নিম্নশ্রেণীর প্রাণীদের মধ্যে পিঁপড়েদের বুদ্ধিবৃত্তি সম্বন্ধে অনেকেই অনেক কিছু শুনে থাকবেন। কিন্তু অনেকের ধারণা – যতই কৌতূহলোদ্দীপক হোক না কেন, এরা প্রত্যেকটি কাজই স্বাভাবিক প্রেরণা বা সংস্কারবশেই করে থাকে। আমাদের দেশে বিভিন্ন শ্রেণীর বহু জাতীয় পিঁপড়ে দেখা যায়। এদের বিচিত্র জীবনযাত্রা প্রণালীর মধ্যে এমন কোনো কোনো ঘটনা ঘটে, যাতে এরা যে প্রত্যেকটি কাজই সংস্কারবশে করে থাকে, এমন কথা বলা যায় না। বিভিন্ন জাতীয় পিঁপড়ের বাসস্থান নির্মাণ ও সন্তানপালনের কৌশল, শৃঙ্খলা ও বিবেচনাশক্তি স্বাভাবিক প্রেরণার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে; কিন্তু যুদ্ধবিগ্রহ, আত্মরক্ষা এবং খাদ্য সংগ্রহ প্রভৃতি ব্যাপারে সময়ে সময়ে এমন দু-একটি কৌশল অবলম্বন করতে দেখা যায়, যা স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন প্রাণীর পক্ষেই সম্ভব। এস্থলে আমাদের দেশের বিভিন্ন জাতীয় পিঁপড়ে সম্বন্ধে নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ কয়েকটি ঘটনার বিষয়ে উল্লেখ করছি। এ কি অন্ধসংস্কার না স্বাধীন বিচারবুদ্ধির ফল, তা পাঠকবর্গই বিচার করবেন।
এক দিন সকাল নটা সাড়ে-নটা সময় পল্লীঅঞ্চলের রাস্তা দিয়ে চলেছি। সকাল থেকেই শিশিরবিন্দুর মত গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। কিছু দূর অগ্রসর হতেই রাস্তার এক পাশে পরিষ্কার স্থানেই একটা সুপারি গাছের উপর নজর পড়লো। কতকগুলি নালসো ( লাল পিঁপড়ে ) সার বেঁধে গাছটার উপরের দিক থেকে নিচের দিকে ছুটে আসছিল। অবশ্য দু-চারটা পিঁপড়ে উপরের দিকেও উঠছিল। নালসোরা সাধারণত গাছের উপরেই চলাফেরা করে, নেহাৎ প্রয়োজন না হলে মাটিতে বা নিচু জায়গায় বড় একটা নামতে চায় না। তাছাড়া সুপারি গাছের উপর এদের সাধারণত দেখতে পাওয়া যায় না। কাজেই ব্যাপারটা কি দেখবার জন্য কৌতূহল হলো। কাছে গিয়ে দেখলাম — গাছটার এক পাশে মাটি থেকে প্রায় এক ফুট উপরে, কালো রঙের একদল ক্ষুদে পিঁপড়ে ছোট্ট একটা গুবরে পোকাকে আক্রমণ করে নিচে নামাবার জন্যে তার ঠ্যাং ধরে প্রাণপণ টানাটানি করছে। উপর দিক থেকে আবার পাঁচ-ছয়টা নালসো তার সামনে দুটো পা ও ঘাড় ধরে এমন ভাবে টান হয়ে রয়েছে যেন আরেকটু হলেই ছিঁড়ে যাবে। গুবরে পোকাটার কাছ থেকে নিচের দিকে গাছটার গোড়ার উপর এখানে-সেখানে আরও অসংখ্য ক্ষুদে পিঁপড়ে ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছিল। সুপারি গাছটা প্রকাণ্ড একটা আমগাছের উপর হেলে পড়েছিল। আমগাছটাতেই ছিল নালসোদের বাসা। সেখান থেকে সুপারি গাছটার উপর দিয়ে দু-একটা টহলদার পিঁপড়ে নিচের অবস্থা তদারক করতে আসায় হয়তো শিকারটা নজরে পড়ে যায়। তার ফলেই খুব সম্ভব উভয় দলে শক্তি পরীক্ষা চলেছে। লক্ষণ দেখে বোধ হলো — ক্ষুদেরাই প্রথম শিকারটাকে আক্রমণ করে তাকে অনেকটা কাবু করে এনেছিল – তারপর এসেছে এই নালসোর দল। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই যে এই কাণ্ডটা চলছিল, তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু উভয় পক্ষের টাগ-অব-ওয়ারটা চলছে অল্পক্ষণ ধরে। কারণ জায়গাটায় তখনও অধিক সংখ্যক নালসো জমায়েত হয় নি। তারা এদিকে-ওদিকে দুচারটা খাড়া পাহারা মোতায়েন করেছে মাত্র। এই পাহারাদার শাস্ত্রীরা শুঁড় উচিয়ে, মুখ হাঁ করে, নিশ্চল ভাবে অপর পক্ষের গতিবিধির দিকে লক্ষ্য রেখেছে। পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে বাকি রইলো না যে, শীঘ্রই একটা গুরুতর ‘পরিস্হিতি’র উদ্ভব হবে।
প্রায় আধ ঘণ্টার মধ্যেই অবস্থা সঙিন হয়ে উঠলো। ইতিমধ্যে আরও অনেক নালসো এসে পোকাটাকে ক্ষুদে-পিঁপড়েদের কবল থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল এবং প্রায় এক ইঞ্চি উপরে শিকারটাকে টেনে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। শিকার হাতছাড়া হয় দেখে ক্ষুদেরা এবার সার বেঁধে দলে দলে অগ্রসর হতে লাগলো। সংখ্যাধিক্যের জোরে পরক্ষণেই তারা পোকাটাকে প্রায় তিন-চার ইঞ্চি নিচে টেনে আনলো। সঙ্গে সঙ্গেই উভয় দলের মধ্যে ‘হাতাহাতি লড়াই’ শুরু হয়ে গেল। সে এক ভীষণ কাণ্ড, এক-একটা লালপিঁপড়েকে প্রায় দশ-বারোটা ক্ষুদে-পিঁপড়ে এক সঙ্গে আক্রমণ করে কাবু করবার চেষ্টা করছিল। পায়ে, শুঁড়ে, চোখে-মুখে সর্বত্র এতগুলি পিঁপড়ে একটা লাল পিঁপড়েকে কামড়ে ধরলে সে আর কতক্ষণ টিকতে পারে? দু-চারটা মাত্র কালো পিঁপড়েকে ছিন্ন-ভিন্ন করে এক-এক করে লাল-পিঁপড়েরা পিঠের দিকে উল্টোভাবে ধনুকের মত বেঁকে গিয়ে জীবনলীলা শেষ করতে লাগলো। কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর লাল-পিঁপড়েরা বেগতিক দেখে শিকার ছেড়ে দিল, কিন্তু লড়াই থামলো না। গাছটার গোড়ার উপর এখানে-সেখানে তুমুল লড়াই চলছিল। অসংখ্য ক্ষুদে-পিঁপড়ের আক্রমণে লাল পিঁপড়েগুলির পরাজয় যে আসন্ন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ রইলো না। কিন্তু অনেক সৈন্য ক্ষয়ের পর তারা বোধহয় বুঝতে পেরেছিল যে, এভাবে আর চলবে না। তারা যেন নতুন ‘প্ল্যানে’ অগ্রসর হবার ব্যবস্থা করছিল। এতক্ষণ নালসোরা যুদ্ধ করছিল একক ভাবে, এখানে-সেখানে। কাজেই এক-একটা নালসো ক্ষুদে-পিঁপড়ে অপেক্ষা পাঁচ-সাতগুণ বড় এবং শক্তিশালী হলেও দশ বারোটা ক্ষুদের বিষাক্ত দংশনে সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু বরণ করছিল। এবার নালসোরা আক্রমণ ক্ষান্ত করে দলে দলে সে স্থানটায় সমবেত হতে লাগলো। অবশ্য