দৈনন্দিন জীবনের চাপগুলো কখন অসুখের আকার নেয়? এর থেকে মুক্তির উপায়ই বা কী?
আজকে আমরা পরিচিত ও অতি-আলোচিত একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো। এর সমস্যা ও পরিণতি আজ 2017-এ দাঁড়িয়ে পরপর আরো প্রকট হয়ে উঠছে, এবং পরবর্তী সময়ে বা ভবিষ্যতে যে তা আরো ভয়ানক হয়ে আমাদের জীবনে আসতে চলেছে, তা টাইম মেশিন-এ ভ্রমণ না করেও আমরা সকলেই আজ নিশ্চিত। স্ট্রেস কথাটি আজ এতটাই ব্যবহৃত ও প্রযোজ্য যে এর সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজতে গিয়ে বেশ হিমশিম খেতে হলো!
প্রথমেই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কথা হিসেবে এটা জানিয়ে রাখি, রোজকার জীবনে প্রতিনিয়ত চলতে থাকা হাজারো চাপ আর স্ট্রেস নামক অসুখকে কিন্তু গুলিয়ে ফেললে চলবে না। রোজকার জীবনে চাপ নেই, এমন ব্যক্তি আজকের পৃথিবীতে বিরল। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় স্ট্রেস শব্দটির যে অসুখ-নিহিত অর্থ আছে, সেটাই আমাদের আজকের আলোচনার মূল বিষয়। মানসিক চাপ সহ্য ক্ষমতার বাইরে গিয়ে যখন ক্ষতি বা অসুখের আকার নেয়, তাকে এই আলোচনায় আমরা স্ট্রেস বলে উল্লেখ করবো।
স্ট্রেস কী এবং কাকে বলে?
স্ট্রেস কথাটি আজকাল প্রায় সব ক্ষেত্রেই বহুল-ব্যবহৃত (আর কিছুক্ষেত্রে অতিরিক্ত ও ভুলভাবে ব্যবহৃত) হলেও স্ট্রেস-কে শব্দের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা একটু হলেও কঠিন কাজ। আমাদের অবশ্যই মনে রাখা দরকার, রোজকার কাজের চাপ আর স্ট্রেস আলাদা — বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রোজকার টুকিটাকি চাপকে কিন্তু স্ট্রেস বলে না। কোনো চাপকে স্ট্রেস হিসেবে গণ্য করতে হলে সেটা একটা মাত্রা ছাড়াতে হয়।
Read more: ডিপ্রেশন
স্ট্রেস-এর বিভিন্ন মাত্রাকে বিজ্ঞানী গিলিয়ার্ড সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। যেমন:
- যে যে কারণে স্ট্রেস হতে পারে (Input function): কর্মক্ষেত্রের চাপ, যেমন, কম সময়ে বেশি কাজ করা, কাজে নির্ভুল থাকার চাপ, প্রতিকূল পরিবেশে কাজ বা তীব্র মানসিক আঘাত/অশান্তির মধ্যে কাজ।
- স্ট্রেস-এর কারণে যা যা হতে পারে (Output function): ব্যক্তির নিজস্ব অনুভব (যা ব্যক্তিবিশেষে বিভিন্ন রকম হতে পারে) ও তার আচরণে বদল।
- তাতে মনের উপর প্রভাব: এটি স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্নরকম হতে পারে।
- স্ট্রেস-এর ফলে কোনো মানুষের কার্যক্ষমতার উপর প্রভাব: যা গুণগত এবং পরিমাণগত, উভয়ভাবেই কমতে থাকে।
স্ট্রেস-এর ফলে কী হয়?
