এর আগে ‘বিজ্ঞান’-এ প্রকাশিত ‘জীবাণুদের যত কথা’ ধারাবাহিকে ব্যাকটেরিয়া কোষের বাহ্যিক গঠন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। আজকের এই লেখাতে আমি ব্যাকটেরিয়ার কোষের ভেতরের গঠন নিয়ে আলোচনা করতে চাই। কোষ-প্রাচীর, কোষ-পর্দা, এসব পার হয়ে ব্যাকটেরিয়ার অন্দরমহল অর্থাৎ কোষ-রসের ভিতরে কি হচ্ছে, সেই গোপন খবর ভাগ করে নিতে চাই বিজ্ঞানের সকল পাঠকের কাছে।
ব্যাকটেরিয়ার কোষ-রসের আপাত বিশেষত্বের অভাব থেকেই ব্যাকটেরিয়াকে বলা হয় “ব্যাগ অফ এনজাইমস্” (Bag of Enzymes)। অর্থাৎ, উৎসেচক দিয়ে ভর্তি শুধুমাত্র একটা থলে। কিন্তু বিগত কয়েক দশক ধরে জীববিজ্ঞানীরা অনুবীক্ষণ যন্ত্রে চোখ রেখে অনেকটা কবিগুরুর সেই পরশপাথর-খোঁজা খ্যাপার মত এই বিশেষত্বহীনতার ছাই উড়িয়ে চলেছেন। জুটেওছে কিছু নতুন রত্ন-পাথর, যার পরশে ব্যাকটেরিয়া কোষ ঝলমলিয়ে উঠেছে তার অন্দরমহলের জৌলুসে। বিজ্ঞানীরা বুঝতে শুরু করেছেন যে সাদাসিধে দেখতে ব্যাকটেরিয়ার অন্দরমহলেও চলছে জটিল জৈবক্রিয়া। এর ফলে ব্যাকটেরিয়ার জীববিদ্যা সম্পর্কে প্রচলিত ধারনা নিয়ে নতুন করে ভাবা শুরু হয়েছে। তেমনই একটি জৈবক্রিয়া, জিনগত তথ্যের আদান-প্রদান, নিয়ে এই কাহিনী।
তথ্যের একমুখী প্রবাহ: ডিএনএ → আরএনএ → প্রোটিন
শুরুতেই পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, “জিনগত তথ্য” বলতে আমরা ঠিক কি বুঝি? আমরা জানি যে জীবের গঠনগত ও কার্যকরী একক হল “কোষ”। কোষের গঠন, কাজ, এবং ক্রমবিকাশের যাবতীয় তথ্যকে এখানে আমরা জিনগত তথ্য (Genetic Information) হিসেবে চিহ্নিত করছি। এই জিনগত তথ্য জমা থাকে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা সংক্ষেপে ডিএনএ-র (DNA) মধ্যে। কিন্তু এই তথ্য অনুযায়ী কোষের যাবতীয় কাজকর্ম সম্পাদন করে থাকে প্রোটিন (Protein) অণুরা। জিনগত তথ্য DNA থেকে প্রথমে রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা আরএনএ (RNA), তারপর RNA থেকে প্রোটিনে সঞ্চারিত হয়। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, জিনগত তথ্যের এই একমুখী প্রবাহ জীববিজ্ঞানের সর্বত্র সত্যি। একেই “আণবিক জীববিদ্যার মূল মতবাদ” (Central Dogma of Molecular Biology) বলা হয়ে থাকে।
এই DNA থেকে RNA হয়ে প্রোটিনে তথ্য প্রবাহ দুটো ধাপে হয়ে থাকে।
১। প্রতিলিপিকরণ বা Transcription – DNA আর RNA দুটিই হলো নিউক্লিক অ্যাসিড। তথ্যপ্রবাহের প্রথম ধাপে এক নিউক্লিক অ্যাসিড থেকে আরেক নিউক্লিক অ্যাসিড-এ জিনগত তথ্য সঞ্চারিত হয় [১]। এই ধাপটি হল প্রতিলিপিকরণ বা Transcription।
২। অনুবাদ বা Translation – প্রোটিন কিন্তু নিউক্লিক অ্যাসিড দিয়ে তৈরী নয়, বরং প্রোটিনের গঠনগত একক হলো অ্যামিনো অ্যাসিড। DNA-র ভাষার [১] প্রতিটি শব্দ-পিছু প্রোটিনে একটি করে অ্যামিনো অ্যাসিড রয়েছে। তথ্যপ্রবাহের দ্বিতীয় ধাপটিতে নিউক্লিক অ্যাসিড (RNA) থেকে জিনগত তথ্য অ্যামিনো অ্যাসিড-এর ভাষায় সঞ্চারিত হয়। এই ধাপটি হল অনুবাদ বা Translation।
দুটো ধাপকে যখন আলাদা করে চেনা গেল
বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ক্রিক, যাকে আমরা অনেকেই DNA-র ডাবল হেলিক্স গঠনসজ্জার একজন আবিষ্কর্তা হিসেবে চিনি, ১৯৫৮ সালে একটি প্রবন্ধে জিনগত তথ্যের আদান-প্রদান সম্পর্কে “আনবিক জীববিদ্যার মূল মতবাদ”-টি প্রস্তাব করেন [২]। কিন্তু, তথ্যপ্রবাহের দুটি ধাপ ও তাদের পরিচয় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা সেই প্রবন্ধে পাওয়া যায় না। এই বিষয়ে প্রথম আলোকপাত করেন ১৯৬১ সালে বিজ্ঞানী ফ্রাঁসোয়া জাকব এবং জাক মোনো-র যুগান্তকারী গবেষণা [৩]। জাকব-মোনো প্রস্তাব করেন যে DNA থেকে প্রোটিনে জিনগত তথ্যের প্রবাহ একটি chemical intermediate বা রাসায়নিক মধ্যমের দ্বারা সংঘটিত হয়। এই রাসায়নিক মধ্যমকে তারা মেসেঞ্জার (messenger) অর্থাৎ “তথ্যবাহক” নাম দেন। একেই আধুনিক জীববিদ্যায় মেসেঞ্জার (Messenger) RNA বা mRNA নামে ডাকা হয় [৪]।
“আণবিক জীববিদ্যার মূল মতবাদ”-এর দুই ধাপ “ট্রান্সক্রিপশন” আর “ট্রান্সলেশন” এর জন্ম এখানেই। এক্ষত্রে বলে রাখা দরকার যে, DNA থেকে RNA তৈরী হয়, সেই তথ্যটির আবিষ্কর্তা কিন্তু জাকব-মোনো নন। এই আবিষ্কারটা আগেই হয়ে গেছিল। ১৯৫৬ সালে বিজ্ঞানী কেন ভল্কিন এবং ল্যারি অস্ট্রাচেন প্রথমবার লক্ষ্য করেন যে ভাইরাস দ্বারা একটি ব্যাকটেরিয়াকে সংক্রমিত করলে, ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে সেই ভাইরাসের DNA থেকে নতুন কিছু RNA তৈরী হয় [৫]। তবে এই RNA-ই যে জিনগত তথ্যপ্রবাহের পথে DNA এবং প্রোটিন এর অন্তর্বর্তী মধ্যম, তা তখন জানা ছিল না। সেই কৃতিত্বের দাবিদার হিসেবে কিন্তু জাকব আর মোনো-র নামই থাকবে।
কিন্তু ব্যাকটেরিয়ার বেলায় কি হয়
জিনগত তথ্যের প্রবাহে, কোষের ভিতরের গঠন কেমন, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ, জিনগত তথ্য-সমৃদ্ধ DNA থাকে কোষের কেন্দ্র নিউক্লিয়াস (Nucleus)-এর মধ্যে। এই নিউক্লিয়াসকে ঘিরে গোটা জীবজগতকে দুটো ভাগে ভাগ করা হয়েছে: “প্রোক্যারিওট”(Prokaryote) আর “ইউক্যারিওট”(Eukaryote) বা এভাবে ভাবা যেতে পারে, আদি আর আধুনিক। “ইউক্যারিওটিক কোষ”-এ এই DNA-সমন্বিত নিউক্লিয়াস একটি পর্দার মধ্যে থাকে। পর্দাটা নিউক্লিয়াসকে কোষ-রসের বাকি উপাদানের থেকে পৃথক করে রাখে। কিন্তু “প্রোক্যারিওটিক সেল” বা “আদি কোষ”-এর ক্ষেত্রে এই পর্দাটি অনুপস্থিত। ব্যাকটেরিয়া এই “প্রোক্যারিওট” গোষ্ঠীতে পড়ে।
কোষের মধ্যে তথ্যের আদান-প্রদানে কোষ পর্দার বিশেষ তাৎপর্য্য রয়েছে। ইউক্যারিওটিক কোষে তথ্য-প্রবাহের যে দুটি ধাপ আছে তার মধ্যে প্রথমটি, অর্থাৎ ট্রান্সক্রিপশন, হয় পর্দার আড়ালে নিউক্লিয়াসের মধ্যে। নিউক্লিয়াসের মধ্যে DNA থেকে RNA তৈরী সম্পন্ন হলে (চিত্র ১.A) সেই RNA নিউক্লিয়াসের পর্দার বাইরে বেরিয়ে আসে। নিউক্লিয়াসের বাইরে সাইটোপ্লাজম-এর মধ্যে মূল অনুবাদযন্ত্র বা ট্রান্সলেশন-মেশিন রাইবোজম (Ribosome)-এর সাহায্যে এই RNA থেকে তৈরী হয় প্রোটিন (চিত্র ১.B)। প্রোক্যারিওট গোষ্ঠীভুক্ত ব্যাকটেরিয়ার এই নিউক্লিয়াসের পর্দাটাই নেই। তাহলে কি ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে তথ্যপ্রবাহের দুটি ধাপ একই স্থানে সংঘটিত হয় ?
