সম্পাদকমণ্ডলী, ‘বিজ্ঞান’
‘বিজ্ঞান’ পত্রিকার শুরু থেকে আমরা দেশে বিদেশে অনেক বিজ্ঞানপ্রেমীর কাছে উৎসাহ পেয়েছি। তার সাথে সাথে একটা প্রশ্নও এসেছে ঘুরেফিরে: “লেখা দিতে চাই। কি ধরণের লেখা আপনারা প্রকাশ করেন?” এই প্রশ্নটা নিয়েই একটু আলোচনা করতে চাই। প্রশ্নটা প্রত্যাশিত। আমরা বিভিন্ন স্বাদের, বিভিন্ন বিষয়ের উপর লেখা প্রকাশ করেছি। কোনো বিষয়ে যেমন গভীর আলোচনা করেছি একদম স্কুলের ক্লাসরুম-এর মতো, তেমনই প্রকাশ করেছি বিজ্ঞানের টুকরো খবর। যেমন পদার্থবিদ্যা–রসায়ন–জীবনবিজ্ঞান–অঙ্ক বিজ্ঞানের এই প্রচলিত শাখাগুলোকে ছুঁয়ে গেছি, তেমনই বিজ্ঞানের ইতিহাস বা বিজ্ঞানীদের জীবনীও কিন্তু বাদ পড়েনি। তাই লেখক হিসেবে মনে হতেই পারে: “এরা কোন বিজ্ঞানটা নিয়ে লেখে? আমি যে বিষয়টা নিয়ে লিখতে চাই, সেটা এই ওয়েবসাইটের উপযুক্ত তো? এই জাতীয় কোনো লেখা তো ওয়েবসাইটে আগে দেখিনি।” সম্প্রতি যেমন একজন ‘মেশিন লার্নিং’ নিয়ে এই ধন্দ প্রকাশ করেছিলেন। এর একটাই উত্তর দিতে পারি: আমরা ব্যাপক অর্থে ‘বিজ্ঞান’ শব্দটাকে দেখি। আপনার কাছে যদি কোনো বিষয়ে একটা গল্প থাকে, যার সাথে সামান্য হলেও বিজ্ঞানের যোগসাজশ আছে, আমরা আপনার লেখা পেতে আগ্রহী। সে মেশিন লার্নিং বা ক্রিপ্টোগ্রাফি নিয়েই হোক, কি গ্রিক দার্শনিকদের সময়কার বিজ্ঞানচর্চা, মানসিক রোগ নিয়েই হোক কি পরিবেশ দূষণ, কোনো বিষয়ই আমাদের কাছে অচ্ছুৎ নয়।
তাহলে সীমারেখাটা কোথায়? আমরা সম্পাদক হিসেবে কোনো লেখাকে যখন প্রকাশ করতে পারি না, তার কি কি কারণ থাকে? সেই ব্যাপারে একটু আলোকপাত করতে চাই, যাতে লেখক হিসেবে সংশয়গুলো কিছুটা দূর হয়। আশা করবো, এটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আগ্রহী কলম ধরবেন এবং আপনার পরের লেখাটা আমরা শীঘ্রই পাবো। বছর দুই আগে একটা সংবাদ মাধ্যমে আমাদের একজন সম্পাদকের ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছিল। তাতে একটা প্রশ্ন করা হয়েছিল, যেটা ভাষান্তরে বললে এরকম দাঁড়ায়: “আপনাদের দুএকটা লেখাতে দেখেছি উইকিপিডিয়া-কে একটা লেখার উৎস হিসেবে বলা হয়েছে। আপনারা কখনও উইকিপিডিয়া-র লেখাগুলোকে বাংলায় অনুবাদ করার কথা ভেবে দেখেছেন?” এই প্রশ্নটার উত্তর দিতে গিয়েই আমাদের কোনো একটি লেখা প্রকাশ না করার প্রধান কারণটা বেরিয়ে আসে। পাঠককে কোনো বিষয়ের একটা সম্পূর্ণ ছবি দিতে হবে, এটা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তাই উইকিপিডিয়া-র বঙ্গানুবাদ আমরা করিনা। এবং একইভাবে সেই জাতীয় রচনাধর্মী লেখা যখন পাই, আমরা লেখককে অনুরোধ করতে বাধ্য হই লেখার ব্যাপ্তি কমিয়ে কোনো একটি অংশে আরো গভীরে যেতে। কিংবা যদি ব্যাপ্তি-টা রাখতেই চান, তাহলে অনেকগুলো অংশে ভেঙ্গে একটি সিরিজ লিখতে। একটা উদাহরণ দিই। এটা নিছক কল্পনা, কোনো লেখক এরকম কিছু পাঠাননি। ধরুন আপনি পরিবেশ দূষণ নিয়ে লিখলেন। তাতে যদি আপনি ২০০০ শব্দের মধ্যে সবরকম পরিবেশ দূষণ নিয়ে লেখেন, ওজন স্তর-এ ফুটো থেকে শুরু করে গ্লোবাল ওয়ার্মিং, অ্যাসিড বৃষ্টি থেকে শুরু করে দিল্লি-র ধোঁয়াশা কমাতে অরবিন্দ কেজরিওয়াল-এর প্রচেষ্টা, কোনো একটি বিষয়ের উপর যথার্থ সময় দিতে পারবেন কি? এই জাতীয় লেখা পেলে