এই সমবেত হওয়াটা খুব সুশৃঙ্খল না হলেও সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল ছিল না। এ অবস্থায় দু-একটি ক্ষুদে পিঁপড়ে দল ছেড়ে তাদের লাইনের নিকট উপস্থিত হওয়া মাত্রই সেগুলিকে ধরে সাঁড়াশির মত ধারালো চোয়ালের সাহায্যে খণ্ড খণ্ড করে ফেলতে লাগলো। এই নতুন কৌশলে ক্ষুদেরা ক্রমশই নিচের দিকে হটতে বাধ্য হচ্ছিল। ইতিমধ্যে এক দল ক্ষুদে-পিঁপড়ে শিকারটাকে টেনে নিয়ে অনেক নিচে চলে গিয়েছিল এবং বাসার ভিতরকার শ্রমিক পিঁপড়েরা গাছের গোড়ার একাংশে চার-পাঁচ ইঞ্চি স্থান জুড়ে প্রায় ১/৪ ইঞ্চি খাড়াই একটা মাটির দেয়াল গেঁথে তুলেছিল। এই জাতীয় পিঁপড়েরা কিন্তু সাধারণত মাটির দেয়াল নির্মাণ করে না। এরা মাটির নিচে গর্তের মধ্যে বিভিন্ন কুঠুরি নির্মাণ করেই বসবাস করে। বাইরে ক্ষুদ্র একটি মুখ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। যাহোক লাল পিঁপড়েদের ধারালো সাঁড়াশি ও বিষাক্ত গ্যাসের আক্রমণে ক্ষুদেরা ক্রমশ হটে গিয়ে সেই নবনির্মিত দেয়ালের আড়ালে আত্মগোপন করে অবস্থান করতে লাগলো। এদিকে শ্রমিকেরা দেয়ালটাকে ক্রমশ উপরের দিকে গেঁথেই তুলছিল। ভিজা মাটির জন্যে দেয়াল গেঁথে তুলতে তাদের বিশেষ সুবিধাই হয়েছিল। প্রকৃত প্রস্তাবে ব্যাপারটা তখন ট্রেঞ্চ লড়াইয়ের আকার ধারণ করলো । দেয়াল গাঁথবার সময় মাঝে মাঝে দু-চারটা শ্রমিক-পিঁপড়েকে নালসোরা ছোঁ মেরে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল বটে, কিন্তু তার সংখ্যা খুবই কম। বলা বাহুল্য, দেয়াল গেঁথে অগ্রসর হবার পরে নালসোরা শত্রুপক্ষের আর তেমন কোনও অসুবিধে সৃষ্টি করতে পারে নি। এ পর্যন্ত দেখে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। প্রায় সাড়ে বারোটার সময় ফিরে গিয়ে দেখি — নালসোরা অনেকেই তখন বাসায় ফিরে গেছে। যদিও কিছু লাল-পিঁপড়ে দলছাড়া ভাবে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করছিল, তথাপি, তাদের সেই লড়াইয়ের ‘মুড’-টা যেন আর ছিল না। ক্ষুদে পিঁপড়েরা ইতিমধ্যে সুপারি গাছের গোড়াটার অনেকটা স্থান জুড়ে ছয়-সাত ইঞ্চি উপর অবধি লম্বা দেয়াল তুলে গুবরে পোকাটাকে সেই দেয়ালের নিচে ঢেকে ফেলেছে।
একবার আঠার শিশির মধ্যে একটা আরশুলা পড়ে মরেছিল। আরশুলাসমেত আঠাগুলিকে এক স্থানে ঢেলে ফেলে দিয়েছিলাম। কিছুকাল পর দেখলাম আরশুলার মৃতদেহ সংগ্রহের নিমিত্ত লাল রঙের এক প্রকার ক্ষুদে বিষ-পিঁপড়ে আঠার চতুর্দিক ঘেরাও করেছে। কলকাতার সর্বত্র এই জাতীয় বিষ-পিঁপড়ে সর্বদাই দেখা যায়। দেখা গেল দু-চারটে পিঁপড়ে আরশুলার নিকট যাবার চেষ্টা করায় তরল আঠার মধ্যে বন্দী হয়ে তখনও হাবুডুবু খাচ্ছে। পাশ কাটিয়ে যাবার সময় এই দৃশ্য দেখে মনে