প্রাককথন
প্রফেসর নিধিরাম পাটকেল কী একটা বিকট আরক বানানোর কাজে ইদানিং ভয়ানক ব্যস্ত। তাই তিনি এবার শিখিয়ে-পড়িয়ে বিজ্ঞানের দরবারে পাঠিয়েছেন ব্যাকরণ সিংকে।
এদিকে উধোর বোঝা বুধোর ঘাড়ে চড়তেই “তবে রে ইসটুপিড উধো” আর “তবে রে লক্ষ্মীছাড়া বুধো” বলে দুই বুড়ো তো লেগে পড়ল ঝটাপট, খটাখট, দমাদম, ধপাধপ !
বুড়ো হাড়ে এতো অত্যাচার সইবে কেন?
খানিক বাদেই উধো উঠে কান্না জুড়ল, “ডাক্তার দেখাব ! এম.আর.আই. করাব !”
তা এম.আর.আই. তো আর হাতের মোয়া নয় ! বাজারে গেলাম আর কিনে নিয়ে এলাম ! আগে দেখতে হবে ভালো ডাক্তার কোথায় পাওয়া যায় আর ভালো এম.আর.আই. কোথায় হয়। খোঁজ করতে উধো বসল ইন্টারনেটে।
খোঁজ যদিবা পাওয়া গেল, যাবে কিভাবে? থাকে তো তারা গাছের ফোকরে।
“চিন্তা কিসের? সেদিন গেছোদাদাকে খোঁজার জন্য যে স্মার্টফোন কিনলাম, ওতে জি.পি.এস. আছে না? চোখ রেখে ঠিক পৌঁছে যাবো দুজনে।” বললো বুধো।
পথে দুই ভাইয়ের হঠাৎ দেখা ব্যাকরণ সিং-এর সাথে। সে তখন দাড়ি নেড়ে বক্তৃতা দিয়ে চলেছে…
মূলপর্ব
হে বালকবৃন্দ ও স্নেহের হিজিবিজবিজ, আজ আমি যে-বক্তৃতা আপনাদের সামনে দিতে চলেছি, তার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় : “মৌলিক বিজ্ঞানচর্চা করে কী হবে মশাই?” প্রথমেই যা জানা দরকার, তা হল বিজ্ঞান কয়প্রকার ও কী কী? বিজ্ঞান দুই প্রকার : এক, ব্যবহারিক বা ফলিত বিজ্ঞান, যাকে আপনারা বলেন Applied Science, যার সাহায্যে আপনি আলো জ্বালান, এসি চালান, ফেসবুক করেন। আর দ্বিতীয়টি হল মৌলিক বিজ্ঞান অর্থাৎ Basic Science, যার মূল উদ্দেশ্য কোনোরকম প্রয়োগের কথা আগেভাগে চিন্তা না করে শুদ্ধ জ্ঞানলাভ। আরো খোলসা করে বললে, আমাদের কাছে-দূরের জগৎ সম্বন্ধে ‘কী’, ‘কেন’, ‘কিভাবে’ এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তাই মৌলিক বিজ্ঞান শিশি-বোতলের মতোই শক্ত লাগে।
যেমন ধরুন কেশব নাগের অঙ্ক। তৈলাক্ত বাঁশে এক বাঁদর উঠছে আর নামছে। আপনি নির্ঘাৎ বলবেন, “দুরছাই ! খামোখা বিচিত্র তৈলাক্ত বাঁশের কল্পনায় জীবন দুর্বিষহ করে লাভ কী? তার চেয়ে বরং এসিটা চালিয়ে আরামে ফেসবুক করি গে’।” আজ আমি আপনাদের যা বলব, তার মূলকথা এটাই : বিশ্বাস করুন ছাই না-ই করুন, আপনাদের আরাম-আনন্দ-আরোগ্যের বীজ লুকিয়ে রয়েছে ঐ বিচিত্র ও আপাত বেকার বিজ্ঞানচর্চার মধ্যেই। কী, বিশ্বাস হচ্ছে না তো? বেশ, তবে শুনুন !
