দ্বিতীয় পর্ব – কে কোয়ান্টাম, কে ক্লাসিক্যাল?
আমাদের পরিচিত জগত, যাকে বলতে পারি ‘ক্লাসিক্যাল’ জগত, তার সাথে কোয়ান্টাম জগতের পার্থক্য ধরা পড়ে কণা ও তরঙ্গের দ্বৈতসত্তায় (wave-particle duality)। উদাহরণস্বরূপ:
- ইলেক্ট্রনের তরঙ্গ ধর্ম: প্রথম পর্বে বর্ণিত ইলেক্ট্রনের ইন্টারফেয়ারেন্স পরীক্ষার ফলাফল ব্যাখ্যা করতে গেলে আমাদের এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হয় যে ইলেক্ট্রনগুলি একই সাথে একাধিক জায়গা দিয়ে গিয়েছিল, যেমন জলের তরঙ্গ একই সাথে অনেকটা জায়গা জুড়ে বয়ে যায়।
- ইলেক্ট্রনের কণা ধর্ম: অথচ, ইলেক্ট্রন সাধারণ (মানে ক্ল্যাসিক্যাল) তরঙ্গের, যেমন জলের তরঙ্গের মতও নয়। কারণ, জলের তরঙ্গের চলার পথে কোন বাধা, যেমন একটি পর্দা বা দেওয়াল রেখে দিলে তার অনেকটা অংশ জুড়ে সেই তরঙ্গ ধাক্কা খাবে। একটি ইলেক্ট্রনের তরঙ্গ যখন যন্ত্রে ধরা পড়ে তখন তার গোটাটাই ধরা পড়ে একসাথে। অর্থাৎ, কণার মত সে পর্দার এক জায়গাতেই এসে ধাক্কা মারে।
তাই ইলেক্ট্রন হল কণা এবং তরঙ্গ – দুটোই একসাথে। আমাদের চেনা ক্ল্যাসিকাল জগতে এমন গোলমাল বাধে না। ক্রিকেটের বল আর সূর্যের আলোর মধ্যে কে তরঙ্গ, সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না।
দর্শক দেখলে ক্রিকেট বলের গতিপথ একরকম আর না দেখলে আর এক রকম – এমনটা ভাবতে পারেন কি? কিন্তু এটাই হয় কোয়ান্টাম জগতে।
ইলেক্ট্রনের ইন্টারফেয়ারেন্স পরীক্ষায় দেখেছিলাম যে ইলেক্ট্রনটি কোন পথ দিয়ে গিয়েছে সেটা দেখার চেষ্টা করলে তার তরঙ্গধর্ম নষ্ট হয়ে যায়। এই ব্যাপারটা অদ্ভুত, কারণ এতদিন অবধি আমরা প্রকৃতির যে সব নিয়ম কানুন জানতাম, যেমন নিউটনের গতিসূত্র, সেখানে পর্যবেক্ষক গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। একটা ক্রিকেটের বল কোন পথ দিয়ে বোলারের হাত থেকে ব্যাটসমানের কাছে গিয়ে পৌঁছবে তা নির্ভর করে বলটাকে কীভাবে ছোঁড়া হল, হাওয়ার গতিবেগ কত, ইত্যাদির উপর। দর্শক দেখলে বলের গতিপথ একরকম আর না দেখলে আর এক রকম – এমনটা আমরা ভাবি না। তাহলে, ইলেক্ট্রনের গতি পর্যবেক্ষক থাকলে একরকম আর না থাকলে আরেক রকম এমন কেন?
