প্রশ্নঃ ক্যান্সার আসলে কি?
ক্যান্সার হল একটি টিউমার যা আমাদের শরীরের যে কোন অংশেই হতে পারে। আমাদের শরীরে কোটি কোটি কোষ আছে। মানুষ জন্মানোর পর ছোট শিশু থেকে ধীরে ধীরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের আকারও বাড়তে থাকে। কিন্তু মোটামুটি ১৮ থেকে ২০ বছর বয়সের পর শরীরের আকার আর বাড়েনা। কোষ বিভাজন পদ্ধতিতে আমাদের শরীরের এই আকার বৃদ্ধির প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ হয়। কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় যখন কোন পরিবর্তন হয় কোন কোষের বৃদ্ধি থেমে না গিয়ে ক্রমাগত বিভাজিত হতে থাকে। এই পরিবর্তন অনেক ক্ষেত্রেই কোষের ডি.এন.এ (DNA) – তে হয়, এবং একে বলে মিউটেশান(১)। এর ফলে অনিয়ন্ত্রিত বিভাজিত কোষের একটি পিণ্ড তৈরি হয় যাকে বলে টিউমার। এই টিউমার তাড়াতাড়ি বাড়তে গিয়ে পাশের সুস্থ কোষ থেকে খাবার নিতে শুরু করে(২)। ফলে পাশের অনেক সুস্থ কোষ তখন মরে যেতে থাকে আর তার প্রভাব শরীরে পড়ে। একেই ক্যান্সার বলে।

অনিয়ন্ত্রিত বিভাজিত কোষের একটি পিণ্ড তৈরি হয় যাকে বলে টিউমার।
প্রশ্নঃ এই অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজনকে বন্ধ করা বা ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস কিভাবে করা সম্ভব?
আমি আজ ক্যান্সার চিকিৎসার একটা পদ্ধতি নিয়ে কথা বলবো(৩)। তার জন্য আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে ১২০ বছর আগে। ১৮৯২ সাল নাগাদ নিউইয়র্কে মেমরিয়াল হসপিটালের ক্যান্সার বিশারদ ডাক্তার উইলিয়াম কলি(William Bradley Coley)ক্যান্সারের চিকিৎসা করতে গিয়ে লক্ষ্য করেছিলেন যে যখন কোন ক্যান্সার রুগীর কোন ব্যাকটিরিয়া ঘটিত সংক্রমণ হয় তখন ক্যান্সারের টিউমারগুলো কমে যায়। কিন্তু তিনি যখন সালফার ওষুধ দিয়ে সংক্রমণটা সারিয়ে দিতেন(অ্যান্টিবায়টিক তখনও আবিষ্কার হয়নি) তখন দেখলেন ক্যান্সার আবার পুরোপুরি ফিরে আসে। তখন উনি ভেবে দেখলেন যে ব্যাকটিরিয়ারা হয়তো

ক্যান্সারের কোষগুলোকে মেরে ফেলতে পারে। এর পরের বেশ কিছু বছর তাই ক্যান্সার কমানোর জন্য ব্যাকটিরিয়া ইঞ্জেকশান করার পদ্ধতিতে চিকিৎসার চল হয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে সমস্যা হল যে এমনিতেই শরীরে ক্যান্সারের কারণে ইমিউনিটি কমে যায় (দেহের ইমিউন কোষগুলো ক্যান্সার কোষদের চিনে জব্দ করতে ব্যস্ত!), সেক্ষেত্রে ব্যাকটিরিয়া ইঞ্জেকশান দিলে ইমিউনিটি অতি সক্রিয় হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতি স্বরূপ শরীর আরো দুর্বল হয়ে যায় ও রুগী মারা যায়।
যখন কোন ক্যান্সার রুগীর কোন ব্যাকটিরিয়া ঘটিত সংক্রমণ হয় তখন ক্যান্সারের টিউমারগুলো কমে যায়।

প্রশ্নঃ তাহলে উপায়?