এই যে উধো আর বুধো, চললে কোথায়? বুড়ো হাড় মচকেছে বুঝি? এম.আর.আই. করাবে? তা যাবে বৈকি ভায়া, নিশ্চয় যাবে। সত্যিই তো, ভাবুন দেখি, চিকিৎসাবিদ্যা আজ কত এগিয়েছে ! আপনাদের শরীরের ভেতরে যেসব কলকব্জা, সেখানেও কী চক্কর চলছে, তা এক লহমায় বলে দেওয়া যাচ্ছে এক্স-রে বা এম.আর.আই. করে। এক্স-রে-র কথা নাহয় বাদই দিলাম, তার গল্প তো আপনারা ছোটবেলায় পড়েছেন। জানেন কি, এই এম.আর.আই.-এর আসল নাম? Magnetic Resonance Imaging। Imaging মানে তো আপনার কাছে জলের মতো পরিষ্কার — ‘ছবি তোলার কল’! আর প্রথম দুটো শব্দ আসে NMR অর্থাৎ Nuclear Magnetic Resonance থেকে!
আহাহা, ‘Nuclear’ শুনেই ঘাবড়ালেন নাকি? তা আপনাদের আর দোষ কী? আপনারা ঘাবড়ে যাবেন বলেই-না NMR থেকে N-কে বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে আসল কথাটি হল, আপনাদের চিকিৎসার সুবিধের জন্য মোটেই বস্তুটি আবিষ্কার হয়নি। এন.এম.আর. আবিষ্কার করেছিলেন এডওয়ার্ড পার্সেল আর ফেলিক্স ব্লক নামে দুজন পদার্থবিজ্ঞানী। তাঁরা খুঁজে পান পর্যায়সারণী অর্থাৎ Periodic table-এর কিছু বিশেষ নিউক্লিয়াসের চৌম্বকীয় ধর্ম। এই ধর্মের নাম চৌম্বকীয় অনুনাদ বা Magnetic Resonance। সেজন্য নোবেল পুরস্কারও পেয়ে যান তাঁরা সেই ১৯৫২ সালে।
আপনাদের আরেকটু ঘাবড়ে দিয়ে বলি, ঐ বিশেষ নিউক্লিয়াসগুলি মূলতঃ তেজস্ক্রিয় মৌল বা radioactive element-এর [১]। বহু পরে এই নিউক্লিয় চৌম্বকীয় অনুনাদকে কাজে লাগিয়ে তৈরী হয় এক বিশেষ ধরণের ‘ছবি তোলার কল’ (imaging technique)। এই খুড়োর কলটির বৈশিষ্ট্য হল এর সাহায্যে আপনাদের শরীরের কোনো বিশেষ অংশের ত্রিমাত্রিক ছবি তুলে ফেলা যায় নিমেষে [২]। হ্যাঁ, ত্রিমাত্রিক — দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা সমেত। এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। জানেনই তো, এক্স-রে তে পাওয়া যায় দ্বিমাত্রিক ছবি। তাই আজকাল ডাক্তারবাবুরা বলেন, এক্স-রের চেয়ে এম.আর.আই.তে আরো নিখুঁতভাবে জানা যায় শরীরের ভেতরের কলকব্জা। তবে শুনে আপনাদের দুঃখ হবে ঠিকই, সত্যি বলতে কী, এই মৌলিক বিজ্ঞানচর্চায় কোথাও চিকিৎসাবিদ্যায় প্রয়োগের উদ্দেশ্যই ছিল না। নেহাৎই অজানাকে জানার আনন্দে তাঁরা আবিষ্কার করেন এই বিশেষ চৌম্বকীয় অনুনাদ। কিন্তু কী আশ্চর্য বলুন! ঐ নিখাদ নির্ভেজাল জানার আনন্দের ‘তৈলাক্ত বাঁশ’টুকু না থাকলে যে আজকের দিনে উধো-বুধো পড়ত মহা ফ্যাসাদে! এন.এম.আর. না থাকলে আর এম.আর.আই.-টা হতো কিভাবে?
