সত্যি ব্যাপারটা একটু গোলমেলে। আমার এক দিদি ছোটবেলায় রীতিমত হলফ করে বলেছিলো “মা কালীর দিব্যি বলছি আমি ভগবানে বিশ্বাস করি না”। আমি এখনও বুঝিনি একে সত্যি বলবো না মিথ্যা। “দিব্যি” ব্যাপারটা হয়তো মুদ্রাদোষের ফসল। এমন হতেই পারে আদতে সত্যিই তার কালীতে রুচি নেই। তাহলে সত্যি বলবো? এবার ফ্রয়েডীয় কেউ এসে বলবে: ওহে, মুদ্রাদোষ তো আকাশ থেকে পড়ে না! তার মানে অবচেতনে সে মা কালীকে দিব্যি মানছে, অতএব ও জানে না যে ও মিথ্যে বলছে। আবার এমনও তো ভাবা যায় যে ও অবচেতনে কি ভাবছে তাতে কি এলো গেলো? ওর সচেতন সিদ্ধান্ত হলো ও ভগবানে বিশ্বাস করে না। তাহলে ওর কথা সত্যি?
অনেক দিন আমাদের এ ধারণা ছিল (এখনো অনেকটাই আছে) যে এই সব “আজাইড়া” যুক্তি “বৈজ্ঞানিক সত্যি”-র ক্ষেত্রে খাটে না। ঠিকই তো। সূর্য পুব দিকেই উঠবে। আমি দেখি, আপনি দেখুন কিংবা ট্রাম্প। শুয়ে দেখুন, বসে দেখুন কিংবা ধনুরাসন করতে করতে। মানে “বৈজ্ঞানিক সত্যি” পর্যবেক্ষক নিরপেক্ষ, সর্বসম্মত সত্যি। একে নিয়ে ফাজলামো চলে না।
বিংশ শতকের গোড়ার দিক থেকেই কিছু আবিষ্কারের ফলে এই ধারণাটা নড়ে গেলো। আইনস্টাইন-এর বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ থেকে জানা গেলো “বৈজ্ঞানিক মাপজোখ”-টাও পর্যবেক্ষকের অবস্থার ওপর নির্ভর করে। আপনি দৌড়তে থাকলে দাঁড়িয়ে থাকার তুলনায় আপনার সময় ধীরে চলবে (সময় প্রসারণ বা time dilation)। মানে শুধু আপনার হাতে বাঁধা ঘড়িটুকু নয়, আপনার বয়সটাও ধীরে ধীরে বাড়বে। আবার গতিশীল থাকলে দৈর্ঘ্য কমে যাবে স্থির অবস্থার তুলনাতে (দৈর্ঘ্য সংকোচন বা length contraction)।
এরপর এলো কোয়ান্টাম মেকানিক্স। তার observer effect তত্ত্ব থেকে জানা গেলো আপনি যদি কোনো কিছুকে পর্যবেক্ষণ করতে যান, তবে তা করতে গিয়ে আপনি তাকে একটু ঘেঁটে দিচ্ছেন। ফলে যা দেখছেন, আপনি না দেখলে তা অন্যরকম ব্যবহার করতো। ধরুন আপনার শোবার ঘরে যদি একখানা CCTV ক্যামেরা লাগিয়ে দি, তবে আপনার ব্যবহার যেভাবে বদলে যাবে ( যে কারণে আমরা Big boss অনুষ্ঠানটি কে ঠিক “reality” ভাবতে পারি না ), ঠিক সেভাবেই একটি ইলেক্ট্রন-কে আপনি দেখলে তার ব্যবহারের পরিবর্তন হবে। আপনার দেখাকালীন সে যে ভাবে ব্যবহার করবে, না দেখলে সেভাবে করবে না। কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এ আমরা নিশ্চিতভাবে কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি না, বরং কোনো কিছুর সম্ভাবনা গণনা করতে পারি শুধু। এছাড়া এলো ক্যাওস তত্ত্ব। যা শুধু আণবিক স্তরেই নয়, আকারে বড় সড় যে পৃথিবী, তাতেও এনে দিল অনির্ণেয়তা।
এবার আমরা আবার ঘেঁটে গেলাম। তাহলে “বৈজ্ঞানিক সত্যি” কি? এখন দেখা যাচ্ছে “বৈজ্ঞানিক সত্যি “ সবসময় পর্যবেক্ষক নিরপেক্ষ নয়। কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এ তো এখন পর্যবেক্ষক কথাটি না বলে অংশগ্রহণকারী বলা হয়।
কিন্তু সমস্যা হলো তাহলে বিজ্ঞান আর না-বিজ্ঞান-এ পার্থক্যটা হবে কী করে? “সত্যি”টাতো বিজ্ঞান এও আর “অমোঘ” থাকলো না (অন্তত সব ক্ষেত্রে নয়) !!
