শীতের দুপুরে বারান্দায় বসে কমলা লেবু খেতে খেতে দেখলাম পাশের বাড়ির মাসিমা কালুকে ডাকছেন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে, হাতে এঁটোকাঁটা ভরা বাটি। কালু এ পাড়ার জাঁদরেল মাদী কুকুর (ছোটবেলায় ওর নাম দেওয়ার সময় পাড়ার বাচ্চারা বুঝতে পারেনি যে ও মাদী ), দুই ভাইকে নিয়ে পাড়ার মোড়টাকে আগলে রাখে সে-ই। মাস খানেক আগে কালুর চারটে নাদুসনুদুস ছানা হয়েছে, আমাদের সামনের বাড়ির বাগানে। তারা এখন শুকনো ড্রেনের আস্তানা ছেড়ে বেরিয়ে এসে দিব্যি গড়াগড়ি খায় ঘাসে, আর মাকে পেলেই হামলে পরে দুধ খাওয়ার জন্য। কালু বেচারা বেশ রোগা হয়ে গেছে এই এক মাসে, অমন তাগড়া চেহারা কোথায় হারিয়ে গেছে, কয়েকটা হাড় দেখা যাচ্ছে পাঁজরের। কালুকে পাড়ার লোকজন আদর করে খেতে দিচ্ছে আজকাল; “ আহা বেচারা, মা তো, দুধ খাওয়াবে কি করে বাচ্চাদের, নিজে না খেলে” রমা বৌদি বলছিলেন সেদিন ওদের কাজের মাসিকে, কালুকে আদর করে মাছের কাঁটা আর ঝোলমাখা ভাত দিতে দিতে। কালু পাড়ার সব বাড়ি থেকে খেয়ে এসে বাচ্চাদের দুধ খাওয়াচ্ছে, বাচ্চারাও নধর হচ্ছে দিনে দিনে।
কালুর খাওয়া দেখতে দেখতে আমি ভাবছিলাম যে আর এক-দেড় মাস পরেই ছবিটা কেমন পাল্টে যাবে – কালু ওর বাচ্চাদের সঙ্গে রেষারেষি করে খেতে চাইবে, প্রথমটায় বাচ্চারা ছোট বলেই পেরে উঠবে না, কিন্তু পরের দিকে মাঝেমাঝেই ঝগড়া করবে মায়ের সঙ্গে, খাবার কেড়ে নিতে চাইবে মায়ের মুখ থেকে। তখন কালুর সৎমা-সুলভ আচরণ দেখে এই বৌদিই হয়ত বিরক্ত হয়ে কালুকে তাড়িয়ে দেবেন, বলবেন “কেমন মা দেখ, নিজের বাচ্চাদের খেতে দেয় না!” প্রশ্নটা হল, আমি কি করে এত নিশ্চিত হতে পারি যে কালু এমনটাই করবে, আর কেনই বা কালু হঠাৎ এরকম করবে?
প্রথম প্রশ্নের উত্তরটা পরিস্কার হয়ে যাবে পরের প্রশ্নের উত্তর থেকেই।
বছর পাঁচেক আগে, আমার ছাত্রী সৃজনী এসে আমায় জানাল যে আমাদের ল্যাবের সামনে যে কুকুরটার মাস দুয়েক আগে বাচ্চা হয়েছিল, সে নাকি খাবার নিয়ে নিজের বাচ্চাদের সঙ্গেই মারামারি করছে। অথচ আমরা জানি যে সে খুবই সচেতন মা, বাচ্চাদের আগলে রাখে, আশেপাশে কাউকে ঘেঁষতে দেয় না, এমনকি, তার বাচ্চারা যখন একদম ছোট, তখন কয়েকজনকে তেড়েও গেছে সে। হঠাৎ হল কি তাহলে ? সৃজনীকে বললাম একটু সময় নিয়ে ওদের পর্যবেক্ষণ করতে, আর সেই সঙ্গে আশেপাশে আরো কয়েকটা কুকুর পরিবার খুঁজে বের করতে। জানার দরকার, এই অদ্ভুত ব্যবহার শুধু এই কুকুরটাই করছে, না এটাই কুকুর মায়েদের পক্ষে স্বাভাবিক, তাদের বাচ্চারা কিছুটা বড় হয়ে যাওয়ার পরে। সৃজনী ফিরে গেল রাস্তায়, নতুন কাজের ভার নিয়ে। আর আমি ভাবতে লাগলাম, সত্যি যদি মা কুকুর একটা সময় তার নিজের বাচ্চাদের প্রতিযোগী হয়ে ওঠে, তাহলে জীববিজ্ঞানের এক বিখ্যাত থিওরির সাক্ষ্যপ্রমাণ দিতে পারব আমরা। আর সেটা হবে একটা গবেষণামূলক কাজের মধ্যে দিয়ে, যা আজ পর্যন্ত খুব কম ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়েছে।
কি এই থিওরি?