আরে রামো ! Radioactive element নিয়ে কত্ত কথা বললাম এতক্ষণ। খেয়ালই নেই, রেডিওলজি (radiology) কথাটা তো আপনারা আকছারই শুনে থাকেন আজকাল। চিকিৎসার কতো ক্ষেত্রেই তো তার প্রয়োগ। মায় রেডিয়েশন থেরাপি দিয়ে ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসা অব্দি। তা এই radioactivity বা তেজস্ক্রিয়তার আবিষ্কারকদের নাম তো আপনারা দিব্যি জানেন। ঠিক, মেরি ক্যুরি আর পিয়ের ক্যুরি [৩]। দুজনেই রসায়নবিদ। তেজস্ক্রিয় মৌল রেডিয়াম ও পলোনিয়াম আবিষ্কার করেছিলেন নিখাদ নতুন কিছু জানার আনন্দে। শোনা যায় পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন সেই মৌল [৪], যাতে আমার-আপনার মতো ছাপোষা লোকদের দেখিয়ে সে-আনন্দে সামিল করা যায়। তার খেসারতও দিতে হয়েছিল অবশ্য হিসেবমাফিক। দু-দুটো নোবেলের পর তেজস্ক্রিয় বিকিরণের প্রভাবে দুরারোগ্য রোগ এপ্লাস্টিক এনিমিয়া (Aplastic Anemia)-র খপ্পরে পড়েন মেরি ক্যুরি।
তা আপনারা নিশ্চয় ভাবছেন, “এরকম মারণ আবিষ্কার না করলেই কি চলতো না?” চলতো না মশাই, চলতো না। নতুনকে জানার আনন্দ যে অপার! সে আনন্দের নেশাতেই তো আপনি বেরিয়ে পড়েন কলম্বাসের রূপ ধরে ডিঙি নৌকায় চড়ে পৃথিবী পরিক্রমায়, কিংবা তেনজিং-হিলারি হয়ে হানা দেন দুরূহ এভারেস্টে। কিন্তু ভাবুন একবার, সেই মারণ আবিষ্কারই কিনা আজ কাজে লাগছে মারণ রোগ ক্যান্সারের চিকিৎসায় রেডিয়েশন থেরাপি হয়ে! কী আশ্চর্য! ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল! কিভাবে জানেন? মৌলিক বিজ্ঞানের এই গবেষণা করতে গিয়েই জানা গেছে ঠিক কী কৌশলে নিখুঁতভাবে (controlled way) তেজস্ক্রিয় রশ্মির প্রয়োগ করা যায় — যা মানবশরীরে ঢুকে শুধুমাত্র ক্যান্সার-সৃষ্টিকারী দুষ্ট কোষগুলোকেই নিখুঁত নিশানায় আক্রমণ করে মেরে ফেলে [৫]। ভাবুন দেখি একবার কাণ্ডটা! তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের সময় কি কেউ এইসব ভেবে এগিয়েছিল? এক্কেবারেই না !
নির্ঘাৎ ভাবছেন, ”দু-একটা এরকম মিলে যেতেই পারে। আসলে এসব ভাগ্নে চন্দ্রখাইয়ের আষাঢ়ে গপ্পো!” তাই তো? এই যে ভায়া বুধো, ভাইয়ের কানে কী যেন বলছিলে ফিসফিসিয়ে? “আজকালকার ডাক্তারদের কথা আর বলিস না। হুট করতেই বলে এই পরীক্ষা করাও, ঐ পরীক্ষা করাও। দাঁড়া, একটু ইন্টারনেটে বসে দেখে নি ব্যাপারখানা।” তা এই যে আন্তর্জাল বা internet — কম্পিউটার রাখুন, আপনাদের পকেটের স্মার্টফোনেই তো দিব্যি ফোর-জি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেখছি। কোনো নতুন ওয়েবসাইট খুলতে হলেই টুক করে লিখে ফেলছেন “www” — তা এই www বা World Wide Web-এর জন্ম কিভাবে জানেন? ব্যবহারিক জগতে নিতান্ত অপদার্থ কণাপদার্থবিদ্যা (Particle Physics)-র কাজ করতে গিয়ে।
গল্পটা তাহলে খুলেই বলি। মৌলিক বিজ্ঞানের তখন রমরমা। এক এক করে আবিষ্কার হচ্ছে নতুন নতুন মৌলিক কণা (elementary particle)। হুহু করে বাড়ছে নানান তথ্য। সাথে বাড়ছে ইউরোপের জেনিভা শহরের পাহাড়ের তলায় তৈরী জগৎবিখ্যাত ল্যাবরেটরি সার্ন (CERN)-এ বিপুল পরীক্ষালব্ধ ফল, যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে ডেটা (data)। তা সারা পৃথিবী জুড়ে যেসব কণাপদার্থবিজ্ঞানীরা কাজ করেন, তাঁরা তো আর নন্দ গোঁসাই নন, যে হুঁকোহাতে হাস্যমুখে দিনাতিপাত করবেন ! তাঁদের চাই সেই ডেটা, যা বিশ্লেষণ করে তাঁরা আরো অনেকটা পথ এগিয়ে নিয়ে যাবেন মৌলিক বিজ্ঞানকে। কিন্তু মুশকিল হল এত এত মাইল দূরে বসে তাঁরা কিভাবে নাগাল পাবেন জেনিভা শহরের ল্যাবরেটরিতে তৈরী সেই ডেটার? সার্ন-এ গিয়ে দিনের পর দিন পড়ে থাকা তো আর সম্ভব না! এদিকে সার্ন-এও তো গুটিকয় লোক। তাঁরাই-বা একা একা কিকরে করবেন এই বিপুল পরিমাণ ডেটার বিশ্লেষণ? মহা ফ্যাসাদ!