2017-এর পৃথিবী বেশ কিছু আনন্দ ও সম্ভাবনার সাথে সাথে বোধহয় অনেক বেশি সমস্যা ও বাধা নিয়ে আসবে আমাদের জন্য যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি স্ট্রেস বা চাপ। স্ট্রেস কথাটি সাধারণভাবে মানসিক চাপ বোঝাতে ব্যবহৃত হলেও স্ট্রেস-জনিত চাপ মন ছাড়িয়ে শরীর বা সামাজিক জীবনেও পড়তে পারে।
স্ট্রেস-এর প্রভাব আমাদের জীবনে যেভাবে পড়ে, তাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় মূলত তিনভাগে ভাগ করা যায়:
- মানসিক
- শারীরিক
- সামাজিক
স্ট্রেস-এর ফলে মানসিক অশান্তি, অল্পেতেই মেজাজ হারানো, খিটখিটে ভাবের উৎপত্তি, কাজে উৎসাহ না পাওয়া থেকে শুরু করে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া, কাজের ক্ষেত্রে ভুল করা, হাল ছেড়ে দেওয়া ভাব এমনকি নিজেকে আঘাত করা বা আত্মহত্যার চিন্তাও আসতে পারে।
মন ও শরীরের মাঝখানের রেখাটি এমনিতেই খুব অস্পষ্ট, আর স্ট্রেস-এর প্রভাব মন ছাড়িয়ে শরীর অব্দি পৌঁছতে বেশি সময় লাগে না। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটা থেকে শুরু করে ঘুম একদম না হওয়া, সর্বদা অবসন্ন লাগা, খিদে কমে যাওয়া, সহজে হজম না হওয়া, এমনকি asthma, গ্রন্থিতে ব্যাথা, ইত্যাদি রোগগুলির বেড়ে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়।
সামাজিক ক্ষেত্রে স্ট্রেস-এর প্রভাব বোধহয় সবথেকে বেশি পড়ে। সম্পর্কে জটিলতা থেকে ক্রমাগত সম্পর্কের ভেঙ্গে যাওয়া, বন্ধুহীনতা, পরিবার ভেঙ্গে যাওয়া, অনাকাঙ্ক্ষিত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া এবং সহজেই নেশার কবলে পড়ে যাওয়া ও ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাওয়া আজকের সমাজে খুব একটা ব্যতিক্রম কিছু নয়।
স্ট্রেস কীভাবে হয়?
স্ট্রেস বা মানসিক চাপ আমরা সবাই কমবেশি অনুভব করি। মানুষের মন ঠিক কোথায় অবস্থিত, সেটা এক কথায় বলা খুব কষ্ট, কিন্তু মানসিক চাপের প্রভাব কিন্তু শরীরের সর্বত্র কমবেশি পড়ে। এখন প্রশ্ন হতে পারে কীভাবে? মূলত যে দুটো পদ্ধতিতে এই প্রভাব কমবেশি শরীরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, তা হলো:
- এন্ডোক্রিন বা হরমোন সিস্টেম
- ইমিউন বা প্রতিরক্ষা সিস্টেম
হরমোন সম্পর্কে আমরা সকলেই আজকের দিনে অল্পবিস্তর জানি। সহজ করে বললে, হরমোন হলো শরীরের সেই রাসায়নিক যা কোনো গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত হয়ে সাধারণত উৎপত্তিস্থল থেকে দূরে অন্য কোনো অঙ্গের উপর ক্রিয়া করে বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলির প্রকাশ ও তাদের নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
আমাদের শরীরে হরমোনগুলির কার্যকারিতা সাধারণত একে অন্যের উপর পারস্পরিক ভাবে নির্ভরশীল, অর্থাৎ, একটির বেশী কম নিঃসরণের উপর অন্যটির নিঃসরণ ও সেই মত কাজ করা নির্ভর করে। এই সম্পর্কগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দ্বিমুখী হওয়ায় শরীর জুড়ে হরমোনগুলির কাজ করার ধরণকে বিভিন্ন অক্ষ বা axis -এ কল্পনা করা হয়ে থাকে। এদের মধ্যে HPA axis এবং HPG axis স্ট্রেস প্রসঙ্গে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ।
