প্রকাশিত হল বিজ্ঞান পত্রিকা-র পঞ্চম সংখ্যা। সেই সাথেই এই পত্রিকা পার করে এল একটি বছর। ‘বিজ্ঞান’ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত লেখাগুলির মধ্যে থেকে বাছাই করা কিছু লেখার সংকলন এই পত্রিকা। অনলাইনে প্রকাশ হয় প্রিন্ট-রেডি PDF ফরম্যাটে। এই সংখ্যা থেকে মোবাইল ফোনে পড়ার সুবিধের জন্য আমরা পত্রিকাটি ই-বুক ফরম্যাটেও প্রকাশ করলাম।
‘বিজ্ঞান পত্রিকা’-র সাফল্য আমাদের নতুন করে উৎসাহ জুগিয়েছে। গত একবছরে প্রকাশিত এই পত্রিকার চারটি সংখ্যা মোট ছয় হাজারের বেশি বার ডাউনলোড হয়েছে। এই পত্রিকার হাত ধরে আমরা অনেক পাঠকের কাছে পৌঁছতে পেরেছি। যখন জানতে পারি যে মফঃস্বল ও গ্রামের বিভিন্ন স্কুলে – যেমন এগরা, হলদিয়া, পাহাড়হাটি, সাগরদ্বীপের মত জায়গায় – ছাত্রছাত্রীদের কাছে ‘বিজ্ঞান পত্রিকা’র লেখা পৌঁছচ্ছে স্কুলের মাধ্যমে, তখন মনে হয় আমাদের পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হয়েছে। ‘বিজ্ঞান’ ওয়েবসাইট আর ‘বিজ্ঞান পত্রিকা’-র হাত ধরে এমনভাবেই আধুনিক বিজ্ঞানের জগৎ বাঙালীদের কাছে মাতৃভাষায় ধরা দিক।
‘বিজ্ঞান পত্রিকা’-র পঞ্চম সংখ্যাটি প্রকাশিত হচ্ছে ভারতের শিক্ষক দিবসে, অর্থাৎ ৫-ই সেপ্টেম্বরে। এর কয়েকটি তাৎপর্য আছে। আড়াই বছর আগে যখন ‘বিজ্ঞান’-এর পথচলা শুরু হয়েছিল, তখন আমাদের লক্ষ্য ছিল স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের কাছে উন্নতমানের বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা পৌঁছে দেওয়া। ধীরে ধীরে আমরা জানতে পারি, যে আমাদের পাঠকদের মধ্যে একটা বড় অংশ হলেন বিভিন্ন স্কুলের মাষ্টারমশাই। এতে আমাদের উৎসাহ অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছে – কারণ মাষ্টারমশাইরা উৎসাহিত হলে তাঁরাই লেখাগুলো পৌঁছে দেবেন ছাত্রছাত্রীদের কাছে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে আমাদের অনুরোধ, আপনারা আপনাদের অঞ্চলের স্কুলগুলোতে ‘বিজ্ঞান’-এ প্রকাশিত লেখাগুলো আরও বেশি করে পৌঁছে দিন। সেই সাথে প্রশ্ন পাঠান আমাদের ‘পাঠকের দরবার’ বিভাগের জন্য (ইমেইল ঠিকানা – [email protected])। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কোন বিজ্ঞান সেমিনারের আয়োজন করলে তার সম্বন্ধেও আমাদের জানান।
দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে বেশিরভাগ স্কুল মাষ্টারমশাইরা আধুনিক গবেষণার জগতের সাথে বিশেষ যোগাযোগ রাখার সুযোগ পান না। বিজ্ঞানে উন্নত দেশগুলিতে বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলি চেষ্টা করে যাতে তাদের গবেষণার খবর সমাজের সবার কাছে, বিশেষত স্কুলপড়ুয়াদের কাছে পৌঁছে যায়। তাই তারা নিয়ম করে বিভিন্ন স্কুল থেকে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষিকা-শিক্ষকদের নিমন্ত্রণ করে থাকে গবেষণাগার পরিদর্শনের জন্য। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই বছরের অন্তত একটি দিন বরাদ্দ থাকে public outreach বা জনসংযোগের জন্য। কিছু প্রতিষ্ঠানে বেশ কিছু দিন ধরে স্কুল শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জন্য ওয়ার্কশপ চলতে থাকে, যার দায়িত্বে অনেকসময়েই থাকেন বিশ্বসেরা কোন বিজ্ঞানী। উদাহরণ স্বরূপ, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (MIT)-র Teaching Opportunities in Physical Science বা TOPS ওয়ার্কশপ-এর উল্লেখ করা যেতে পারে।
