আমি ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা, আয়ুর্বেদ, রসায়ন ও ধাতুবিদ্যার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে চলেছি। এই আলোচনার উদ্দেশ্য এটা দেখানো যে কিভাবে নিম্নমানের বিজ্ঞানশিক্ষা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক বিজ্ঞানচর্চার অবক্ষয় প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান ও সভ্যতার পতন ঘটিয়েছে।
প্রথমেই বলে নিতে চাই, এই লেখার বিষয় আর আমার গবেষণার বিষয় এক নয়। তবে একজন ভারতীয় বৈজ্ঞানিক হিসেবে ভারতের বিজ্ঞান চর্চার অবক্ষয় অবশ্যই আমার জন্য চিন্তার বিষয়। তাই আমি কয়েকজন বরেণ্য ভারতীয় বৈজ্ঞানিকের উদ্ধৃতির উপর ভিত্তি করেই এই বিষয়টি উপস্থাপন করতে চলেছি।
এই পর্বের আমরা দেখবো কিভাবে শল্যবিদ্যা ও ধাতুবিদ্যার কিছু পদ্ধতি সমাজের মূলস্রোত থেকে হারিয়ে গেলেও তথাকথিত নিচুজাতীর মধ্য দিয়ে টিকে গেছে। এই টিকে যাওয়া সত্ত্বেও কেন এই বিষয়গুলির অগ্রগতি হয়নি, সেই নিয়েও আলোচনা করবো।
আগের তিনটি পর্বে আমরা দেখেছি পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের উপর গুরুত্ব না দেবার জন্যে কিভাবে ভারতবর্ষে বিজ্ঞানচর্চার অবনতি হতে হতে অনেক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার প্রায় বিলুপ্তির পথে পা দেয়। আগের পর্বে শল্যচিকিৎসার কথা বলা হয়েছে। ভারতীয় সমাজের মূলস্রোত থেকে হারিয়ে গেলেও, সমাজের কিছু তথাকথিত নিচুতলার জাতিদের মধ্যে প্রাচীন শল্যচিকিৎসার পদ্ধতিগুলো টিকে রয়েছে।
একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো সুশ্রূত-এর নাক মেরামতি-পদ্ধতি। কিছু দায়সারা টিকা বাদ দিলে, আয়ুর্বেদিক গ্রন্থ বা আলোচনায় সুশ্রূত-এর নাক মেরামতি-পদ্ধতির কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। এমনকি বিখ্যাত শল্যচিকিৎসক কিংবা বৈদ্যরাও এই পদ্ধতি ব্যবহার করতেন না। সবকিছুর আড়ালে, পুনের “কুমার” জাতির মধ্যে কিন্তু এই শল্যপদ্ধতিটির ব্যবহার চলেছিল বহুবছর ধরে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে কিছু ব্রিটিশ চিকিৎসক আকস্মিকভাবে এর খোঁজ পান, এবং শল্যচিকিৎসার জগতে পদ্ধতিটির একরকম পুনর্জন্ম ঘটে [১]।
পুনের নাক মেরামত পর্ব
১৭৯৩ সালে, পুনেতে বসবাসকরি একজন ডাক্তার, ড: স্কট, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্যাপ্টেন আরভাইন-এর কাছে এক অদ্ভুত গল্প শোনেন। পুনের কিছু নিচুতলার জাতের মধ্যে অপরাধীর নাক কেটে দিয়ে শাস্তি দেওয়ার প্রচলন ছিল। ক্যাপ্টেন আরভাইন জানান যে পুনের এইসব জাতির মধ্যে ওই কাটা-নাক জোড়া দেওয়ার পদ্ধতিও রয়েছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনেক কর্মীই নাকি চাক্ষুষ দেখেছে যে কাটা নাক মেরামত করে বেশ সুন্দর নাক বসানো হয়েছে। এই কাহিনী শুনে ড: স্কট পুনের সার্জন মিস্টার ফিনলেকে কাহিনীটির সত্যতা যাচাই করার অনুরোধ করে একটি চিঠি পাঠান। কারণ ইউরোপের চিকিৎস্যজগতে এমন পদ্ধতির কোনো প্রচলন তো ছিলই না, ধারণাও ছিল না।