মুশকিল-আসান হলেন টিম বার্নার্স-লি নামে এক তরুণ গবেষক। তিনি ভাবলেন, আচ্ছা, মহম্মদ পর্বতের কাছে আসতে না পারলে পর্বতই যদি যায় মহম্মদের কাছে, তাহলে? যেই ভাবা, সেই কাজ! ভাবতে ভাবতে ১৯৮৯ সালে তিনি বানিয়ে ফেললেন এই ডেটা পাঠানোর কল, যে-কলের নাম World Wide Web। বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর যে-প্রান্তেই থাকুন না কেন, এর সাহায্যে এক নিমেষে তাঁদের হাতে পৌঁছে যাবে কণাপদার্থবিদ্যার ডেটা। ইচ্ছেমতো। শুধু তাঁদের কাছে ইন্টারনেট প্রযুক্তির সুবিধাটুকু থাকতে হবে, ব্যাস ! আর হলোও তাই, হুহু করে এগোতে থাকলো কণাপদার্থবিদ্যার জগৎ। এসবের ফাঁকেই কিন্তু গোলেমালে www থেকে আপনারা পেয়ে গেলেন ইন্টারনেট।
একবার ভাবুন মশাই, সেই ইন্টারনেট — যা কিনা আবিষ্কার হয়েছিল অকর্মণ্য মৌলিক পদার্থবিদ্যা গবেষণা করতে গিয়ে — তার হাত ধরে আপনারা আজ পৌঁছে যাচ্ছেন আপনাদের কাজ-অকাজের সব তথ্যের দোরগোড়ায়, পাঠাচ্ছেন ইমেইল, করছেন অনলাইন লেনদেন, জানছেন বিশ্বের শেষ প্রান্তের নানান তথ্য, করছেন ফেসবুক, ভিডিও কনফারেন্সিং, আরো হাজারো কাজ! কিন্তু এসব করবেন ভেবে তারপর যদি গবেষণাটা শুরু করতে হত, তাহলে তো মশাই তা হয়ে যেত নন্দখুড়োর হাতগণনা!
শুধু কি তাই? সেদিন যে বড় আপনি, আপনার গিন্নী আর আপনার নয় ছেলে — সবাই মিলে ত্রিমাত্রিক চলচ্চিত্র (3D movie) দেখে এলেন মাল্টিপ্লেক্সে, তা এই থ্রী-ডি মুভি দেখতে পান কার সাহায্যে? ফোটন কণিকা — যাকে সহজ ভাষায় আপনারা বলেন আলো — তার এক বিশেষ ধর্ম পোলারাইজেশানের সাহায্যে [৬]। এ গল্প কিন্তু প্রফেসর পাটকেল আগেই বলেছেন “মহাবিশ্বের প্রথম আলো”তে [৭]। ফোটনের পোলারাইজেশান ধর্ম আলোকে দুটি পরস্পর লম্ব দিকে ভেঙে দেয়। আর তা দেখতেও পাওয়া যায়। তবে কিনা খালি চোখে না, বিশেষ চশমায়, যাতে থাকে পোলারাইজার। এই চশমা চোখে পরলেই সাধারণ দ্বিমাত্রিক পর্দা (2D screen) হয়ে পড়ে ত্রিমাত্রিক (3D)। আর আপনারাও দিব্যি দেখতে পান থ্রী-ডি মুভি।
আরো আছে। আজকাল আপনারা কেউ কেউ শোনেন গামা ক্যামেরার কথা (Gamma camera) — যা দিয়ে মস্তিস্ক, কিডনি, ফুসফুস এসবের স্ক্যান করা হয়। এরও আবির্ভাব গামা-রে নামক অপদার্থ রশ্মির আবিষ্কারের ফলেই-না! এই যে চন্দ্রখাইবাবু, বেজার মুখে এককোণে দাঁড়িয়ে মুঠো মুঠো বাদাম খাচ্ছেন দেখছি। ভাবুন দেখি একবার, আপনার হাতে সে-যুগে এই গামা ক্যামেরা থাকলে বন্দাকুশ পর্বতে চিল্লানোসোরাসের শারীরিক গঠনের ছবিটা টুক করে তুলে ফেলতে পারতেন। চাই কী, টুক করে হোয়াটস্যাপ করে দিতেন সন্দেশের দপ্তরে, নিদেনপক্ষে ড্রপবক্সে ফেলে রাখতেই পারতেন — মৌলিক বিজ্ঞানের আবিষ্কার ইন্টারনেট তো আছেই। আপনাকে আর ‘গপ্পোথেরিয়াম’ বদনামের ভাগিদার হতে হত না।