শুধু তাই নয়, এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে নিয়ম করে জানানো হয় বিভিন্ন আবিষ্কারের খবর – সহজ সরল ভাষায় যাতে সাধারণ পাঠক বুঝতে পারে যে তাদেরই দেওয়া করের টাকা গবেষকরা কীভাবে খরচ করছেন। অবশ্যই এখানে কেউই আশা করবেন না, যে একদল বিজ্ঞানী গভীর গবেষণার মধ্য দিয়ে যা আবিষ্কার করেছেন তার সব একজন স্কুলশিক্ষক বা পড়ুয়া একদিনের পরিদর্শনে বুঝে যাবে। কিন্তু, এই ধরণের জনসংযোগ স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও পড়ুয়াদের উৎসাহ অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের দেশেও কিছু গবেষণাগার এমন জনসংযোগের কাজ করে থাকে, যেমন মুম্বইয়ের হোমি ভাবা সেন্টার ফর সায়েন্স এডুকেশান (HBCSE) শিক্ষা প্রদানের পদ্ধতি সম্বন্ধে অনেক গবেষণা এবং ওয়ার্কশপ করে। যে কোন শিক্ষক তাদের কাছ থেকে ট্রেনিং নিতে পারেন। যাদবপুরের Indian Association for the Cultivation of Science (IACS) বহু বছর ধরে ‘সামার স্কুল’-এর আয়োজন করে আসছে সদ্য উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞান পড়তে উৎসাহিত করার জন্য। কিম্বা, IUCAA-র SciPop প্রোগ্রামটি, যার মাধ্যমে এই রিসার্চ ইনস্টিটিউট-টি তাদের গবেষণার কথা জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেয়। কিন্তু এই ধরণের উদ্যোগ সংখ্যায় কম, আর অনেক ক্ষেত্রেই এর সুফল বড় শহরাঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকে। শুধু তাই নয়, আমাদের দেশের গবেষণাগারে কী নতুন গবেষণা হল, তা গবেষণাগারগুলির ওয়েবসাইটে সহজ করে আঞ্চলিক ভাষায় লেখাও হয়না। যা লেখা হয়, সেটা ইংরেজিতেই সীমিত থেকে যায়।
আমরা আশা করব, ‘বিজ্ঞান’ এই অভাব আংশিকভাবে পূরণ করতে পারবে। আমাদের বেশিরভাগ লেখাই সদ্য আবিষ্কৃত বিষয়ের উপর, এবং বেশিরভাগ লেখকেরই সেই বিষয়ের গবেষণার সাথে প্রত্যক্ষ যোগ আছে। ‘বিজ্ঞান’-এর প্রতিটা লেখা peer review পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যায়, সেখানে অন্তত তিনজন সম্পাদক ও বিশেষজ্ঞ লেখার বৈজ্ঞানিক ও ভাষাগত গুণমান যাচাই করেন। এমনকি, লেখক তালিকায় সম্পাদকমণ্ডলীর এক বা একাধিক সদস্য থাকলেও এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয় না।
শিক্ষক দিবসে এই সংখ্যা প্রকাশের আর এক তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া যাবে এই সংখ্যার লেখাগুলির মধ্যে। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আবিষ্কারের উপর একটি প্রবন্ধ এই সংখ্যার মূল আকর্ষণ। কিন্তু, এর সাথে শিক্ষক দিবসের যোগ কোথায়?