শরীরের ভিন্ন হরমোনগুলির মধ্যে স্ট্রেস বিষয়ক যে হরমোনগুলোর কথা জানা প্রয়োজন তা হলো HPA axis এবং HPG axis।
HPA axis আমাদের শরীরে বিভিন্নভাবে কাজ করে। সামগ্রিকভাবে শরীরের ক্রিয়া-প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে স্মৃতি, নতুন জিনিস শেখা, অনুভূতি, এমনকি ব্যাথা ও ঘুমের মতো প্রাথমিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলিও অনেকাংশে এই axis-এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। এই প্রক্রিয়াটির স্বাভাবিক কর্মক্ষমতায় ব্যাঘাত ঘটলে তা বহুক্ষেত্রেই মন, চিন্তা বা উৎকণ্ঠার বিভিন্ন অসুবিধে বা অসুখে পরিণত হতে পারে। এমনকি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, স্বাভাবিক বুদ্ধি ইত্যাদিতেও ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
HPG বা Hypothalamo-pituitary-gonadal axis অন্যদিকে মানুষের যৌনক্ষমতার স্বাভাবিক পরিণতি প্রাপ্ততার সাথে সাথে সমগ্রভাবে ভালো থাকা, মানসিক সুখ-শান্তি ও কর্মদক্ষতা বজায় রাখতেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এ প্রসঙ্গে এই axis-এর অন্তর্গত testosterone আর Di-hydro Epiandrosterone হরমোনটির অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাম্প্রতিক গবেষণাতে দেখা যাচ্ছে, উৎকণ্ঠা, ভয় পাওয়া ও তাকে সময়ের সাথে জয় করা এবং স্মৃতিশক্তি রক্ষা করায় এই হরমোনটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। স্মৃতিশক্তি এবং অভিজ্ঞতা থেকে আমরা যা শিখি, তা থেকে আমাদের ভবিষ্যতে আসতে চলা স্ট্রেস ও তার সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে সাবধান হতে পারি ও পুরোনো অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমরা সেই স্ট্রেস-কে আরো ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারি | সঙ্গত কারনেই, এই দুই অক্ষ যখন ঠিকভাবে কাজ করে না তখন এই সমস্ত কাজগুলিও ঠিক ভাবে সম্পন্ন হয় না|
এই দুই অক্ষ-ই শারীরবৃত্তীয় স্বাভাবিক অবস্থায় পূর্ণ মাত্রায় বা বলা ভালো সঠিক মাত্রায় কাজ করে থাকে এবং শরীরের স্বাভাবিক ভারসাম্য বজায় রাখে। মুশকিল তখনি হয় , যখন স্ট্রেস-এর কারণে এই দুই অক্ষ বেশি মাত্রায় কাজ করতে থাকে, যার ফল স্বরূপ কিছু হরমোন অধিক পরিমাণে ক্ষরণ হতে থাকে। এতে শরীরের স্বাভাবিক ভারসাম্যটি নষ্ট হয়ে যায়, ফলে নেগেটিভ ফিডব্যাক পদ্ধতি টি সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙে পড়ে এবং করটিসল জাতীয় হরমোন আরো বেড়ে গিয়ে স্ট্রেস-এর বিভিন্ন উপসর্গগুলি তৈরি করে।