আর সে-যে দুর্যোগে পড়েছিলেন সেবার, আমরা তো শুনেইছি। ভাবুন দেখি ওরকম দুর্গম জায়গায় যদি একটা হিমবাহ নেমে আসত, তাহলেই চিত্তির ! হিমবাহ চেনেন তো? আমরা যাকে বলি glacier — শুনেছেন, এই হিমবাহভায়া কোন পথে নামবেন তা আগাম আঁচ করা — যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে track করা — তার সম্ভাবনাও নাকি তৈরী হচ্ছে। কার কেরামতিতে জানেন? সেই যে মৌলিক বিজ্ঞানচর্চার একভাই কণাপদার্থবিদ্যা — সেই সার্ন-এর কর্মযজ্ঞের অবিচ্ছেদ্য অংশ accelerator-এর কেরামতিতে !
আহা ভাই বুধো, চটো কেন? কি বললে? “আমরা ছাপোষা মানুষ, যাচ্ছি ভাই উধোর ডাক্তার দেখাতে, আমাদের হিমবাহ ট্র্যাক করে কী হবে মশাই?” হক কথা। হিমবাহ না হোক, ডাক্তারের ঠিকানা তো ট্র্যাক করবে? সে উত্তরও রেডি বুঝি? “চিন্তা কিসের? সেদিন গেছোদাদাকে খোঁজার জন্য যে স্মার্টফোন কিনলাম, ওতে জি.পি.এস. আছে না? চোখ রেখে ঠিক পৌঁছে যাবো।” তা যাচ্ছো যাও, তবে শুনেই যাও নাহয় এই GPS বা Global Positioning System এল কোত্থেকে?
সে ভারী মজার কাহিনী। ১৯১৬ সালে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন নিয়ে এলেন সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ বা General Relativity [৮] — যার সাহায্যে জানা যায় মহাবিশ্বের অনেক অজানা তথ্য, জন্ম নেয় নতুন নতুন বিস্ময়। কিন্তু এসবই তো ব্যবহারিক প্রয়োগ-বিহীন মৌলিক গবেষণা। ঘোরতরভাবে তাত্ত্বিক। ‘অকর্মণ্য’ বলে দূরছাই করতেই পারেন। কিন্তু যদি আপনাকে বলি, এই যে জি.পি.এস., এর গণনা নিখুঁত ও সঠিকভাবে করা সম্ভব হয়েছে কিসের সাহায্যে জানেন? ঐ সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের সাহায্যে। একমাত্র সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের সাহায্যেই সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর গতির নিখুঁত ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। সে হিসাবই কাজে লাগে এই পৃথিবীর ঠিক কোথায় কোন জায়গা রয়েছে — বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, দোকানবাজার — এসবের সঠিক ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনায়, অর্থাৎ জি.পি.এস.এ। আর আপনি তো জানেনই, গেছোদাদাকে খুঁজতে গিয়ে জি.পি.এস.-এর হিসেবে সামান্য ভুলচুক হলেই চিত্তির। উলুবেড়ে যেতে গিয়ে পৌঁছে যাবেন মোতিহারি। তবে সত্যি কথা হল ঐ। মৌলিক বিজ্ঞানের এই অংশের গবেষণাও হয়েছে শুধুই জানার আনন্দে। আজও তাই হয়। জানা যায় অনেক নতুন নতুন তথ্য, জন্ম হয় নতুন বিস্ময়ের। এরকম কিছু বিস্ময় নিয়ে প্রফেসর পাটকেল তো আগেই ঘুরে গেছেন। “মহাবিশ্বের প্রথম আলো” আর “আকাশজুড়ে এই আঁধারে” পড়েই নিন না-হয় আরেকবার [৭]। কিন্তু মৌলিক বিজ্ঞানের এই চলার পথে ব্যবহারিক দিকগুলো বেরিয়ে আসে আপনাআপনি। ব্যাস! কেল্লা ফতে! আপনি তো হাতে পেয়ে গেছেন জি.পি.এস.! যাবেন নাকি মশাই বন্দাকুশ পর্বতের চূড়ায় হেঁসোরাম হুঁশিয়ারির সাথে নতুন অভিযানে?
