কীট-পতঙ্গের মধ্যে পিঁপড়েদের জীবনকাহিনী খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। এরা সামাজিক প্রাণী এবং দলবদ্ধভাবে বাস করে থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে এ পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণীর বহু পিঁপড়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। বিভন্ন জাতের অধিকাংশ দলেই সাধারণত স্ত্রী , পুরুষ ও কর্মী – এই তিন শ্রেণীর পিঁপড়ে দেখতে পাওয়া যায়। কোনও কোনও জাতের কর্মীদের আবার ছোট কর্মী, বড় কর্মী ও যোদ্ধা এই তিনরকমের বিভিন্ন আকৃতি বিশিষ্ট পিঁপড়ে দেখা যায়। বাসগৃহ নির্মাণ, খাদ্যসংগ্রহ, সন্তানপালন – এমন কী, যুদ্ধবিগ্রহ পর্যন্ত যাবতীয় কাজ ক্রীতদাসের মতো এই কর্মীদেরই করতে হয়। স্ত্রী ও পুরুষ পিঁপড়ের একমাত্র কাজ বসে বসে খাওয়া এবং বংশবৃদ্ধি করা। আমাদের দেশেও বিভিন্ন জাতীয় বহুবিধ পিঁপড়ে দেখতে পাওয়া যায়। কোনো কোনো জাতের পিঁপড়ের দলে হাজার হাজার কর্মী থাকে ; আবার কোনো কোনো জাতের পিঁপড়ের দলে কর্মীর সংখ্যা ত্রিশ-চল্লিশটি মাত্র। অধিকাংশ পিঁপড়েই গর্তের মধ্যে অথবা বৃক্ষ-কোটরে বাস করে থাকে। আবার কেউ কেউ বড় গাছের উপরে সবুজ পত্র-পল্লবের সাহায্যে বাসগৃহ নির্মাণ করে বসবাস করে। উগ্র প্রকৃতি ও বিষাক্ত দংশনের জন্যে নালসো নামে এক জাতীয় লাল রঙের পিঁপড়ে আমাদের দেশে সর্বজন পরিচিত। হাজার হাজার নালসো এক বাসার মধ্যে একসঙ্গে বাস করে। বাসস্থান নির্মাণ, খাদ্য-সংগ্রহ ও যুদ্ধবিগ্রহের সময় এরা যেরূপ বুদ্ধিবৃত্তির পরিচয় দেয়, তা কতকটা সংস্কারমূলক হলেও এতে সহজেই তাদের প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়।
নালসো-পিঁপড়েরা গাছের উঁচু ডালে অনেকগুলি সবুজ পাতা একসঙ্গে জুড়ে বড় বড় গোলাকার বাসা নির্মাণ করে এবং তার মধ্যে শত শত পিঁপড়ে একসঙ্গে বসবাস করে থাকে। এদের বাসা নির্মাণপ্রণালী অতি অদ্ভুত। কতকগুলি নালসো কর্মী একসঙ্গে পাশাপাশি ভাবে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে পরস্পর সন্নিহিত দুটি পাতাকে একত্রিত করে টেনে ধরে রাখে। তখন অপর কর্মীরা তাদের কীড়া মুখে করে উপস্থিত হয়। শুঁড়ের সাহায্যে এই কীড়াগুলির মুখের কাছে সুড়সুড়ি দিলেই তারা এক প্রকার আঠালো সুতা বের করতে থাকে। কাপড় বোনবার সময় তাঁতিরা যেমন একবার এদিকে আবার ওদিকে মাকু চালায়, কতকটা সেই কায়দায় কর্মীরা কীড়াগুলির মুখ একবার এ-পাতায় আবার ও-পাতায় ঠেকিয়ে সূক্ষ সুতার সাহায্যে পাতার ধারগুলি জুড়ে দেয়। এইরূপে বুনন শেষ হলে বড় বড় ফাঁকগুলিকে বারবার সুতা বুনে সাদা কাগজের মতো পাতলা