বন জঙ্গল থেকে সুসভ্য সমাজে পদার্পণ করার সময় মানুষ অনেক কিছুই শিখেছে। পরিষ্কার পরিছন্ন থাকার ইচ্ছে তাদের মধ্যে অন্যতম। পরিষ্কার থাকলে রোগ হয় কম, মন মেজাজ তাজা থাকে। শরীর, চুল, জামাকাপড় এমনকি বাসনপত্র সাফ করার জন্য একটি প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত উপকরণ হল সাবান। এটা ঠিক, শ্যাম্পু কিংবা ডিটারজেন্ট সাবান নয়, কিন্ত দুটি জিনিসের পিছনেই রসায়ন শাস্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অথচ সহজ তত্ত্ব লুকিয়ে আছে:
“Like dissolves like”
সাবান-ডিটারজেন্ট-শ্যাম্পু ইত্যাদি কেমন করে পরিষ্কার করতে সাহায্য করে, এটি বোঝার আগে বুঝতে হবে ময়লা কী। আর বুঝতে হবে ময়লা নিজে থেকেই জলে মেশে না কেন। যদিও ময়লা জৈব (organic) এবং অজৈব (inorganic), দু’প্রকারেরই হতে পারে, আমরা গতানুগতিক ভাবে ময়লা বলতে যা বুঝি, তা জৈব এবং অজৈব পদার্থের মিশ্রণ। আমাদের দেহ (প্রোটিন, ফ্যাট), আমাদের কাপড় (সেলুলোজ ), রান্নার তেল (ফ্যাট এবং ফ্যাটি অ্যাসিড) — এ সবই জৈব পদার্থ দিয়ে তৈরী। এই জৈব উপাদানগুলির জলের প্রতি বিকর্ষণের (hydrophobic nature) জন্য শরীর-নিষ্কৃত বর্জ্যপদার্থ, কাপড়ে আটকে থাকা ময়লা, কিংবা বাসনের গায়ে তেলচিটে দাগ প্রচণ্ড ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকে নিজেদের অবস্থান। অন্যদিকে খাঁটি অজৈব ‘ময়লা’, যেমন সোনালী বালি জলকে বিকর্ষণ করে না। তাই সোনালী বালি না ময়লা করে, না অপ্রয়োজনীয় ভাবে চিটে থাকে। ঝেড়ে দিলেই সাফ!
আণবিক স্তরে, জলের ময়লার প্রতি কিংবা ময়লার জলের প্রতি আকর্ষণশক্তির চেয়ে উভয়ের নিজেদের প্রতি বেশি আকর্ষণশক্তি। তাই জলের অণু খুশি জলের অণুর সাথে, ময়লার অণু খুশি নিজের বা অন্য জৈব পদার্থের অণুর সাথে। জল দিয়ে ময়লা ধুয়ে ফেলতে হলে জলের সাথে ময়লার অণুর আকর্ষণ বাড়াতে হবে। সরাসরি ভাবে এই আকর্ষণ বাড়ানো কঠিন। তবে জলের অণুর নিজের প্রতি আকর্ষণ কমাতে পারলে পরোক্ষভাবে ময়লার প্রতি জলের আকর্ষণ শক্তি বাড়ানো যেতে পারে।
সাবান জাতীয় রাসায়নিক পদার্থগুলিকে সার্ফেকট্যান্ট (Surfactant) বলা হয়। এরা জলের নিজের অণুর প্রতি আকর্ষণ কমিয়ে দিতে পারে। সার্ফেকট্যান্ট নামের উৎপত্তি সারফেস অ্যাকটিভ এজেন্ট (surface active agent) থেকে। জলে সার্ফেকট্যান্ট মেশালে জলের অণুর কমে আসা আকর্ষণের জন্য জলের পৃষ্ঠটান (surface tension) কমে যায়। একটি ছোট পরীক্ষা করে এটা প্রমাণ করা যায়। একটা কাচের গ্লাসে জল নিয়ে আস্তে করে একটি আলপিন জলের উপরে রাখলে উপরের ছবির মত আলপিনটা ভাসতে থাকে। এর আসল কারণ হলো, জলের পৃষ্ঠটান ঐ আলপিনের ওজন ঠেকাতে সক্ষম। এখন এই পরীক্ষাটি যদি সাবানগোলা জলে করা হয়, তাহলে অনেক কষ্ট করেও আলপিনটাকে ভাসিয়ে রাখা যায় না। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, জলের কমে যাওয়া পৃষ্ঠটান (surface tension) আলপিনের ওজন ঠেকাতে পারে না। ময়লার অণুগুলিকে এই আলপিনের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। সাবান বা ডিটারজেন্টগোলা জলে যেমন আলপিন আর ভাসতে পারে না, ঠিক তেমনি ময়লা আর জামাকাপড়ের সাথে আটকে থাকতে পারে না।