Immune system বা শারীরবৃত্তীয় প্রতিরক্ষা ক্ষমতাটির কাজ হলো, শরীরের দুর্গ সৈনিকের মতো পাহারা দেওয়া। বাধা-বিপত্তি-ঝড়-ঝঞ্ঝা যাই আসুক না কেন, অনুগত সৈনিকের মতো সে তার সমস্ত হাতিয়ার দিয়ে দুর্গ ও দুর্গের মালিককে রক্ষা করে যাবে। তবে যেকোনো সৈনিক যতই পারদর্শী হোক না কেন, তারও যেমন লড়াই করার ক্ষমতা সীমিত, ঠিক একইভাবে শরীরের প্রতিরক্ষা ক্ষমতাটি একটি নির্দিষ্ট সময় অব্দিই বাইরের শত্রুর সাথে লড়তে পারে। বিজ্ঞান শেষ দুই দশকে ক্রমাগত প্রমাণ করেছে যে সর্দি, কাশি বা জ্বর-এর মতো ইনফেকশন-এ যেমন শরীর-এর প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, ঠিক একই ভাবে মানসিক চাপও তাৎক্ষণিকভাবে বা সুদূরপ্রসারী ক্ষেত্রেও শরীরের প্রতিরোধক্ষমতা কমিয়ে দেয়, যা আমাদের ভিতর থেকে আরো দুর্বল করে দেয়। এই দুর্বল শরীরে অন্য অসুখ বাসা বাঁধতে অল্প সময় নেয় যা খুব সঙ্গত কারণেই আমাদের মানসিকভাবে আরো বিপর্যস্ত করে তোলে। ফলস্বরূপ, স্ট্রেস/চাপ/চিন্তা সব একসাথে ক্রমাগত বাড়তে থাকে। আর এই চক্রের আবর্তে শরীর থেকে মন বেচারা ক্রমশ আরো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
স্ট্রেস: কিছু ভালো কথা
স্ট্রেস কথাটি সাধারণত নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হলেও কখনো কখনো সদর্থক অর্থেও প্রযোজ্য হতে পারে। স্ট্রেস নিয়ে গবেষণায় যে বিজ্ঞানীকে পথিকৃৎ মানা যেতে পারে, সেই বিজ্ঞানী Hans Selye স্ট্রেস-কে দুভাগে ভাগ করেছেন: ইউস্ট্রেস (eustress) এবং ডিস্ট্রেস (distress)1। ইউস্ট্রেস বা পজিটিভ স্ট্রেস-এ আমাদের শারীরিক বা মানসিক অভিযোজন ক্ষমতা অনেকখানি বেড়ে যায়, এবং শরীর ও মন প্রতিকূল অবস্থার সাথে লড়তে অনেকখানি তৈরী হয়ে ওঠে। ইউস্ট্রেস-এর উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আন্তর্জাতিক মানের কোনো ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় খেলোয়াড় বা দৌড়বীররা বা কোনো অভিজ্ঞ মঞ্চাভিনেতা/সংগীতশিল্পী প্রতিযোগিতা বা অনুষ্ঠানের আগে আগে যে মানসিক চাপ অনুভব করেন, তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের ভালো করে কাজটি সম্পন্ন করতে সাহায্য করে। একটি নির্দিষ্ট মাত্রা অব্দি স্ট্রেস ও কর্মক্ষমতা সমানুপাতিক হারে বাড়তে থাকে। এক্ষেত্রে মনে রাখা ভীষণভাবে প্রয়োজনীয় যে সেই নির্দিষ্ট মাত্রার পর কিন্তু গল্পটি সম্পূর্ণ বদলে যায়। সেক্ষেত্রে স্ট্রেস আরো বাড়ার সাথে সাথে কর্মক্ষমতা ক্রমশ কমতে থাকে এবং ইউস্ট্রেস ক্রমশ ডিস্ট্রেস-এ বদলে যেতে থাকে।
এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞানী Yorkes-Dodson কথিত curveটি বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এই দুই বিজ্ঞানী পরীক্ষার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, যেকোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে অল্পবিস্তর মানসিক চাপ আমাদের সকলেরই হয়2। এই বিজ্ঞানীদ্বয় ইঁদুরের উপর পরীক্ষা করে এটা প্রমাণ করে দিয়েছেন যে এক বিশেষ সীমা অব্দি স্ট্রেস বাড়ার সাথে কাজকর্ম ভালো ও সঠিকভাবে করার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে এবং এক বিশেষ বিন্দুতে গিয়ে নির্দিষ্ট পরিমান স্ট্রেস-এর সাথে ভালো ফলাফল করার সম্ভাবনা সর্বোচ্চ হয়ে ওঠে। সেই সর্বোচ্চ বিন্দুর পর ভালো ফলাফল করার সম্ভাবনা ক্রমশ কমতে থাকে ও সর্বোচ্চ স্ট্রেস-এ সেটা প্রায় শূন্য হয়ে যায়। অঙ্কের ভাষায় এই সম্পর্কটি অনেকটা উল্টো U বা একটি বেল-সদৃশ্য কার্ভ-এর মতন, সর্বোচ্চ বিন্দুর পর যার ফলাফল সম্পূর্ণ বিপরীত হতে থাকে।