১৯৭৪-এ, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নবীন বিবর্তনবিদ, রবার্ট ট্রিভার্সের (Robert Trivers) উত্থাপন করা পেরেন্ট-অফস্প্রিং কনফ্লিক্ট থিওরি (Parent-Offspring Conflict Theory)। এর ভিত আবার উইলিয়াম হ্যামিল্টনের (William Hamilton) কিন সিলেকশন থিওরি (Kin Selection Theory)। বেশির ভাগ প্রাণী তার মা বা বাবার জীনের ৫০% বহন করে (অঙ্কের হিসেবে)। সুতরাং এক একটি সন্তান তার মা-বাবাকে দিতে পারে ০.৫০ fitness, অর্থাৎ বিবর্তনের হিসেবের খাতায় আয়। এই অঙ্কটা একটু বুঝিয়ে বলি। চার্লস ডারউইনের থিওরি অফ ন্যাচারাল সিলেকশন (Theory of Natural Selection) অনেকেই জানেন। এই তত্ত্বের মূল ভাব হল, জীবজগতে যে যত প্রজননক্ষম সন্তান পালন করতে পারবে, বিবর্তনের হিসেবে তার “ফিটনেস (fitness)” তত বেশি, অর্থাৎ এক একটি সন্তানের জন্য তার মা-বাবার ফিটনেস এক করে বাড়ে, তখনই, যখন সেই সন্তান নিজে সন্তানের জন্ম দিতে পারে। একে বলা হয় ডারউইনীয় ফিটনেস (Darwinian fitness)। ডারউইনের সময় জীনের কথা জানা ছিল না। পরবর্তীকালে যখন জেনেটিক্স (genetics) সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক সমাজ অবগত হল, তখন ডারউইনের তত্ত্ব এক নতুন রূপ পেল, যার নাম নব্য ডারউইনবাদ (neo-darwinism)। সহজ ভাষায়, এ হল জেনেটিক্স ও পরিসংখ্যান (statistics) ব্যবহার করে ডারউইনের তত্ত্বকে বোঝার চেষ্টা। জানা গেল যে বেশির ভাগ প্রাণীর জীবন শুরু হয় একটি কোষ থেকে, যা বহন করে তার মা ও বাবার থেকে পাওয়া এক সেট করে ক্রোমোজোম (chromosome), যেগুলি বহন করে জীন। সুতরাং যে কোনো জীন থাকে এক জোড়া, যার একটি আসে মায়ের থেকে, অন্যটি বাবার থেকে। মানুষের ক্ষেত্রে রয়েছে ২৩ জোড়া ক্রোমোসোম, যার ২২টি অটোজোম (autosome), এবং শেষ জোড়া হল সেক্স ক্রোমোজোম (sex chromosome) – এই শেষ জোড়াটি নির্ধারণ করে একটি ভ্রূণের লিঙ্গ। এবারে আসি অঙ্কে।
মনে করুন, আমি আপনাকে এক বাক্স লাল বল আর এক বাক্স নীল বল দিলাম, যেখানে দুটো বাক্সেই ১০০ করে বল রয়েছে, এবং বলগুলোতে ১ থেকে ১০০ নম্বর দেওয়া রয়েছে। এবারে একটা থলে দিয়ে বললাম এই বাক্সদুটো থেকে ৫০টা করে বল এই থলেতে ভরে দিতে। তাহলে থলেতে রইল ৫০% লাল বল আর ৫০% নীল বল। আবার থলের লাল বল বাক্সের ১০০টা বলের ৫০%, সুতরাং থলের সঙ্গে লাল বাক্সের সম্পর্ক ৫০%, এবং একইভাবে থলে আর নীল বাক্সের মধ্যে সম্পর্ক ৫০%। এই পর্যন্ত হিসেবটা খুব কঠিন নয় নিশ্চয়ই? এবারে যদি বলি, লাল বাক্স মা, নীল বাক্স বাবা, আর থলে হল সন্তান, যে মা ও বাবার জীনের অর্ধেক করে পেয়েছে, তাহলে? ঠিক এই হিসেবেই, একটি সন্তানের সঙ্গে তার মা-বাবার জীনের সাদৃশ্য ৫০%, আর এই কারণে একটি সন্তান পালন করে তাকে প্রজননক্ষম করে তুলে তার মা-বাবা পেতে পারে ৫০% বা ০.৫০ ফিটনেস।