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ম্যাক্স প্লাঙ্ক, নীলস বোর, শ্রডিংগার, হাইজেনবার্গ, আইনস্টাইনের মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন যে এতদিন প্রকৃতিকে যেভাবে বুঝতাম (যাকে ক্লাসিক্যাল ফিজিক্স বলা যেতে পারে) তা সম্পূর্ণ নয়১। নিউটনের গতিসূত্র ইত্যাদি ক্লাসিক্যাল ফিজিক্সের সূত্র দিয়ে খুব ছোট কণা যেমন পরমাণু বা ইলেক্ট্রনকে ব্যাখ্যা করা যায় না। প্রকৃতির নিয়ম বোঝার ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষকের গুরুত্ব নিয়ে অনেক দার্শনিক বিতর্ক হয়েছিল এই সময়।
যুক্তি দেওয়া হল, পর্যবেক্ষণ ছাড়া প্রকৃতিকে বোঝার কোন বৈজ্ঞানিক মানে নেই, কারণ বিজ্ঞান এমন সত্যেরই সন্ধান করে যা পরীক্ষা করে প্রমাণ করা যেতে পারে। বড়সড় বস্তুর, যেমন ইট-পাথর-মটরদানা ইত্যাদির ক্ষেত্রে নিউটনের গতি সূত্রই খেটে যায়, কারণ তাদেরকে ‘দেখতে’ গিয়ে আমরা তাদের অবস্থার পরিবর্তন করি না। মুশকিল হয় ছোট কণাদের ক্ষেত্রে। কারণ তাদের শক্তি এতই কম যে এই ‘দেখা’ ব্যাপারটাই যা দেখতে চাইছি তা পালটে দিতে পারে।
যেমন, পর্যবেক্ষণের জন্য প্রয়োজন বস্তুর সাথে আলোর সংঘর্ষ – সেই আলোই আমাদের বা যন্ত্রের চোখে ধরা দিয়ে বলে দেবে বস্তুটির অবস্থা। কিন্তু যদি বস্তুটির শক্তি এতই কম হয় যে আলোর ধাক্কাতেই সে কুপোকাৎ, তাহলে? তখন সেই বস্তুর গতি বা অবস্থার আলোচনার মধ্যে পর্যবেক্ষকের গুরুত্ব অস্বীকার করা যাবে না। এখানে আলো মানে কিন্তু শুধু দৃশ্যমান আলোর কথা বলছি না – পর্যবেক্ষণের জন্য অন্য তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গও ব্যবহার করা যেতে পারে! তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের সাহায্য ছাড়াও অন্যভাবে বস্তুটির অবস্থা সম্বন্ধে তথ্য বের করার চেষ্টা করতে পারি আমরা। কিন্তু মোদ্দা কথা হচ্ছে বস্তুটির অবস্থা সম্বন্ধে জানতে হলে কোন না কোন ভাবে পর্যবেক্ষককে তার সাথে আন্তঃক্রিয়া (interact) করতেই হবে।
এই যে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে যা পর্যবেক্ষণ করতে চাইছি তাকেই প্রভাবিত বা বিরক্ত (disturb) করার কথা বলছি, তা কতটা? একটা ছোট হিসেব করা যাক! যাকে বলা যেতে পারে Back-of-the-envelope calculation২!
ধরা যাক, একটা মৌমাছি ডানা ঝাপটে উড়ে চলেছে। মৌমাছির গতিবেগ ঘন্টায় প্রায় পনেরো মাইল বা সেকেণ্ডে সাত মিটারের কাছাকাছি, তাদের (শ্রমিক মৌমাছির) ভর প্রায় এক গ্রামের দশভাগ। এর থেকে আমরা তাদের গতিশক্তি হিসেব করতে পারি:
(১/২) x ভর x বেগ^2 = ০.০০২৪৫ জুল
মৌমাছিকে আমরা দেখতে পাচ্ছি কেননা তার গায়ে আলো ধাক্কা খেয়ে আমাদের চোখে বা ক্যামেরায় ধরা পড়ছে। মৌমাছির গতিশক্তির তুলনায় এই আলোর শক্তি কত বড় বা ছোট? যদি আলোর শক্তি আর মৌমাছির গতিশক্তি কাছাকাছি হয় তাহলে মৌমাছিকে দেখতে বা তার ছবি তুলতে গিয়ে তাকে অনেক ‘বিরক্ত’ করা হবে!