স্ট্রেস-এর ফলে আমাদের কর্মক্ষমতায় কী রকম প্রভাব পড়ে? এ প্রসঙ্গে নানা মুনির নানা মত।
রোজকার জীবনে কাজের চাপ নতুন কিছুই নয়। সেই চাপ, আর আমরা যে স্ট্রেস নিয়ে আলোচনা করছি, তা কি সমার্থক? এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞানী Gilliard-এর বিশ্লেষণ আবারো ঘুরে দেখা যেতে পারে। রোজকার কাজের চাপে শারীরিক শক্তির খরচ হওয়া এবং তার সাথে আমাদের কাজ করার ক্ষমতাকে Gilliard স্বাভাবিক অভিযোজন বলেই বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ, রোজকার কাজ দায়িত্বের সাথে আমাদের কর্মক্ষমতা এবং তার কার্যকারিতা পরিস্থিতি অনুযায়ী বাড়তে থাকে। তাই, অফিস-এর হঠাৎ এসে যাওয়া বছর শেষের কাজ হোক বা পরীক্ষার আগের দিনের শেষ মুহূর্তের রিভিশন হোক, আমাদের শরীর ও মন, দুইই সেই কাজ সম্পূর্ণ করে নেয়। তবে তা সম্ভব হয় একটা সীমারেখা অব্দি। প্রসঙ্গত, স্ট্রেস পরিমাপ করার জন্য বহু ধরনের rating scale ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে Homes and Rahe Stress Scale টি উল্লেখ্য| যাইহোক, একটা বিশেষ সীমারেখার পরেই অসুখ ‘স্ট্রেস’ শুরু হয়, যেখানে কাজ অনুযায়ী শারীরিক শক্তি তো খরচ হয় দ্বিগুণ কিন্তু তার সাপেক্ষে কার্যকারিতা না বেড়ে ক্রমশ কমতে থাকে। অর্থাৎ আমাদের শরীর ও মন একটা নির্দিষ্ট ক্ষমতা বা সময় পর্যন্ত পরিবর্তিত অবস্থার সাথে মানিয়ে নিয়ে সেইমতো কাজের চাপ নিতে পারে। সেখানে স্ট্রেস হলো সেই সর্বনাশা পরিস্থিতি যেখানে শরীর ও মনের এই ভারসাম্য যায় বিগড়ে। অর্থাৎ সেই ভারসাম্যটি বিগড়ে গেলে পরিণতি বা ফলাফল আন্দাজ করা বহু ক্ষেত্রেই সম্ভব নাও হতে পারে। পরিণতিটা সামান্য ‘অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রব্লেম’ থেকে মারাত্মক ‘সাইকোসিস’ নামক মানসিক রোগ বা বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অব্দি যেতে পারে।
অতঃপর কী করণীয়?
মানসিক চাপ সামলানোর জন্য আমরা সকলেই কোনো না কোনো উপায় নিয়েই থাকি। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় সেই উপায়গুলিকে কোপিং স্কিল (coping skill) বলা থাকে। কোপিং স্কিল বা কঠিন পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার নিজস্ব পদ্ধতিগুলিকে মূলত দুভাগে ভাগ করা যায়:
- ইমোশন ফোকাসড কোপিং (Emotion focused coping): বাংলায় একে আবেগজনিত মানসিক প্রক্রিয়া বলা যেতে পারে। এখানে লক্ষ্য থাকে মূলত তাৎক্ষণিক উপশম আর তার জন্য প্রয়োজনীয় আবেগের পরিবর্তন করা। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, কোনো হঠাৎ আসা মানসিক চাপে দিশাহারা অবস্থায় আমাদের প্রাথমিক প্রবৃত্তি হতে পারে সেটিকে এড়িয়ে যাওয়া বা সম্পূর্ণ অস্বীকার করা। এই প্রকার মানসিক পদ্ধতির পিছনে লক্ষ্য থাকে মূলত সেই পরিস্থিতি বা পরিস্থিতি-জনিত আবেগকে নিয়ন্ত্রণে আনা কারণ সেই জরুরি অবস্থায় সেটাই মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে। এই প্রক্রিয়াটি সচেতন, অর্ধচেতন বা অচেতন যে কোনো প্রকারেই হতে পারে। এই প্রকার মানসিক প্রক্রিয়ায় তাৎক্ষণিক সংকট হয়তো কাটিয়ে ওঠা যায় কিন্তু দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে মূল সমস্যার সমাধান হয়না, বরং পরবর্তীকালে সমস্যা আরো বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- প্রব্লেম ফোকাসড কোপিং (Problem focused coping): কোপিং বা মানিয়ে নেওয়া তখনি আদতে ফলপ্রসূ হয় যখন স্ট্রেস-এর সময় স্ট্রেস-জনিত অনুভূতিকে বাদ দিয়ে কারণটিকে দেখতে আমরা সমর্থ হই এবং সেই কারণটিকে কী করে কমানো যায় বা দূর করা যায়, তাতে মনোনিবেশ করি। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একেই প্রব্লেম ফোকাসড কোপিং বলে। অর্থাৎ, শুধু আবেগের দ্বারা চালিত না হয়ে কারণটি সমাধানের চেষ্টা করলে শেষ অব্দি অসুবিধা আর তার সাথে থাকা অনুভূতি, দুই মুশকিলেরই আসান করে। আপাতভাবে এটি সাধারণ বুদ্ধি লাগলেও স্ট্রেস-এর সময় সেটিই অনেকসময় আমাদের লোপ পায় এবং শুধুমাত্র আবেগ বা অনুভূতির বশবর্তী হয়ে বিপদ বা প্রব্লেমকে অনেকক্ষেত্রেই আরো বাড়িয়ে তুলি।
- পজিটিভ হেলথ / হেলথ রিসার্ভ / পজিটিভ সাইকোলজি (positive health / health reserve / positive psychology): পজিটিভ সাইকোলজি-র ধারণাটি মনোবিজ্ঞানের জগতে ক্রমশ জায়গা করে নিতে থাকে। বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই, যখন সাইকোলজি বা মনোবিজ্ঞানকে কেবল অসুখ বা অসুবিধের প্রতিকার হিসেবে না দেখে ব্যক্তিগত উন্নতির মাধ্যম হিসেবেও গণ্য করা হয়ে থাকে। পজিটিভ সাইকোলজি কেবল মানুষের খামতিগুলি দূর করার চেষ্টা না করে কোনো ব্যক্তিবিশেষের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য ও সদর্থক দিকগুলিকে আরো শক্তিশালী করে তোলে। সহজভাবে পজিটিভ সাইকোলজি-র চর্চার মাধ্যমে আমরা সকলেই নিজের মানসিক ও আত্মিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারি। এক কথায়, পজিটিভ সাইকোলজি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমস্ত সদর্থক দিকগুলি দেখতে আমাদের সাহায্য করে, যা তিনভাবে আমাদের প্রভাবিত করতে পারে:
- নিজস্ব সত্ত্বার উন্নতিতে: ভালোলাগা, খুশি ও আশার মুহূর্তগুলোকে খুঁজে নিতে ও সেখান থেকে ভালোকিছু করার অনুপ্রেরণা পাওয়া
- ব্যক্তিসত্ত্বার উন্নতিতে: নিজের ভালো গুণগুলি, যেমন সাহস, সৃজনশীলতা, মৌলিক দিকগুলিকে চিনে নেওয়া
- বৃহত্তর সমাজের অংশ হিসেবে নিজেকে দেখা: মানবতা ও জাতীয়তা বোধ, অপরকে সাহায্য করা, কর্মোদ্যোগী হয়ে নিজেকে বহু মানুষের সাথে যুক্ত করা।
স্ট্রেস কমাতে আর কী করতে পারি আমরা?