আমাদের বলতেই হয়, যে কোনো একটি বিষয়ে লিখুন। নয়তো একটা সিরিজ লিখুন, যাতে অনেকগুলো লেখা থাকবে। আমাদের শুধু এই একটাই অনুরোধ, আপনার লেখা থেকে যেন একটা স্পষ্ট এবং সুপাঠ্য গল্প বেরিয়ে আসে, যেন তোড়ায় বাঁধা নিরস তথ্যের ঝুড়ি মনে না হয়। কারণ আমরা চাই যাতে পাঠক লেখাটি আগ্রহের সাথে পড়ে। নিছক প্রয়োজনীয় তথ্য খুঁজে নেবে লেখার মধ্যে, যেটা উইকিপিডিয়ার মুখ্য উদ্দেশ্য, এটা আমাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য নয়। অবশ্যই যে কোনো ভালো ব্লগ লেখার হয়তো এই একটাই শর্ত থাকে। বিজ্ঞান যেহেতু খুবই তথ্যনির্ভর, তাই এই শর্তটা হয়তো আলাদা করে মনে করিয়ে দিতে প্রয়োজন: তথ্যের ভিড়ে মূল বক্তব্য যেন হারিয়ে না যায়। এটা করতে খুব সুবিধে হবে যদি প্রথমেই এই প্রশ্নটা করেন: এই লেখাটা পড়ে পাঠক কি জানবে? কোন প্রশ্নটার উত্তর পাবে? এই প্রশ্নের উত্তর কি পাঠ্যবইয়ে ভালো করে দেওয়া থাকে? চাইলে, আপনার লেখার একটি সারাংশ দিয়ে শুরু করতে পারেন। আমরা লেখা প্রকাশ করার সময় লেখার শুরুতে একটা এক-দু লাইনের প্রশ্ন লিখি, চলচ্চিত্রের টিসার-এর মতো। আপনার লেখার টিসার-টা আপনিই লিখুন নাহয়। তাতে শুধু আমাদেরই সুবিধে হবে, তা কিন্তু নয়, আপনার বাকি লেখাটা হয়তো নিজে থেকেই বেরিয়ে আসবে। জীবনীমূলক লেখাতে এই কাজটা করা বোধহয় সবথেকে জরুরি। একজন বিজ্ঞানীর সম্পূর্ণ জীবনকে তুলে ধরতে গেলে আবার সেই তথ্যের ফাঁদে পড়তে হয়। জন্ম-ছোটবেলা-সংগ্রাম-পুরষ্কারপ্রাপ্তি-বিবাহসন্তানাদি এইসবের মধ্যে একটা বিজ্ঞানীর কাজটা অনেকসময় হারিয়ে যায়। শুধু তার বৈজ্ঞানিক অবদান নয়, মানুষ হিসেবে তিনি কেমন ছিলেন, সেটাও অনেকসময় স্পষ্ট হয়না। তাই, জীবনীমূলক লেখার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে অনুরোধ, একটা সম্পূর্ণ জীবনকে তুলে ধরার চেষ্টা না করাই বোধহয় ভালো।
ব্যাস, শুধু এইটুকু বলেই বিজ্ঞান পত্রিকার নবম সংখ্যা আপনাদের হাতে তুলে দিচ্ছি। আমাদের লেখা দেওয়ার রীতিনীতি আরো বিশদে জানতে এখানে দেখুন। তবে সত্যি বলতে কি, নিয়ম একটাই: আপনার লেখাটির তথ্যগুলি যেন সঠিক হয় (যেমন, প্রয়োজনমতো রেফারেন্স যেন থাকে) এবং তার থেকে যেন একটি স্পষ্ট এবং মনোগ্রাহী গল্প বেরিয়ে আসে। এবারের সংখ্যাতে আছে একটা ছোট ধাঁধা। ধাঁধাটি দুটো আলাদা চরিত্রকে একই সূত্রে জুড়ে দেয়: লোকাল ট্রেন-এর চটিবই বিক্রেতা আর বিখ্যাত গণিতজ্ঞ কার্ল ফ্রেডরিক গাউস। তারপর আছে এক ঝলক পদার্থবিদ্যার ইতিহাস: গ্রাফিন-এ ডিরাক সমীকরণ। জানতে পারবেন, পদার্থবিদ্যার এক শাখায় তৈরী তত্ত্ব কিভাবে সম্পূর্ণ অন্য একটি শাখায় পুনরুজ্জীবিত হলো এবং পরীক্ষানিরীক্ষার আওতায় এলো। আর সবশেষে আছে একটি সিরিজ: জীবাণুদের যত কথা। লেখক যত্নসহকারে অতিক্ষুদ্র এই জীবাণুদের জগৎটাকে তুলে ধরেছেন। ব্যাকটেরিয়া কোষের গঠন থেকে শুরু করে লেখক দেখিয়েছেন সেই কোষে কিভাবে এন্টিবায়োটিক্স প্রভাব ফেলে। ইস্কুলের পাঠ্যবইয়ে এতো গভীরে এই আলোচনা পাওয়া যাবে না বলেই আমাদের ধারণা। অবশেষে বলি, বিজ্ঞান পত্রিকা পড়ুন এবং পড়ান। এবং আপনার কাছে যদি বিজ্ঞান-সংক্রান্ত কোনো গল্প জমা থাকে, তাহলে সেই গল্পটা লিখে ফেলুন এবং আমাদের পাঠান।