আলোক তরঙ্গের শক্তি কত, এই প্রশ্ন উনবিংশ শতাব্দীতে জানা থাকলেও৩ বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আলোর স্বরূপ নিয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গী পাওয়া গেল। বলা যেতে পারে কোয়ান্টাম তত্ত্বের শুরু সেইখান থেকেই। জার্মান বিজ্ঞানী প্লাঙ্ক ‘ব্ল্যাকবডি রেডিয়েশান’ সমস্যার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বুঝেছিলেন যে কোন বস্তুর উপর আলোক তরঙ্গ পড়লে তা শোষিত হতে পারে কেবল নির্দিষ্ট কিছু শক্তির ধাপে। অর্থাৎ, বস্তুটি আলোক তরঙ্গ থেকে এক বা একাধিক পূর্ণসংখ্যক শক্তির ‘প্যাকেট’-ই শোষণ বা বিকিরণ করতে পারে। আলোক তরঙ্গের শক্তির এই ক্ষুদ্রতম মান পাওয়া যায় একটি ধ্রুবককে সেই আলোর কম্পাঙ্ক দিয়ে গুণ করলে। এই ধ্রুবক পরবর্তীকালে পরিচিত হয় প্লাঙ্কের ধ্রুবক হিসাবে, যাকে সংক্ষেপে h চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হয়।
প্লাঙ্কের ধ্রুবকের মান:
৬.৬২৬ x ১০^(-৩৪) মিটার^2 কিলোগ্রাম/সেকেণ্ড
১০^(-৩৪) মানে হল দশমিকের পরে তেত্রিশটা শূন্য আর তারপর এক! প্লাঙ্কের ধ্রুবকের মান যে একটা অত্যন্ত ছোট সংখ্যা তা সহজেই বুঝতে পারি আলোর কণিকার শক্তির সাথে আমাদের পরিচিত বস্তুর, যেমন ওই মৌমাছির গতিশক্তির তুলনা করে। উদাহরণ স্বরূপ, হলুদ আলোর (৫৯০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের) একটি কণিকার শক্তি = প্লাঙ্কের ধ্রুবক x হলুদ আলোর কম্পাঙ্ক = প্রায় ৩.৩ x ১০^(-১৯) জুল। আর উপরে আমরা মৌমাছির গতিশক্তি হিসেব করেছিলাম মোটামুটি ০.০০২৪৫ জুল মানে ২.৪৫ x ১০^(-৩) জুল। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আলোর একটা কণিকার শক্তি৪ মৌমাছির শক্তির তুলনায় নগন্য – কোটি কোটি ভাগেরও কম। অর্থাৎ, একটি বা কয়েকটি আলোর কণিকা মৌমাছির গায়ে ধাক্কা দিলেও মৌমাছি আদৌ বিরক্ত হবে না! মৌমাছির গতি আলোচনায় তাই কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রয়োজন নেই।
উপরের উদাহরণে মৌমাছির গতিশক্তি এত বেশি তার একটি বড় কারণ হল মৌমাছির ভর অনেক বেশি। একই বেগে চলা কম ভরের বস্তুর গতিশক্তিও কম। তাহলে আমরা আন্দাজ করতে পারি যে খুব কম ভরের কণা, যেমন একটি বিচ্ছিন্ন পরমাণুর গতিশক্তি আলোর একটি মাত্র কণিকার ক্ষীণ শক্তির সমতুল্য হতেই পারে। বিশেষ করে পরমাণুটিকে যদি কোনভাবে ঠাণ্ডা করে গড় বেগ প্রায় শূন্যের কাছে নিয়ে চলে আসা যায়। অর্থাৎ, ছোট বস্তুর গতি আলোচনায় কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রয়োজন কিনা সেটা বিশেষভাবে ভেবে দেখতে হবে।
মৌমাছির ভরের জন্য তার গতিশক্তি বেশি, তাই আলোককণার দ্বারা পর্যবেক্ষণের জন্য তার অবস্থার পরিবর্তন হবে না। কিন্তু ঠাণ্ডা পরমাণুর বেলা অন্য কথা।
তাহলে, কোয়ান্টাম আর ক্লাসিক্যাল জগতের সীমারেখা কে ঠিক করে দেয়? উপরের আলোচনা থেকে মোটামুটি আন্দাজ করা যায় যে এই প্রশ্নের উত্তরে প্লাঙ্কের ধ্রুবকের ভূমিকা আছে। প্লাঙ্কের ধ্রুবক এত ছোট বলেই বড় বস্তুর ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে ভাবতে হয় না।
প্লাঙ্কের ধ্রুবক