সন্তানের দিক থেকে কিন্তু হিসেবটা একটু অন্যরকম। আবার ফিরে যাই সেই বাক্স, থলে আর বলের খেলায়। মনে করুন প্রথম থলেটা ছিল কালো। এবারে আমি বললাম, লাল থলের সব বলের রঙ আর নম্বর লিখে রেখে তাদের যার যার বাক্সে ফেরত দিয়ে দিতে। এবারে একটা সাদা থলে দিয়ে বললাম বাক্সগুলো ভাল করে ঝাঁকিয়ে আবার ৫০টা করে লাল বল আর নীল বল এবারে সাদা থলেতে ভরতে। এবারে বলুন তো, আমি এই সাদা থলে থেকে যদি একটা লাল বল তুলে দেখি তার গায়ের নম্বর ১০, কালো থলের বলের তালিকায় এই ১০ নম্বর লাল বলকে পাওয়ার সম্ভাবনা কত? প্রোবাবিলিটি থিওরি (Probability theory) বলে, এর উত্তর হল ২৫%। একইভাবে, যে কোনো একটি নীল বলের কালো ও সাদা থলেতে থাকার সম্ভাবনা ২৫%। এবারে যেহেতু লাল ও নীল বল একইসঙ্গে থলেতে ভরা হয়েছে, এই দুই বলের এক থলেতে থাকার সম্ভাবনা যোগ করে হয় ৫০% – অর্থাৎ কালো থলের সঙ্গে সাদা থলের মিল ৫০%। এবারে কালো থলে আর সাদা থলে যদি দিদি আর ভাই হয়? এই হিসেবে যে কোনো প্রাণীর সঙ্গে তার ভাইবোনদের জীনগত আত্মীয়তা (genetic relatedness) ৫০%, যদিও নিজের বেলায় এই সংখ্যাটা ১০০%। অতএব মা-বাবার কাছে সব সন্তান সমান হলেও, সন্তানের নিজের প্রতি পক্ষপাতের দাবি করাটাই স্বাভাবিক। Trivers সাহেব এই হিসেব মাথায় রেখেই দেখালেন যে parental care বা সন্তানের প্রতি মা-বাবার যত্ন কখনই অনন্তকাল চলতে পারেনা।
ধরে নেওয়া যাক এক ক্যারিবু বাছুরকে – মায়ের দুধ খেয়ে সে বড় হয় জন্মের পর, দুধ না পেলে সে বাঁচবে না, সুতরাং মায়ের এই ‘যত্ন’ তার কাছে খুবই প্রয়োজনীয়, অথবা বিবর্তনের হিসেবে দামী। সদ্যজাত ক্যারিবুর মা তাকে যদি দুধ না খাওয়ায়, তাহলে তার নিজের ক্ষতি, কারণ তার সন্তান হারালে বিবর্তনের খাতায় তার হিসেবে ০.৫০ ফিটনেস কমে যাবে। তাছাড়া একবার জন্ম দেওয়ার পরেই মায়ের আবার জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা থাকেনা, তার শরীরে যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করতে কিছুটা সময় লাগে। এই সময় তার সদ্যজাতকে যত্ন করলে মায়েরও লাভ, সন্তানেরও লাভ। তবে কিছুদিন পরেই সেই ক্যারিবু বাছুর নিজে খাবার জোগাড় করতে শেখে, এবং সেই সময় মা যদি তাকে দুধ না খাইয়ে নিজের তাকত বাড়ায়, তাহলে মায়ের লাভ, কারণ সে আর একজন সন্তানকে জন্ম দিয়ে আরও ০.৫০ ফিটনেস অর্জন করতে পারে। এখানেই শুরু হয় মতের অমিল, যার মূলে সেই হিসেবের তারতম্য। বাছুরের নিজের জন্য আয় ১.০, আর সম্ভাব্য ভাই বা বোনের জন্য আয় ০.