আজ থেকে প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে ঠিক তেমনই একটি প্রস্তাব করেন জীববিজ্ঞানী গুন্থার স্টেন্ট। ১৯৬৪ সালে “সায়েন্স” পত্রিকার একটি প্রবন্ধে জাকব-মোনো-র গবেষণা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন যে ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে ট্রান্সক্রিপশন-এর সাথে ট্রান্সলেশন-এর একটি পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে [৬]। দুটি ধাপ আলাদা আলাদা ভাবে না হয়ে, ট্রান্সক্রিপশন চলাকালীন অসম্পূর্ণ mRNA থেকেই প্রোটিন প্রস্তুত শুরু হয়ে যায়। ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে নিউক্লিয়াসের পর্দাটির অনুপস্থিতির জন্যই এমনটা সম্ভব। এই প্রস্তাবনা থেকেই উৎপত্তি হয় co-transcriptional translation শব্দটির। তবে এটাকে প্রমাণ করার জন্য ব্যাকটেরিয়ার অন্দরমহলে উঁকি মারার দরকার পড়লো।
চাই ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ
ব্যাকটেরিয়ার কোষের অন্দরমহলে অনুসন্ধান পর্বে সাধারণ অণুবীক্ষণ যন্ত্রের বিশেষ মূল্য নেই কারণ আকারে ব্যাকটেরিয়া অত্যন্ত ছোট। ব্যাকটেরিয়ার মাপ সাধারণত ৫০০ থেকে ৫০০০ ন্যানোমিটারের মধ্যে ( ১ ন্যানোমিটার = ১০-৯ মিটার )। সাধারণ অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ব্যবহার হয় “দৃশ্যমান” আলোকরশ্মি। তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সীমাবদ্ধতার জন্য “দৃশ্যমান” আলোকরশ্মিতে ২০০ ন্যানোমিটার-এর চেয়ে ছোট কোনো গঠনগত বিশেষত্ব দেখা সম্ভব নয়। তাই সাধারণ অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়াদের দেখা সম্ভব হলেও, তাদের ভিতরের গঠনসজ্জা নাগালের বাইরেই থাকে।
ব্যাকটেরিয়ার গঠনসজ্জা মূল্যায়নের মূল মাধ্যম হলো ইলেক্ট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্র (Electron Microscope)। “ইলেক্ট্রন”-এর ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের জন্য, ১৯৩১ সালে আবিষ্কৃত ইলেক্ট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে প্রায় ১ ন্যানোমিটার মাপের গঠনসজ্জা দেখা সম্ভব হয়।
হাতেনাতে প্রমাণ
এই ইলেক্ট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের হাত ধরেই ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে ট্রান্সক্রিপশন আর ট্রান্সলেশন-এর পারস্পরিক সম্পর্কের প্রথম পরীক্ষামূলক প্রমাণ মেলে। ১৯৭০ সালে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের কিছু বিজ্ঞানী ব্যাকটেরিয়ার ভিতরে জিনগত তথ্যের আদান-প্রদান দেখতে ইলেক্ট্রন অনুবীক্ষণ যন্ত্রের ব্যবহার করেন [৭]। এই পরীক্ষার জন্য তাঁরা ব্যবহার করেন এমন কিছু ব্যাকটেরিয়া যাদের কোষ-প্রাচীর খুবই ভঙ্গুর। ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়ার কিছু জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে একধরনের “মিউট্যান্ট” ব্যাকটেরিয়া তৈরী করা হয়েছিল, যাদের কোষ-প্রাচীর স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ভঙ্গুর। এই ব্যাকটেরিয়াগুলিকে খুব দ্রুত জলে মিশ্রিত করলে কোষের অন্দরমহলের অভিস্রবণ চাপে কোষ-পর্দা ও কোষ-প্রাচীর ভেঙ্গে ব্যাকটেরিয়ার উপাদান বাইরে বেরিয়ে আসে। বিজ্ঞানী অস্কার মিলার ও তার সহকর্মীরা ইলেক্ট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে সেই কোষ-নির্যাসের ছবি তোলেন যার সাহায্যে ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে জিনগত তথ্যের আদান-প্রদান প্রক্রিয়া সম্পর্কে অভিনব এবং অমূল্য কিছু তথ্য পরিবেশন করে।