আগেই বলা হয়েছে, প্লাঙ্কের ধ্রুবকের মান অত্যন্ত ছোট, ৬.৬২৬ x ১০^(-৩৪) মিটার^2 কিলোগ্রাম/সেকেণ্ড। কোয়ান্টাম আর ক্লাসিক্যাল জগতের সীমারেখা বের করার জন্য এই প্লাঙ্কের ধ্রুবকটিকে আমরা ভাল করে বিশ্লেষণ করব। এই পদ্ধতিকে মাত্রাগত বিশ্লেষণ (dimensional analysis) হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। কোন রাশি বা প্রাকৃতিক ধ্রুবকের মাত্রাগত বিশ্লেষণ বেশ সহজ হলেও সেখান থেকে কিছু অন্তর্দৃষ্টি পাওয়া যায়।
প্লাঙ্কের ধ্রুবকের একটি একক (unit) আছে, যেহেতু এটি একটি প্রাকৃতিক রাশি। এককটির দিকে ভাল করে তাকানো যাক। মিটার (m), কিলোগ্রাম (kg), আর সেকেণ্ড (s) হল যথাক্রমে দৈর্ঘ্যের, ভরের, আর সময়ের একক। পদার্থবিজ্ঞানে কোন রাশির একক বা মাত্রা (dimension) বিশ্লেষণ করার জন্য সেই রাশিটিকে কিছু মৌলিক রাশির, যেমন দূরত্ব (L), ভর (M), সময় (T) ইত্যাদির বিভিন্ন ঘাতের সমবায়ে লেখা হয়। প্লাঙ্কের ধ্রুবকের এককের দিকে তাকালেই পরিষ্কার হবে যে রাশিটির মাত্রা হল L^2 M/T, অর্থাৎ প্লাঙ্কের ধ্রুবকের মধ্যে দৈর্ঘ্য দ্বিঘাতে, ভর এক ঘাতে এবং সময় ব্যাস্তানুপাতে একঘাতে আছে।
এবার ভাবা যাক যে এই মাত্রা আর কোন প্রাকৃতিক রাশির হতে পারে? এটাকে সাজিয়ে লেখা যায়:
L^2 M/T = M (L/T^2) L T = ((ভর x ত্বরণ) x দূরত্ব) x সময় = (বল x দূরত্ব) x সময় = শক্তি x সময়
ভরকে ত্বরণ দিয়ে গুণ করলে যে বল পাওয়া যায় তা নিউটনের গতিসূত্র থেকে জানি। বলকে সরণ দিয়ে গুণ করলে কার্য বা শক্তি পাওয়া যায়, তাও জানি।
প্লাঙ্কের ধ্রুবকের সাথে তুলনা করে বলা যায় কে কোয়ান্টাম জগতের, আর কে ক্লাসিক্যাল জগতের।
এই সহজ বিশ্লেষণ থেকে ধারণা করতে পারি যে, কোন বস্তুর শক্তি এবং যে সময় ধরে তার অবস্থা বা গতি বিশ্লেষণ করা হচ্ছে এই দুটো সংখ্যা গুণ করলে যে রাশিটি পাওয়া যায় তার মাত্রা (বা একক) প্লাঙ্কের ধ্রুবকের মাত্রার (বা এককের) সমান৫। দুটি রাশির একক এক হলে তাদের মধ্যে সরাসরি তুলনা করা চলে। যেমন, দূরত্বের সাথে দূরত্বের তুলনা করা যায়, সময়ের সাথে সময়ের। ঠিক তেমনিই, প্লাঙ্কের ধ্রুবকের সাথে বস্তুটির শক্তি ও সময়ের গুণফলের তুলনা করা যায়। আর এই তুলনাই বলে দেবে কে কোয়ান্টাম জগতের, আর কে ক্লাসিক্যাল জগতের! যখনই আমরা খুব কম শক্তির বা খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাওয়া কোন ঘটনার আলোচনা করছি, অর্থাৎ যেখানে শক্তি ও সময়ের গুণফলের মান প্লাঙ্কের ধ্রুবকের সমতুল্য (বা ছোট) হয়ে উঠছে – সেখানেই আমাদের কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সাহায্য নিতে হবে। আর যেখানে প্লাঙ্কের ধ্রুবকের তুলনায় এই গুণফল অনেক অনেক বড় সেখানে নিরাপদে ক্লাসিক্যাল তত্ত্ব দিয়ে চালিয়ে নেওয়া যায়!

কোয়ান্টাম আর ক্লাসিক্যালের জগত সাদা-কালো নয়। পুরো কোয়ান্টাম আর পুরো ক্লাসিক্যাল – এই দুইয়ের মাঝে অনেকটা ধূসর জায়গা আছে। কারণ, কোন বস্তুর ব্যবহার বা প্রাকৃতিক ঘটনার মধ্যে কতটা কোয়ান্টাম প্রভাব আছে, এটা বোঝা সবসময় সহজ নয়। খুব ছোট ‘বস্তু’ যেমন একটি পরমাণু বা ইলেক্ট্রনের ব্যবহার কোয়ান্টাম কিনা অনেক ক্ষেত্রেই বোঝা যায়, মুশকিল হয় আরেকটু জটিল বস্তুর ক্ষেত্রে। যেমন, সালোকসংশ্লেষ পদ্ধতিতে যেভাবে শক্তির রূপান্তর হয়, সেখানে কোয়ান্টাম প্রভাব আছে – এমন দাবী অনেক বিজ্ঞানী করেছেন৬। মুশকিল হল, সালোকসংশ্লেষের জন্য যে অণুগুলো দায়ী তারা বেশ বড়সড় – তাদের শক্তিও নগন্য নয়। তাই তারা কতটা সময় ধরে কোয়ান্টাম প্রভাব দেখাতে সক্ষম সে নিয়ে বিতর্কও প্রচুর।
কত সময় ধরে কোয়ান্টাম?