মনে ভাবলাম বেশ হয়েছে — এবার আর আরশুলার দেহ উদরসাৎ করতে হবে না। প্রায় আধ ঘণ্টা পর ফিরে এসে দেখলাম, তখনও তারা মৃত আরশুলার দেহটাকে উদরসাৎ করবার আশা পরিত্যাগ করে নি — বরং সেস্থানে পিঁপড়ের সংখ্যা পূর্বাপেক্ষা বেশি হয়েছে বলে মনে হলো। একটু মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ্য করতেই একটা অদ্ভূত ব্যাপার দেখে অবাক হয়ে গেলাম। পিঁপড়েগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাঁকর মুখে করে আঠার উপর জড়ো করেছে। আঠার উপর দিয়ে এইরূপ কাঁকরের পথ প্রস্তুত করতে তাদের প্রায় আরো দু-ঘণ্টা সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। কিন্তু সময়ের দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। কোনো রকমে আরশুলাটা পর্যন্ত পথ নির্মিত হওয়া মাত্রই দলে দলে পিঁপড়েরা তার উপর দিয়ে অগ্রসর হতে লাগলো। প্রায় ঘণ্টাখানেক বাদেই আরশুলার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেহ-খন্ড মুখে করে সার বেঁধে মহোল্লাসে বাসার দিকে অগ্রসর হতে দেখা গেল।
এই ঘটনার পর একদিন মেঝেতে বসে কাজ করছি। কতকগুলি কালো রঙের সুরসুরে-পিঁপড়ে এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করছিল। মেঝের উপর এক স্থানে অল্প খানিকটা জল পড়ে ছিল। তিন-চারটা সুরসুরে-পিঁপড়ে প্রায় একসঙ্গে ওই জলটার পাশ দিয়ে কয়েকবার ছুটে গেল। আবার এসে জলটার পাশেই ঘোরাফেরা করতে লাগলো। এদের স্বভাব অদ্ভূত — চলতে চলতে খানিকক্ষণ থমকে দাঁড়ায় — কিছুক্ষণ হাত-পা আর শুঁড় পরিষ্কার করে — পরমুহুর্তেই আবার দ্রুতগতিতে ছুটতে থাকে। মেঝের উপর জলটুকুর পাশ দিয়ে দুটি একসঙ্গে ছুটে যাবার সময় অকস্মাৎ একটা পিঁপড়ে জলের সঙ্গে আটকে গেল। পিঁপড়েটা জল থেকে সরে আসবার জন্যে যতই চেষ্টা করে, জলটাও সঙ্গে সঙ্গে ততটা ছড়িয়ে পড়ে। মোটের উপর জলটা যেন তরল আঠার মত তার দেহের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। পিঁপড়েদের দলের মধ্যে কেউ মরে গেলে অথবা চলচ্ছক্তিহীন হলে তাকে অন্য পিঁপড়েরা অনেক সময়ই খাদ্য হিসেবে মুখে করে নিয়ে যায়; কিন্তু এরূপভাবে বিপন্ন হলে এক অন্যকে বড় একটা সাহায্য করতে দেখা যায় না। হয় তারা ব্যক্তিগত বিপদ সম্পর্কে উদাসীন নয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পারে না। যাহোক এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনাই লক্ষ্য করলাম। অপর পিঁপড়েটা কিছুক্ষণ ইতস্তত করে অবশেষে জলমগ্ন পিঁপড়েটার শুঁড় ধরে তাকে জল থেকে অনেকটা দূর টেনে নিয়ে গেল এবং একটা শুকনো জায়গায় রেখে এক দিকে ছুটে চলে গেল। জলমগ্ন পিঁপড়েটা অনেকক্ষণ সেই স্থানে নির্জীবের মত পড়ে রইলো এবং শরীরের জল শুকাবার পর ধীরে ধীরে চাঙ্গা হয়ে পা, চোখ, মুখ পরিষ্কার করবার পর ছুটে পালালো। ঘটনাটা তুচ্ছ হলেও এটা যে পিঁপড়ের মতো নিম্নস্তরের প্রাণীর পক্ষে বিশেষ বুদ্ধিবৃত্তি ও সহানুভূতির পরিচায়ক, সে সম্বন্ধে বোধ হয় কেউ দ্বিমত হবেন না।