জলের এই পরিবর্তন আনার জন্য কতটা সাবান বা ডিটারজেন্ট প্রয়োজনীয়? এক বালতি জলে এক চামচ সাবান? নাকি এক মুঠো? নাকি এক কিলোগ্রাম? সাবান বা ডিটারজেন্টের আণবিক গঠনে একটি মিল আছে — এদের একটি মাথা এবং একটি লেজ আছে, যেমন দেখানো হয়েছে ছবি ২-এর বাম দিকে। সাধারণত মাথাটা হাইড্রোফিলিক (hydrophilic), অর্থাৎ মাথাটার জলের অণুগুলির প্রতি আকর্ষণ প্রবল। লেজটা আবার হাইড্রোফোবিক (hydrophobic), অর্থাৎ লেজটা জলকে একেবারেই পছন্দ করে না। সাবান বা ডিটারজেন্টের কার্যক্ষমতা জলে তাদের ঘনত্বের (concentration) উপর নির্ভরশীল। সাবানের অণুর ঘনত্ব একটা বিশেষ ঘনত্বের (একে ক্রিটিক্যাল মাইসেল ঘনত্ব বা CMC বলা হয়) নিচে হলে, অণুগুলির মধ্যে মিথোষ্ক্রিয়া
(interaction) না হওয়ায় অণুগুলি জলে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু ঘনত্ব CMC-র উপরে পৌঁছলেই দ্রুত এরা নিজেদেরকে গোলকাকারে সাজিয়ে নেয়। এই গোলকাকারের সৃজনকে বলে মাইসেল (micelle), যেমন দেখানো হয়েছে ছবি ২-এর মাঝখানে। এই মাইসেল এমন ভাবে তৈরী হয়, যাতে হাইড্রোফিলিক মাথাটা বাইরের দিকে, অর্থাৎ জলের সংস্পর্শে থাকে। ফলে, হাইড্রোফোবিক লেজটি জলকে এড়িয়ে থাকতে সক্ষম হয়। আমরা সবাই জানি যে জল ও তেল একে অপরের সাথে মেশে না। অতএব, অনুমান করা যেতে পারে যা জলে মেশে না তা তেলে মিশবে। আবার যা তেলে মেশে না তা জলে মিশবে। কাজেই এই একই সাবান বা ডিটারজেন্ট তেলে গুললে, হাইড্রোফোবিক লেজটি বাইরের দিকে আর হাইড্রোফিলিক মাথাটা ভেতরের দিকে থাকে —এর ফলে যে বিশেষ সৃজন তৈরী হয় যাকে বলে inverse micelle, যেমন দেখানো হয়েছে ছবি ২-এর ডানদিকে।
সাবান বা ডিটারজেন্টের এই দ্বৈত চরিত্রকে কাজে লাগিয়ে জল দিয়ে সহজেই বিভিন্ন জিনিস পরিষ্কার করা যায়। যেমন দেখানো হয়েছে ছবি ৩-এ, ধরা যাক একটা সুন্দর সবুজ জামায় চিটচিটে বাদামী রঙের জৈব ময়লা লেগে আছে। অনেক কষ্ট করেও শুধু জল দিয়ে তা ধুয়ে ফেলা যাচ্ছে না। এবার ধরা যাক জলে খানিক সাবান গুলে দেওয়া হল। এই ময়লার প্রতি জলে গোলা সাবানের অণুর লেজের আকর্ষণ প্রবল। তাই ময়লাটা সাবানের অণুর সাথে সহজেই আটকে যায়। অন্য দিকে জলের অণু আবার সাবানের অণুর মাথাকে আকর্ষণ করে। ‘কান টানলে মাথা আসে‘, তাই জল সহজেই এই মাথায় ‘টান মেরে‘ লেজে আটকে থাকা ময়লাকে কাপড় থেকে তুলে ফেলে। এরপর এই ময়লাগোলা জল ধুয়ে ফেললেই কাপড় এক্কেবারে সাফ!
সার্ফেকট্যান্ট শুধু ময়লা সাফ করতেই ব্যবহার হয় না। এই মাইসেলের মধ্যে এই সীমিত জায়গায় অনেক রকম রাসায়নিক পরিবর্তনও ঘটানো যায়। তবে সে গল্প বলব পরের বার!
khub sundor