সালটা ১৯৯৭, ফুটবল মাঠের যুদ্ধক্ষেত্রে যুযুধান দুই প্রতিপক্ষ : ব্রাজিল বনাম ফ্রান্স। জনৈক তরুণ ব্রাজিলীয় খেলোয়াড় রবের্তো কার্লোস প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন একটি ফ্রি-কিকের, গোল থেকে ৩৫ মিটার দূর থেকে। সাদাচোখে গুরুত্বহীন ফ্রি কিক – কারণ কোন সরলরেখা বরাবরই গোলপোস্ট দৃষ্টিগোচর না ফ্রি কিকের স্থান থেকে।
কার্লোস সিদ্ধান্ত নিলেন এই আপাত অসম্ভব ঘটনার বাস্তবায়নে। তাঁর শট বলটিকে সামনে “দেওয়াল” হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা খেলোয়াড়দের থেকে দূরে পাঠালো। কিন্তু ঠিক মোক্ষম মূহুর্তে, যখন সকলে ধরেই নিয়েছেন বল লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে চলেছে আপাত নির্বিষ শটে, সেই বল বাঁকা শুরু করলো বামদিকে এবং ঢুকে গেলো গোলের মধ্যে।
নিউটনের প্রথম গতিসূত্র অনুসারে গতিশীল বস্তু সমবেগে (অর্থাৎ সমদ্রুতি ও অভিমুখ অপরিবর্তিত রেখে) চলতে থাকে যতক্ষণ না একটি বাহ্যিক বল বস্তুর উপর প্রযুক্ত হয়।
কার্লোস যখন শটটি মেরেছিলেন, তখন তিনি বলটিকে একটি দ্রুতি এবং অভিমুখ দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো কোন বাহ্যিক বলের প্রভাবে বলটি সেই বাঁকটা নিয়েছিলো এবং ফুটবল ইতিহাসের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ দৃষ্টিনন্দন গোলটি হয়ে গিয়েছিলো?
আসল কেরামতি লুকিয়েছিলো বলের ঘূর্ণনে (বলা ভালো – কার্লোসের লাথিতে)!!
শট মারতে গিয়ে কার্লোস লাথিটা মেরেছিলেন বলের ডানদিকে নিচের কোণে যাতে বলটি ফ্রি-কিকের স্থান থেকে ডানদিকে কোণাকুণি উঁচুতে উঠে যায় এবং সাথে সাথে নিজের অক্ষের চারিদিকে বনবন করে ঘুরতেও থাকে।
বলটি তার গতিপথের শুরুতে একটি আপাত সরলরেখা বরাবর ই হাওয়ায় উড়ে গিয়েছিলো। ডান এবং বাম – দুইদিকের নিরবচ্ছিন্ন বায়ুপ্রবাহ তার গতি শুরু থেকেই হ্রাস করার চেষ্টা করছিলো।
বলের এক দিকে (অর্থাৎ ডানদিকে) বায়ুপ্রবাহ ঘটছিলো বলের ঘূর্ণনের বিপরীত অভিমুখে, যা বলের ডানদিকে উচ্চচাপ অঞ্চলের সৃষ্টি করে এবং বলের অন্যদিকে (অর্থাৎ বামদিকে) বায়ুপ্রবাহ ঘটছিলো বলের ঘূর্ণনের সম অভিমুখে, যা বলের বামদিকে নিম্নচাপ অঞ্চলের সৃষ্টি করেছিলো।
এই দুই অঞ্চলের বায়ুচাপের পার্থক্যের কারণে বলটি উচ্চবায়ুচাপ অঞ্চল থেকে নিম্নবায়ুচাপ অঞ্চলের দিকে বাঁক নেয়। এই ঘটনাটি “ম্যাগনাস এফেক্ট” নামে পরিচিত।
এই ধরণের শট সাধারণতঃ খেলার মাঠের ভাষায় “ব্যানানা কিক” নামেই পরিচিত।
খেলোয়াড়রা প্রায়শঃই সফলভাবে এই শট নেওয়ার প্রচেষ্টা করে থাকেন এবং “সুন্দর খেলা”-টিকে আরও সুন্দর করার জন্য এই শট অন্যতম প্রধান উপকরণ।