লাল-পিঁপড়েদের বাসা নির্মাণ, সন্তান পালন, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং খাদ্যসংগ্রহ প্রভৃতি অনেক কিছু অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করেছি ; কিন্তু সেগুলি কৌতূহলোদ্দীপক হলেও স্বাভাবিক সংস্কারের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয় বলেই উল্লেখ করবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যাকে নিছক সংস্কারমূলক বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না এরূপ দু-একটা ঘটনার বিষয় বলছি।
শিবপুরের বাগানে কীট-পতঙ্গ সংগ্রহ করবার সময় একদিন দেখলাম — মাটির উপরে কতকগুলি উইয়ের সুড়ঙ্গ প্রকাণ্ড একটা গাছের গুড়ি অবধি বরাবর চলে গেছে। গাছটার লম্বা গুড়ির এখানে-সেখানে অনেকগুলি নালসোকে এদিক-ওদিক ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে দেখলাম। তাদের গতিবিধি অনুসরণ করে দেখা গেল, অনেক পিঁপড়ে মাটিতে নেমে উইপোকার সুড়ঙ্গের আশেপাশে প্রায় নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা কি বুঝতে না পেরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। প্রায় আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করবার পর ওঠবার উপক্রম করছি, এমন সময় একটু দূরে একটা লাল-পিঁপড়ে যেন কিছু খুঁটে খাচ্ছে বলে মনে হলো। কাছে গিয়ে দেখি — প্রায় তিন ইঞ্চি লম্বা একটা ছোট্ট উইয়ের সুড়ঙ্গের উপর নালসোটা সুড়ঙ্গের মাটি সরিয়ে গর্ত করবার চেষ্টা করছে। পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই দু-এক টুকরো মাটি সরিয়ে সুড়ঙ্গের উপরের দিকে সে ছোট্ট একটা গর্ত করতে সক্ষম হলো। গর্ত হবার পর প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ সেকেন্ড পরেই সুড়ঙ্গের ভগ্ন স্থানের মধ্যে দিয়ে একটা উইপোকাকে মুখ বাড়াতে দেখা গেল। উইপোকাটা শ্রমিক শ্রেণীর, গর্ত বোজাবার জন্যেই এসেছিল। এদিকে নালসোটা শুঁড় উচু করে গর্তের মুখে নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়েছিল। উইপোকাটাকে নজরে পড়বামাত্রই তাকে শক্ত চোয়ালের সাহায্যে ধরে গাছের দিকে ছুটে চললো। এই ঘটনার পর আরও অনেক ক্ষেত্রে এরূপ ব্যাপার লক্ষ্ করেছি। উইপোকা নালসোদের অতি উপাদেয় খাদ্য।