না, উপায় আছে। বিজ্ঞান আর অবিজ্ঞান-এর পার্থক্য হলো “সত্যি”-টাতে পৌঁছনোর পদ্ধতিতে। বিজ্ঞানকে সত্যে পৌঁছতে হয় শৃঙ্খলাবদ্ধ যুক্তিসম্মত পথে। এবার যুক্তিসম্মত পথ কোনটা তা নিয়ে সেই পুরোনো সময় থেকেই অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা বিতর্ক চলছে। আসুন এবার দেখা যাক সেই পুরোনো সময় থেকে ঠিক কোন কোন পথে বিজ্ঞান “সত্যি”-র খোঁজ করে চলেছে।
অবরোহী যুক্তি (deductive logic)
এই পথটি সবচেয়ে প্রাচীন। প্রায় খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে এরিস্টটল এর কথা বলেন। এখানে কিছু “সত্যি” বা তত্ত্ব প্রথমে আন্দাজ করে নেওয়া হয়। এই আন্দাজগুলো অনেক সময় সরাসরি পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব নাও হতে পারে। এবার খুঁজে নেওয়া হয় এমন একটি উপসংহার যাতে শুরুর আন্দাজগুলো “সত্যি” হলে উপসংহারটিও “সত্যি” হতে বাধ্য। শুরুর তত্ত্বটিকে পরীক্ষা করে দেখা না গেলেও উপসংহারটিকে পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব যে সেটি আসলে “সত্যি” কি না। যদি উপসংহারটি পরীক্ষা করে “সত্যি” প্রমাণিত হয় তাহলে আমাদের শুরুর আন্দাজগুলোও ঠিক ছিল বলতে হবে। নয়তো আন্দাজ ছিল ভুল। একটা উদাহরণ দেখা যাক।
প্রথমে আমাদের দুটো “সত্যি” আন্দাজ করতে হবে। করে দেখি : ক) যদি কেউ ভাবতে পারে, তার অস্তিত্ব আছে। খ ) আমি ভাবতে পারি। এবার তবে উপসংহারটা কী হবে এদুটো “সত্যি” হলে ?
উপসংহার : আমার অস্তিত্ব আছে।
এবার আমি তো রীতিমত বেঁচেবর্তে আছি। কম্পিউটার-এর কী বোর্ড টিপে লিখে পর্যন্ত যাচ্ছি। তাহলে আমার আন্দাজ দুটো ঠিকই ছিল বলা যায়।
এই পদ্ধতি বহুদিন ধরে খুবই জনপ্রিয় ছিল, এমনকি এখনো আছে। কিন্তু এর কিছু সমস্যা আছে। যেমন আন্দাজটা যে শুরুতে করবো তা কিসের ওপর ভিত্তি করে? হতে পারে আমার অভিজ্ঞতার ওপর। কিংবা হয়তো হেঁচকি ওঠার মতোই হট করে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। অর্থাৎ, যদিও পরে যুক্তি দিয়ে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে যে আমার শুরুর আন্দাজগুলো ঠিক ছিল কিনা, আন্দাজ করার পদ্ধতিটা যুক্তির পথে নাও হতে পারে।
আরোহী যুক্তি (inductive logic)
এর জন্ম অনেক পরে। ১৭ শতকে ফ্রান্সিস বেকন-এর হাত ধরে। এই পদ্ধতি আজও বিজ্ঞানীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। এখানে হাঁটা হয় উল্টো পথে। আগে থেকেই কোনো কিছুকে “সত্যি” ধরে না নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে দেখা হয় কিছু ঘটনাবলীকে।
হাতেনাতে পরীক্ষা করে যে যে টুকরো “সত্যি” গুলো জানা যায় সেগুলোকে জুড়ে একটা সর্বসম্মত “সত্যি” খুঁজে বের করার চেষ্টা হয়। অনেকটা বিন্দু জুড়ে জুড়ে ছবি আঁকার মতো ব্যাপার।