৫০, কিন্তু মায়ের কাছে তো দুজনেই সমান। তাই মা দুধ খাওয়ানো বন্ধ করতে চাইলেও, বাছুর কিন্তু তা চাইবে না, সে চাইবে আরও কিছুদিন মা তাকে যত্ন করুক, অর্থাৎ দুধ খাওয়াক। আরো কিছুদিন বাদে, বাছুর আর একটু বড় হলে, সে নিজেও আর মায়ের কাছে এই যত্ন দাবি করবেনা, কারণ মা যদি তাকে দুধ খাইয়ে বেশি কাহিল হয়ে পড়ে, তাহলে হয়ত আর সন্তানের জন্ম দিতেই পারবেনা, যার ফলে ০.৫০ ক্ষতি হবে দুই পক্ষেরই। এই যে টানাপোড়েন, এর মেয়াদ খুব কম হলেও, মা ও সন্তানের সম্পর্কে এর যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। ট্রাইভার্সের তত্ত্ব মূলত দুধ খাওয়ানো নিয়ে মা ও সন্তানের দ্বন্দ্ব আলোচনা করলেও, এর পরিধি বহুব্যাপি। জীবনের বিভিন্ন স্তরে এই দ্বন্দ্ব দেখা যায়, বিভিন্নভাবে এর প্রকাশ ঘটতে পারে, এমনকি মানুষের ক্ষেত্রে অনেক সামাজিক প্রসঙ্গেও এই একই যুক্তি লাগিয়ে মানুষের ব্যবহারকে ব্যাখ্যা করা হয়। কিন্তু এই বিষয়ে বেশিরভাগ গবেষণাই হয়েছে তাত্ত্বিক পদ্ধতিতে, মডেলিং (modeling) ব্যবহার করে। সুতরাং কুকুর মায়ের তার বাচ্চাদের সঙ্গে সৎ-মা সুলভ আচরণের কথা শুনে আমার মাথায় এল যে এটা হয়ত পেরেন্ট-অফস্প্রিং কনফ্লিক্ট থিওরির প্রমাণ দিতে পারে।
কয়েকদিনের মধ্যেই সৃজনী চার-পাঁচটা কুকুর পরিবারের সন্ধান পেলো, যেখানে কুকুরছানারা প্রায় এক বয়সের, আর আমরা দেখলাম যে একাধিক মা কুকুর একইভাবে তাদের বাচ্চাদের সঙ্গে খাবার নিয়ে মারামারি করছে। সব ক্ষেত্রেই বাচ্চাদের বয়স দুমাসের একটু বেশি বা কম।ঠিক হলো, আমরা শুরু করবো একটা আনকোড়া এক্সপেরিমেন্ট – যার নাম দেওয়া হলো POC (parent-offspring conflict) পরীক্ষা। আমাদের উদ্দেশ্য একটাই, মা কুকুর আর তার বাচ্চাদের খাবার দিয়ে প্রতিযোগিতার সুযোগ করে দেওয়া, আর দেখা যে ওদের মধ্যে খাবারের জন্য প্রতিযোগিতা ঠিক কি ধরণের হয়। খাবার হিসাবে বেছে নেওয়া হল পাঁউরুটি বা বিস্কুট – ভারতের নেড়ী কুকুরদের যা নিত্য নৈমিত্তিক আহার! ঠিক হল, খাবার দেওয়া হবে কুকুরদের, প্রতি সপ্তাহে দুদিন করে, দিনে দুবার, সকালে আর দুপুরে। একটি পরিবারে মা আর বাচ্চা মিলিয়ে যতজ ন সদস্য, ঠিক তত টুকরো খাবার পাবে তারা, কিন্তু একসঙ্গে নয়, একটা টুকরো শেষ হলে পরেরটা ছুঁড়ে দেওয়া হবে তাদের দিকে। এমনভাবে দেওয়া হবে যাতে সবাই সমান সুযোগ পায় টুকরোটা পাবার। সবগুলো টুকরো খাওয়া হয়ে গেলে থামানো হবে পরীক্ষা। এভাবে কুকুরছানাদের ৮ থেকে ১৪ সপ্তাহ বয়েসে প্রতি সপ্তাহে চারবার করে করা হবে পরীক্ষা, আর পুরো কাজটাই রেকর্ড করে রাখা হবে ভিডিওতে। পুরো কাজ শেষ হলে তবেই সেই ভিডিও দেখে তথ্য (data) সংগ্রহ করা হবে, যাতে কোনোভাবেই