- খেলাধুলা ও কায়িক পরিশ্রম: সক্রিয়ভাবে খেলাধুলা করা এবং ঘাম-ঝরানো কায়িক পরিশ্রম যে শুধু শরীরের উপকার করে, তা নয়। আধুনিক বিজ্ঞান আজ বারবার প্রমাণ করে দিয়েছে যে পরিশ্রমের ফলে শরীরের অন্তর্নিহিত বিশেষ রাসায়নিকগুলি ক্ষরিত হতে থাকে। এদের মধ্যে এন্ডরফিন (endorphin) রাসায়নিকটি বিশেষভাবে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে কাজ করে যা আমাদের হাসি খুশি রাখতে ও স্ট্রেস-মুক্ত রাখতে সাহায্য করে। একই কথা যোগব্যায়াম-এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
- ঘুম: ঘুম একটি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে আমাদের সকলেরই শরীর খারাপ হয়। উপযুক্ত এবং পরিমাণমতো ঘুম স্ট্রেস-কে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। ঘুমের প্রয়োজন যদিও বিভিন্ন মানুষের বিভিন্নরকম, তবে দিনে ৭-৮ ঘন্টা ঘুম আমাদের সকলেরই দরকার।
- নিজের পছন্দের বিষয়গুলি নিয়ে সময় কাটানো: হবি (hobby) বা শখ। অবসর বিনোদনের উপায়। যদিও আজ ২০১৭-তে এসে টিভি সিরিয়াল দেখা বা স্মার্টফোনে গেম খেলা বা সোশ্যাল মিডিয়াতে সময় কাটানোতে পরিণত হয়েছে, ‘হবি’ বা শখ শব্দটার অর্থ কিছুকাল আগেও একটু আলাদা ছিল। নাচ, গান বা কোনো বাদ্যযন্ত্র শেখা থেকে ডাকটিকিট বা সেইরকম কিছু জমানোর দিনগুলিতে যদি আবার ফিরে যাওয়া যায়, সেই আনন্দ কিন্তু স্ট্রেস কাটাতে নিঃসন্দেহে ভালো কাজ করবে।
- খাদ্যাভ্যাস ও নেশা থেকে দূরে থাকা: সঠিক (গুণগত ও পরিমাণগত, দুইই) প্রকার খাবার ও সর্বনাশা নেশা থেকে দূরে থাকা স্ট্রেস-কে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখে। যেকোনো নেশার অভ্যেস সাধারণত শুরু হয় স্ট্রেস কমানোর উপায় হিসেবে, যদিও সেই নেশাই স্ট্রেস-এর কারণ হতে বেশি সময় নেয় না।
- পরিবার ও বন্ধুবান্ধব: সবশেষে যা উল্লেখ করা অবশ্যই প্রয়োজন তা হলো পাশে থাকা বন্ধু বা পরিবারের লোকজন আমাদের স্ট্রেস-কে আয়ত্বে রাখতে অনেকটাই সাহায্য করে। শুধুমাত্র শুনবার কেউ বা কয়েকজন সঠিক লোক ও সম্পর্কের উষ্ণতা অনেকাংশেই আমাদের মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
এই লেখায় আমরা মূলতঃ স্বাস্থ্য জনিত মানসিক বা ব্যবহারিক সহজ উপায়গুলি নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করলাম। স্ট্রেস-কে সামলানোর জন্য বিভিন্ন রকম ওষুধের অনেকখানি ভূমিকা আছে যার অবদান বিজ্ঞানসম্মতভাবে আজ প্রমাণিত। সেই বিভিন্নরকম ওষুধের বিবরণে না গিয়েও যে কথাটি বলা এ প্রসঙ্গে অবশ্যই জরুরি, তা হলো: বহুল-প্রচলিত চটজলদি ঘুমের ওষুধ, যেমন alprazolam, nitrazepam বা zolpidem জাতীয় ওষুধ, খাওয়ার অভ্যেস (বা বহুক্ষেত্রে চিকিৎসক-প্রণীত পরামর্শ-ও !) প্রায় সবক্ষেত্রেই ক্ষতিকারক, যার ফল সুদূরপ্রসারী।তাই সঠিক কারণ ও সঠিক পরামর্শ ছাড়া ঘুমের ওষুধ খাওয়াটাই সবসময় ‘নৈব নৈব চ’!
তথ্যসূত্র ও অন্যান্য টুকিটাকি:
- Dr. Hans Selye , Journal of Human Stress, 1975
- Yerkes R.M. Dodson J.D, Journal of Comparative Neurology and Psychology(1908)