এই ঘটনার কিছুদিন আগে ঐ বাগানেই একদিন দেখলাম — একটা ফলসা গাছের কচি ডালের ডগার পাতাগুলি মুড়ে নালসোরা একটা বাসা নির্মাণ করেছে। বাসাটাকে আরও বড় করবার জন্যে তারা বোধহয় অনেক চেষ্টা করেছিল — কিছু সুবিধে করতে পারেনি, কারণ পরস্পর সন্নিহিত পাতাগুলি সবই ইতিপূর্বে মুড়ে ফেলেছে। কাছাকাছি হলেও খানিকটা কোঁকড়ানো একটা মাত্র পাতা বাকি ছিল। সেটাকে বাসার সঙ্গে জুড়ে দেবার জন্যে অনেকগুলি পিঁপড়ে মিলে প্রাণপণে চেষ্টা করছিল। সে পাতাটাকে ছিঁড়ে ফেলে অপেক্ষা করতে লাগলাম। প্রায় তিন ঘণ্টা অতিবাহিত হয়ে গেল — নতুন কিছুই দেখা গেল না। আরও কিছুকাল অপেক্ষা করবার পর দেখা গেল — পিঁপড়েরা ডালটার নিচের দিকে স্তূপাকারে একত্রিত হয়ে ঝুলে পড়বার চেষ্টা করছে। উপরের ডালটার সমান্তরালে নিচের দিকে আরেকটা সরু ডাল ছিল। বাসা থেকে তার পাতাগুলির ব্যবধান ছিল প্রায় আট-দশ ইঞ্চির মত। ঐ পাতাগুলিকে কাছে টেনে বাসার সঙ্গে জোড়বার উদ্দেশ্যেই তারা শিকল গাঁথবার মতলব করছিল। প্রায় অধ ঘণ্টার মধ্যেই শত শত পিঁপড়ে পরস্পর জড়াজড়ি করে প্রায় ১/৪ ইঞ্চি মোটা ও ফুটখানেক লম্বা একটা শিকল তৈরি করে নিচের ডাল পর্যন্ত ঝুলে পড়লো এবং সঙ্গে সঙ্গেই নিচের ডালের একটা পাতার প্রান্তভাগ কামড়ে ধরে পুনরায় ক্রমশ শিকলের দৈর্ঘ্য কমাতে লাগলো। প্রায় ঘণ্টা দেড়েকের প্রাণপণ চেষ্টার ফলে তারা নিচের পাতাটাকে বাসার উপরে টেনে আনতে সক্ষম হয়েছিল। তারপর পাতাটাকে বাসার সঙ্গে জুড়ে দেবার পালা। বয়নকারী শ্রমিক পিঁপড়েরা তখন শূককীট অর্থাৎ লার্ভা মুখে করে তাদের সাহায্যে বয়নকার্য শুরু করে দিল।
পরীক্ষার উদ্দেশ্যে ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিম বাসায় লাল-পিঁপড়ে পুষেছিলাম। হলদে রঙের ক্ষুদে-পিঁপড়েরা এদের ভীষণ শত্রু। সুবিধা পেলেই এরা লাল-পিঁপড়ের ডিম, কীড়া, পুত্তলী, পুরুষ ও রানী পিঁপড়েগুলিকে উদরসাৎ করবার চেষ্টা করে। কৃত্রিম বাসার চতুর্দিকে প্রশস্তভাবে জলের বেষ্টনী দেওয়া ছিল। একবার দেখলাম — ক্ষুদে পিঁপড়েরা জলের উপর দিয়ে অতি সন্তর্পণে হেঁটে গিয়ে লাল-পিঁপড়ের বাসায় যাবার চেষ্টা করছে। সাত-আট দিনের চেষ্টায় তারা জলের উপর দিয়ে লাইন করে যেতে সক্ষম হয়েছিল। এই বেষ্টনীর জল সর্বদাই স্থিরভাবে থাকে বলে আর একবার পিঁপড়েগুলিকে অভিনব উপায়ে পার হতে দেখেছিলাম। প্রথমবার জল অতিক্রম করতে গিয়ে কতকগুলি ক্ষুদে পিঁপড়ে জলে ডুবে মারা যায়। তাদের মৃতদেহগুলি সেই স্থানেই ভাসতে থাকে; আবার কতকগুলি অগ্রসর হয়। তাদেরও অনেকেই মারা যায় এবং বাকিগুলি ফিরে আসে। এইভাবে ক্রমশ মৃতদেহের একটা লাইন অগ্রসর হতে থাকে। এই মৃতদেহের ফাঁকে ফাঁকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শুকনো ঘাসের টুকরো এনে তারা সুন্দর একটি ভাসমান রাস্তা তৈরি করেছিল। এই রাস্তার উপর দিয়েই ক্ষুদে পিঁপড়েদের ডিম, বাচ্চা, পুত্তলিগুলিকে অপহরণ তো করলোই, অধিকন্তু পিঁপড়েগুলিকে মেরে ফেলে মৃতদেহগুলিকে খণ্ড খণ্ড করে নিজেদের বাসায় নিয়ে গেল।