নিচের ১ নম্বর ছবিতে ধরা যাক ওই তিনটি বিন্দু আমাদের পরীক্ষা করে জানা “সত্যি”। এবার বলা হল, ওই তিনটি বিন্দু আসলে একটি বড় ছবির অংশ আর ছবিটিকে আমাদের আন্দাজ করতে হবে। আন্দাজ করি তাহলে? কী আন্দাজ করা গেলো? বড় ছবিটি একটি ত্রিভুজ? হতে পারে। আমাদের বেশিরভাগ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারই এভাবে এসেছে বলা যায়। আপেল প্রথমে মাটিতে এসে পড়ে। একটি-দুটি-১০০ টি আপেল মাটিতে এসে পরে। এই যে কোনো কিছুর মাটিতে এসে পড়া, এটা আমাদের হাতে নাতে পরীক্ষা করে দেখা টুকরো সত্যি। আর সেগুলো জুড়ে বড় যে “সত্যি”, সেটাই নিউটন বাবুর মাধ্যাকর্ষণ। অর্থাৎ আগে পর্যবেক্ষণ, পরে এমন কিছু আন্দাজ করা যা ওই পর্যবেক্ষণের সাথে মিলে যায়।
এরও কিছু অসুবিধা আছে। আবার ফিরি ১ নম্বর ছবিতে। আচ্ছা, বিন্দুগুলো জুড়ে বড় ছবিটা কী মনে হচ্ছিলো? মনে মনে ভেবে রাখুন। এবার দেখি ২ নম্বর ছবি।
অর্থাৎ বড় ছবিটা বৃত্তও হতে পারে! কিংবা আরো অনেক কিছু। এবার ৩ নম্বর ছবি।
এবার আমাদের হাতে বিন্দুর সংখ্যা বেশি। এবার বলা যায় যে বড় ছবিটা কিছুতেই বৃত্ত হতে না। বরং ত্রিভুজ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়লো। ঠিক তাই। অবরোহী যুক্তির মতো আরোহী যুক্তি নিশ্চিত হয়ে কিছু বলতে পারে না। কোন “সত্যি”টার ঠিক হবার সম্ভাবনা আছে তা বলে দেয়। আর আমাদের কাছে যত বেশি পর্যবেক্ষণলব্ধ ফলাফল (data) থাকবে, তত নিখুঁতভাবে আমরা “ সত্যি”-র কাছে যেতে পারবো।
মিথ্যাবকাশ তত্ত্ব (theory of falsification)
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কার্ল পপার “বৈজ্ঞানিক সত্যি” খোঁজার এই নতুন পথটির কথা বলেন। এই সময়টি বিজ্ঞান (প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিজ্ঞান) এর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। একসাথে হুড়মুড়িয়ে অনেক নতুন নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার হয়। তার মধ্যে যে যে তত্ত্বগুলো পপারকে খুব প্রভাবিত করে সেগুলো আইনস্টাইন-এর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ, ফ্রয়েড এর সাইকো এনালাইসিস, মার্ক্স্বাদ এবং আলফ্রেড এল্ডার এর ইন্ডিভিজুয়াল সাইকোলজি। এর সবগুলি নিয়ে বিস্তারে আলোচনা করার অবকাশ নেই। এলেম আছেও ভেবে বসবেন না।
যা হোক। যে ব্যাপারটা কার্ল পপারকে ভাবালো, তা হলো: প্রতিটি তত্ত্বকেই “বৈজ্ঞানিক” তত্ত্ব বলে দাবি করা হচ্ছে। এখানে বলে রাখা ভালো যে উপরের তত্ত্বগুলো ভালো না খারাপ, কার্যকরী না বেফালতু তা নিয়ে পপার কিছু বলেননি। ওনার উদ্দেশ্য ছিল শুধু এটা প্রমাণ করা যে সব কটি তত্ত্বকেই “বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব” বলা যায় কিনা।
আমরা যদি “সত্যি” খোঁজার জন্য আরোহী যুক্তির পথে হাঁটি, তবে উপরের প্রতিটিই “বৈজ্ঞানিক” তত্ত্ব। কারণ আপনি যদি প্রথমে হাতেনাতে পরীক্ষা করে তথ্য সংগ্রহ করেন, আর তার পর তত্ত্ব দিয়ে সেগুলো ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন, তবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই।
