সকালবেলা ব্যস্ত সময়ে কাপ হাতে চলতে গিয়ে চা বা কফি উছলে পরে বিড়ম্বনার শিকার আমার অনেকেই হয়েছি। কে জানতো দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গী এই আপাত তুচ্ছ ঘটনা বিজ্ঞানীদের এমন ভাবাবে? হান্স মেয়ার এবং রুজলান ক্রেচেটনিকভ নামে দুই বিজ্ঞানী এই ঘটনারই ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং মজার ব্যাপার হলো ওনাদের কাজ ফিজিক্যাল রিভিউ ই, মানে পদার্থবিদ্যার অন্যতম সেরা পত্রিকায় স্থান পেয়েছে।
বিজ্ঞানের অনেক কাজেই যেমন আপাতভাবে অসংলগ্ন অনেক ঘটনা একই ভাষায় বর্ণনা করা যায়, এখানেও তেমনি এক ভাবনা এই কাজে উৎসাহ জুগিয়েছিল। একটা পাত্রে কোন তরলকে নিয়ে নাড়ালে, সেই তরলের হাবভাব কি হবে তা জানার দরকার পড়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়, যেমন রকেট ওড়ার সময় তার জ্বালানী (প্রপেলান্ট) কিরকম আচরণ করবে বা জ্বালানীবাহী ট্যাঙ্ক কিভাবে চললে তার ভেতরের জ্বালানি তেল চলকে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটাবে না এইসব। চায়ের কাপের ব্যাপারটায় ফিরে এলে, এই ধরণের কাজ থেকে নতুন ধরণের চা-পাত্র বা কাপ বানানোর ধারণা পাওয়া যেতে পারে, যেগুলো নড়লেও তাতে রাখা চা কখনোই চলকে পড়বে না। সেই পাত্রগুলোতে চা নিয়ে চলাফেরা করতে অনেক সুবিধে হবে এবং চলন্ত গাড়িতেও সেগুলো অনায়াসে ব্যবহার করা যাবে। এইসব ব্যবহারিক দিক বাদ দিলেও, উদ্গতিবিদ্যার (ফ্লুইড ডাইনামিক্স) একটা মজাদার কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে এই কাজটা বিজ্ঞনীদের কাছে বেশ চিত্তাকর্ষক।
একটা মজাদার `এক্সপেরিমেন্ট’ এবং পেন্ডুলাম সমীকরণ
গবেষণাপত্রে ওনারা জানিয়েছেন যে মানুষের হাঁটার রকমসকম আর পাত্রে তরলের উথালপাথাল দুটোই মোটামুটি ভালো জানা; কিন্তু যেটা নতুন সেটা হলো হাঁটার গতির সাথে কাপে কফির আন্দোলনের সম্পর্ক কি সেটা বের করা। আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভুত শোনালেও এই জিনিসটা শ্রেফ নিউটনের সূত্র ব্যবহার করেই অঙ্কের ভাষায় লিখে ফেলা যায়। কিন্তু সেভাবে সমীকরণগুলো লেখা গেলেও, সেগুলোর সমাধানে বাধ সাধে পানীয়-বাহকের হাঁটার রকমফেরে তৈরি জটিলতা। তাই কেবলমাত্র অঙ্ক কষেই বলে দেওয়া যায় না ঠিক কোন ঘটনা কফি চলকে পড়ার জন্য দায়ী, দরকার হয় সত্যিকারের পরীক্ষানিরীক্ষা। রহস্য উদ্ঘাটন করতে তাই লেখকরা একজনকে কফির কাপ হাতে হাঁটিয়ে তাঁর এবং তাঁর কফির গতিবিধি রেকর্ড করেছেন — দারুণ পরীক্ষা , সন্দেহ নেই! কফিবাহককে নির্দেশ দেওয়া ছিল যে তিনি বিভিন্ন গতিতে নিজের স্বাভাবিক ছন্দে সোজা পথে হাঁটবেন। তবে তিনি কিছু সময় কাপের পানীয়ের দিকে খেয়াল রেখে হাঁটবেন, আর অন্য সময়ে তা চলকে পড়ার পরোয়া না করে হাঁটতে থাকবেন। স্বভাবতঃই, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কফি উথলে পড়ার প্রবণতা অনেক বেশি। কফির রকমসকমের দিকে নজর রাখতে ব্যবহার করা হয়েছিল একটি সেন্সর, যার কাজ ছিল কফি উথলে পড়লেই একটা এলইডি আলো জ্বালিয়ে দেওয়া। আর হাঁটার সমস্ত ভিডিও রেকর্ডিং থেকে একটা সফটওয়ারের মাধ্যমে হাঁটার গতি, ত্বরণ এইসব বের করা হয়েছিল।