উপরের আলোচনায় আমরা শক্তি ও সময়কে গুণ করে সেই গুণফল প্লাঙ্কের ধ্রুবকের থেকে বেশি না কম তা দেখলাম। শুরুতেই পাঠকের মনে হতে পারে এখানে তো অনেকগুলো ঝামেলা আছে। যেমন, আমার সামনে টেবিলে একটা মার্বেল রাখা আছে। তার তো বেগ শূন্য (আমার সাপেক্ষে, বা আমার রেফারেন্স ফ্রেমে)। তাহলে, তার গতিশক্তিও শূন্য – তাহলে কি এত বড় মার্বেল একটা কোয়ান্টাম বস্তু নাকি?
দ্বিতীয় ঝামেলা হচ্ছে শক্তির সাথে সময় গুণ করে সেই গুণফলকে প্লাঙ্কের ধ্রুবকের সাথে তুলনা করে দেখব বস্তুটা কোয়ান্টাম কিনা – এখানে কোন সময়ের কথা বলা হচ্ছে? আমি যদি খুব কম একটা সময়কে বড় শক্তি দিয়ে গুণ করি, তাহলে গুণফল ছোট হতেই পারে। তার মানে কি কোন বস্তু অল্প সময়ের জন্য কোয়ান্টাম, আর বেশি সময়ে ক্লাসিক্যাল – এমন হতে পারে?
এই লেখার বাকী অংশে এই দুটি প্রশ্নের আলোচনা করব।
যেহেতু প্লাঙ্কের ধ্রুবক একটা অত্যন্ত ছোট সংখ্যা, তাই ‘আমার ফ্রেমে মার্বেলটির গতিশক্তি শূন্য’- এই কথাটা বলার আগে একটু ভাবতে হবে! শূন্য মানে কি একদমই শূন্য? না কি শূন্য দশমিক শূন্য শূন্য শূন্য … অনেকগুলো শূন্যের পর একটা এক বা অন্য কোন সংখ্যা? এই চুলচেরা বিচারই করতে হবে, কারণ প্লাঙ্কের ধ্রুবকেও তো এতগুলো শূন্য!
গতি একেবারে শূন্য হতে পারে কিনা সেই চুলচেরা বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
তাহলে ঠাণ্ডা মাথায় বিচার করতে বসা যাক। ধরা যাক আমার কাছে একটা অতি শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র আছে। সেই যন্ত্রে চোখ লাগিয়ে দেখলাম যে মার্বেল কণাটি আসলে পুরো স্থির নেই। একটু একটু কাঁপছে। কারণ, সে যে টেবিলের উপর বসে সেই টেবিলটি কাঁপছে একটু একটু। কারণ, টেবিলটি যে মেঝের উপর বসে সেই মেঝে কাঁপছে একটু একটু। কারণ, অনেক দূর দিয়ে গাড়ি চলছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। তার মানে মার্বেলটির বেগ তথা গতিশক্তি একদম শূন্য নয়। কল্পনার নৌকো ছুটিয়ে দিলাম আমি। মনে মনে মার্বেলটার সাথে একটা চুম্বক আটকে দিয়ে সেটাকে অন্য কিছু চুম্বকক্ষেত্রের সাহায্যে শূন্যস্থানে ভাসিয়ে দিলাম! এবার মার্বেলের সাথে টেবিলের কোন সম্পর্ক নেই, তাই টেবিলের কম্পনে তার কাঁপুনিও নেই।
কিন্তু, হাওয়ার ধাক্কা আছে! যতই কম হোক হোক না কেন, বাতাসের মধ্যেকার অণুগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে এসে মার্বেলটাকে গুঁতো মারছে। আমার ভয়ঙ্কর শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দেখতে পারছি মার্বেলটা কখনো এদিকে কখনো ওদিকে নড়ছে।
আচ্ছা, এই বেগ বন্ধ করারও ফন্দি এঁটেছি – দাও ব্যাটাকে ঠাণ্ডা ভ্যাকুয়ামের মধ্যে পাচার করে! যন্ত্রের মধ্যে মহা শূন্যস্থান, হাতে গোণা যে ক’টা বাতাসের অণু ছিল তারাও কম তাপমাত্রার জন্য প্রায় থেমে গিয়েছে। তার মাঝে আমার চুম্বক ওয়ালা মার্বেল শূন্যকলে ঝুলছে। হাওয়া নেই তো ধাক্কা মারেগা কৌন?