এই ছবিগুলিতে দেখা যায় যে প্রায় সমস্ত mRNA-ই জিনগত DNA-র সাথে সংযুক্ত। ছবিগুলিতে আরও দেখা যায় যে প্রতিটি mRNA-র উপরই রয়েছে বেশ কযেকটি করে ২০ ন্যানোমিটার মাপের কণা (চিত্র ১.D)। এই কণাগুলি আসলে কোষের অনুবাদযন্ত্র, রাইবোজম (ribosome)।
আমরা আজ জানি যে, একটি mRNA থেকে একসাথে একাধিক রাইবোজম প্রোটিন তৈরী করতে পারে। mRNA সহ একাধিক রাইবোজমের এই সমষ্টিকে বলে পলিজোম (polysome) (চিত্র ১.C)। মিলার ও তার সহকর্মীদের ছবিগুলি এই পলিজোম-এর অস্তিত্বের প্রথম প্রমান (চিত্র ১.D)। কিন্তু তা ছাড়াও জিন-গত তথ্য-প্রবাহের দুই ধাপের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করতে ছবিগুলির একটি বৈশিষ্ট্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইলেক্ট্রন অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে তোলা কোষ-নির্যাসের ছবিগুলোতে, জিন-গত DNA থেকে বিছিন্ন কোনো পলিজোমের ছবি নেই!!
জিনগত DNA থেকে বিচ্ছিন্ন পলিজোম থাকলে কি হত? তার মানে, আমরা দেখতাম একটি সম্পূর্ণ mRNA এবং তা থেকে প্রোটিন তৈরীরত একাধিক রাইবোজম। “সম্পূর্ণ” mRNA মানে জিন থেকে যার ট্রান্সক্রিপশন সম্পূর্ণ হয়েছে এমন একটি mRNA । যদি ট্রান্সলেশন আর ট্রান্সক্রিপশন প্রক্রিয়া দুটি একে অপরের থেকে স্বাধীনভাবে সম্পন্ন হত, তাহলে নিশ্চয় কিছু বিচ্ছিন্ন পলিজোমের দেখা মিলত।
কিন্তু তা মেলেনি। ইলেক্ট্রন অনুবীক্ষণ যন্ত্রে তোলা ছবিগুলিতে বিচ্ছিন্ন পলিজোমের অনুপস্থিতি প্রমান করে যে, ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে mRNA থেকে প্রোটিন সংশ্লেষ সব সময়ই ট্রান্সক্রিপশন চলাকালীন হয়। ড: মিলার ও তার সহকর্মীদের কথায় “সমস্ত ট্রান্সলেশন ট্রান্সক্রিপশন চলাকালীন হয়”। সুতরাং ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে তথ্য-প্রবাহের দুটি ধাপ-এর মধ্যে শুধু পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে তা নয়, ধাপ-দুটি একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। মিলার ও তার সহকর্মীদের গবেষণাপ্রাপ্ত এই ছবিগুলিকে গুন্থার স্টেন্ট-এর প্রস্তাবনার যথার্থতার চাক্ষুষ প্রমাণ বলা যেতে পারে।
তাহলে কি দাঁড়ালো
তাহলে দেখা গেল, শুধু গঠনগত পার্থক্য ছাড়াও “প্রোক্যারিওট” (নিউক্লিয়াস পর্দাহীন) আর “ইউক্যারিওট” (নিউক্লিয়াস পর্দাযুক্ত)-এর মধ্যে জৈবক্রিয়াগত তফাতও রয়েছে। লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হচ্ছে, এখানে গঠনগত পার্থক্য থেকেই ক্রিয়াগত পার্থক্যের সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে।
ইউক্যারিওটিক কোষের মধ্যে নিউক্লিয়াসের পর্দার আড়ালে mRNA উৎপাদন সম্পন্ন হলে সঙ্গে সঙ্গেই সেই mRNA থেকে অনুবাদ শুরু হয় না। সদ্যসমাপ্ত প্রতিলিপিকরণ প্রক্রিয়া থেকে তৈরী mRNA-কে জায়মান RNA (Nascent RNA) বলা হয়। ট্রান্সক্রিপশনের পর আরো বেশ কিছু পদ্ধতির (Post-transcriptional Processing) মাধ্যমে এই জায়মান RNA থেকে পূর্ণতাপ্রাপ্ত mRNA তৈরী হয়। এই পূর্ণতাপ্রাপ্ত mRNA থেকেই অনুবাদ সম্ভব।
ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে এই “জায়মান RNA” অবস্থাটি অনুপস্থিত। mRNA-র পূর্ণতাপ্রাপ্তির আগেই, ট্রান্সক্রিপশন চলাকালীন অসম্পূর্ণ mRNA থেকেই “co-transcriptional translation”-এর মাধ্যমে নতুন প্রোটিন সংশ্লেষ শুরু হয়ে যায়। কিন্তু এই তফাতটার তাৎপর্য কি? সেই আলোচনা পরের অংশে।
শেষ করার আগে ড: মিলার ও তার সহকর্মীদের “সমস্ত ট্রান্সলেশন ট্রান্সক্রিপশন চলাকালীন হয়” এই সিদ্ধান্তটি আরেকটু তলিয়ে দেখি। ট্রান্সক্রিপশন চলাকালীন অসম্পূর্ণ mRNA থেকে ট্রান্সলেশনের সম্ভাবনা আছে, এটা বলা এক জিনিস। কিন্তু ব্যাকটেরিয়ায় “সমস্ত ট্রান্সলেশনই ট্রান্সক্রিপশন চলাকালীন হয়” এই সিদ্ধান্তটি ব্যাকটেরিয়া আর ইউকারইওট -এর তফাতকে এক চূড়ান্ত সাদা-কালো মাত্রা দান করে। কারণ, ইউক্যারিওটিক কোষে সমস্ত ট্রান্সলেশন ট্রান্সক্রিপশন সমাপ্ত হওয়ার পর শুরু হয়।
প্রশ্ন হলো, ১৯৭০ সালে তৈরী হওয়া এমন একটি সিদ্ধান্ত কি সত্যি সময়ের পরীক্ষা পার করতে পেরেছিল? নাকি বিজ্ঞানীরা কিছুকালের মধ্যে এর ত্রুটি খুঁজে বার করেছিলেন? লেখার পরের পর্বে আমরা সেই আলোচনাতেই প্রবেশ করব। সময়ের সাথে সাথে অগ্রসরমান ও ক্রমপ্রসারমান বিজ্ঞান গবেষনার কষ্টিপাথরে ঝালাই করে দেখব এই সিদ্ধান্ত ও তার তাৎপর্য্যকে। তবে এটুকু বলাই যায় যে, নিউক্লিয়াসের পর্দার অনুপস্থিতির সুত্র ধরে জিন ও প্রোটিনের মধ্যে এই যে অবিচ্ছিন্ন যোগসূত্রটির হদিস মিলল, তা ৭০-এর দশকে বিজ্ঞানী মহলে হইচই ফেলে দিয়েছিল।
(ছবি – লেখক এবং নিচে রেফারেন্স [৭])
তথ্যসূত্র ও অন্যান্য টুকিটাকি:
[১] জিনগত তথ্য যে ভাষায় লেখা তার অক্ষর হলো এক একটি “নিউক্লিওটাইড” (Nucleotide)। তিনটি করে নিউক্লিওটাইড মিলে তৈরি হয় একটি ‘কোডন’ (Codon)। অক্ষর জুড়ে যেমন শব্দ তৈরি হয়, তেমনি। ক্রমানুসারে সাজানো শব্দ দিয়ে যেমন একটি কথা তৈরী হয়, তেমনি ক্রমানুসারে সাজানো বেশ কযেকটি কোডন দিয়ে তৈরী হয় একটি জিনগত বার্তা।
[২] Francis Crick, On Protein Synthesis, Symp Soc Exp Biol. 1958;12:138-63
[৩] François Jacob and Jacques Monod, On the Regulation of Gene Activity, Cold Spring Harb Symp Quant Biol. 1961. 26: 193-211
[৪] এমআরএনএ ব্যতীত আরএনএ-এর আরো কিছু প্রকারভেদ রয়েছে। পরবর্তী পর্বের লেখাতে এই বিষয়ে আলোচনা থাকবে।
[৫] Elliot Volkin, L. Astrachan, Phosphorus incorporation in Escherichia coli ribonucleic acid after infection with bacteriophage T2, Virology 2(2):149-161
[৬] Gunther S. Stent, The Operon: On its third anniversary, Science 144(3620):816-20
[৭] Miller, O.L., Hamkalo, B.A., and Thomas, C.A., Visualization of bacterial genes in action, Science 169(3943):392-5