সম্পাদকমণ্ডলী, ‘বিজ্ঞান’
ছোটবেলায় স্কুলে পড়ার সময় প্রচন্ড উৎসাহ থাকা সত্ত্বেও আমাদের অনেকেই বাংলায় ভালো বিজ্ঞানের লেখার অত্যন্ত অভাব বোধ করতাম। স্কুলের বেশিরভাগ পাঠ্যবইতে যেরকম নীরসভাবে বিজ্ঞান পড়ানো হয়, তাতে বিজ্ঞানের উৎসাহ পালাতে পথ পায় না। জিজ্ঞাসার জায়গায় চলে আসে নম্বর নিয়ে প্রতিযোগিতা। নম্বর দিয়ে বিচার হয় একজন ছাত্র বা ছাত্রীর মেধা, চাপা পড়ে যায় জিজ্ঞাসু মনটা। অথচ পরবর্তী জীবনে আমরা যখন গবেষণা করতে আসি তখন দেখি সেখানে নম্বরের কোনো মূল্যই নেই। যে সৃষ্টিশীল, যে নতুন নতুন ভাবনার জন্ম দেয়, যার মনে পাখা মেলে কল্পনারা, আর সেই কল্পনাকে বাস্তব করতে যে পুরোনো ভাবনার ভুল-ত্রুটি দূর করে নতুন পথের দিশা দেখায়, বিজ্ঞানের দরবারে তারই কদর।
সৃষ্টিশীলতা মানুষের সহজাত। তাই নতুন প্রজন্মকে নম্বর বাড়ানোর ইঁদুর দৌড়ে সামিল না করে মুক্তমনে ভাবনা চিন্তা করার অবকাশ দিতে হবে আমাদের । সেই আশাতেই বিভিন্ন স্বাদের , বিভিন্ন আবিষ্কারের গল্প আমরা ‘বিজ্ঞান’-এর ওয়েবসাইটে তুলে ধরি আমাদের মাতৃভাষা বাংলায়। ‘বিজ্ঞান’-এ প্রকাশিত লেখার বাছাই সংকলন হল ত্রৈমাসিক ‘বিজ্ঞান পত্রিকা’।
এবারের সংখ্যায় আমরা তুলে ধরতে চেয়েছি মূলত প্রাণীজগতে সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতার অন্তর্দ্বন্দ্ব। কোনো জটিল যন্ত্র বা কঠিন তত্ত্ব ছাড়াই বিজ্ঞানীরা কেবল অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে এই দ্বন্দ্বের খুঁটিনাটি খুঁজে বার করেছেন। কেবল অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে আর চোখ-কান খোলা রেখেই তাঁরা করে গেছেন একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার, দেখিয়েছেন আমাদের আসে-পাশের আপাত সাধারণ ঘটনার মধ্যে বিজ্ঞানের অসাধারণ কারসাজি। আমাদের বিশ্বাস এই লেখাগুলি আমাদের পাঠক বন্ধুদের বইয়ের বাইরের জগৎকে বিজ্ঞানীর চোখ দিয়ে দেখতে অনুপ্রাণিত করবে। জন্ম নেবে বিজ্ঞানের প্রতি অপরিসীম আগ্রহ/ভালোলাগা।
প্রথম লেখাটির ভূমিকায় একটা আপাত সহজ প্রশ্ন করা যায়। আচ্ছা বলো তো, পুকুরে হাবুডুবু খাওয়া ভাইকে বাঁচাতে কি তুমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়বে? প্রথমে শুনে মনে হতে পারে, ‘অবশ্যই, ভাই ডুবে যাচ্ছে, বাঁচাবো না?’ কিন্তু একটু ভাবলেই পরিষ্কার হবে যে , উত্তরটা নির্ভর করবে জলে লাফ দিতে কতটা ‘রিস্ক’ আছে, তার উপর। যদি কেউ জানে যে জলের স্রোত এমন যে ঝাঁপ দিলেই সাক্ষাৎ মৃত্যু, তাহলেও কি সে ঝাঁপ দেবে? আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, মনুষ্য সমাজে অনেকেই আছে যারা নিজেদের বিপদের তোয়াক্কা না করেই এগিয়ে যায় অন্যদের সাহায্য করতে, আবার অনেকেই আছে যারা তুলনামূলকভাবে বেশি ‘স্বার্থপর’।