পর্দায় ঢেকে দেয়। বাইরে বেরোবার জন্যে একটি কী দুটি মাত্র পথ রাখে। পাতার পর পাতা জুড়ে ক্রমশ বাসা বড় করে তোলে। বাসা বড় করবার জন্যে যদি কোনও সময়ে একটু দূরবর্তী নিচের ডাল থেকে পাতা নেবার প্রয়োজন হয়, তখন এরা দলে দলে বাসার নিচের দিকে জড়ো হতে হতে পরস্পর একে অন্যকে আঁকড়ে ধরে শিকলের মতো নিচের দিকে ঝুলে পড়ে। ক্রমে ক্রমে অপরাপর কর্মীরা এসে সেই শিকল বাড়াতে বাড়াতে সর্বশেষ পাতার নাগাল পেলেই কয়েকজন সেটাকে কামড়ে ধরে থাকে। অপর কর্মীরা তাদের পা কামড়ে ধরে।
তখন উপর দিক থেকে শিকল ক্রমশ খাটো করতে করতে নিচের পাতাকে টেনে কাছে এনে কীড়ার সাহায্যে মূল বাসার সঙ্গে শক্ত করে গেঁথে দেয়।
এরা মাংসাশী প্রাণী। মৃত কীট-পতঙ্গ, মাছের কাঁটা, পাখির পালক প্রভৃতি সংগ্রহ করে বাসায় নিয়ে যায় এবং অবসর মতো সকলে মিলে সেগুলি চেটে খায়। অন্যান্য পিঁপড়ের ডিম ও উই এদের উপাদেয় খাদ্য। নালসোরা সুকৌশলে উই ধরে থাকে। উইয়েরা কখনও অনাবৃত স্থানে যাতায়াত করে না, সর্বদাই অন্ধকারে থাকতে ভালবাসে। এই জন্যই মাটির সুড়ঙ্গ গাঁথতে গাঁথতে অগ্রসর হয়ে থাকে।
জীবন্ত ফড়িং বা ওই জাতীয় কোনো পতঙ্গকে একবার ধরতে পারলে আর রক্ষা নেই। একটা পিঁপড়ে কোনো রকমে একবার শিকার কামড়ে ধরলেই হলো – দেখতে দেখতে দলের অন্যান্য পিঁপড়েরা এসে চতুর্দিক থেকে তাকে ঘিরে ফেলবার চেষ্টা করতে থাকে দংশন-যন্ত্রনায় অস্থির হয়ে শিকার উড়ে পালাবার জন্যে প্রাণপণে ধ্বস্তাধ্বস্তি করে ; কিন্তু পিঁপড়েরাও তাকে কাবু করবার জন্যে দ্বিগুণ উত্সাহে বলপ্রয়োগ করতে থাকে। ডানা চেপে ধরতে না পারলে শিকার সহজেই উড়ে যেতে সক্ষম হয় ; সে অবস্থায় কিন্তু পিঁপড়েরাও কামড় ছাড়ে না। অন্যান্য পিঁপড়ে এসে তখন সে পিঁপড়েটার পা অথবা কোমর কামড়ে ধরে টেনে রাখতে চেষ্টা করে। এই অবস্থায় ক্রমশ পিঁপড়ের একটা শিকল গেঁথে ওঠে। অনেক সময় দেখা যায়, ফড়িং উড়ে যাচ্ছে আর তার লেজ অথবা পা কামড়ে ধরে দু-তিনটা নালসো শিকলের মতো ঝুলছে।
নালসো-পিঁপড়েদের প্রকৃতি এতই উগ্র যে, শত্রু হোক কী মিত্রই হোক বাসার কাছে এলে কারও নিস্তার নেই। প্রবল-দুর্বল নির্বিশেষে দলে দলে ছুটে এসে আক্রমণ করবে। প্রাণের ভয় যেন এদের মোটেই নেই। একবার আক্রমণ করলে কিছুতেই পিছু হটবে না। শত্রুর আক্রমণে সঙ্গীরা দলে দলে প্রাণ হারাচ্ছে দেখেও এরা যেন মোটেই বিচলিত হয় না বরং চতুর্গুণ উত্তেজনার সঙ্গে মরণপণ লড়াই শুরু করে দেয়। একবার শত্রুকে কামড়ে ধরতে পারলেই হয় – কিছুতেই আর কামড় ছাড়বে না। মস্তক থেকে দেহ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও মস্তকটি সেই একই ভাবে