই বিজ্ঞানমনস্ক। কল্পনা করা যাক, সেখানে লোকাল ট্রেনে তাসের সাথে লোকজন আড্ডা জুড়েছে মানুষের ক্লোনিং করা উচিত কিনা তাই নিয়ে। সেই আড্ডায় যারা অংশ নিয়েছে, তারা কেউই কিন্তু বিজ্ঞানী নয়। চাকরী শেষে বাড়ি ফিরছে মফস্বলে। আলোচনা হয়ে উঠেছে প্রাণবন্ত। মোটামুটি দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে জনতা। একদল ক্লোনিং-এর পক্ষে, তাদের যুক্তি কৃত্রিম ভাবে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বানানো সম্ভব হলে চিকিৎসাশাস্ত্রে যুগান্তর আসবে। আরেক দলের বক্তব্য সহজে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্লোনিং করা উচিত না, এর সাথে জড়িয়ে আছে অনেক ন্যায়নীতির প্রশ্ন। এই আলোচনার মাঝে হঠাৎ স্মার্টফোনের হোয়াটসঅ্যাপে এক ফরোয়ার্ডেড মেসেজ পেল একজন। ঝকঝকে ছবিতে সেখানে লেখা – জাতিসঙ্ঘ আমাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীতকে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতের মর্যাদা দিয়েছে! পাশের জন দেখতে পেয়ে বলল – “আমায় ফরোয়ার্ড কর, দারুণ খবর”! কিন্তু সে ফরোয়ার্ড না করে জাতিসঙ্ঘের ওয়েবসাইটে গিয়ে খুঁজল এই খবরের সত্যতা। কই, এমন খবর কোথাও নেই তো! এ হল ফেক বা ভুয়ো খবর, সবাইকে সতর্ক করে দিল সে।
বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ মানে প্রযুক্তিতে উন্নত সমাজ নয়। প্রযুক্তির সুফল তো পয়সা থাকলে কেনা যায়। কিন্তু, সমাজে বিজ্ঞান মানসিকতা তৈরি করার কাজটা সময়সাপেক্ষ, প্রকৃত অর্থেই দুরূহ। ভারতের সংবিধানে সায়েন্টিফিক টেম্পার বা বিজ্ঞান মানসিকতা সকল নাগরিকের মৌলিক কর্তব্য হিসাবে উল্লিখিত আছে। অথচ, বিজ্ঞান মানসিকতা যে তেমন তৈরি হয়নি সেটা বোঝা যায় যখন দেখা যায় ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে ফেক খবর যাচাই না করে ফরোয়ার্ড করতে থাকে উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি। বিজ্ঞান মানসিকতার অভাব বোঝা যায় জ্যোতিষের রমরমা থেকেও। বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরির কোন ম্যাজিক ফর্মুলা নেই। তবে তা তৈরিতে কয়েকটি বিষয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। এক, বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরি করতে বিজ্ঞানের নিয়মিত আলোচনা জরুরী। তার জন্য বিজ্ঞানী হওয়াটা আবশ্যক নয়। প্রয়োজন গোঁড়ামি মুক্ত, যুক্তিবাদী, স্বচ্ছ ও সাহসী চিন্তাধারার। দুই, যদি এমন একটা সমাজের স্বপ্ন দেখি যেখানে পাড়ার রকে বা লোকাল ট্রেনে সিনেমা, ক্রিকেটের সাথে গ্লোবাল ওয়ার্মিং, ক্লোনিং, ইবোলা কিভাবে দূর করা যায়, বা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের আবিষ্কার যে কী রোমহর্ষক সে বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, তাহলে সেই সমাজ তৈরিতে বিজ্ঞানের আলোচনা ও নতুন উদ্ভাবনের কথা প্রচার করা জরুরী মাতৃভাষায়। অর্থাৎ, সেই ভাষায়, যে ভাষায় মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মনের ভাব প্রকাশ করতে শেখে।
বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ তৈরির লক্ষ্যে, মাতৃভাষায় বিজ্ঞানের আলোচনার স্বাদ আস্বাদনের উদ্দেশ্যে আত্মপ্রকাশ ‘বিজ্ঞান’-এর।
মুদ্রিত মাধ্যমে এই প্রথম আত্মপ্রকাশ করলেও ‘বিজ্ঞান’-এর সামান্য ইতিহাস আছে। প্রায় সাড়ে চার বছর আগে ‘বিজ্ঞান’ অনলাইন যাত্রা শুরু করেছিল www.bigyan.org.in-এ। বিজ্ঞান আর মাতৃভাষা বাংলার প্রতি যুগ্ম ভালবাসা ও স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সাথে বিজ্ঞানের মজা ভাগ করে নেওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে এই উদ্যোগ শুরু করেছিল গুটিকয়েক বাঙালী বিজ্ঞানপ্রেমী। সময়ের সাথে বহু বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ এই উদ্যোগে যোগদান করেন। কিছুদিনের মধ্যেই ‘বিজ্ঞান’ হয়ে ওঠে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাঙালী বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানপ্রেমীদের এক সংগঠন। ‘বিজ্ঞান’-এ আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণার বহু গভীর আলোচনা পাওয়া যাবে, যা গবেষণাপত্রের তুলনায় সহজবোধ্য। অথচ, সেগুলো প্রচলিত দৈনিক সংবাদপত্রে পরিবেশিত খবরের মত উপমায় অতিরঞ্জিত এবং প্রায়শই ভুলে ভরা নয়। গবেষণাজগতে প্রচলিত peer review-পদ্ধতিতে সম্পাদনার মাধ্যমে লেখাগুলির বৈজ্ঞানিক সত্যতা অক্ষুণ্ণ রাখতে আমরা সদা সচেষ্ট। bigyan.org.in-এ প্রকাশিত লেখার গুণমান আকৃষ্ট করেছে বহু বিজ্ঞানপ্রেমীকে। কাঁথি বিজ্ঞান সংস্থা (Contai Science Academy)-র সদস্যদের সাথে আলাপ সেই সূত্র ধরেই। সেই আলাপ থেকে একসাথে কাজ করার ভাবনা, তারই প্রথম ধাপ হল ‘বিজ্ঞান’ মুদ্রিত পত্রিকা। bigyan.org.in-এর মতই ‘বিজ্ঞান’ পত্রিকাতেও থাকবে পপুলার সায়েন্স ও পাঠক্রমিক লেখার সংকলন। ওয়েবসাইটে পূর্ব প্রকাশিত ও নতুন কিছু লেখা নিয়ে তৈরি ‘বিজ্ঞান’ পত্রিকাটি ছাপার অক্ষরে বাংলাভাষী সাধারণ মানুষের ও ছাত্রছাত্রীর উৎসাহী মনের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়বে, এই আশা রাখি।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের মজা ভাগ করে নেওয়ার জন্য আমাদের এই সংগঠন গড়ে উঠেছে ইন্টারনেটেই। bigyan.org.in-এর সক্রিয় সদস্যদের বেশিরভাগই একে অপরকে বাস্তবে দেখেনি! তারা ছড়িয়ে আছে বিশ্বের নানা প্রান্তে – ভারত, জার্মানী, নরওয়ে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইংল্যান্ড ইত্যাদি নানা দেশে। ইন্টারনেট আজ বিশ্বের এক বড় অংশের মানুষের সঙ্গী। স্যোশাল মিডিয়া থেকে ব্যাঙ্কের লেনদেন – সবই হয় ইন্টারনেটে। কিন্তু, এই ইন্টারনেটের আবিষ্কার কোথা থেকে হল? আশ্চর্য হলেও সত্যি যে