আমাদের দেশের সোলেন্পসিস্ জাতীয় লাল রঙের এক প্রকার ক্ষুদে-পিঁপড়ে মাঠে-ঘাটে মাটির নিচে গর্ত খুঁড়ে বাস করে। সময়ে সময়ে এরা গর্তের চারদিকে বেশ উঁচু মাটির স্তূপ সাজিয়ে রাখে। বর্ষার সময় অতি বৃষ্টিতে মাঠ-ঘাট জলে ডুবে গেলে এদের দুর্দশার সীমা থাকে না। দুর্দশা যতই হোক — জলমগ্ন হয়ে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়াটাই প্রধান সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের জন্যে তারা এক অদ্ভূত উপায় অবলম্বন করে থাকে। গর্তে জল ঢোকবার সঙ্গে সঙ্গেই সকলে মিলে জড়াজড়ি করে এক-একটা ডেলা পাকিয়ে জলের উপর ভেসে বেড়ায়। ডেলার নিচের দিকে যারা থাকে, তারা যাতে শ্বাসরুদ্ধ না হয়, সে জন্যে প্রত্যেকেই ডেলাটাকে আঁকড়ে উপরের দিকে উঠতে চেষ্টা করে। ফলে ডেলাটা জলের উপর ধীরে ধীরে গড়াতে থাকে। এতে একটি পিঁপড়েরও প্রাণহানি ঘটে না। জল নেমে গেলেই আবার পুরাতন বাসায় ফিরে যেতে পারে। স্থানভ্রষ্ট হলে নতুন বাসার পত্তন করে। উটপাখিরা তাড়া খেলে যেমন বালিতে মুখ গুঁজে আত্মগোপন করেছে বলে নিশ্চিন্ত মনে অবস্থান করে — আমাদের দেশীয় কাঠ-পিঁপড়েদের মধ্যেও এরূপ ব্যাপার দেখতে পাওয়া যায়। শত্রুর আগমন টের পেলেই তারা এমন নিশ্চলভাবে অবস্থান করে যে, সহজে খুঁজে বের করা যায় না। কিন্তু শত্রু অনুসরণ করলে এরা ছুটতে ছুটতে কোনও কিছুর আড়ালে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। শুধু মুখটা আড়ালে পড়লেই মনে করে — সে যেমন কাকেও দেখতে পাচ্ছে না, শত্রুও বোধহয় সেরূপ তাকে দেখতে পাচ্ছে না। কাজেই সেই অবস্থায় সে নিশ্চল ভাবে অবস্থান করে। উপরের আবরণটি সরিয়ে নিলেও সে নিশ্চিন্ত মনেই চুপ করে থাকে।
আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে উপরিউক্ত কৌশল দুটি কৌতুহলোদ্দীপক হলেও নিঃসন্দেহেই তা সংস্কারমূলক। কিন্তু অন্যান্য ঘটনাগুলি বুদ্ধিবৃত্তির পরিচায়ক কিনা তাই বিবেচ্য।
পিঁপড়ে-সমাজে খাদ্য-সংগ্রহ, সন্তানপালন, যুদ্ধ-বিগ্রহ প্রভৃতি যাবতীয় কাজ কর্মীরাই করে থাকে। উল্লিখিত ঘটনাগুলিতে কর্মীদের কথাই বলা হয়েছে। আকৃতি, প্রকৃতিতে কর্মীরা পুরুষ ও স্ত্রী-পিঁপড়ে থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। স্ত্রী ও পুরুষের ডানা গজায়, কিন্তু কর্মীদের ডানা নেই। আবার এমন এক সময় আসে যখন স্ত্রীদেরও ডানা থাকে না। যাঁরা এ বিষয়ে পর্যবেক্ষণে আগ্রহী তাঁদের পক্ষে এদের স্ত্রী, পুরুষ, কর্মী, ডিম, বাচ্চা ও পুত্তলি সম্বন্ধে ধারণা থাকা প্রয়োজন।
__________________
প্রবাসী, আশ্বিন, ১৩৪৯