এই ‘স্বার্থপর’ বা ‘স্বার্থশূন্যতা ’ কি একান্তই ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য? না কি এটাও বিবর্তনের নিয়মে কোন প্রজাতির মধ্যে বেশি আর কোন প্রজাতির মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম আছে? এই প্রশ্নটার উত্তর খোঁজার চেষ্টা হয়ে চলেছে অনেকবছর ধরে । সন্তানের কল্যানের জন্য পিতামাতার স্বার্থত্যাগ বহু প্রজাতির মধ্যেই দেখা যায়। এটা বোঝা যেতে পারে এইভাবে, যে সন্তানকে বাঁচানোর মাধ্যমে কোন প্রজাতি আসলে নিজের ভবিষ্যতই রক্ষা করছে। কিন্তু এই তত্ত্বে যে গলদ আছে তা দেখিয়ে দিল এক অতি পরিচিত প্রাণী – শ্রমিক মৌমাছি ! এদের সন্তান হয় না, অথচ এদের নিঃস্বার্থ ব্যবহারের জুড়ি নেই। কেন? এই ধরণের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মুশকিলে পড়লেন অনেকেই, এমনকি বিবর্তনবাদ তত্ত্বের প্রবর্তক ডারউইনও। ডারউইন তার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। তাঁর মৃত্যুর প্রায় আশি বছর পরে কিভাবে হল এই গোলমেলে ধাঁধার সমাধান, সেই গল্প পড়া যাবে ‘ধাঁধার থেকেও জটিল প্রাণী’ লেখাটিতে।
এই ধাঁধার সমাধান তো হল, কিন্তু প্রত্যক্ষ প্রমাণ না পেলে বিজ্ঞানের কোনো তত্ত্বই সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাসযোগ্য নয়। বিভিন্ন বিজ্ঞানীরা নানা কঠিন পরীক্ষা করে যাচাই করলেন এই তত্ত্বের যথার্থতা। আশ্চর্যজনকভাবে দেখা গেলো অনেক ক্ষেত্রেই এই তত্ত্ব খাটে। এমনকি আমাদের অতি পরিচিত প্রাণী কুকুর, বেড়ালও এই তত্ত্বের আওতায় পড়ে, তাই তাদের উপর পরীক্ষা করেই এই তত্ত্ব প্রমাণ করা যায়। বাঁচার তাগিদে কোন মা কি করে তাঁর সন্তানের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে সেই আশ্চর্য আবিষ্কারের কথা আমাদের শোনাচ্ছেন অনিন্দিতা ভদ্র, ‘স্বার্থপর মা’ লেখাটিতে। এটি লেখক ও তাঁর সহকর্মীদের মৌলিক গবেষণা।
কিন্তু আমরা তো সকলেই জানি সন্তানদের প্রতি মায়েদের ভালোবাসা এক অনন্য অনুভূতি। শুধু মনুষ্যসমাজে নয়, প্রায় সমস্ত প্রাণীজগতেই এই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। অনিন্দিতা ভদ্র বলছেন কুমোরে পোকাদের মায়েদের আখ্যান, যাদের বাঁচার একমাত্র উদ্দেশ্য হল সন্তানের জন্ম দেওয়া ও তাকে বড় করার ব্যবস্থা করা। কিন্তু কুমোরে পোকারা কেন এমন করে? ডারউইনের বিবর্তনবাদ থেকে কি এর উত্তর পাওয়া যায়? মায়েদের চিরপরিচিত সন্তান স্নেহের উপাখ্যান জানতে হলে পড়তে হবে এই লেখাটি।
বিবর্তনের উপর লেখাগুলো ছাড়াও এই সংখ্যায় রয়েছে ‘দৈনন্দিন জীবনে রসায়ন’ বিভাগের একটি লেখা। খুব সহজ একটা প্রশ্নের উপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে ‘পেঁয়াজি’ লেখাটি – পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে চোখে জল তো আমাদের সকলেরই আসে, কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর বুঝতে পারলে এমন প্রশ্নও তো করা যায়, এমন পেঁয়াজ কি কোনভাবে ‘তৈরি করা’ যায় যা কাটলে চোখ দিয়ে জল গড়ায় না?
আশা করি বিজ্ঞান পত্রিকার এই নতুন সংখ্যাটি পড়তে সকলের ভালো লাগবে। মন্তব্য পাঠাতে আমাদের ইমেইল করবে [email protected] – এই ঠিকানায়।