মরণ-কামড় দিয়ে শত্রুর দেহ্সংলগ্ন হয়ে থাকে। শত্রুর আগমনের আশঙ্কা হলেই দেহের প্রান্তদেশ থেকে এক প্রকার বিষাক্ত রস পিচকিরির মতো ছুড়ে মারতে থাকে। এই রসের বিষাক্ত উগ্র গন্ধে এরা অনেক দূর থেকেই পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে। লড়াই শুরু হবার মুখে এরা শরীরের পশ্চাদ্দেশ ঊর্ধ্বে তুলে সম্মুখের পা উঁচু করে এমন উত্তেজিত অবস্থায় মুখ হাঁ করে ছুটে এসে দলে দলে বাসার উপর সার বেঁধে দাঁড়ায় যে, অতি বড় শত্রুও অগ্রসর হতে ইতস্তত করতে বাধ্য হয়। উত্তেজিত জনতা যেমন জিগির তুলে সকলের প্রাণে উৎসাহের সঞ্চার করে, প্রবল উত্তেজনার সময় এরাও তেমনই শরীরের পশ্চাদ্দেশ পাতার উপর ঠুকে ঠুকে এক প্রকার অদ্ভুত শব্দ উৎপাদন করে। বাসার সম্মুখে কান পেতে রাখলে এক প্রকার অষ্ফুট খস্ খস্ শব্দ শুনতে পাওয়া যায়।
এদের দূর্ধর্ষ কোপন স্বভাবের ফলে, অন্যান্য পিঁপড়েদের সঙ্গে হামেশাই ঝগড়া-ঝাঁটি লেগে থাকে – এমন কি, বিভিন্ন দলের স্বজাতীয়দের মধ্যে সময় সময় ভীষণ লড়াই বেঁধে যায়। এই জন্যেই বোধ হয় অন্যান্য জাতের পিঁপড়েরা এদের নিকট থেকে যথাসম্ভব দূরে দূরেই অবস্থান করে। তবে দলে ভারী বলেই হোক বা উগ্র বিষের ভয়েই হোক ক্ষুদে পিঁপড়েদের সঙ্গে কিন্তু এরা কিছুতেই এঁটে উঠতে পারে না। ক্ষুদেরা কোনও রকমে সন্ধান পেলে নালসোদের সমূলে ধ্বংস না করে ছাড়ে না। এই জন্যেই যে সব স্থানে ক্ষুদে পিঁপড়ের আস্তানা আছে, সেখানে কখনো নালসো পিঁপড়ে দেখতে পাওয়া যায় না। ক্ষুদে, ডেঁয়ো ও ছোট ছোট কালো বিষ পিঁপড়ের সঙ্গে এদের লড়াই অনেকবার প্রত্যক্ষ করেছি ; কিন্তু এদের স্বজাতীয়ের পরস্পরের মধ্যে দল ভাঙার যে ভীষণ লড়াই প্রত্যক্ষ করেছিলাম, সেটা সত্যই ভয়াবহ।
একবার বিকালের দিকে কলকাতার সন্নিহিত সোনারপুর অঞ্চলের একটা বাগানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। বাগানের চার দিকে পালিতা মাদারের মোটা মোটা ডাল পুঁতে তার গায়ে খুব ফাঁক করে বাঁশের বাখারী এঁটে এমনভাবে বেড়া দিয়ে রেখেছে যেন গরু-বাছুর ভিতরে ঢুকতে না পারে। বাগানের গাছপালার অবস্থা দেখে পরিষ্কার বুঝতে পারা গেল যে, আগের দিন সেখানে বেশ ঝড়বৃষ্টি হয়ে গেছে। আর একটু অগ্রসর হতেই নজরে পড়লো – খুব বড় একটা পিঁপড়ের বাসা সমেত ছোট একটা আমের ডাল একটা খুঁটির খুব কাছেই বাখারীর সঙ্গে ঝুলে রয়েছে। মনে হলো ঝড়ের বেগে ডালটা ভেঙে বেড়ার গায়ে পড়ে আটকে গিয়েছিল। খুব কাছে গিয়ে দেখলাম ছিন্ন-বিছিন্ন বাসাটার ভিতরে সহস্র সহস্র পিঁপড়ে অবস্থান করছে। কতকগুলি পিঁপড়ে বাসার উপরে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছে আর কতকগুলি একবার ডালটার গা বেয়ে উপরের দিকে উঠছে আবার নেমে আসছে। তাদের গতিবিধি দেখে পরিস্কার বোঝা গেল যে, তারা ঐ ঝুলন্ত ভাঙা বাসা থেকে বেরিয়ে অন্য কোথাও যাবার রাস্তা খুঁজছে। কিন্তু একটু লক্ষ্য করতেই বুঝতে পারলাম, তাদের বাইরে যাবার রাস্তা বন্ধ। কারণ যে বাখারীটার সঙ্গে বাসাটা ঝুলছিল, সেই বাখারীটার উপর দিয়ে বরাবর এক সার লাল-পিঁপড়ে যাতায়াত করছে। বাগানের কোণে একটা ঝোপের ভিতর পূর্ব থেকেই আর একদল লাল-পিঁপড়ে বাসা তৈরি করে বসবাস করছিল। তারাই বাখারীর উপর দিয়ে প্রায় ২৫।৩০ ফুট লম্বা লাইন করে একটা সদ্যকর্তিত কচ্ছপের খোলা থেকে মাংসের কণা সংগ্রহ করে বাসায় তুলছিল। ঝুলন্ত বাসার পিঁপড়েরা ডাল বেয়ে বাখারীর কাছে এসে উক্ত পিঁপড়ের দল দেখেই আর অগ্রসর হতে সাহসী হয় নি। বাখারীর উপরের পিঁপড়েদের অতিক্রম না করে তাদের অন্যত্র যাবার কোনই উপায় নেই। ছিন্ন-বিছিন্ন ভগ্ন বাসাতেও বেশিদিন বাস করা অসম্ভব। একে তো শত্রু নিকটে, তার উপর পাতা শুকিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই বাসা কুচকে যাবে, নয়তো শুকনো পাতার জোড়া মুখ খুলে গিয়ে বাসাটার স্থানে স্থানে ফাটল দেখা দেবে। কাজেই এই বাসা পরিত্যাগ করে অন্যত্র নতুন আশ্রয়ের সন্ধান করতেই হবে। বিশেষত বাসার ভিতরে অসংখ্য ডিম ও বাচ্চা রয়েছে তাদের নিরাপদ স্থানে রক্ষা করা দরকার। এইসব নানা ব্যাপারে বিব্রত হয়ে ঝুলন্ত বাসার অধিবাসীরা বিষম উত্তেজিতভাবে ইতস্তত ছুটাছুটি করছিল। বাখারীর উপরে যারা যাতায়াত করছিল, তারাও এই আগন্তুক দলের সন্ধান পেয়েছিল বোধহয়, কারণ তাদের ভিতরেও উত্তেজনার ভাব লক্ষিত হচ্ছিল। তারাও ক্রমে ক্রমে ঝুলন্ত ডালটার কাছাকাছি এসে ভিড় জমাচ্ছিল। প্রায় আধ ঘন্টার উপর দাঁড়িয়ে উভয় দলের এই তোড়জোড় লক্ষ্য করছিলাম। একমাত্র উত্তেজিত ভাব বা একস্থানে দলে দলে জমায়েত হওয়া ব্যতিরেকে লড়াইয়ের আর কোনও লক্ষণই দেখতে পাই নি। ঝুলন্ত বাসার পিঁপড়েরা কিরূপ কৌশল অবলম্বন করে বাখারীর উপরের পিঁপড়েদের লাইন অতিক্রম করে যায় – কেবল সেটাই দেখবার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। আরও দশ-পনেরো মিনিট এ ভাবেই কাটলো।
অবশেষে দেখলাম, ঝুলন্ত বাসার প্রায় পাঁচ-সাতটা পিঁপড়ে ডাল বেয়ে বাখারীটার কাছে এসেই ইতস্তত করতে লাগলো। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার পর সেই দলের গোটা তিনেক পিঁপড়ে বাসায় ফিরে গেল। বাকি যারা রইলো তারা শুঁড় উঁচু করে যেন বাখারীর উপরের দলটাকে মনোযোগ সহকারে দেখতে লাগলো। ইতিমধ্যে অগ্রবর্তী পিঁপড়েটা অসীম সাহসে ভর করেই যেন অকস্মাৎ বাখারীর পিঁপড়েদের লাইনের মধ্যে দিয়ে ছুটে পার হতে গিয়েই তুমুল কাণ্ড ঘটিয়ে তুললো। বাখারীর দলও যেন প্রস্তুত হয়েই ছিল। তত্ক্ষণাৎ দশ-বারোটা পিঁপড়ে মিলে একযোগে তাকে কামড়ে ধরে বন্দী করে ফেললো। বন্দী করবার কায়দাও অদ্ভুত। ছয়জনে ছয়টা ঠ্যাং কামড়ে ধরে যথা সম্ভব টেনে ফাঁক করে রাখলো। তখন আর দুজনে দুটা শুঁড় টেনে ধরে পিঁপড়েটাকে এমন অবস্থায় রাখলো যে, বেচারার আর নড়াচড়ার সাধ্য ছিল না। এবার দু-দলে সত্যিকারের লড়াই হয়ে গেল। উভয় দলের সৈন্য-সমন্তেরাই শুঁড় উঁচিয়ে পুচ্ছদেশ ঊর্ধ্বে তুলে প্রবল উত্তেজনায় যেন তাণ্ডব নৃত্য শুরু করে দিল। মাঝে মাঝে এক-একটা পিঁপড়ে অন্য একটার শুঁড়ে শুঁড় ঠেকিয়ে কী যেন বলে দেয়। তত্ক্ষণাৎ সে ছুটে বাসার ভিতর চলে যায় এবং পরক্ষণেই কতকগুলি নতুন সৈন্য দল বেঁধে বাইরে এসে পড়ে। এরূপ ঘটনাস্থলে উভয়-পক্ষেরই ভিড় জমে গেল। ইতিমধ্যে বাখারীর উপরকার দল শত্রুপক্ষের একটাকে বন্দী করে উৎসাহের অতিশয্যেই বোধ হয় আস্ফালন করতে করতে ভাঙা ডালটার খুব নিকটে এগিয়ে গেল। ভাব দেখে মনে হলো যেন তারা বাসাটাকেই দখল করতে যাচ্ছে ; কিন্তু তার ফল হলো বিপরীত। মুহূর্তের মধ্যেই ছিন্ন বাসার পিঁপড়েরা শত্রুপক্ষের পাঁচ-সাতটি অগ্রবর্তী সৈন্যকে শুঁড়ে কামড়ে ধরে একেবারে তাদের দলের মধ্যে টেনে নিয়ে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে কিছু সৈন্যসামন্ত তাদের ঘিরে ফেললো। তাদের কয়েকটা এসে তাদের কেটে ছিন্ন-বিছিন্ন করে দিল আর বাকি ক’টাকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সকলে মিলে পূর্বোক্ত উপায়ে টানা দিয়ে রেখে দিল। এই সব ঘটনা ঘটতে দু-তিন মিনিটের বেশি সময় লাগে নি। এদিকে বাখারী ও ঝুলন্ত ডালের সংযোগস্থলে দ্বৈরথ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। দু-দলের দুজন করে টানাটানি কামড়াকামড়ি চলছে। দেখলাম বেড়ার উপরের দলের কয়েকটি সৈন্য ঝুলন্ত বাসার কয়েকটি সৈন্যকে শুঁড়ে কামড়ে ধরে তাদের দিকে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে, আবার কেউ কেউ ছ’টি পা দিয়ে অবলম্বন-স্থল আঁকড়ে রয়েছে। অনেকক্ষণ টানাটানির পর কেউ কেউ শুঁড়ের অর্ধাংশ শত্রুর মুখে রেখে উর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করছে।
ক্রমশ লড়াই এমন ভীষণাকার ধারণ করলো যে, দু-তিন হাত প্রশস্ত স্থানের মধ্যে প্রায় সর্বত্র এরূপ টানাটানি কামড়াকামড়ি চলতে লাগলো। এখন শুধু টানাটানি নয়, কামড়াকামড়িই যেন বেশি দেখা যেতে লাগলো। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই বিষ-বাষ্পের অবাধ প্রয়োগ। এতগুলি পিঁপড়ের দেহনিঃসৃত বিষাক্ত রসের উগ্র গন্ধে যেন নাক জ্বলে যাচ্ছিল। কামড়াকামড়ি করতে করতে জড়াজড়ি করে শত শত পিঁপড়ে ঝুপ ঝুপ করে নিচে পড়ছিল। নিচে মাটির উপর চেয়ে দেখলাম – প্রায় পনেরো-বিশ মিনিটের মধ্যে উভয় পক্ষের এত পিঁপড়ে মারা গেছে যে, ঘাসপাতাগুলি তাদের মৃতদেহের নিচে প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে। মনে হলো উভয় পক্ষের সৈন্য সংখ্যা প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে। যারা তখনও ছুটাছুটি করছিল, তাদের দিকে বিশেষভাবে লক্ষ করে দেখলাম – প্রায় প্রত্যেকেরই শুঁড় অথবা পায়ের সঙ্গে মরণ-কামড় দিয়ে ঝুলে রয়েছে শত্রুদের ছিন্ন মস্তক অথবা দেহের সম্মুখাংশ। বেড়ার উপরের পিঁপড়েরা সর্বদাই চেষ্টা করছিল, যাতে বাসাটাকে গিয়ে দখল করতে পারে। এত লড়াইয়ের পরেও দেখলাম তাদের উৎসাহ কিছুমাত্র কমেনি। তাদের বাসা থেকে নতুন নতুন সৈন্য এসে পূর্ণোদ্যমে আবার আক্রমণ শুরু করলো। এবার যেন তারাই জয়ী হয়েছে বলে বোধ হলো। ঝুলন্ত বাসার সৈন্যদের সংখ্যা আর বেশি দেখা যাচ্ছিল না। বিশেষত উভয় পক্ষের সৈন্যদের আকৃতি একই প্রকার বলে বিশেষ কিছু বুঝতে পারছিলাম না যে, কে শত্রু কে মিত্র। কিন্তু এরা পরস্পর শুঁড়ে শুঁড় ঠেকিয়ে বা অন্য কোনও উপায়ে শত্রু-মিত্র চিনে নিচ্ছিলো। এদিকে বাখারীর উপরের দল দুই চারটি করে ক্রমে ক্রমে বাসার উপরে এসে জড়ো হতে লাগলো, কিন্তু তারাও যে বেশ ভয়ে ভয়ে ইতস্তত করে অগ্রসর হচ্ছিল, তাও বেশ বোঝা গেল। কিছুক্ষণ বেশ চুপচাপ। বাসার সৈন্য সামন্ত যেন ক্রমশ বিরল হতে লাগলো। ঝুলন্ত বাসার পিঁপড়েরা যে যুদ্ধে হেরে গেছে, সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু বাসাটার খুব কাছে গিয়ে কান পেতে শুনলাম – ভিতরে যেন অজস্র পিঁপড়ের একটা খস্ খস্ আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
প্রায় পাঁচ-সাত মিনিট এভাবে কেটে গেল, তার পরেই দেখি – গুটিকয়েক পিঁপড়ে বাসার ভিতর থেকে অপরিণতবয়স্ক বাচ্চাগুলিকে মুখে নিয়ে বেরিয়ে এলো। পিছনে তাদের একদল সৈন্য যেন পাহারা দিতে দিতে চলেছে। বাচ্চাবহনকারীরা কোনও দিকেই ভ্রূক্ষেপ না করে গাছের ডাল ও বাখারীটার উপর দিয়ে অতি দ্রুতগতিতে পালিতা-মাদারের খুঁটিটার উপর যেতে লাগলো। সৈন্যরাও তাদের অনুসরণ করছিল। এই ব্যবধানটুকুর মধ্যে শত্রুরা বিশেষ কিছু বাধা দেবার চেষ্টা করলো না, কেবল দু-একটা সৈন্যকে ধরে টানা দিয়ে রাখল মাত্র। বিশেষত তখন সেস্থানে শত্রুর সংখ্যাও খুব কমই ছিল। যারা ছিল তাদের অধিকাংশই যেন মারামারি করা অপেক্ষা বাসাটা লুট করবার উত্সাহে সেই দিকেই ছুটছিল। খানিক পরে দেখা