যুগান্তকারী অন্যান্য বহু আবিষ্কারের মতই ইন্টারনেটও আবিষ্কার হয়েছে মৌলিক বিজ্ঞানের গবেষণার হাত ধরেই। মৌলিক বিজ্ঞান মানে যে গবেষণার উদ্দেশ্য কোন যন্ত্র বানানো নয়, অজানাকে জানার আনন্দে জ্ঞান আহরণ এবং মনের মধ্যে বুদবুদের মত উঠতে থাকা এক একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা। যেমন মহাবিশ্বের উৎপত্তি কোথা থেকে হল? মহাবিশ্ব কি দিয়ে তৈরি? আপাতভাবে ‘অকাজের’ এই বিজ্ঞানের হাত ধরেই আসে ‘কাজের’ আবিষ্কার। যেমন এসেছে ইন্টারনেট। সুপ্রতীক পাল লিখছেন সে কথা।
এই সংখ্যার এক অন্যতম আকর্ষণ অভিনব কিছু কার্টুন। পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক কৌশিক দাস আমেরিকার ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশানের এক অভিনব প্রোজেক্টের প্রধান। হাই স্কুল এবং কলেজের শুরুর দিকে বহু ছাত্রছাত্রী পদার্থবিজ্ঞানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কনসেপ্ট ভুলভাবে বোঝে। যেমন বল বা ফোর্স আর গতি নিয়ে বহু ভুল ধারণা তৈরি হয়। সেই ধরণের কিছু প্রশ্ন কার্টুনের আকারে তৈরি করা হল এই অভিনব প্রোজেক্টের উদ্দেশ্য। আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে বাংলাতেও আমরা সেই প্রশ্নগুলোর অনুবাদ করার সুযোগ পেয়েছি। প্রশ্নগুলো পাঠককে ভাবাবে, ছাত্রছাত্রী শিক্ষক-শিক্ষিকা নির্বিশেষে। প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া হল না ইচ্ছে করেই, যাতে প্রশ্নগুলো নিয়ে আলোচনা হয় সবার মধ্যে, যেমন ভাবে আমরা চায়ের দোকানে কোনো আকর্ষণীয় বিষয় নিয়ে তুমুল তর্কে মেতে উঠি, ও যুক্তি দিয়ে অন্যের মত খণ্ডন করার চেষ্টা করি ঠিক সেই ভাবে। ‘বিজ্ঞান’-এর ইমেইলে ([email protected])-এ প্রশ্নগুলোর উপর আলোচনা, উত্তর, বা প্রতিপ্রশ্ন পাঠানোর আহ্বান জানাই। সম্পাদকমন্ডলীর পছন্দের আলোচনা পরবর্তী সংখ্যায় ছাপা হতে পারে।
এছাড়াও থাকছে বেশ কিছু আকর্ষণীয় বিজ্ঞানের প্রবন্ধ। মহাকর্ষীয় তরঙ্গের আবিষ্কার, সোঁদা গন্ধের পিছনে বৈজ্ঞানিক রহস্য, ময়ূরের পেখম রহস্য, বালি ও তার অদ্ভুত ধর্ম ইত্যাদি। সেই সাথে bigyan.org.in-এর পাঠকের পাঠানো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এক প্রশ্ন ‘নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র থেকে কি তৃতীয় সূত্র প্রতিষ্ঠা করা যায়?’-এর উত্তর দিয়েছেন প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক জয়ন্ত ভট্টাচার্য। এই সব জমাটি বিজ্ঞানকথা নিয়েই যাত্রা শুরু হল ‘বিজ্ঞান’ পত্রিকার মুদ্রণ সংস্করণের!
প্রাপ্তি স্থান:
রয়্যাল আই টি আই,
প্রফেসর কলোনি, কন্টাই,
পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিমবঙ্গ – ৭২১৪০৪
যোগাযোগ নং – ৯৪৩৪০০৫৭৫৭, ৯৪৩৪৯৯১৯১৫
ইমেইল – [email protected],
মূল্য: ৩০ টাকা
I want to subscribe the magazine. Please send me details.