কিন্তু অভ্রান্তভাবে বলটিকে “মানব-প্রাচীর”-এর নাগালের বাইরে দিয়ে (গোলের বিপরীতে) একবার বাঁকিয়ে পুনরায় বলটিকে গোলের দিকে বাঁকানো খুউউবই কঠিন।
বেশি উঁচুতে শট মারলে, বল তিন-কাঠির অনেক ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাবে; আবার একটু নিচে শট মারলে বল গোলের অভিমুখে বাঁকার আগেই মাটিতে পড়ে যাবে; গোলের থেকে বেশি দূরে শট নিয়ে ফেললে তা গোলের মধ্যে কখনোই ঢুকবে না; আবার বেশি সাবধানী হয়ে গোলের দিকে শট নিতে গেলে “মানব-প্রাচীর” হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা খেলোয়াড়রা পেয়ে যাবে বল। আবার খুউব ধীরে শট নিলে ঈপ্সিত দূরত্বের আগেই বল বাঁক নিতে পারে বা আদৌ বাঁক নাও নিতে পারে। কিন্তু বেশি জোরে শট নিলে গোল পেরিয়ে বল বাঁক নিতে পারে।
পদার্থবিজ্ঞানের এই একই তত্ত্ব এরকম আরোও একটি আপাত অসম্ভব গোলকে বাস্তবায়িত করতে পারে – তা হলো সরাসরি “কর্ণার কিক”।
১৬৭০ সালে স্যার আইস্যাক নিউটন টেনিস খেলতে গিয়ে সর্বপ্রথম “ম্যাগনাস এফেক্ট”-এর ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেন ও নথিবদ্ধ করেন। এই একই তত্ত্ব গল্ফ বল, ফ্রিসবী, এমনকী বেসবল-এর গতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। প্রতিটি ক্ষেত্রেই একই ঘটনা ঘটে। বলের ঘূর্ণন, সংলগ্ন অঞ্চলের বায়ুচাপের মধ্যে পার্থক্যের (pressure-gradient / pressure differential) সৃষ্টি করে যা বলকে ঘূর্ণনের অভিমুখে বাঁকতে বাধ্য করে।
এবং এখানেই উঠে আসে একটি গভীর প্রশ্ন। তত্ত্বগতভাবে খাতায়-কলমে তুমি কি একটি বলকে এতটা জোরে মারতে পারো যে বলটি বাতাসে প্রক্ষিপ্ত হবার পর ব্যুমেরাং-এর ন্যায় তোমার কাছেই ফিরে আসবে ?
আফশোসের ব্যাপার – ঘটনাটি সম্ভব না।
প্রচন্ড জোরে শট নেওয়ার ফলে যদি বলটি তৎক্ষণাৎ ফেটে না যায় বা কোনো বস্তুতে আঘাত না করে, তাহলেও যেহেতু বায়ুপ্রবাহ বলটির গতি হ্রাস করে, সে’কারণে বলটির স্বাভাবিক গতিপথ থেকে বিচ্যুতিকোণ ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাবে প্রতি মূহুর্তে। ফল স্বরূপ: বলটি ক্রমহ্রাসমান ব্যাসার্ধের বৃত্তে একটি সর্পিল চক্রাকারে পাক খেতে থাকবে, যতক্ষণ না পুরোপুরি থেমে যায়।
মজার ব্যাপার এইভাবে সর্পিলাকার পথে বলটিকে পাক খাওয়াতে গেলে, কার্লোস যে ঘূর্ণনের জন্ম দিয়েছিলেন তাঁর অমর ফ্রি-কিকে; তার ১৫ গুণ ঘূর্ণনের প্রয়োজন।
সুতরাং, শুভেচ্ছা রইলো – দেখো … এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারো কিনা।
Awesome writing Mr. Chatterjee . You have made to so simple.