পক্ষপাত (bias) না ঢুকে পড়ে আমাদের কাজে – এ হলো পশুপাখি নিয়ে কাজ করার পদ্ধতির নানান সাবধানতার মধ্যে একটি। পক্ষপাত বা Bias বলতে আমি কি বোঝাচ্ছি তা একটু খোলসা করে বলি। ধরুন যদি পরীক্ষা চলাকালীন ভিডিও দেখে স্পষ্ট হয় যে কোনো একটি মা একটু বেশি কাড়াকাড়ি করে খাবার খেয়ে নিচ্ছে, বা কোনো একটি কুকুরছানা একটু বেশি পিছিয়ে পড়ছে, তবে অবচেতনে থাকা “মানবিকতা” অনেক সময় কাজে বাধ সাধতে পারে, খাবার দেওয়ার সময় ঢুকে পড়তে পারে পক্ষপাত।
গোটা দুয়েক পাইলট এক্সপেরিমেন্ট চালালো সৃজনী। পাইলট যেমন বিমানকে সঠিক পথে চালান, তেমনই পাইলট এক্সপেরিমেন্ট করা হয় কোনো বড় কাজে হাত দেওয়ার আগে, যাতে পরিকল্পনায় কোনো ত্রুটি থাকলে তা শুধরে নেওয়া যেতে পারে মূল কাজ শুরুর আগে। সেই সময় আমাদের ল্যাবে নতুন আসা মানবীকেও লাগিয়ে দেওয়া হলো এই কাজে। কুকুরছানার কোনো অভাব নেই আমাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের কলকাতা (IISER) ক্যাম্পাসে, অভাব শুধু সময়ের। এই কুকুরছানারা বড় হয়ে গেলে আবার এক বছর অপেক্ষা করতে হবে এই কাজটা শেষ করার জন্য। আর হলও তাই – দুজনে মিলে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল টানা কাজ করেও পরীক্ষামূলক তথ্য পাওয়া গেল সাতজন মা আর তাদের বাচ্চাদের। কাজ যথেষ্ট ভালো হলেও, আরো এক বছর অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় রইলো না, কারণ সাতজন মায়ের থেকে তথ্য সংগ্রহ করে স্ট্যাটিসটিকাল অ্যানালিসিস (statistical analysis) চালিয়ে কিছু একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হলেও, তা বাঞ্ছিত নয়। পরের বছর আবার চললো কুকুর পরিবারদের নিয়ে গবেষণা, আর এবারে পাওয়া গেলো যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য। খুব খুশি হয়ে আমরা এবারে ওই পনেরোটি কুকুর পরিবারের ভিডিও থেকে তথ্য নিয়ে নামলাম সেগুলো কাটাছেঁড়া করার কাজে – অস্ত্র পরিসংখ্যান, আর অবশ্যই মগজাস্ত্র।
যা জানা গেলো, তাতে আমরা আহ্লাদে আটখানা। প্রথমদিকে মায়েরা খাবার দেখেও মুখ ফিরিয়ে থাকে, অথবা খাবার মুখে নিয়ে বাচ্চাদের দেয়, বসে বসে তাদের খাওয়া দেখে – যেন মাতৃত্বের আদর্শ নিদর্শন। কিন্তু যত বাচ্চারা বড় হতে থাকে, তত দেখা যায় মা-সুলভ এই ব্যবহারের অভাব। তখন মাঝেমাঝেই আগেভাগে খাবারে ভাগ বসাতে ছুটে যায় মা, অনেক সময় বাচ্চাদের মুখ থেকে কেড়ে নেয় খাবার, খেঁকিয়ে ওঠে ছুটে আসা বাচ্চাদের। ১২-১৩ সপ্তাহের কুকুরছানারা প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠে না এই পালটে যেতে থাকা মারমুখী মায়ের সঙ্গে। মায়ের এই দুই ধরনের ব্যবহারকে