১৭৯৪ সালের পয়লা জানুয়ারী মিস্টার ফিনলে এবং মিস্টার ক্রুসো ঘটনাটি স্বচক্ষে দেখে একটি বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠান। তাদের চোখের সামনে, “কুমার” জাতির একজন লোক একটি সামান্য পুরোনো ক্ষুর দিয়েই একটি কাটা নাক মেরামত করে দেখায়। ক্ষুর দিয়ে লোকটি রোগীর নিজেরই কপালের কিছুটা অংশ কেটে নিয়ে রোগীর নাকের সাথে একপ্রকার আসঞ্জন দিয়ে জুড়ে দেন, কোনো সেলাই বা ব্যাণ্ডেজ ছাড়াই। রিপোর্ট-এ ও বলা হয় যে, নাকের প্রতিটি অংশের সাথে কপালের অংশটি নির্ভুলভাবে জুড়ে যায়।
সেই বছরই লন্ডনের “জেন্টলম্যান্স ম্যাগাজিন”-এ এই ঘটনার বিবরণ ফলাও করে ছাপা হয়। শল্যচিৎিসক ড: জে. সি. কাপ্রুর নজরে আসে খবরটি। ফিনলের লেখার বর্ণনা পড়ে, তিনি পাশ্চাত্যে প্রথমবার এই পদ্ধতি অবলম্বন করে অস্ত্রপ্রচার করেন। সেই অস্ত্রপ্রচারের বিবরণ পাওয়া যায় ১৮১৬ সালে তার লেখা “An account of two successful operations for restoring a lost nose from the integuments of the forehead” রচনায়। এই ঘটনার হাত ধরেই ইউরোপের চিকিৎসাজগতে প্রবেশ করে প্রাচীন-ভারতের এই প্রায় হারিয়ে যাওয়া চিকিৎসা-পদ্ধতিটি।
শল্যবিদ্যার অন্যান্য নমুনা
উপরের ঘটনার মতোই, সুশ্রূত-এর চোখের ছানির অস্ত্রপ্রচার পদ্ধতি অবলম্বনে কোয়েম্বাটোরে ১৯১৬ সালে করা একটি অস্ত্রপ্রচারের চাক্ষুস বিবরণ পাওয়া যায় ড: একামবারাম-এর কাছ থেকে। তার কথা থেকে জানা যায়, ভ্রাম্যমান মহামেডান বৈদ্যরা সুশ্রূত-এর পদ্ধতিটির প্রতিটি ধাপ অনুসরণ করে ছানির অস্ত্রপ্রচার করতো [১]। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে: যে সমস্ত বৈদ্যরা সুশ্রূত-এর পদ্ধতি অবলম্বন করে পুনেতে নাকের অস্ত্রপ্রচার করতেন কিংবা যারা কোয়েম্বাটোরে ছানি সারাতেন, তারা কেউই তথাকথিত আয়ুর্বেদিক নন। তারা শুধু এমন লোকজন যারা প্রথাগত শিক্ষার বদলে তাদের পূর্ব-প্রজন্মের কাছ থেকে এই শিক্ষাগুলি রপ্ত করেছেন।
এইভাবেই প্রাচীন কাল থেকে, হাত দিয়ে ভাঙা হাড়ের জোড় দেওয়া, দাইমাদের দ্বারা সন্তান-প্রসব, এইধরণের পদ্ধতিগুলো, যাদের “হাত নোংরা করা” হিসেবে মনে করা হতো, সেইগুলো ঠেলে দেওয়া হয় নিচুজাতের লোকজনের দিকে। তারা পদ্ধতিগুলির মূলতত্ব না বুঝেই সেইগুলি রপ্ত করে। এতে যেন আমাদের জাতির মাথা আর হাতের মধ্যকার মেলবন্ধন ছিন্ন হয়, আর এইভাবেই শল্যবিদ্যার পথ ধরে ভবিষ্যতে নতুন কোনো আবিষ্কারের পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়।