এই ভাবনায় ভর করে আমাদের মনে হল যে এই ব্যাকটিরিয়ার আক্রমণে ক্যান্সার কমে যাওয়ার পদ্ধতিটা বিশদভাবে জানা দরকার। ব্যাকটিরিয়ারা ঠিক কোন অস্ত্র দিয়ে ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধটা করে সেটা জানা প্রয়োজন। তা জানতে গিয়ে দেখা গেল যে কয়েক জাতির ব্যাকটিরিয়া ক্যান্সারের কোষ দেখলেই কিছু প্রোটিন নিজেদের কোষ থেকে বাইরে পাঠিয়ে দেয় ক্যান্সার-কোষের সাথে মোকাবিলা করার জন্য । এদের অ্যান্টি-ক্যান্সার প্রোটিন বলে। এই প্রোটিনগুলি ক্যান্সার কোষের মধ্যে ঢুকে যেসব প্রোটিন ক্যান্সার বৃদ্ধি পেতে সাহায্য করে তাদের ধ্বংস করে। কিন্তু এই অ্যান্টিক্যান্সার প্রোটিন কোন সুস্থ কোষকে আক্রমণ করে না (কি ভাবে এই ব্যাকটিরিয়া ক্যান্সার এবং সুস্থ কোষের পার্থক্য নির্ণয় করে, তা কিন্তু এখনো বৈজ্ঞানিকদের কাছে একটা রহস্য!)। সুতরাং এই অ্যান্টিক্যান্সার প্রোটিন ব্যাকটিরিয়া থেকে বার করে পরিশুদ্ধ করে সেটি ক্যান্সারের চিকিৎসার ওষুধ হিসেবে ব্যবহার । কিন্তু প্রোটিন পরিশুদ্ধকরণ(Purification) অনেক সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। USFDA (United States Food and Drug Administration)-র সঠিক নিয়মাবলী মেনে তা করতে হয়। সুতরাং এবার জানার দরকার পড়ল যে ঐ ক্যান্সার প্রতিরোধক বৈশিষ্ট্য প্রোটিনটির কোন নির্দিষ্ট অংশে আছে। প্রোটিন হল অ্যামিনো অ্যাসিডের লম্বা শৃঙ্খল। সুতরাং প্রোটিনের ঐ নির্দিষ্ট অংশটিকে বা পেপটাইডকে কৃত্রিমভাবে সংশ্লেষ করতে পারলেই তা কার্যকরী ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। পেপটাইড সংশ্লেষ অনেক কম সময়ে কম অর্থব্যয়ে করা যায়।
ব্যাকটিরিয়ারা অ্যাজুরিন নামের এক প্রোটিন দিয়ে ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করে।
এই ধরণের কার্যকারিতা সম্পন্ন প্রোটিনটির নাম হল অ্যাজুরিন(Azurin)। যা সিউডোমোনাস ব্যাকটিরিয়া থেকে সংশ্লেষ করা হয়েছে। ১২৮টি অ্যামিনো অ্যাসিড সমন্বিত এই অ্যাজুরিন প্রোটিন থেকে মাত্র ২৮টি অ্যামিনো অ্যাসিড সমন্বিত নির্দিষ্ট যে পেপটাইড শৃঙ্খলটি ক্যান্সারের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয় তার নাম পি২৮( P28)।
অ্যাজুরিনের মত আরেকটি প্রোটিন ল্যায( Laz) চিহ্নিত করা হয়েছে। যেটি গ্লিওব্লাস্টোমা( Glioblastoma) বা ব্রেন টিউমার এর ক্ষেত্রে কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছে। এই প্রোটিনটি ব্রেনের অসুখ মেনিনজাইটিস( Meningitis) সৃষ্টিকারী ব্যাকটিরিয়া Niesseria meningitides থেকে সংশ্লেষ করা হয়েছে। যেহেতু ব্রেন খুবই সুরক্ষিত অংশ তাই সহজে কোন ওষুধ ব্লাড-ব্রেন বেরিয়ার( blood-brain barrier) অতিক্রম করতে পারেনা। কিন্তু ল্যায প্রোটিন যেহেতু ব্রেনের অসুখ সৃষ্টিকারী ব্যাকটিরিয়া থেকেই সংশ্লেষিত সেহেতু এই প্রোটিনের পেপটাইডকে ব্রেন টিউমারের ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করলে সহজেই তা ব্লাড-ব্রেন বেরিয়ার অতিক্রম করতে সক্ষম হয়।

প্রশ্নঃ মানব শরীরে এই ওষুধ পরীক্ষা করা হয়েছে?