মহাকর্ষীয় তরঙ্গ, যা আইনস্টাইন একশো বছর আগে অঙ্ক কষে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, বিজ্ঞানীরা সেটা খোঁজার চেষ্টা করে চলেছেন গত পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে। অবশেষে বহু বিজ্ঞানীর সহযোগিতায় তৈরি ‘লাইগো’ যন্ত্রে ধরা পড়ে একশ তিরিশ কোটি বছর আগে মহাকাশের সুদূর প্রান্তে দুটি ব্ল্যাকহোলের ধাক্কায় তৈরি হওয়া কম্পন! এই যন্ত্রটির ধারণা দেন MIT-র বিজ্ঞানী রাইনার ওয়াইস। ১৯৬৭ সালে তাঁকে পদার্থবিদ্যা বিভাগ থেকে দায়িত্ব দেওয়া হয় আইনস্টাইনের সাধারণ অপেক্ষবাদ (general relativity) পড়ানোর জন্য। কিন্তু, তিনি তো এই বিষয়ের গবেষকই নন! রাইনার তাও চ্যালেঞ্জটা লুফে নিলেন। ভাবতে থাকলেন, কী পরীক্ষা করলে সাধারণ অপেক্ষবাদের অন্যতম ভবিষ্যদ্বাণী এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ মাপা যেতে পারে? একটি পরীক্ষার নকশা করে ছাত্রছাত্রীদের হোম ওয়ার্ক প্রবলেমে ঢুকিয়ে দিলেন। সেই নকশাই পরবর্তীকালে জন্ম দিল ‘লাইগো’-র। বিজ্ঞানের এত বড় একটা মাইলফলকের আদিতে ছিল এক শিক্ষকের জেদ আর একটা হোম ওয়ার্ক!
আরেকটা লেখা হল আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্সের জনক বলে পরিচিত সদ্য প্রয়াত মার্ভিন মিন্সকি-কে নিয়ে। ইনি একজন বহুল প্রতিভাধর মানুষ – তৈরি করেছেন কনফোকাল মাইক্রোস্কোপ যা জীববিদ্যার জগতে বিপ্লব এনে দিয়েছে। মার্ভিন গভীরভাবে ভাবনা চিন্তা করেছেন আমরা কীভাবে শিখি সেই পদ্ধতি নিয়ে। তাঁর সাহচর্যে MIT Media laboratory-তে গবেষণা করেছেন অনেক ছাত্রছাত্রী যারা আজ কম্প্যুটার সায়েন্স ও আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্সের জগতের সেরা গবেষক। ঐ ল্যাবরেটরীরই এক বর্তমান গবেষক মার্ভিন মিনস্কিকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন ‘বিজ্ঞান’-এর পাতায়।
এই সংখ্যার অন্য লেখাটি একটা অতি সাধারণ বস্তু নিয়ে – বালি! বিজ্ঞানীদের বহুদিন ধরেই ধন্ধে ফেলেছে এই আপাত সহজ বস্তুটি। এমনকী বালি কঠিন না তরল, সে নিয়েও ঝামেলা! এই লেখার শেষে আমরা রাখছি একটা প্রোজেক্টের সম্ভাবনা। বালি নিয়ে এই প্রোজেক্টটি বিভিন্ন স্তরের ছাত্রছাত্রী দিয়ে করানো যায় – স্কুল থেকে কলেজে। আশা করি, স্কুল বা কলেজের কোন শিক্ষক তাদের স্কুল বা কলেজের বিজ্ঞান প্রদর্শনীর জন্য এই প্রোজেক্টটি করাবেন। সফল হলে ‘বিজ্ঞান’-এর ইমেইলে ([email protected]) জানাতে ভুলবেন না!
এই শিক্ষক দিবসে বিশ্বের সকল শিক্ষককে আমরা শ্রদ্ধা জানাই।