শুধু কি জি.পি.এস.? ভূসমলয় উপগ্রহ (geostationary satellite), যার সাহায্যে আপনি বাড়িতে বসে দিব্যি দেখছেন স্যাটেলাইট টিভিতে হরেক অনুষ্ঠান, মায় কাল সকালের আবহাওয়াটা কেমন থাকবে তাও দিব্যি জেনে যাচ্ছেন আবহাওয়া দপ্তর থেকে — এককথায় তামাম মহাকাশ প্রযুক্তি (space technology) দাঁড়িয়ে আছে এই তাত্ত্বিক গবেষণার ওপর। আরও আছে। নিউক্লিয় শক্তি দিয়ে যে বিদ্যুৎ তৈরী হয়, এ তো আপনি জানেনই। তাই দিয়ে আপনি আলো জ্বালাতে পারেন, পারেন পাখা-এসি, মায় কলকারখানা চালাতে। উন্নত দেশে এখনই শুরু হয়ে গেছে এসব। আমাদের দেশে আজ নয় কাল এলো বলে! পেট্রোলিয়ামজাত জ্বালানি তো সীমিত! পালাবেন, তার জো আছে?
(কিছুক্ষণ সাহেবের তাঁবু চিবিয়ে, অতঃপর): ভাইসকল, আপনারা জানেন, আমার নাম ব্যাকরণ সিং, BA খাদ্যবিশারদ। সত্যি বলতে কী, আমি ভাবতেও পারি না এরকম কতরকম ব্যবহারিক প্রয়োগ সম্ভব ! এই তো সেদিন প্রফেসর নিধিরাম পাটকেলের কাছে শুনলাম এসব মৌলিক গবেষণা করতে গিয়ে নাকি নতুন নতুন প্রযুক্তিরই (technology) জন্ম দিতে হচ্ছে, যা নাকি প্রযুক্তিবিদরাও কোনোকালে কল্পনা করেন নি। যেমন ধরুন না, যে মহাকর্ষ তরঙ্গের (gravitational waves) আবিষ্কার নিয়ে সারা বিশ্বে হৈহৈ পড়ে গেছে, তা তো নেহাৎই তাত্ত্বিক বিষয়। কিন্তু এই আবিষ্কার করতে গিয়েই গবেষণাগার লাইগো (LIGO)-তে তৈরী করতে হয়েছে এক নতুন প্রযুক্তি — যার নাম ব্যতিচার প্রযুক্তি বা interferometer tenchnology [৯]। এই প্রযুক্তি মার্কিন সংস্থা নাসা (NASA)-র চল্লিশ বছর ধরে আর্থিক ও বৈজ্ঞানিক সাহায্যের ফলশ্রুতি। হ্যাঁ, চল্লিশ বছর! বড় কিছু কাজ করতে তো এটুকু সময় লাগবেই। বিনিময়ে প্রযুক্তির প্রভূত উন্নতিটাও দেখুন।
আর এই ধরুন, নতুন এক টেলিস্কোপ তৈরির কাজ চলছে পৃথিবীজুড়ে — যার নাম স্কোয়ার কিলোমিটার এরে (Square Kilometer Array: SKA) । জানেন, এতে যতটা অপটিক্যাল ফাইবার লাগবে, তাই দিয়ে আমাদের পৃথিবীকে পাক্কা দুই পাক দিয়ে ফেলা যায়? ফাইবার অপটিক্সের উন্নতি ঠেকায় কে? আর জানেন, এর মূল কম্পিউটারখানি তৈরী করা হচ্ছে আমার-আপনার ঘরে যে আধুনিক কম্পিউটার আছে, সেরকম দশ কোটি কম্পিউটারের সমতূল করে? হ্যাঁ, ঐ একটি কম্পিউটারই হবে দশ কোটির সমতূল! ভাবুন দেখি কম্পিউটার প্রযুক্তির কী বিপুল উন্নতি ঘটে যাচ্ছে এই ফাঁকে। উদাহরণের কি শেষ আছে মশাই? শুনলাম আর এক টেলিস্কোপ থার্টি মিটার টেলিস্কোপ (Thirty Meter Telescope: TMT) — যার পরিকল্পনা চলছে ইতিমধ্যেই — তার লেন্সের ব্যাস কত