প্রসূন গুহ জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনে খ্যাতনামা বিজ্ঞানী সলোমন স্নাইডারের ল্যাবে রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট। আদতে প্রসূন ক্যান্সার বায়োলজিস্ট হয়েও স্নায়ুবিজ্ঞানের ওপর তাঁর গবেষণা ইদানিংকালে উচ্চ প্রশংসিত। তিনি প্যাসিফিক কড মাছ থেকে একটি প্রোটিন খুঁজে পেয়েছেন যেটি প্রস্টেট ক্যান্সার এবং সম্ভবত অন্য ক্যান্সারকেও দেহের ভেতর ছড়িয়ে পড়তে বাধা দেয়। তবে আমাদের আজকের আড্ডা তাঁর কোকেন সম্পর্কিত নিউরোসায়েন্সের গবেষণা নিয়ে। তাঁর সাথে কথা বললেন ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য।
ঋতুপর্ণা: বিজ্ঞানের মত নিভৃত সাধনা করেও তুমি তো এখন সেলিব্রিটি! বিবিসি, গার্ডিয়ান ছাড়াও দুশোটির ওপর ছোট বড় মিডিয়ায় তোমার কাজ নিয়ে হইচই রীতিমতো।
প্রসূন: (হেসে) তেমন কিছুই না। আসলে সব গবেষণাই গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি যে গবেষণা অসফল, তার মধ্যেও লুকিয়ে আছে আগামীর সাফল্যের বীজ। সবাই একটু একটু করে এগিয়ে দিচ্ছে সভ্যতাকে। কোনটা প্রচার পায়, কোনটা পায়না। তাছাড়া গবেষণাটি আমার একার নয়। এই কাজের কৃতিত্ব অনেকটাই আমার সুপারভাইজর সলোমন স্নাইডারের। তিনি আমায় পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন নিজের মত কাজ করার। তুমি আমার যেই পেপার নিয়ে কথা বলছ, আমি আর আমার সহকর্মী মাজিদ হ্যারাজ দুজনেই সেটির “equally contributing lead author”, যার অর্থ এই কাজের ব্যাপারে আমাদের কৃতিত্ব সমান।
ঋতুপর্ণা: তা বেশ। এইবার তাহলে ফেরা যাক কাজের কথায়। কোকেন যে মস্তিষ্ককোষের “ক্যানিবালিজম”-এর (স্বজাতিভক্ষণ) সাথে জড়িয়ে আছে এই রোমহর্ষক ঘটনা আসলে কি!
প্রসূন: একদম ছোট করে যদি বলি, ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে আমরা প্রমাণ করেছি যে নেশার সাথে জড়িয়ে বারবার উঠে আসা নাম কোকেন ব্রেনে একটি অতিসক্রিয় অটোফ্যাজি (autophagy) প্রক্রিয়াকে উদ্দীপ্ত করে। এর সাহায্যে মস্তিষ্কের কোষগুলি নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস করে ফেলে। এই পেপারে আমরা একটি সম্ভাব্য অ্যান্টিডোটও (CGP3466B ) প্রস্তাব করেছি।
ঋতুপর্ণা: “অটোফ্যাজি”, “অ্যান্টিডোট” এগুলো যদি একটু খুলে বল আমাদের পাঠকদের সুবিধে হবে।
প্রসূন: আচ্ছা এভাবে বলা যেতে পারে। মানুষের জীবনে যেমন দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ফলে বাড়িতে নানান আবর্জনা তৈরি হয়, কোষেও নানা শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়ার ফলে তেমনই কিছু বর্জ্য পদার্থ জন্মায়। অটোফ্যাজিকে বলা যেতে পারে ঘরের পরিচারক যে আবর্জনা সরিয়ে কোষকে পরিষ্কার আর কর্মক্ষম রাখে। এই প্রক্রিয়া কোষের রুগ্ন বা ক্ষতিগ্রস্ত অংশকেও সারাই করার কাজে অংশ নেয়। যেমন প্রয়োজন হলে ম্যাক্রো অটোফ্যাজি বাতিল মাইটোকন্ড্রিয়ার সম্পূর্ণ বিনাশ করে, আবার যদি মেরামতের অবকাশ থাকে তবে মিটোফ্যাজি (mitophagy) দিয়ে “সিলেক্টিভ ডিগ্রেডেশন” করা হয়। আমরা যেমন জঞ্জাল জমিয়ে রাখি ডাস্টবিনে, কোষ তেমনি মেমব্রেন বা পর্দা দিয়ে ঢাকা ব্যাগ বা ভ্যাকুওলে জমিয়ে রাখে বর্জ্য। ভ্যাকুওল নানান রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একে অন্যের সাথে জুড়ে যায় আর তারপর অ্যাসিড আর উতসেচক (enzyme) সমৃদ্ধ লাইসজোম ভ্যাকুওলে সংরক্ষিত আবর্জনার বিনাশ ঘটায়। এই উপকারী প্রক্রিয়াটি যদি প্রয়োজনের তুলনায় বেড়ে যায় এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তবেই ঘটে কোষের মৃত্যু। যেমন কোকেন সেবনের ফলে অটোফ্যাজি হয়ে যায় অনিয়ন্ত্রিত। তখন সে বর্জ্যপদার্থের সাথে সাথে প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন কোষের শক্তির উৎস সুস্থ মাইটোকন্ড্রিয়াকেও অনিয়মিতভাবে ধ্বংস করে ফেলে। ঠিক যদি আজ আমাদের গৃহপ্রচারিকা ঘর সাফাই করতে গিয়ে মিটারবক্সকে তুলে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেন, ব্যাপারটা যেমন দাঁড়াবে, অনেকটা ঠিক তেমন। এই পুরো প্রক্রিয়াকে থামানোর জন্য আমরা CGP3466B নামে একটি এমনই বস্তু বা অ্যান্টিডোটের কথা বলেছি যা আদতে কোকেনসেবনের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এই নিয়ে আরো গবেষণা দরকার।
ঋতুপর্ণা: আচ্ছা এই প্রসঙ্গে জানতে ইচ্ছে করছে কোষের মৃত্যু সাধারণত কিভাবে হতে পারে?
প্রসূন: প্রাণীরা যেমন চরম আবহাওয়া, বিষাক্ত পদার্থ বা টক্সিন আর দৈহিক অসুস্থতার কারণে মারা যায়, কোষও তাই। তবে এছাড়াও কোষ মানুষের মতই আত্মহত্যা করতে পারে। এই উপায়গুলি সাধারণত রাসায়নিকভাবে সঞ্চালিত এবং নানান প্রোটিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এতক্ষণ যে কোকেনের প্রভাবে অনিয়ন্ত্রিত অটোফ্যাজি নিয়ে কথা হল সেও একধরনের আত্মহত্যা বলা যেতে পারে।
ঋতুপর্ণা: এইবার যদি কাজটার গোড়ার কিছু কথা বল।
প্রসূন: আমরা আসলে কিভাবে কোকেনের অতিরিক্ত সেবনের ফলে কোষের মৃত্যু ঘটে সেই নিয়ে ফরেনসিক এক্সপার্টদের মত অটোপ্সি করেছি বলা যায়। অনেক আগেই স্নাইডার দেখিয়েছিলেন মস্তিষ্কের কোষগুলি নাইট্রিক অক্সাইডের মাধ্যমে যোগাযোগ করে। বহুদিন ধরে তার প্রভাব নিয়ে অনেক কাজকর্ম আছে তাঁর। ২০১৩ সালে আমাদের ল্যাব থেকেই জানা যায় এই কোকেনের প্রভাবে কোষের মৃত্যুর পেছনে নাইট্রিক অক্সাইডের সাথে GAPDH নামের একটি উতসেচকের যোগসাজস আছে। কিন্তু তখনও পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি কোষের পুরো মৃত্যুপ্রক্রিয়াটি। এইবারের কাজে আমরা সেই প্রক্রিয়াটি নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
ঋতুপর্ণা: কিভাবে এগোলে সেই কাজ নিয়ে?
প্রসূন: আমরা দেখেছিলাম যেসব গর্ভবতী ইঁদুরকে কোকেন দেওয়া হয়েছিল তাদের সন্তানদের ব্রেনসেলে অটোফ্যাজি দেখা যাচ্ছে। আমরা তখন বিভিন্ন প্রোটিনের (যেগুলি কোষের মৃত্যুর সাথে জড়িয়ে আছে) মাত্রা পরিবর্তন এবং কোষের কিরকম ভৌত পরিবর্তন ঘটে সেটি লক্ষ্য রাখছিলাম। এই দুটি পদ্ধতিই কোষের মৃত্যু ঘটার সংকেত দেয়। দেখা গেল কোকেনের প্রভাবে অনিয়ন্ত্রিত অটোফ্যাজি ঘটছে এবং কোষের মৃত্যু হচ্ছে। এইখানে বলা যায়, এর আগেও দুটি অন্য রিসার্চ ল্যাব থেকে প্রস্তাব করা হয়েছিল যে এস্ট্রসাইটস আর মাইক্রোগ্লিয়াতেও কোকেনের প্রভাবে নিয়ন্ত্রণবিহীন অটোফ্যাজি ঘটে (এরা নিউরন সহকারী কোষ)। তবে আমাদের রিসার্চে প্রথম বলা হয়েছে যে কোকেনের প্রভাবে ব্রেন সেলের মৃত্যু “সম্পূর্ণভাবে কেবল অটোফ্যাজি নিয়ন্ত্রিত”। নাইট্রিক অক্সাইড আর GADPH-এর যুগ্ম বিক্রিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি বিক্রিয়াপথও উল্লেখ করেছি আমরা (cascade signalling)।
ঋতুপর্ণা: তোমাদের এই গবেষণার প্রভাব বাস্তবে কতখানি?