এবার মনে হচ্ছে মার্বেলটা নিস্তেজ গতিহীন হয়ে আছে। কিন্তু, আমার সন্দেহবাতিক মন। বাড়িয়ে দিলাম অণুবীক্ষণের শক্তি আরও সূক্ষ্ম ভাবে দেখব বলে। কি মুশকিল, এখনো নড়ে কেন? ঝামেলা হল মার্বেলটার গায়ে যে চুম্বক লাগিয়ে দিয়েছিলাম সে নিজেই মার্বেলকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। কেননা, ঘরের মধ্যেকার চৌম্বক ক্ষেত্র একটু হলেও মুহূর্তের মধ্যে পালটাচ্ছে। কারণ বাড়ির সামনে দিয়ে একটা লরি চলে গেল, তার গায়ে অনেক লোহা – সে চৌম্বক ক্ষেত্রকে কিছুটা হলেও পালটে দিয়েছে। ইলেক্ট্রনিক্সের ফন্দিফিকির খাটিয়ে এমন সার্কিট বানানো যেতে পারে যে কোন স্থানে চৌম্বক ক্ষেত্র মোটামুটি স্থির রাখা যায়। কিন্তু সম্পূর্ণ স্থির করে দেওয়া অসম্ভব।
এমন করে হাজারটা কারণ বের হয়ে এল যারা মার্বেলটাকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না। এমনকি বুঝলাম যে আমি যে মার্বেলটাকে দেখতে পাচ্ছি তার কারণ হল আলো এসে মার্বেলের গায়ে ধাক্কা খেয়ে আমার চোখে এসে পড়ছে। এই আলোর ধাক্কাতেও মার্বেল গতি পাচ্ছে। অতীব ক্ষীণ ধাক্কা, কিন্তু শূন্য নয়। এখানেও সেই পর্যবেক্ষণের ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না, যেমন এই লেখার শুরুতে আলোচনা করেছি।
মার্বেলের গড় দ্রুতি কখনই এত কম হয়না যে তার ভর দিয়ে গুন করলে প্লাঙ্কের ধ্রুবকের সমতুল্য হতে পারে। তাই তাকে কোয়ান্টাম ভাবার কারণ নেই।
তার মানে মার্বেলটার গতি পুরো বন্ধ করে দিতে হলে তাকে বাইরের জগতের সব প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হবে। এমনকী তার উপর আলোও ফেলা যাবে না! তবে গিয়ে বলতে পারব তার শক্তির কোন হেরফের নেই। অর্থাৎ একদম শূন্য। বলা সহজ, কিন্তু বাস্তবে একটা আস্ত মার্বেলকে (বা যেকোন বড় বস্তুকে) বাকী জগতের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করা এখনো পর্যন্ত অসম্ভব। পরিবেশের বিভিন্ন প্রভাবের (যেমন কয়েকটি আলোচনা করলাম উপরে) জন্য তার গড় দ্রুতি খুব কম হলেও শূন্য নয়। মার্বেলের ভর কয়েক গ্রামের মত, তাই দ্রুতি কম হলেও শক্তি এতটাও কম নয় যে তাকে আমরা মাপতে পারি এমন কোন সময়ের সাথে গুণ করলে প্লাঙ্কের ধ্রুবকের সমতুল্য হতে পারে। তাই মার্বেল ক্লাসিক্যাল।

আস্ত একখানা মার্বেল না হলেও পরীক্ষাগারে এক বা গুটি কয়েক পরমাণুকে জগতের বাকী সবার থেকে মোটামুটি আলাদা করে রাখা সম্ভব। ‘মোটামুটি’, কারণ বাস্তবে নিখুঁত অন্ধকার বানানো যায় না। কোন এক সময়ে আলোর একটা কণিকা এসে ধাক্কা মারবে পরমাণুকে। আর মুহূর্তের মধ্যে পরমাণুর কোয়ান্টাম অবস্থা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। আবার নিখুঁত শূন্যস্থানও বানানো যায় না। যদিও বর্তমানে পরীক্ষাগারে ভ্যাকুয়াম চেম্বারে যে শূন্যস্থান বানানো যায়, তা মহাবিশ্বের যে জায়গাগুলোকে আমরা পুরো ফাঁকা ভাবি তার থেকেও বেশি ফাঁকা!