পরীক্ষা করে যা দেখা গেল সেটাও কম চমকপ্রদ নয়। ব্যক্তিবিশেষে হাঁটাচলার ধরণ বদলালেও দেখা যায় যে কিছু বৈশিষ্ট কমবেশি সবার মধ্যেই থাকে। এই কাজে সেগুলোর ওপরেই জোর দেওয়া হয়েছিল। এটা জানাই ছিল যে কাপের গতি এবং কাপের মধ্যে তরলের গতি – এই দুরকম গতির আন্তঃক্রিয়ায় তরল কাপ থেকে উথলে পড়ে। দেখা গেছে স্থির অবস্থা থেকে হাঁটা শুরু করার সময়ে যে ত্বরণ হয়, সেটাই কাপ এর চা-কে প্রথম বার নাড়িয়ে দেয়। তাই সেই ত্বরণ যত বেশি হবে, চা ও তত চলকাবে। তাছাড়াও দেখা গেছে কাপের মধ্যে তরলের নিজস্ব স্বাভাবিক কম্পাঙ্ক থাকে, তা কাপের আকৃতি এবং তরলের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। এখন হাঁটার ছন্দ সেই কম্পাঙ্কের কাছাকাছি কোনো একটা কম্পাঙ্কে হলে সেটা ওই তরলকে সহজেই আন্দোলিত করতে পারে। রেসোন্যান্সের জন্য যেকোনো পরবশ দোলনের পরিমাণ যেমন বেড়ে যায়, এটাও সেই ব্যাপার। শুধু তাই নয়, হাঁটার সময়ে হাত-পা সবসময়ে একরকম ভাবে চলে না। বিশেষত যদি অমসৃণ মেঝেতে হাঁটা হয় বা হাঁটতে গিয়ে অন্যদিকে মন চলে যায়, তখন হাঁটার স্বাভাবিক ছন্দে ব্যাঘাত ঘটে অর্থাৎ অতিরিক্ত ত্বরণ সৃষ্টি হয়, চা চলকাতে পারে তাতেও। এতো গেলো এক্সপেরিমেন্ট এর কথা, সেই এক্সপেরিমেন্টের পর্যবেক্ষণ থেকে ধারণা নিয়ে দুই বিজ্ঞানী পুরো জিনিসটার একটা সহজ গাণিতিক ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। সেখানে তাঁরা হাঁটার সময়ে কাপ এর চায়ের উপরিতলের দোলনকে একটা পেন্ডুলাম এর গতির সাথে তুলনা করেছেন, যার ওপর বাইরে থেকে বল প্রযুক্ত হচ্ছে। এই প্রযুক্ত বলের উৎস হাঁটার সময় কফি-বাহকের দেহের গতি আর তাই, তার ধরণ এক্সপেরিমেন্ট থেকে পাওয়া তথ্য থেকেই মডেল করা হয়েছে।
এরপর, সাধারণ নিউটনের সূত্র থেকে পাওয়া (পেন্ডুলামের সমীকরণ গোছেরই) বেশ সহজ দেখতে কিছু সমীকরণ দিয়ে পুরো ঘটনাটার বর্ণনা করেছেন তাঁরা, এবং সেগুলোর সমাধানে পরীক্ষায় দেখতে পাওয়া প্রায় সব ধরণের মজাদার ঘটনাই দেখতে পাওয়া গেছে। তাছাড়াও উপরি পাওনা হলো যে এই কাজের পর লেখকরা জানাতে পারছেন কাপের ডিজাইন কেমন হলে তা থেকে তরল চলকে পড়ার আশঙ্কা কম। তাঁদের ধারণা, নমনীয় কাপ তরলের আন্দোলনকে মন্দীভূত করবে। কাপের ভেতরের দেয়ালে আংটির মতো ‘বাফল’ (baffle) ব্যবহার করলে তা একই কাজ করবে, তাছাড়াও তা উথলে ওঠা তরলকে ছোট ছোট ভাগে ভেঙে ফেলতে পারবে। ফলে কফি পড়ে যাওয়ার ভয় তখন অনেক কমবে।
প্রতিদিনের বিজ্ঞান, ভাবনা-জাগানো বিজ্ঞান
এই কাজ এর ফলাফল কিছু ভবিষ্যত কাজকেও উদ্বুদ্ধ করেছে। প্রথমত, ব্যক্তিবিশেষে হাঁটাচলার ভঙ্গিমার পার্থক্য, পদক্ষেপের দৈর্ঘের তারতম্য এইসবের ভূমিকা দেখা বাকি। তাছাড়াও, যখন কফি-বাহক সচেতন ভাবে হাঁটছেন, তখন কফি গরম না ঠান্ডা সেই ভিত্তিতে তাঁর মানসিক হিসেবের কি তফাৎ হয় সেইসব নিয়ে ভাবারও অবকাশ আছে। কিন্তু তাতে ঢুকতে হবে মানুষের মনের জটিল জগতে, ফলে তখন পরীক্ষার ধরণ একেবারে আলাদা, আর পরীক্ষার তত্ত্ব আর সমীকরণ ও আর নিউটনের সূত্র দিয়ে লেখা যাবে না। সব মিলিয়ে, কাজটা থেকে দেখা যায় যে, যেসব জিনিস আমরা প্রায়শই দেখতে অভস্ত, একটু থেমে তাদের বিজ্ঞান নিয়েও ভাবতে পারি আমরা।