প্রসূন: অনেকটাই। এর ফলে কোকেনের বিষক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিষেধক তৈরি সহজ হবে। যেহেতু আমাদের কাজের মধ্যে দিয়ে জানা গেছে কোকেন কিভাবে কাজ করে, এমন কোন বস্তু যদি আবিষ্কার করা যায় যেটা শুধুমাত্র অটোফ্যাজিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে কিন্তু কোষের অন্য কোন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করেনা, কোকেনের বিরুদ্ধে জয়লাভ সম্ভব। এমনকি যাদের মায়েরা কোকেনে আসক্ত সেইসব গর্ভজাত সন্তানও উপকৃত হবে।
ঋতুপর্ণা: তোমরা কি নিজেরাও এমন কিছুর সন্ধান দিয়েছ?
প্রসূন: যেমন আগেই বললাম, আমরা একটি রিসার্চ পেপারে এর আগেই দেখিয়েছিলাম CGP3466B নামের একটি প্রতিষেধক ইঁদুরের ওপর কোকেনের মারাত্মক প্রভাবকে কাটিয়ে ব্রেন সেলের পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু তখন আমরা জানতে পারিনি অটোফ্যাজির সাথে এর যোগাযোগের কথা। এই এখনকার কাজটিতে আমরা সেটা বলতে পেরেছি।
ঋতুপর্ণা: আগামীদিনে কিভাবে এগোবে ভাবছ?
প্রসূন: কিছু গবেষণা থেকে প্রমাণিত CGP3466B মানুষের জন্য ক্ষতিকারক নয়। ফলে আমাদের ইচ্ছে আছে এর কিছু ডেরিভেটিভ নিয়ে কাজ করে দেখার। এর ফলে কোকেনের প্রভাবে অটোফ্যাজি নিয়ে আরো আলোকপাত সম্ভব হবে। জানা যেতে পারে ব্রেনের বাইরেও কোকেন দেহের অন্য কোন কোষকে ধ্বংস করে কিনা। তাছাড়া কোকেনের বিরুদ্ধে মানবজাতির যুদ্ধজয়ের আরো জোরালো ওষুধ তৈরি করা যেতে পারে হয়ত।
ঋতুপর্ণা: আলোচনার শেষভাগে একটু অন্য কথা জানতে চাই। তুমি তো সম্প্রতি কলকাতায় স্কুল এবং কলেজে অনেক লেকচার দিলে। আজকের ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণা সম্পর্কে কিরকম ধারণা দেখলে?
প্রসূন: সত্যি বলতে আজকের ছেলেমেয়েদের মধ্যে উৎসাহের অভাব নেই। পরবর্তী প্রজন্মকে সঠিক পথ দেখাতে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আমাদের এগিয়ে আসতে হবে আরো। আমরা যারা সরাসরি বিজ্ঞানের সাথে যুক্ত আছি, তাদের অনেকেই এই বিষয়ে সচেতন। এতে উপকার হবে। শুধু পাঠ্যপুস্তকে তাদের আটকে না রেখে তাদের সৃষ্টিশীলতাকে বাহবা দেওয়া দরকার। বিজ্ঞানকে সহজলভ্য করে নিয়ে আসতে হবে শিশুমনের জন্য যাতে তাদের আগ্রহ আসে। এই প্রসঙ্গে বিজ্ঞান পত্রিকাকে আমি স্বাগত জানাই। তবেই তো আজকের ছেলেমেয়েরা নতুন কিছু চিন্তা করার দক্ষতা অর্জন করবে ধীরে ধীরে। যা একদিন তাদের এগিয়ে দেবে বিজ্ঞানের সাধনায়।
যে পেপারটি নিয়ে কথা হল, সেটির লিংক দেওয়া হল:
http://www.pnas.org/content/113/5/1417
তাছাড়া এখানে রয়েছে ওঁর অন্যান্য কাজের খোঁজ:
https://scholar.google.com/citations?user=RcpaCgQAAAAJ&hl=en
তথ্যসূত্র:
- https://www.theguardian.com/science/2016/jan/18/high-cocaine-doses-can-cause-brain-to-eat-itself
- https://www.hopkinsmedicine.org/news/media/releases/new_evidence_in_mice_that_cocaine_makes_brain_cells_cannibalize_themselves