আমরা নাম দিলাম “সহযোগিতা” (cooperation) আর “সংঘাত” (conflict)। দেখা গেল যে পনেরোজন মায়ের মধ্যে বিশেষ কোনো হেরফের হয় না, বাচ্চাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে। এমনকি litter size, অর্থাৎ কার ক-জন বাচ্চা তার ওপরেও নির্ভর করে না মায়ের খাবার কেড়ে নেওয়ার প্রবণতা। এটা ধরে নেওয়া স্বাভাবিক যে একজন বাচ্চাকে যে দুধ খাওয়ায়, তার চেয়ে চারজন বাচ্চাকে যে দুধ খাওয়ায় তার খিদে বেশি, আর সেই কারণে তার সংঘাতের প্রবণতাও বেশি হওয়ার কথা। বাচ্চাদের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা litter size এর সঙ্গে বাড়লেও, মায়ের “সংঘাত” কিন্তু এসবের ধার ধারে না। আমাদের তথ্য দেখে বোঝা গেল যে মায়েরা ‘ইচ্ছেমত’ খাবারে ভাগ বসায়, যতজন ক্ষুধার্ত বাচ্চাই তাদের মুখ চেয়ে থাকুক না কেন। শুধু তাই নয়, বাচ্চাদের দুধ খাইয়ে উত্তরোত্তর রোগা হতে থাকা কুকুর মায়েরা এই পরীক্ষার সময়টুকুর মধ্যে দিব্যি স্বাস্থ্য ফিরে পায়। এমন মাকে স্বার্থপর ছাড়া আর কি বলা যায়?
সুতরাং আমাদের কাজ দিয়ে আমরা প্রমাণ করলাম যে, কুকুর মা আর তার সন্তানদের মধ্যে রয়েছে এক বিবর্তনীয় দ্বন্দ্ব, এবং এই দ্বন্দ্বের ফলে বাচ্চাদের একটা বয়সের পরে মা যে শুধু তাদের দুধ খাওয়াতেই নারাজ তা নয়, তাদের মুখের খাবার কেড়ে নিতেও সে পিছপা হয় না। এর ফলে মা কিছুদিনের মধ্যেই স্বাস্থ্য ফিরে পায়, তৈরী হয় আর একবার মা হওয়ার জন্য। আপাতদৃষ্টিতে এতে বাচ্চাদের ক্ষতি হলেও, বিবর্তনের হিসেবের খাতায় এতে উভয় পক্ষের লাভই হয়। সুতরাং আমাদের কালু আপাতত যতই ভালো মা হোক না কেন, অচিরেই তার সৎ-মা সুলভ আচরণ যে শুরু হবে, সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। মজাটা হল যে, কুকুর মায়েরা যখন তাদের বাচ্চাদের সঙ্গে খাবার নিয়ে মারামারি আরম্ভ করে, তখন মানুষ খুবই বিরক্ত হয়, আর তার ফলে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আদর করে খেতে দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে মায়েদের হাতে কয়েক সপ্তাহ সময় থাকে, যখন তারা আর দুধ খাওয়ায় না, বাচ্চারা যথেষ্ট বড় না হয়ে যাওয়ার ফলে মানুষ তাদের আদর করে খেতে দেয় এবং সেই খাবারে তারা ভাগ বসিয়ে নিজেদের স্বাস্থ্য ফেরাতে পারে। কয়েক হাজার বছর ধরে মানুষের সাথে তাল মিলিয়ে বিবর্তিত হতে হতে এই সময়টুকুর সদব্যবহার করতে শিখে গেছে কুকুর-মায়েরা।
লেখার উৎস ও আরও কিছু খুঁটিনাটি
[১] ভিডিও: https://www.youtube.com/watch?v=_WpeuPjhWGo
[২] অন্য মিডিয়া কভারেজ: https://www.scimex.org/newsfeed/selfish-bitch!-mummy-dogs-pinch-food-from-pups