ধাতুবিদ্যা
ঠিক একইভাবে সমাজের তথাকথিত নিচুজাতীর লোকজনের মধ্যে আজও টিকে আছে প্রাচীন ভারতের ধাতুবিদ্যার কিছু শাখা [১,৩]। তার স্বপক্ষে কিছু কাহিনী-প্রমাণও রয়েছে।
১৮২৮ সালে, বেঙ্গল সরকারের অনুরোধে, জেমস ফ্র্যাংকলিন, এফ আর এস, মধ্যভারতের স্থানীয়দের আকরিক, চারকোল এবং চুল্লি ব্যবহার করে লোহা তৈরী করা বিশদভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি লেখেন:
“ধাতু গলানোর চুল্লিগুলোর বাইরের গঠন যেমনই হোক, ভিতরের গঠনসজ্জা ও তাদের সুসমতা প্রশ্নাতীতভাবে নিখুঁত। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, যেসমস্ত লোকজন এই চুল্লি নির্মাণ করছেন, চুল্লিনির্মাণ এর মূলতত্বগুলি সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণভাবে অজ্ঞ। কিন্তু তবুও তারা নিখুঁত কারিগরি দক্ষতায় এই চুল্লিগুলি তৈরী করছেন।”
চুল্লিগুলির জ্যামিতিক ও ব্যবহারিক নির্মাণ-পদ্ধতি, প্রতিটি চুল্লির যে দুটি করে শোধনাগার ছিল তাদের নির্মাণ, ধাতু গলানো এবং পরিশোধনের পদ্ধতি, ইত্যাদি নিয়েও তিনি বিস্তারিত ভাবে লেখেন। সাগর টাকশালে এই পদ্ধতিতে প্রস্তুত ধাতু যাচাই করে তিনি দেখেন, লোহা খুবই উৎকৃষ্ট মানের, এবং নমনীয়তা কিংবা প্রসারতার দিকে থেকে সবচেয়ে ভালো মানের সুইডিশ লোহাকেও টেক্কা দিতে পারে।
কিন্তু এই কারিগরদের কেউই ফ্র্যাংকলিন-এর প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হননি, কিংবা শতবছর ধরে তাদের পূর্বপুরুষের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই নির্মাণ-পদ্ধতির সূক্ষ্ম বিবরণ দিতে পারেননি। এদের কাজ দেখে ফ্রাঙ্কলিনের মনে হয়েছে যে, এমন মৌলিক চুল্লি-নির্মাণ-এর প্রথম পরিকল্পনা কোনো খুব উন্নত চিন্তাশীল ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছ থেকে এসেছে। এই ধরণের চুল্লি-নির্মাণ সেই সমাজের স্মৃতিচিহ্ন, যারা ৪০০ খ্রিস্টাব্দে দিল্লী/বিদিশা-র এবং ১০০০ খ্রিস্টাব্দে ধর-এর লৌহস্তম্ভ দুটি নির্মাণ করেন। বাস্তবেই, বিদিশা এবং ধর, দুইই মধ্যভারতে অবস্থিত, অর্থাৎ তাদের ভৌগোলিক অবস্থান এবং উপরে উল্লিখিত লোহা-নিৰ্মাতা কারিগরদের কর্মস্থল একই।
উপসংহার
উপরের সংক্ষিপ্ত কাহিনীগুলি চিত্তাকর্ষক হলেও, প্রশ্ন হচ্ছে, এদের থেকে আমরা কি শিক্ষালাভ করি? কিংবা এর থেকে কি আমাদের আনন্দিত না দুঃখিত হওয়া উচিত? সমাপ্তিতে এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তরে আমি প্রফেসর বালিয়াথন-এর কথা ও ভাবনা, এবং আচার্য্য পি. সি. রায়-এর উক্তিগুলি তুলে ধরতে চাই।