যতক্ষণ একটা বস্তুকে বাইরের জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখা যাবে, ততক্ষণ ধরে রাখা যাবে তার কোয়ান্টাম ধর্ম।
তাহলে যতক্ষণ একটা বস্তুকে বাইরের জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখা যাবে, একটা আলোও আসতে দেওয়া যাবে না ততক্ষণ সে কোয়ান্টামের মত ব্যবহার করবে। আমরা উপরে যে সময়ের কথা বলছিলাম প্লাঙ্কের ধ্রুবকের সাথে তুলনার জন্য, এই সেই সময়। কোন বস্তুকে যত বেশি বিচ্ছিন্ন করে রাখা যাবে তত তার শক্তির হেরফের কম হবে। সেই শক্তিকে শূন্যের খুব কাছাকাছি বলে ভাবা যাবে। তাই তত বেশি সময় ধরে শক্তি ও সময়ের গুণফল প্লাঙ্কের ধ্রুবকের সমতুল্য থাকবে। তত বেশি সময় ধরে সে কোয়ান্টাম। এই সময়কে পদার্থবিজ্ঞানে ডিকোহেরেন্স টাইম (decoherence time) হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। সাধারণভাবে এই সময়ের মধ্যেই কোয়ান্টামের যাদু দেখা যায়, যেমন একসাথে একটা ‘কণা’ অনেক জায়গা দিয়ে চলে যাচ্ছে তরঙ্গের মত ইত্যাদি! বস্তু যত বড় হয় তার উপর প্রকৃতির হাজার প্রভাব খাটতে থাকে, তাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা সম্ভব হয় না বেশিক্ষণ। তাই তার decoherence time-ও তত কমতে থাকে।

পরীক্ষাগারে একটা পরমাণু৭ থেকে আরম্ভ করে ন্যানোগ্রাম ওজনের পর্দাকে৮ (nano-mechanical membrane) কোয়ান্টাম অবস্থায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। পরমাণুর ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম প্রভাব অনেকক্ষণ ধরে (অনেক মিনিট ধরে) দেখা যায়৯। বড় বস্তু, যেমন ন্যানো পর্দার ক্ষেত্রে এই সময়টা খুবই সংক্ষিপ্ত – ন্যানোসেকেণ্ডের মত।

মৌলিক ধ্রুবকের রহস্য
আমাদের মহাবিশ্ব ঠিক এই রকম দেখতে কেন? প্রশ্নটি দার্শনিক শুনতে লাগলেও এর কারণ হিসাবে প্লাঙ্কের ধ্রুবক ও অন্যান্য মৌলিক ধ্রুবকগুলির (যেমন শূন্যস্থানে আলোর গতিবেগ c, মহাকর্ষীয় ধ্রুবক G) নির্দিষ্ট মানের প্রভাবকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এই ধ্রুবকগুলির মান এমন কেন, আলাদা হলে – যেমন, প্লাঙ্কের ধ্রুবক যদি অনেক বড় হত, আলোর গতিবেগ এত বেশি না হয়ে যদি আমাদের ধরা ছোঁয়ার মধ্যে হত, বা মহাকর্ষীয় ধ্রুবক যদি আরও অনেক বড় হত – তাহলে আমাদের জগত কেমন দেখতে হত, বিজ্ঞানীরা মাঝেমধ্যেই এমন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। বিজ্ঞানী জর্জ গ্যামো এই বিষয়ে রসিয়ে বইও লিখেছেন, যেখানে মিঃ টম্পকিন্স এমন দেশে গিয়ে হাজির যেখানে আলোর গতিবেগ মাত্র ঘন্টায় দশ মাইল! আবার এই মৌলিক ধ্রুবকগুলি আদৌ ধ্রুবক, না ধীরে ধীরে পালটাচ্ছে, সেটাও তাত্ত্বিক ও পরীক্ষামূলক গবেষণার বিষয়। এই প্রশ্নগুলির উত্তর আমরা জানি না এখনো।
যে কারণেই হোক না কেন, আমাদের মহাবিশ্বে প্লাঙ্কের ধ্রুবক খুব ছোট। আর তাই কোয়ান্টাম জগত অদ্ভুতভাবে ধরা দেয় – আমাদের অভিজ্ঞতার সাথে মেলে না। গত একশো বছরে বিজ্ঞানীরা এই জগত সম্বন্ধে বেশ কিছুটা জেনেছে। এমনকি, এই রহস্যময় জগতের ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানাকে কী করে প্রযুক্তিগতভাবে মানবকল্যানে ব্যবহার করা যায় তা নিয়েও কিছুদূর এগোনো সম্ভব হয়েছে। তা সত্ত্বেও বহু প্রশ্নের উত্তর এখন অজানা। কোয়ান্টাম জগতের একটা বড় অংশ রহস্য হয়ে আরও অনেক প্রজন্মের বিজ্ঞানীর অপেক্ষায় বসে আছে।