গেল, আরও অনেক ডিম ও বাচ্চাগুলিকে মুখে নিয়ে দলে দলে বাসা থেকে ছুটে বের হয়ে সেই গাছটার দিকেই প্রাণপণে ছুটছে। তন্মুহূর্তেই আবার ভীষণ লড়াই শুরু হয়ে গেল। বাসার ভিতরে এতক্ষণ অসংখ্য সৈন্য যেন দম নেবার জন্যে চুপ করে বসেছিল – এবার তারা দলে দলে বেরিয়ে এসে শত্রুদের খণ্ড খণ্ড করে ফেলতে লাগলো। এদিকে ফাঁকে ফাঁকে তারা বাসার ডিম ও বাচ্চাগুলিকে সরিয়ে নিচ্ছিল। সেই গাছটার উপর শত্রুরা এবার সত্যসত্যই পৃষ্ঠভঙ্গ দিল।
খুঁটিটার মাথার উপর কতকগুলি নতুন ডাল গজিয়েছিল। সেই ডালের পাতা মুড়ে সঙ্গে সঙ্গে কতকগুলি কর্মী পিঁপড়ে নতুন বাসা নির্মাণে লেগে গেল। এভাবে একটা ডালের মধ্যেই তিন-চারটা ছোট ছোট বাসা তৈরি হয়ে গেল। বাসা নির্মাণ শেষ হতে না হতেই তারা ডিম ও বাচ্চাগুলিকে তার মধ্যে স্তূপাকারে রাখতে লাগলো। এদিকে ঝুলন্ত বাসাটার নিচের দিকে নজর পড়তেই দেখি – এক আশ্চর্য ব্যাপার। যখন শত্রু-সৈন্যরা ভিতরে ঢুকে পড়েছিল, সেই সময়ে ভয় পেয়ে কতকগুলি কর্মী-পিঁপড়ে বাচ্চা মুখে করে বাসাটার নিচের দিকে জড়ো হয়েছে। ক্রমশ স্থানাভাব হওয়ায় কর্মীরা বাচ্চা মুখে করে স্তূপাকারে নিচের দিকে ঝুলে রয়েছে। যাহোক, এদিকে শত্রুপক্ষ পরাভূত হওয়ায় তাদের রাস্তা খোলা হয়ে গিয়েছিল। এখন বাখারী ও গাছটার দুদিকে ইতস্তত অনেক সৈন্য পাহারায় নিযুক্ত করে তারা ডিম ও বাচ্চাগুলিকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। ডিম ও বাচ্চাগুলিকে সরাবার পর তারা পুরুষ পিঁপড়েগুলিকে ঠিক নিশান বহন করবার মতো উঁচু করে নিয়ে আসতে লাগলো। পুরুষের সংখ্যাও কম ছিল না। দেড়শ কী দু’শর উপর হবে। তার পর রানীদের পালা। রানীরা আকারে ওদের তুলনায় খুবই বড়। সেগুলিকে বহন করে আনা অসুবিধাজনক। রাখালেরা যেমন গরুর পাল তাড়িয়ে নেয়, কর্মীরাও রানীগুলিকে তেমনি পিছনে পিছনে তাড়িয়ে আনছিল। শত্রুপক্ষের লাইন তখন ভেঙে গেছে। কেবলমাত্র দু-চারটা কর্মী বিচ্ছিন্নভাবে এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করছিল। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। এপর্যন্ত দেখেই সেদিন সেখান থেকে ফিরে এসেছিলাম। তার পরের দিন সকালে গিয়ে দেখি – বাসাটি শূন্য অবস্থায় ঝুলছে। বাসিন্দাদের কতকগুলি অবশ্য তখনও সেখানে এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করছিল। পালিতা-মাদারের খুঁটির গা বেয়ে বাখারীর উপর দিয়ে তারা পরিষ্কার রাস্তা করে দলে দলে উপরে-নিচে আনাগোনা করছে। আর শত্রুপক্ষ বাখারীর বিপরীত দিকে দিয়ে পূর্বের ন্যায় লাইন করে চলেছে। এখন আর শত্রুতার ভাব দেখা গেল না।
______________
প্রবাসী, পৌষ, ১৩৪৪