এম. এস. বালিয়াথন-এর বক্তব্য
কোয়েম্বাটোরের সেই নাক-মেরামত করার, ছানি সারানোর কারিগরদের, কিংবা জবলপুরের আকরিক গলানোর কারিগরদের, সকলকেই অশিক্ষা, মানসিক দৈন্য, সামাজিক অমর্যাদা ও চূড়ান্ত হতাশার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। যে দেশের শত-সহস্র কারিগরদের এমন নির্মম সম্ভাবনাহীনতার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়, সেদেশের ভাগ্যবিপর্য্যয় অবশ্যম্ভাবী [১]।
পি. সি. রায়-এর বক্তব্য
সুশ্রুতের মতে শল্যচিকিৎসার ছাত্রদের শিক্ষার এক অপরিহার্য অংশ হল শবদেহের ব্যবচ্ছেদ। এথেকে বোঝা যায়, শল্যবিদ্যা-শিক্ষায় পরীক্ষা-নিরিক্ষার দ্বারা অর্জিত জ্ঞানের উপর কতটা জোর দেওয়া হতো। কিন্তু মনু এতে রাজি ছিলেন না। মনুর মতে, একজন ব্রাহ্মণ শবদেহ স্পর্শ করার অর্থ, তার নিজের পবিত্র দেহ অশুচি করা। তাই ভাগবত-পরবর্তী যুগে হিন্দুসমাজে ল্যানসেট ব্যবহার করে অঙ্গ-ব্যবচ্ছেদ কিংবা শল্যচিকিৎসার প্রচলন কমে যায়, এবং শরীরবিদ্যা এবং শল্যবিদ্যা বিজ্ঞানের মূলস্রোত থেকে হারিয়ে যেতে থাকে। একইভাবে ধাতু-নিষ্কাশনের চুল্লিগুলিতে কাজ করাকেও সমাজে অসম্মানজনক হিসেবে মনে করা হতো। বিজ্ঞানের এই শাখাগুলিকে সমাজের নিচুতলার লোকজনের দিকে ঠেলে দিয়ে, হয়তো এটুকু নিশ্চিত করা গিয়েছিলো যে কাজগুলির জন্য প্রয়োজনীয় উপযুক্ত শারীরিক ক্ষমতা, সূক্ষতা, এবং যোগ্যতার অভাব ঘটবে না। কিন্তু তা অর্জিত হয়েছিল এক কঠিন মূল্যের বিনিময়ে। এই শাখাগুলির ব্যবহারিক জ্ঞান ও অন্তর্নিহিত বিজ্ঞানের মধ্যে যোগসাজশ হারিয়ে গিয়েছিলো। স্বাভাবিকভাবেই, সূক্ষ্ম জল্পনা ও আধ্যাতিকতায় আস্থা রাখা এই দেশের মানুষের মধ্যে থেকে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের মানসিকতাই হারিয়ে যেতে শুরু করে। বস্তুত এই দেশে একজন বয়েল, একজন ডেকার্টেস, কিংবা একজন নিউটন-এর জন্মলাভের সম্ভাবনা লুপ্ত হয়, এবং বিজ্ঞান-জগতের মানচিত্র থেকে এই দেশের নাম একসময় মুছে যায় [২]। এই পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে, প্রাচ্য ও পাশ্চ্যাত্যের মুকাবিলায় ভারতবর্ষের ভূমিকা অর্থহীন হয়ে পরে [১]।
প্রচ্ছদের ছবি – সুশ্রূত (উৎস)
[১] M. S. Valiathan: Towards Ayurvedic Biology, A Decadal Vision Document of Indian Institute of Sciences, Bangalore (2006).
[২] P. C. Ray: History of Chemistry in Ancient and Medieval India, Indian Chemical Society, Calcutta (1956).
[৩] Dharampal: Indian Science and Technology in the 18th Century, Academy of Gandhian Studies, Hyderabad (1983).