হবে জানেন? তিরিশ মিটার! তা এই তিরিশ মিটার ব্যসের লেন্স আদতে কতটা বড়, আন্দাজটা একটু দি। প্রফেশনাল ফটোগ্রাফাররা ঘাড়ে করে যে-সুবিশাল ক্যামেরা বয়ে বেড়ান, তার লেন্সের ব্যাস হয় মোটামুটি কয়েক ইঞ্চি মাপের। এবার তো জলের মত হিসেবটা পরিষ্কার হয়ে গেল! হিসেব কষলে দেখবেন, TMT-তে যে লেন্সটি ব্যবহার হবে, তা উচ্চতায় একটি দশতলা বাড়ির সমান উঁচু! বুঝুন, কী ভয়ানক হবে ব্যাপারখানা! তবে এই লেন্সটি হবে আসলে বেশ কয়েকটি লেন্সের সমন্বয়ে তৈরী। সবে মিলে তারা তৈরী করবে ঐ তিরিশ মিটার ব্যাসের লেন্সের সমান ক্ষমতা। এতে করে আলোকপ্রযুক্তির উন্নতি ঘটবে অসীম। নেহাৎই অসম্ভব মনে হচ্ছে নাকি? তাহলে জানাই, সাড়ে আট মিটার ব্যাসের টেলিস্কোপ বিজ্ঞানীরা আজকের দিনেই ব্যবহার করেন কিন্তু। আর এসবই হচ্ছে কিনা সেই অকর্মার ঢেঁকি মৌলিক বিজ্ঞান চর্চা করতে গিয়ে !
এসবের মাঝে ভারতও এগোচ্ছে গুটিগুটি পায়ে। ইসরো (ISRO) তো আছেই, আরো অনেক নতুন বহুদেশীয় উদ্যোগেরও অংশীদার আমরা। “ভারতের মত গরিব দেশে এসব কি বিলাসিতা নয়?” — আপনাদের সাবেকি প্রশ্নটাও তাই নস্যাৎ হয়ে যায় এখানেই। নিশ্চয় এতক্ষণে বুঝে গেছেন একটা দেশকে বিজ্ঞানে উন্নত হতে গেলে ফলিত ও মৌলিক দুই স্তরেই উন্নতি দরকার পাশাপাশি। নিশ্চয় মানবেন, এতে লাভ হয় দুই তরফেরই।
হে বালকবৃন্দ ও স্নেহের হিজিবিজবিজ, আমি আর বেশি সময় নেবো না। উধো-বুধোরও বেলা হয়ে যাচ্ছে। শেষ গল্পটি বিখ্যাত গণিতজ্ঞ জি.এইচ.হার্ডি-কে নিয়ে — যাঁর নাম উচ্চারিত হয় বিজ্ঞানী রামানুজনের সাথে এক বন্ধনীতে — হার্ডি-রামানুজন তত্ত্বের জন্য। এহেন হার্ডি গর্বভরে বলতেন, “No discovery of mine has made, or is likely to make, directly or indirectly, for good or ill, the least difference to the amenity of the world.” কাষ্ঠগদ্যে বললে, “আমার কোনো আবিষ্কারই কোনোদিন মানবসমাজের কোনো কাজে আসবে না হে বৎস।” আর কিমাশ্চর্যমতঃপরঃ! তাঁরই আবিষ্কৃত সংখ্যা তত্ত্ব (number theory)-এর ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে কিনা আজকের জিনবিদ্যার (Genetics) মতো মহামূল্য ব্যবহারিক দিক, যার সাহায্যে কতশত জটিল রোগের চিকিৎসা হচ্ছে! আপনার হাতের ছাপ দিয়ে যে আপনাকে যায় চেনা, যার পোশাকী নাম সুরক্ষাবিদ্যা (Cryptology) — আরও সহজ ভাষায় বললে পাসওয়ার্ড প্রটেকশন — এখানেও সেই সংখ্যা তত্ত্বের প্রয়োগ। কী কাণ্ড বলুন! বিজ্ঞানী নিজেই ভাবেননি কোনোদিন তাঁর আবিষ্কারের এই বিপুল ব্যবহারিক প্রয়োগ ঘটবে!