কিন্তু পপার লক্ষ্য করলেন যে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের সাথে বাকি তত্ত্বগুলোর একটা মূল পার্থক্য আছে। আগে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে দু-চার কথা বলি। সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ আসলে আমাদের নিউটন বাবুর মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের একটি নতুন (ও উন্নত) বিকল্প দিয়েছিলো। সেই তত্ত্ব দিয়ে আইনস্টাইন মশাই অঙ্ক কষে বের করেছিলেন যে একটি তারার পাশ দিয়ে যদি আলো ছুটে যায়, তবে সেই আলো খানিকটা বেঁকে যাবে। কতটা বেঁকে যাবে, তাও বের করেছিলেন। এবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে একদিকে যখন জার্মানি আর ব্রিটেন কোমর বেঁধে লড়ে যাচ্ছে, জার্মান বিজ্ঞানী আইনস্টাইন-এর তত্ত্ব হাতেনাতে পরীক্ষা করতে এলেন আরেক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী এডিংটন সাহেব। উনি এক সূর্যগ্রহণের দিন সত্যি সত্যি হাতে নাতে মেপে ফেললেন তারার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে আলো বেঁকে যাচ্ছে কিনা। যদি বেঁকে যায় তবে কতটা বেঁকেছে। দেখা গেলো আইনস্টাইন মশাই অঙ্ক কষে যা বলছেন, ঠিক ততটাই বেঁকেছে। ব্যাস, প্রমান হলো যে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ “সত্যি”!
লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো যে এই পরীক্ষাটিতে কিন্তু সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ ভুল প্রমাণ হবারও অবকাশ ছিল! হাতেনাতে পরীক্ষার ফল অন্য কিছুও হতে পারতো! আইনস্টাই-এর তত্ত্বে ভুল প্রমাণিত হওয়ার ঝুঁকি নেওয়া হয়েছিল। যদিও অবশেষে তা ঠিকই প্রমাণ হয়।
পপার বলেন, ঠিক এখানেই আইনস্টাইন-এর তত্ত্বের সাথে বাকি তত্ত্বগুলোর পার্থক্য। আমি যদি রোজ একটি কুকুরকে খেতে দি, আদর করি, তবে আমার মানসিক অবস্থা ফ্রয়েড-এর তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। আবার যদি আমি কুকুরটির লেজ এ তারাবাতি বেঁধে দেবার মতো কাজ করি (কারোই করা উচিত নয়, আমিও করি না), তাহলেও আমার মানসিক অবস্থা ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করে দেওয়া সম্ভব। মানে আমার প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ যাই হোক না কেন, সব কিছুই ব্যাখ্যা করে দেওয়া যাবে সেই তত্ত্ব দিয়ে। আবার ১-নম্বর ছবিটা দেখুন। আমি যদি বলি ওই তিনটি বিন্দু যে বড় ছবিটার অংশ তা হলো অসীম পর্যন্ত ছড়ানো একটি চাদর, তাহলে যেমন হবে, এ খানিকটা তাই। আপনি ভুল প্রমাণ করতে পারবেন না।
পপার আরোহী যুক্তির আর একটি দুর্বলতার কথাও বললেন। ধরুন আমি একটি কাক দেখলাম। দেখলাম তা কালো। আরো একটি দেখলাম। সেটাও কালো। ১০০০ টি দেখলাম। সব কটি কালো। এবার আরোহী যুক্তি দিয়ে আমি বলতে পারি, কাক মাত্রই কালো। কিন্তু উনি বললেন, সত্যিই কি বলতে পারি ? আগেই দেখেছি, আরোহী যুক্তি শুধু সম্ভবনার কথা বলে! এবার আমার এক বন্ধু কলকাতা চিড়িয়াখানায় গিয়ে একটি সাদা কাক দেখলো। ব্যাস, সঙ্গে সঙ্গে আমি যা বলেছিলাম “কাক মাত্রই কালো”, তা ভুল প্রমান হলো। এবার আর সম্ভবনা টম্ভবনা নয়। আমি নিশ্চিত ভাবেই ভুল প্রমাণিত হলাম। অর্থাৎ যত সংখ্যক পর্যবেক্ষণই হোক না কেন, কোনো কিছুকে ঠিক প্রমান করাটা শক্ত। দিনের শেষে সেগুলো কেবল ঠিক হবার সম্ভবনার কথা বলবে। কিন্তু একটি মাত্র পর্যবেক্ষণ দিয়েই কোনো কিছুকে নিশ্চিতভাবে ভুল প্রমান করা সম্ভব!
পপার তাই বললেন: কোনো তত্ত্বকে “বৈজ্ঞানিক” বলার আগে আমাদের এমন কোনো পরীক্ষার কথা ভাবতে হবে যাতে তত্ত্বটির মিথ্যে প্রমাণিত হবার ঝুঁকি থাকবে। যদি তত্ত্বটি এমন পরীক্ষাতে উৎরে যায় তবেই তাকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বলা হবে, যতদিন না অন্য কোনো পরীক্ষাতে সেটি মিথ্যে প্রমাণিত হয়।
বৈজ্ঞানিক যুগ পরিবর্তন তত্ত্ব
পপার এর সমসাময়িক আর এক বিজ্ঞান দার্শনিক (philosopher of science) থমাস কুহন পপার-এর তত্ত্বতে খুব একটা খুশি হতে পারলেন না। উনি প্রশ্ন করলেন সত্যিই কি তাই? পৃথিবীর সমস্ত বিজ্ঞানীরা যখন গবেষণা করেন, প্রতিদিন তারা ল্যাবরেটরিতে ঢোকার সময়ে কি জামার হাতা গুটিয়ে ভাবতে ভাবতে ঢোকেন: “আজ আমি আইনস্টাইনকে ভুল প্রমাণিত করবো”?
যারা গবেষণার সাথে যুক্ত তারা জানেন যে ব্যাপারটা একেবারেই তা নয়।
সাধারণভাবে সে সময়ে যে তত্ত্বগুলো জনপ্রিয় ও স্বীকৃত সেগুলোকে “সত্যি” ভেবে নিয়েই বিজ্ঞানীরা ওই তত্ত্বের ভেতরের বিভিন্ন ছোটখাটো সমস্যার মোকাবিলার চেষ্টা করেন। এমনকি যদি দু একটি পরীক্ষাতে এমন কিছু পাওয়াও যায় যা প্রচলিত তত্ত্বকে মিথ্যে প্রমাণ করছে বলে মনে হয়, তাহলেও প্রচলিত তত্ত্বটিকে সাথে সাথে বাতিল করা হয় না। বরং প্রথমে প্রচলিত তত্ত্ব দিয়েই ওটাকে আবার প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়। নাহলে তত্ত্বটিকে আরেকটু সাজিয়ে গুছিয়ে শুধরে নেবার চেষ্টা হয়। তাও যদি না হয়, তবে যতদিন না অন্য কোনো বড়সড় তত্ত্ব এসে পুরনোটিকে হঠিয়ে দিচ্ছে, ততদিন ওই খাপছাড়া পর্যবেক্ষণগুলোকে উপেক্ষা পর্যন্ত করা হয়। শুনতে খারাপ লাগলেও কুহন বলেন, এরও প্রয়োজন আছে। তা নাহলে একটি তত্ত্ব থেকে যতগুলো অজানাকে জেনে নেওয়া সম্ভব, তা শেষ হবার আগেই তত্ত্বটি হারিয়ে যাবে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। যখন নিউটনবাবুর তত্ত্বটি খুব জনপ্রিয় ছিল, হঠাৎ দেখা গেলো, সৌরজগতের সবচেয়ে বাইরের গ্রহটি যেভাবে ঘোরা ফেরা করছে, নিউটন এর তত্ত্ব অনুযায়ী ঠিক সেভাবে করার কথা না। এ ঘটনার পর পরই নিউটন এর তত্ত্বটিকে বাতিল করে দেওয়া হয় নি। বরং নিউটন এর তত্ত্বটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য একটি নতুন গ্রহ কল্পনা করে নেওয়া হলো। গ্রহটি সত্যি সত্যি থাকলে তার আগের গ্রহটির নিয়ম ভাঙা চালচলনের ব্যাখ্যা নিউটন-এর তত্ত্ব দিয়েই করা সম্ভব। এ ঘটনার বহুদিন পর সত্যি সত্যি সেই কাল্পনিক গ্রহটিকে খুঁজেও পাওয়া যায়। তার নাম প্লুটো।
কিন্তু তাহলে বিজ্ঞান এগোবে কী করে? নতুন তত্ত্ব আসবে কী করে ? কুহন বললেন, হ্যাঁ তাও হবে। উনি বললেন বিজ্ঞান চর্চা দুভাবে হয়। প্রথম টিকে বললেন সাধারণ বিজ্ঞান চর্চা (normal science), যেটা উপরে বলা হয়েছে। এর মাঝে হঠাৎ করে হয় যুগ পরিবর্তন (paradigm shift )। সাধারণ বিজ্ঞান চর্চা করতে করতে যখন এমন অনেক তথ্য জমে যায় যা আর কিছুতেই পুরোনো তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না, তখন একটা সংকট তৈরী হয়। সংকট খুব বেড়ে গেলে অবশেষ একটা নতুন তত্ত্ব উঠে আসে যা পুরোনো তত্ত্বের থেকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে চারপাশকে দেখবে জানবে। আর যা দিয়ে ওই ব্যাখ্যা না পাওয়া ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা করা যাবে।
একেই উনি বললেন যুগ পরিবর্তন। যেমন টলেমি-র যুগ, কোপার্নিকাস-এর যুগ, নিউটন-এর যুগ কিংবা আইনস্টাইন-এর যুগ। যুগ পরিবর্তনের সময় যে নতুন তত্ত্বটি উঠে আসবে, তা আসপাশ যে ভাবে দেখবে, যে ভাবে ভাববে, তার ওপর সেসময়ের সমাজ, পরিবেশ, রাজনীতি সবকিছুর ছাপ থাকবে। এরপর থমাস কুহন একটি কথা বললেন, যা বেশ বিতর্কিত। বললেন কোনো ভাবেই নাকি নতুন তত্ত্বটিকে পুরোনোটির তুলনাতে “সত্যি”-র বেশি কাছাকাছি তা বলা যাবে না। নতুনটি আরো বেশি সময়োপযোগী মাত্র!
এবার তবে ঘুরেফিরে প্রশ্ন সেই একই, আসল সত্যিটা তাহলে কী? টলেমি-র সময় সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরতো আর এখন উল্টো, দুটোই সমান সত্যি? এ তো ভারী গোলমাল! কুহন নিজেও পরে এই নিয়ে একটু বিব্রত হয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, তিনি তাঁর কথা বোঝাতে পারেননি ঠিকভাবে অথবা লোকে তাঁর কথা বুঝে উঠতে পারেনি।
এরপর এলেন পল ফ্যেরওবেন্ড। তিনিও পপার-এর মত মানলেন না, সেই একই কারণে, যে কারণে কুহন মানেন নি। তবে তিনি কুহকেও মানলেন না। তাঁর বক্তব্য খুব সোজা। “বৈজ্ঞানিক সত্যি” খোঁজার পথ নিয়ে অতশত ভাবার কিছু নেই। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে বিজ্ঞানীরা যেন তেন উপায়ে, ছলে বলে কৌশলে, নিত্য নতুন উপায়ে “সত্যি” খুঁজে গেছেন। তাই ওনার মতে “সত্যি” খোঁজার সবচেয়ে ভালো বৈজ্ঞানিক পথ হলো “ যে কোনো উপায়ে” (“anything goes”)।
কিন্তু তাহলে তো সেই আবার সেই পুরোনো প্রশ্নে ফিরলাম, যা দিয়ে শুরু করেছিলাম। তাহলে বিজ্ঞান আর অবিজ্ঞান এ পার্থক্য করবো কী করে? ফ্যেরওবেন্ড বললেন, কি দরকার বাবা পার্থক্য করার! বিজ্ঞান আলাদা কিছু নয়। আর পাঁচটা পথের মতোই “সত্যি” খোঁজার আর একটা মতলব !!!
মোটামুটি এই হলো “সত্যি” নিয়ে সত্যিকারের টানাটানির গল্প।
যাক শেষ করার আগে বলে নিই। পপার হোক কিংবা কুহন অথবা ফ্যেরওবেন্ড, অসুখ করলে সবাই কিন্তু ওঝা নয়, ডাক্তার এর কাছেই যেতে বলেছেন !!
(প্রচ্ছদের ছবি: সূর্যকান্ত শাসমল)
তত্ত্ব কৈফিয়ত :
১) বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ: আইনস্টাইন মশাইয়ের এই তত্ত্বটি স্থান ও কাল (space and time ) এর মধ্যে সম্পর্কের কথা বলে। এই তত্ত্বটি দাঁড়িয়ে আছে দুটি সূত্রের উপর। ক) সকল বৈজ্ঞানিক সূত্রগুলি যেকোনো জড়ত্বীয় নির্দেশ তন্ত্রেই (inertial reference frame) অপরিবর্তিত থাকবে। খ) শূন্য মাধ্যমে আলোর গতিবেগ যেকোনো পর্যবেক্ষক এর কাছেই (গতিশীল বা স্থির) একই থাকবে।
২) কোয়ান্টাম মেকানিক্স: পদার্থ বিজ্ঞানের এই শাখাতে খুব ছোট পারমাণবিক কণাগুলির আচার ব্যবহার ব্যাখ্যা করা হয়। এই পত্রিকাতেই এ নিয়ে সুন্দর একটি লেখা বেরিয়েছে
৩) সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ: এটিও আইনস্টাইন মশাইয়েরই দেওয়া। এখানে মহাকর্ষের ব্যাখ্যা করা হয়েছে, নিউটন বাবু যেভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন, তার থেকে ভিন্ন উপায়ে। নিউটন বাবুর দেওয়া তত্ত্ব যা কিছু ব্যাখ্যা করতে পারছিলো না, এই নতুন তত্ত্বটিতে তা ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে। এ বিষয়েও এই পত্রিকাতে ভালো লেখা বেরিয়েছে।
৪) ক্যাওস তত্ত্ব: এই তত্ত্বে এমন সব পরিবর্তনশীল প্রাকৃতিক প্রণালী নিয়ে আলোচনা করা হয় যার চূড়ান্ত অবস্থা, তার প্রাথমিক অবস্থার ওপর অত্যধিক মাত্রায় নির্ভরশীল। যেমন আবহাওয়া অথবা বাস্তুতন্ত্র।
৫) মার্ক্স্ বাদ: কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলস এর দেওয়া একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তত্ত্ব যা পুঁজির অসমান বাটোয়ারা কে ধনী ও গরিব এর মধ্যে অসাম্যের জন্য দায়ী করে।
৬) ফ্রয়েড এর সাইকো এনালাইসিস: এ তত্ত্বে মানুষের মনের অবচেতনের কান্ডকারখানা দিয়ে সজাগ মনের কাজকে ব্যাখ্যা করা হয়।
আরো পড়াশুনোর অলিগলি :
- The logic of scientific discovery , Karl Popper, Routledge classics, London, 2002
- The structure of scientific revolutions, Thomas Kuhn, University of Chicago press, Chicago,2012.
- Science in history, J. D. Bernal, MIT press, Cambridge ,1971
- Science as falsification, K. R. Popper, Conjectures and Refutations, 1963
- Interview of Hiary Putnam in BBC on 1987