পরীক্ষাগারে এই ওষুধ টিউমার সমন্বিত ইঁদুরের মধ্যে দিয়ে দেখা গেছে যে টিউমারের আকার ক্রমশঃ কমে যাচ্ছে এবং ধীরে ধীরে টিউমার পুরোপুরি চলে গেছে। ২০০৯ থেকে ২০১১ পর্যন্ত শিকাগোতে একটি ফেজ-১ (phase-I) ক্লিনিকাল ট্রায়াল (clinical trial) চালান হয় এই ওষুধটির। ১৫জন চতুর্থ স্তরের (stage IV) ক্যান্সার রোগীর ওপর এই ট্রায়াল চালান হয়। এদের ক্ষেত্রে কোন ওষুধই আর কাজ করছিল না আর প্রত্যাশিত আয়ু ছিল সর্বাধিক ৬ মাস। এদেরকে ওষুধটি প্রথমে খুব কম ডোজ (dose)দেওয়া হয়। যেহেতু মানব শরীরে তা কিভাবে কাজ করবে বা তার কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয় কিনা তা জানা ছিলনা তাই ফলাফলের উন্নতির ওপর নির্ভর করে USFDA-র অনুমতি সাপেক্ষে ধীরে ধীরে ডোজ বাড়ান হয়। ট্রায়ালের সময়সীমার শেষে দেখা যায় ১৫ জনের মধ্যে ২ জনের টিউমার পুরোপুরি সেরে গেছে। বাকিদের ক্ষেত্রেও ক্যান্সার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। যেহেতু এই ওষুধ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্যান্সার কোষকেই আক্রমণ করে তাই আশেপাশের সুস্থ কোষের বিশেষ ক্ষতি হয় না। অতএব কেমোথেরাপীর চেয়ে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক কম ।
আরেকটি ট্রায়াল করা হয় ২০১৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত আমেরিকার ন্যাশানাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট (National Cancer Institute)-এর সহায়তায় শিশুদের ব্রেন টিউমারের (pediatric brain tumor) ওপর। ১৮জন রোগীর ওপর ১১টা হসপিটালে এই ট্রায়াল চালানোহয়। ট্রায়ালের পর এই ঔষধটিকে USFDA অরফ্যান ড্রাগ(orphan drug) হিসেবে ছাড়পত্র দেয়।
প্রশ্নঃ তাহলে এর পরবর্তী পদক্ষেপ কি?
বর্তমানে প্রফেসর আরও বেশী সংখ্যক রোগী নিয়ে ফেজ-২র (phase-II) ক্লিনিকাল ট্রায়াল করার প্রচেষ্টা করছেন। তারই সংগে এই প্রোটিনটিকে কোন ফল বা সব্জিতে জিনগত পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঢুকিয়ে ক্যান্সার প্রতিরোধক ফল বা সবজি তৈরি করার পদক্ষেপ নিয়েছেন। সেই গবেষণা ভারত সহ বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের সাথে সংগঠিতভাবে এগিয়ে চলেছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়ত আমরা এই ধরণের ফল বা সবজি খেয়ে ক্যান্সারের মত মারণ রোগের হাত থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পাব।
প্রচ্ছদের ছবি: ড: আনন্দ মোহন চক্রবর্তী (উৎস)
ক্যান্সারের মোকাবিলা করা এত কঠিন কেন?
আগ্রহী পাঠকদের জন্য:
(১) DNA’র পরিবর্তন মিউটেশন ছাড়াও আরো অনেক রকম ভাবে হতে পারে — ‘copy number alteration’, ‘aneuploidy’, ‘translocation’, ‘chromothripsis’, ইত্যাদি। প্রত্যেকটা গভীর গবেষণার বিষয়, এবং আরও জানতে পড়ুন এখানে: https://www.jci.org/articles/view/59954 ।
(২) সুস্থ কোষের বিভাজনের জন্য “growth-factor” বলে নানান রকমের রাসায়নিক পদার্থ লাগে যা কোষের বাইরে তৈরী হয়। ক্যান্সার কোষরা কিন্তু অনেক সময় নিজেদের growth-factor নিজেরাই বানিয়ে নেয় অথবা আশপাশের সুস্থ কোষদের দিয়ে বানিয়ে নিতে সক্ষম হয়।
(৩) ক্যান্সার কোষদের বিভাজন বন্ধ করার নানান পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যেমন ‘chemotherapy’, ‘radiation’, ‘targeted agents’, ‘immunotherapy’, ‘bacterial treatment’ ইত্যাদি । বিভিন্ন পদ্ধতিগুলো আলাদা আলাদা ভাবে কাজ করে — কোনোটা ক্যান্সার এবং সুস্থ কোষ, দুই প্রকারের কোষেদের মেরে ফেলে, কোনোটা প্রধানত ক্যান্সার কোষেদের মারে, কোনো কোনো পদ্ধতি আবার ক্যান্সার কোষদের সরাসরি ভাবে না মেরে দেহের immune কোষদের দিয়ে কাজ সেরে ফেলে। আফশোসের ব্যাপার এই যে বেশিরভাগ সময় কোনো একটা পদ্ধতি দিয়ে ক্যান্সারকে সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না। তাই নানান আলাদা পদ্ধতিকে মিলিয়ে মিশিয়ে (combination therapy) রোগ সারানোর চেষ্টা করা হয়।
(৪) ডঃ আনন্দ মোহন চক্রবর্তী -র গবেষণার বিষয়ে আরও জানতে এখানে দেখুন। তাঁর অন্যান্য কাজের সম্বন্ধে পড়ুন এখানে।
Clear description.