সব শুনে আপনারা নিশ্চয় বলবেন, “বাহবা বাবুলাল বাহবা বাহা” ! কিন্তু দিনের শেষে আর একটিবার সত্যি কথাটা আপনাদের মনে করিয়ে দি? এসব ব্যবহারিক দিকের কথা মাথায় রেখে কিন্তু মৌলিক গবেষণা মোটেও হয় না। গবেষকরা আপনাতে আপনি মজে কাজ করেন জানার আনন্দে, শেখার আনন্দে, সৃষ্টির আনন্দে — এগিয়ে চলেন সত্যের পথে। তারই ফাঁকে মণিমুক্তোর মতো ঝরে পড়ে তার ব্যবহারিক প্রয়োগ। আজকে আপনারা বিজ্ঞানের যেসব সুবিধা ভোগ করছেন, তার বীজ লুকিয়ে রয়েছে ঐ শুদ্ধ আনন্দটুকুর মধ্যেই। তাই মৌলিক বিজ্ঞানচর্চার প্রয়োজন যতটা বিশুদ্ধ জ্ঞান আহরণের জন্য, ঠিক ততটাই মানবসভ্যতা বিকাশের জন্যও। কে জানে হয়তো-বা এরকম করেই আরো অনেক নতুন দিক খুলে যাবে মৌলিক ও ব্যবহারিক বিজ্ঞানের মেলবন্ধনে! হয়তো কিছুদিন পরে, হয়তো-বা কালই। আপনার-আমার স্বপ্ন দিয়েই তো এগোয় সভ্যতা। স্বপ্ন দেখতে দোষ কোথায়?
তথ্যসূত্র ও অন্যান্য টুকিটাকি:
[১] এখানে স্পষ্ট করে দেওয়া ভালো, তেজস্ক্রিয় মৌলগুলির তেজস্ক্রিয়তার সাথে NMR-এর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে এই মৌলগুলি সাধারণত MRI-এ ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
[২] MRI-এর পিছনে যে আবিষ্কারগুলি রয়েছে সেগুলো নিয়ে জানতে এখানে দেখুন: https://www.magnetic-resonance.org/ch/20-02.html
[৩] ক্যুরিদ্বয় ছাড়াও অঁরি বেকেরেল-ও রেডিওঅ্যাকটিভিটি আবিষ্কারের সাথে যুক্ত ছিলেন। বিশদে জানতে এখানে দেখুন:
[৪] ক্যুরিদের কাণ্ডকারখানা নিয়ে জানতে এখানে দেখুন: https://www.nobelprize.org/nobel_prizes/themes/physics/curie/
[৫] রেডিয়েশন থেরাপি নিয়ে জানতে উইকিপিডিয়া-তে পড়ুন: https://en.wikipedia.org/wiki/Radiation_therapy
[৬] 3D মুভি-তে পোলারাইজেশন-এর ব্যবহার নিয়ে জানতে এখানে দেখুন:
[৭] ‘মহাবিশ্বের আলো’ নিয়ে প্রফেসর পাটকেলের কাছ থেকে শুনুন:
‘আকাশজুড়ে এই আধাঁরে’-এর কথা পড়ুন এখানে:
[৮] জি পি এস-এর পিছনে ‘সাধারণ অপেক্ষবাদ’-এর ভূমিকা নিয়ে জানতে এখানে দেখুন:
[৯] Gravitational waves বা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ-এর আবিষ্কার নিয়ে জানতে ‘বিজ্ঞান’-এ প্রকাশিত এই সিরিজ-টা দেখুন:
ক্যালিফর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি-র ওয়েবসাইটে এই খবরটাও দেখুন: