আগের অংশে আমরা দেখেছিলাম মৌমাছির আপাত নিঃস্বার্থ কর্মজীবন কিভাবে ডারউইনের ন্যাচারাল সিলেকশন তত্ত্বকে বিপাকে ফেললো। কর্মী মৌমাছিদের প্রজননক্ষমতাই নেই, অথচ তারা প্রাণ ঢেলে দিচ্ছে কলোনীর সুরক্ষার জন্য। তাদের কাজের তাগিদটা আসে কোত্থেকে? হ্যালডেন ও পরে হ্যামিল্টন এই সমস্যার একটা সুরাহা করলেন। তারা বললেন, পপুলেশনে নিজের জিনের সংখ্যা যে শুধু প্রজনন করলেই বাড়বে এমন তো নয়। যারা আপনার রক্তের সম্পর্কে আত্মীয় বা ‘জেনেটিক রিলেটিভ’, তাদের মধ্যেও আপনার জিনের প্রতিরূপ আছে। তাই তাদের যদি আপনি বেঁচে থাকতে সাহায্য করেন, তাহলেও পপুলেশনে আপনার জিনের সংখ্যা বাড়তে পারে।
আপনি আপনার জিনের সংখ্যা কত বাড়াতে পারছেন তার মাপকাঠিই হল আপনার ‘ফিটনেস’। হ্যামিলটনের থিওরি অনুযায়ী, প্রজনন ক্ষমতা নেই এরকম কোনো ব্যক্তিও জ্ঞাতিগুষ্ঠির মাধ্যমে কিছু ‘ফিটনেস’ পেয়ে যেতেই পারে, আর নিজের জিনের সংখ্যা বাড়িয়ে নিতে পারে। বিজ্ঞানীরা এই থিওরির নাম দিয়েছেন ‘কিন সিলেকশন থিওরি’, ‘কিন’ অর্থে জ্ঞাতি। কিন্তু কীভাবে মাপা যাবে এই ফিটনেস?
প্রথমেই দেখতে হবে জ্ঞাতিদের সাথে আপনি কতটা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত বা ‘রিলেটেড’। মানুষ ও অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের গোটা জিনোমটা১ তৈরী হয় বাবা আর মা, দুজনের থেকেই অর্ধেক অংশ করে জিন নিয়ে। তাই এক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তির নিজের সন্তানের সঙ্গে জেনেটিক রিলেটেডনেস বা সম্পর্ক হল ১/২। তেমনি ভাইবোনেদের সঙ্গে সম্পর্কও ১/২, নাতি-নাতনি, ভাইপো-ভাইঝি, বোনপো-বোনঝিদের সঙ্গে ১/৪ আর যাবতীয় খুড়তুত, জ্যাঠতুত, মামাত, মাসতুত ভাইবোনদের সঙ্গে ১/৮। এখন আপনি যদি আপনার তিনজন ভাইপোকে লালন-পালন করেন, তাহলে আপনার ফিটনেস হবে ৩ X ১/৪ = ৩/৪, যদি পাঁচজন মামাত বোনের দেখাশোনা করেন তো আপনার ফিটনেস হবে ৫ X ১/৮ = ৫/৮, এইরকম। এই সমস্ত ফিটনেস যোগ করে হিসেবটা যা দাঁড়ায় সেটাই হল আপনার ‘ইনক্লুসিভ ফিটনেস’। আর আপনার এই ‘ইনক্লুসিভ ফিটনেস’ বেড়ে যাওয়া মানেই হল আপনার বৈশিষ্ট্যগুলো সিলেক্টেড হওয়ার সুযোগ বাড়া।
‘জেনেটিক রিলেটেডনেস’ বা সম্পর্কের সরলীকৃত চিত্রণ। ছবিতে একই জিনের ‘কপি’ বা প্রতিরূপের রং একই। ছবিতে উপস্থিত নেই এমন ব্যক্তির জিন বোঝাতেই শুধু কালো রং ব্যবহার করা হয়েছে। জেনেটিক সম্পর্ক দেখা হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যক্তিটির দৃষ্টিকোণ থেকে। মানুষের ক্ষেত্রে জেনেটিক সম্পর্ক দেখানো হচ্ছে এখানে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যক্তি হচ্ছেন আপনি। সমস্ত স্তন্যপায়ী সহ বেশির ভাগ প্রাণীর জেনেটিক সম্পর্কই এইরকম।
সঙ্গের চার্টে স্ত্রী পুরুষ দুজনের দৃষ্টিকোণ থেকেই তাদের আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক কত তা বলা আছে।
লিঙ্গ | মা/বাবা | ভাই/বোন | ছেলে/মেয়ে | ভাইপো/ভাইঝি | বোনপো/বোনঝি |
---|---|---|---|---|---|
স্ত্রী | ১/২ | ১/২ | ১/২ | ১/৪ | ১/৪ |
পুরুষ | ১/২ | ১/২ | ১/২ | ১/৪ | ১/৪ |
চলুন এবারে বুঝে দেখি হ্যালডেন সেই সাংকেতিক জবানিতে ঠিক কী বলতে চেয়েছিলেন। হ্যালডেন নিজের একজন বা দুজন ভাইয়ের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতে চাননি। বলেছিলেন, তিনজন বা তার বেশি ভাইকে বাঁচানোর সুযোগ থাকলে তবেই তিনি সেই ঝুঁকি নিতে রাজি আছেন। এখানে জীবনের ঝুঁকি নেওয়ার অর্থ হল নিজের পুরো জিনোমটাই নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি। আর সকলেরই তো নিজের সাথে নিজের জেনেটিক সম্পর্ক ১! তাই হ্যালডেন সেটা হারানোর ঝুঁকি তখনই নিতে পারেন যখন তিন বা তার বেশি সংখ্যক ভাইকে বাঁচানোর সুযোগ থাকবে, যাতে করে ক্ষতিটা পুষিয়ে যায়। কারণ, ভাইয়ের সাথে জেনেটিক সম্পর্ক ১/২, তাকে অন্তত তিন দিয়ে গুণ করলে তবেই সেটা এক এর চেয়ে বেশি হবে।
হ্যালডেনই এটা প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন। কিছু কঠিন শর্ত পূরণ হলে, নিজের জীবন দিয়ে অন্যের জীবন বাঁচানোর মত নিঃস্বার্থ প্রকৃতিও ন্যাচারাল সিলেকশন-এর মাধ্যমে একটা প্রজন্ম থেকে আরেকটাতে চলে আসতে পারে।
হ্যামিলটনের বিধান
এই ছোট্ট অথচ সরল হিসেবটাই অঙ্কের আকারে প্রকাশ করেছিলেন ডব্লু.ডি. ওরফে বিল হ্যামিলটন। ধরুন, আপনার শরীরে এমন কোনো জিন রয়েছে যার ওপর নির্ভর করছে আপনি একজন ডুবন্ত মানুষকে বাঁচাতে জলে ঝাঁপ দেবেন কি দেবেন না। ঝাঁপ দিলে আপনার ক্ষতি বা ‘কস্ট’ (cost)-এর পরিমাণ c, ডুবন্ত মানুষের লাভ বা ‘বেনিফিট’ (benefit)-এর পরিমাণ b, আর আপনার ও ডুবন্ত মানুষের মধ্যে জেনেটিক সম্পর্ক r। সেক্ষেত্রে পপুলেশনে আপনার জিনের সংখ্যা বাড়তে পারে যদি
b/c > 1/r
শর্তটা পূরণ হয়। এই অসমীকরণেরই পোষাকি নাম হল ‘হ্যামিলটন’স রুল’। b আর c কিন্তু মাপতে হবে ফিটনেসের এককে। যেমন, শুরুর উদাহরণে হ্যালডেন নিজের একটা জিনোম খুইয়ে (c=১) অন্তত তিনজন ভাইয়ের জিনোম বাঁচাতে চান (b=৩), কারণ ভাইয়ের সাথের তার জেনেটিক সম্পর্ক r=১/২। নিঃস্বার্থ প্রকৃতির ধাঁধাটার সমাধানে হ্যামিলটনের এই বিধানই হল বিজ্ঞানীদের প্রধান হাতিয়ার।
হ্যামিলটনের বিধান থেকে এটা সহজেই বোঝা যায় যে প্রাণীজগতে নিঃস্বার্থ চরিত্রের উদ্ভব হওয়া বেশ কঠিন। আপনার সবচেয়ে নিকটাত্মীয় হল আপনার সন্তান আর ভাইবোনরা, যাদের সঙ্গে আপনার জেনেটিক সম্পর্ক ১/২। মনে করুন আপনার মধ্যে দু’ ধরণের জিন রয়েছে: এক ধরণের জিনের প্রভাবে আপনি নিজে সন্তানের জন্ম দিতে চান (স্বার্থপর বা নন-আল্ট্রুইস্ট), অন্য জিনটার প্রভাবে আপনি নিজের ভাইবোনদের মানুষ করতে চান (নিঃস্বার্থ বা আল্ট্রুইস্ট)। ধরে নিচ্ছি আপনি দুজন সন্তানকে জন্ম দিয়ে মানুষ করে তোলার ক্ষমতা রাখেন। এখন আপনি যদি চান আপনার নিঃস্বার্থ জিনের সংখ্যা তুলনায় বাড়ুক, তাহলে আপনাকে কমকরে তিনটে ভাই বা বোনকে মানুষ করতে হবে! কাজেই আপনাকে খাটতে হবে কিন্তু অনেক বেশি!
সেক্ষেত্রে নিঃস্বার্থ আচরণের উদ্ভবের জন্য এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হিসেবে চলে আসছে যে আপনি বেশি খাটতে পারেন কিনা। কাজেই প্রাণীজগতে নিঃস্বার্থ আচরণ যে বিরল, তাতে আর আশ্চর্য্য কি! কিন্তু মজার ব্যাপার হল যে কীটপতঙ্গের দুনিয়ায় এটা এমন কিছু বিরল নয়। মৌমাছি তো আছেই, প্রায় সমস্ত পিঁপড়ে আর বেশির ভাগ বোলতাই খুবই সামাজিক। আর তাদের সবার বাসাতেই আলট্রুইস্ট ওয়ার্কারদের দেখা মেলে। কেন এদের মধ্যেই সোশ্যালিটির ছড়াছড়ি? এর উত্তরটাও অংশত লুকিয়ে আছে হ্যামিলটনের দেওয়া বিধানের মধ্যেই।
নিঃস্বার্থ আচরণের রহস্যভেদ
প্রাণীজগতের শ্রেণীবিভাগ অনুযায়ী পিঁপড়ে, মৌমাছি আর বোলতা, এই তিন প্রাণীরই স্থান একটা বিশেষ গ্রুপে, যার নাম ‘হাইমেনপটেরা’। এই গ্রুপের নানা বিশেষত্বের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল এদের প্রজননের পদ্ধতি।
এদের রাণীদের একটা বিশেষ ক্ষমতা থাকে, এরা চাইলেই ইচ্ছামত ছেলে বা মেয়ে সন্তানের জন্ম দিতে পারে। এরা নিজেদের শরীরের মধ্যে একটা থলিতে করে শুক্রাণু জমিয়ে রেখে দিতে পারে দিনের পর দিন। তারপর ইচ্ছেমত সেগুলো ব্যবহার করতে পারে। যখন রাণী মেয়ে সন্তান (কর্মী কিংবা ভবিষ্যতের রাণী) চায়, শুক্রাণুর থলির মুখ একটু ফাঁক করে দেয় – কিছু শুক্রাণু বেরিয়ে এসে ডিমের নিষেক বা ‘ফার্টিলাইজেশন’ করে। আর যখন রাণী ছেলের (ড্রোন) জন্ম দেবে ভাবে, শুক্রাণুর থলির মুখ শক্ত করে বন্ধ রেখে দেয়, ফলে ডিমের নিষেক ঘটে না। নিষিক্ত ডিম থেকে মেয়ে আর অনিষিক্ত ডিম থেকে ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। কাজেই হাইমেনপটেরা গ্রুপের মেয়েদের দু’-সেট ক্রোমোজম২ থাকে, একটা আসে মার ডিম্বাণু থেকে, অন্যটা বাবার শুক্রাণু থেকে। কিন্তু ছেলেদের ক্রোমোজম থাকে মাত্র এক-সেট, সেটা আসে শুধুমাত্র মার ডিম্বাণু থেকেই।
হাইমেনপটেরা-র এই অসম প্রজনন ব্যবস্থার ফলে জেনেটিক সম্পর্কের সব হিসেব উল্টোপাল্টা হয়ে যায়। মায়েদের সাথে নিজের মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক ১/২-ই থাকে। কিন্তু একই বাবা মায়ের থেকে জন্মান দুই বোনের মধ্যে সম্পর্ক বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৩/৪। তার মানে, একজন কর্মী-মৌমাছি নিজে সন্তানের জন্ম না দিয়ে যদি নিজের বোনের দেখাশোনা করে, তাহলে সে দুদিক দিয়ে সুবিধে পেয়ে যাচ্ছে! এক তো সে ফিটনেস পাচ্ছে বেশি, অন্যদিকে বাকিদের তুলনায় তাকে খাটতেও হচ্ছে কম! তার জিনের সংখ্যা তুলনায় বাড়ছে, অথচ তাকে বেশি খাটুনিও খাটতে হচ্ছেনা! কর্মী-মৌমাছির মধ্যে যদি ‘নিঃস্বার্থ’ আর ‘স্বার্থপর’, এই দু’ ধরণের জিনই থাকে, তাহলে বুঝতেই পারছেন, হাইমেনপটেরার এই বিশেষ প্রজনন ব্যবস্থার ফলে একই খাটুনিতে নিঃস্বার্থ জিনটা সংখ্যায় বাড়বে বেশি হারে। অনেক প্রজন্ম পরে দেখা যাবে সবাই নিঃস্বার্থ হয়ে গেছে। ঠিক এই কারণেই বাকি প্রাণীজগতের তুলনায় হাইমেনপটেরাতে নিঃস্বার্থ আচরণের উদ্ভবের সুযোগ অনেক বেশি।
হাইমেনপটেরা গ্রুপে ‘জেনেটিক রিলেটেডনেস’ বা সম্পর্কের সরলীকৃত চিত্রণ। কেন্দ্রীয় ব্যক্তি হল ওয়ার্কার। খেয়াল করুন এখানে পুরুষদের জিনের পরিমাণ স্ত্রীদের অর্ধেক।
সঙ্গের চার্টে স্ত্রী পুরুষ দুজনের দৃষ্টিকোণ থেকেই তাদের আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক কত তা বলা আছে।
লিঙ্গ | কন্যা | পুত্র | মা | বাবা | বোন | ভাই |
---|---|---|---|---|---|---|
স্ত্রী | ১/২ | ১/২ | ১/২ | ১/২ | ৩/৪ | ১/৪ |
পুরুষ | ১ | – | ১ | – | ১/২ | ১/২ |
নিঃস্বার্থ এই জগতে
আপনি প্রশ্ন তুলতেই পারেন, হাইমেনপটেরার বাইরে কি তাহলে নিঃস্বার্থ আচরণ নেই? মৌমাছির মত চরম না হলেও বাকি প্রাণীজগৎ জুড়ে সমাজবদ্ধ বসবাসের অনেক নজিরই চোখে পড়ে। এই থিওরি কি সেখানেও চলবে? এই যেমন সিংহই একটা সামাজিক প্রাণী। সিংহ-সমাজেও কি আত্মীয়দের প্রতি পক্ষপাত দেখা যায়? সিংহের প্রজনন পদ্ধতি তো মানুষেরই মত, সে তো আর মৌমাছির মত জেনেটিক সম্পর্কের সুবিধে পায় না। তাহলে সিংহরা একসাথে থাকে কেন?
মনে করে দেখুন, সিংহের একেকটা দলে এক বা একের বেশি পূর্ণবয়স্ক সিংহ থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, ছোট দলগুলোতে সিংহরা সবাই মোটামুটি একই হারে প্রজনন করে, প্রায় একই সংখ্যায় সন্তানের জন্ম দেয়। কিন্তু বড় দলগুলোতে প্রধানত একটা সিংহকেই প্রজনন করতে দেখা যায়, দলের বেশির ভাগ ছানাপোনার বাবা সে-ই। মজার ব্যাপারটা হল, এটাও দেখা গেছে যে ছোট ছোট দলের সিংহদের তুলনায় বড় দলগুলোতে সিংহদের মধ্যে সম্পর্ক বেশি – মানে বড় দলগুলোতে সিংহরা পরস্পরের বেশি কাছের আত্মীয়৩। অন্যভাবে বলতে গেলে, নিজে প্রজনন বন্ধ রেখে দলের সঙ্গীসাথীদের সাহায্য করতে সিংহের খুব একটা আপত্তি নেই যদি সেই দলে তার আত্মীয়স্বজন-জ্ঞাতিগুষ্ঠিরা থাকে। কিন্তু সেটা না হলে এই স্বার্থত্যাগ করতে সে একটুও রাজি নয়! অর্থাৎ এখানেও সেই ‘কিন সিলেকশন’-এর ছায়া।
আফ্রিকা থেকে এবার চলে আসুন উত্তর-পশ্চিম আমেরিকাতে। এখানে দেখা পাবেন ‘বেল্ডিং’স গ্রাউন্ড স্কুইরেল’ বলে একধরনের কাঠবিড়ালির, যারা শিকারী নেকড়ে, বেজি বা ঈগলদের দেখতে পেলেই চিৎকার করে বাকিদের সাবধান করে দেয়। তাদের এই ‘অ্যালার্ম কল’ শুনে বাকিরা পালিয়ে গেলেও স্কুইরেল নিজে কিন্তু প্রায়শই শিকারীর চোখে পড়ে যায়, হয়ত সবার আগে মারাও পড়ে। স্কুইরেল নিজেই আগে পালিয়ে যায়না কেন? গবেষণায় দেখা গেছে স্কুইরেল এই ‘অ্যালার্ম কল’টা তখনই দেয় যখন তার জ্ঞাতিগুষ্ঠিরা আশেপাশে থাকে। অর্থাৎ, নিজের জীবনের ঝুঁকিটা স্কুইরেল তখনই নেয় যখন আত্মীয়দের মাধ্যমে কিছু ফিটনেস পাবার সুযোগ আছে৪।
আনুবীক্ষণিক জগতেও উদাহরণ পেয়ে যাবেন। এককোষী অ্যামিবা ‘স্লাইম মোল্ড’কে দেখুন – মাটিতে ব্যাকটেরিয়া খেয়েই এরা বেঁচে থাকে। এমনিতে এরা সোশ্যাল নয়, একা একাই থাকে। কিন্তু একজায়গায় খাবার ফুরিয়ে এলে, যখন বাঁচতে গেলে দূরে কোথাও যেতেই হবে, তখন অনেকে মিলে একজায়গায় জড়ো হয়ে একটা মণ্ড তৈরী করে। সেখান থেকে তৈরী হয় ‘স্টক’ বা লম্বা ডাঁটার মত একটা অংশ, তাতে থাকে কিছু মৃত অ্যামিবা। আর সেই ডাঁটার মাথায় থাকে জ্যান্ত অ্যামিবার একটা ‘স্পোর’ বা গুটি। কিছু অ্যামিবা নিজেরা আত্মহত্যা করে ওই ‘স্টক’ অংশটা তৈরী করে। ফলে ‘স্পোর’ অংশের অ্যামিবাদের দূরে কোথাও বাহিত হয়ে গিয়ে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। গবেষণায় প্রমান হয়েছে অ্যামিবার এই চরম স্বার্থত্যাগের পেছনে রয়েছে নিজের ‘ক্লোন’-দের বাঁচানোর চেষ্টা৫! নিজের ক্ষতি করে অন্যের উপকারের এমনি অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের চারপাশের জীবজগতে। আর তার সাথেই জড়িয়ে রয়েছে ‘কিন সিলেকশন’ থিওরির সাফল্য।
তাহলে কি রহস্যের অবসান হলো? বিজ্ঞানের ইতিহাসে সব সময়েই দেখতে পাবেন যখনই কোনো একটা ধাঁধার সমাধান হয়, আবার সেখান থেকেই শুরু হয়ে যায় নতুন কোনো ধাঁধা। পরের সপ্তাহে আমরা দেখবো, কিন সিলেকশন তত্ত্ব কি নতুন ধাঁধার সৃষ্টি করলো আর বিজ্ঞানীরা তার সমাধানে কতদূর এগিয়েছেন।
প্রচ্ছদের ছবি: হ্যালডেনের কাহিনীর চিত্ররূপ। শেডের তারতম্যে বোঝানো হয়েছে যে পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির জিনের কত ভাগ ডুবন্ত মানুষের মধ্যে রয়েছে। পাড়ের মানুষটি নিজের জীবনের ঝুঁকি তখনই নিচ্ছেন যখন নিজের তুলনায় বেশি সংখ্যক জিন বাঁচানোর সুযোগ রয়েছে। ছবিটি আঁকা হয়েছে ‘সারভাইভাল স্ট্র্যাটেজিস’ বইতে ছাপা সুধা প্রেমনাথ-এর আঁকা কার্টুনের অনুকরণে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: এই লেখাটি হাভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ছাপা প্রফেসর রাঘবেন্দ্র গদগকর-এর ‘সারভাইভাল স্ট্র্যাটেজিস’ বই-এর অনুসরণে লেখা। সঙ্গে গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য-র ‘বাংলার কীটপতঙ্গ’ বইটির সাহায্যও নেওয়া হয়েছে। লেখার ব্যাপারে মূল্যবান মতামত দিয়ে সাহায্য করেছেন পারমিতা সাহা, সৈকত চক্রবর্তী এবং সৌভিক ভট্টাচার্য।
তথ্যসূত্র ও অন্যান্য টুকিটাকি:
[১] কোনো প্রাণীর সমস্ত জেনেটিক উপাদানগুলোকে একসাথে ‘জিনোম’ বলে। তাই জিনোম বলতে প্রাণীর সমস্ত জিন তো বোঝায়ই, তা ছাড়াও আরো কিছু ‘নন-কোডিং’ অংশ, যেগুলোতে কোনো প্রোটিন তৈরির সংকেত থাকেনা। প্রাণীদের শরীরের সমস্ত সাধারণ কোষের নিউক্লিয়াসে তাদের জিনোম-এর একটা করে প্রতিরূপ থাকে।
[২] কোষের নিউক্লিয়াসের মধ্যে এই ক্রোমোজম-অংশেই জিনগুলো গুটিয়ে পাকিয়ে ছোট্ট হয়ে বসে থাকে।
[৩] C. Packer et. al. (1991) Why lions form groups: food is not enough. American Naturalist 136, 1-19
[৪] P.W. Sherman (1977) Nepotism and the evolution of alarm calls, Science 197, 1246-1453
[৫] M.J. DeAngelo et. al. (1990) Altruism, selfishness, and heterocytosis in cellular slime molds, Ethology Ecology & Evolution 2, 439-443