(ক্রমশ)
প্রচ্ছদের ছবি – শ্রডিংগারের বিড়াল (বিস্তারিত) বাস্তব জগতে কেন দেখা যায় না তার একটি উত্তর লুকিয়ে আছে উপরের আলোচনায়। খুব ক্ষুদ্র কণা যেমন একটি ইলেক্ট্রন বা পরমাণুকে পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা সম্ভব অল্প সময়ের জন্য, কিন্তু বিড়ালের মত বড় বস্তুকে বিচ্ছিন্ন করা প্রায় অসম্ভব। (Image by Dhatfield – Own work, CC BY-SA 3.0, https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=4279886)
বিশদে জানতে –
[১] কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ঊষালগ্নে বিজ্ঞানীদের মধ্যে যে বিতর্ক চলছিল তার সুন্দর বিবরণ পাওয়া যাবে Geroge Gamow-র Thirty Years that Shook Physics বইতে।
[২] Back-of-the-envelope ক্যালকুলেশান সম্বন্ধে আরও জানতে পড়ুন ‘বিজ্ঞান’-এ প্রকাশিত এই লেখকের লেখা – https://bigyan.org.in/2016/09/26/science-teaching-in-schools/
[৩] বিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েল তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের পূর্ণাঙ্গ সমীকরণ লিখেছিলেন, ও আলো যে তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ তা দেখিয়েছিলেন। আলোক তরঙ্গের শক্তি তার তড়িৎ ও চৌম্বক ক্ষেত্র থেকে হিসেব করা যায়। যেমন, https://hyperphysics.phy-astr.gsu.edu/hbase/Waves/emwv.html
[৪] উৎসাহী পাঠকের জন্য – আমাদের ঘরের মধ্যে বেশি সংখ্যক আলোক কণিকা আছে না বেশি সংখ্যক ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন আছে? Hint – ঘরের মধ্যে একটা ১০০ ওয়াটের বাল্ব জ্বলছে। আলোক কণিকার শক্তি থেকে মোটামুটি কতগুলি আলোক কণিকা আছে বের করা যাবে। অ্যাভোগাড্রো সংখ্যা থেকে ঘরের মধ্যে মোটামুটি কত পরমাণু আছে আন্দাজ করা যাবে।
[৫] প্লাঙ্কের ধ্রুবকের মাত্রা অন্যভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তা কৌণিক ভরবেগের (angular momentum) সমান। এখানে যেমন আলোচনা করলাম সেভাবেই বোঝা যায় যে কোন ঘূর্ণনশীল বস্তুর কৌণিক ভরবেগ যদি অত্যন্ত কম হয়, যা প্লাঙ্কের ধ্রুবকের সাথে তুলনীয়, তাহলে সেই ঘূর্ণন গতি ব্যাখ্যা করতেও কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রয়োজন।
[৬] উদাহরণ স্বরূপ – ক্যালিফোর্ণিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলির বিজ্ঞানী ও সহকর্মীদের গবেষণা – https://www.nature.com/nphys/journal/v6/n6/abs/nphys1652.html (Nature Physics 6, 462-467 (2010))
[৭] একাধিক পরীক্ষায় পরমাণুর কোয়ান্টাম ধর্ম দেখা গিয়েছে, যেখানে সে একই সাথে দুটি বা তার বেশি অবস্থায় একই সাথে থেকেছে তরঙ্গের মত। উদাহরণ – https://tf.nist.gov/general/pdf/1112.pdf (Science, 272, 1131 (1996))
[৮] উদাহরণ – https://journals.aps.org/prl/abstract/10.1103/PhysRevLett.108.033602
[৯] রেকর্ড হল – লেজার রশ্মি দিয়ে ঠাণ্ডা করা একটি ইটারবিয়াম আয়নকে প্রায় পনেরো মিনিট ধরে কোয়ান্টাম অবস্থায় দেখা গিয়েছে। IEEE Transactions on Instrumentation and Measurement, 44, 2 (1995)