ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে জার্মানীর লিপজিগ শহরে গবেষণারত চব্বিশ বছরের এক অনামী চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র এবং বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে আর্জিণ্টিনার বুয়েনোস আইরেসে গবেষনারত এক পিএইচডি ছাত্রের মধ্যে অমিল অনেক। শুধু স্থান-কাল আলাদা নয়, এই অর্ধশতকের মধ্যে প্রযুক্তিও অনেক উন্নত হয়েছে। কিন্তু লিপজিগে বসে সেই যুবক যখন নিজের উৎসাহে বিশ্ব বিজ্ঞান সীমানার এক নতুন দিক নির্দেশ করছে, তখনো অবধি সে জানেনা এর পরিপূর্ণতা পেতে এতটা সময় আর এই উন্নত প্রযুক্তিরই প্রয়োজন হবে। আর সময়ের প্রবাহ যোগসূত্র ঘটাবে ক্যান্সার নিয়ে গবেষণারত এক উন্নত পৃথিবীর স্বপ্নে পথ চলা আশ্চর্য দুই মননকে। সেই যোগসূত্র বুঝতে হলে ইতিহাসের হাত ধরে আমাদের চলে যেতে হবে জার্মানির লিপজিগ শহরের সদ্য ডাক্তারী পড়তে আসা পল আর্হলিখ-এর কাছে।
এক দূরসম্পর্কের ভাই-এর সূত্রে ব্যাক্টেরিয়ার কোষ রং করার এক প্রক্রিয়া পলের গোচরে আসে। শিল্পবিপ্লবের হাত ধরে তৎকালীন ইওরোপে রাসায়নিক শিল্পের যে জোয়ার এসেছিল , তার ফলে বহু নতুন অজানা রাসায়নিক তাদের নানাবিধ বর্ণমালার ছটায় বিশ্বের বস্ত্রশিল্পকে রাঙিয়ে তুলছিল। আর্হলিখের ব্যবহৃত রাসায়নিকও এমনি একটি রাসায়নিক বস্তু। কিন্তু এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে আর্হলিখ নিয়ে এলেন এক নতুন ভাবনা। বস্ত্রের পরিবর্তে মানবদেহ থেকে আহরিত কোষ এবং টিসু (কলা) কে রং করাই ছিল তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য। অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে দেহকোষকে আর একটু দৃশ্যমান করে তলার জন্য এই প্রয়াস যে জীববিজ্ঞানের জগতে এতবড় বিপ্লব ঘটাবে তা হয়তো তখন কেউ কল্পনাও করে উঠতে পারেনি। রঙে চুবিয়ে কোষগুলি অনুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় রাখতেই তাক লেগে গেল সদ্য গবেষণার জগতে পা রাখা আর্হলিখের। তিনি সবিস্ময়ে দেখলেন যে সব রঙ সব ধরণের কোষকে একই ভাবে রাঙায় না। কোষের মধ্যে নানা অংশ নানারকমের রং ধারণ করে ! সে যুগের অনুবীক্ষণ যন্ত্রে খুব বেশী বিশদ পর্যবেক্ষণ সম্ভব ছিল না, কিন্তু এটুকু বোঝা গেলো যে মানব দেহকোষ সেই অর্থে কোনো সমসত্ব নির্মাণ নয়, বরং এর মধ্যেও রয়েছে গঠণগত গভীর জটিলতা। এর সঙ্গে আরো একটি বিষয় স্পষ্ট হলো : মানব কোষ রাসায়নিক গঠণ অনুসারেও যথেষ্ট জটিল, অসমসত্ব এবং এর বিভিন্ন অংশ বিশেষভাবে কোনো কোনো রাসায়নিকের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার ক্ষমতা রাখে।
পরবর্তী জীবনে আর্হলিখ এই গবেষণাকে আরো অনেক দূর নিয়ে যান। মানবদেহে প্রতিটি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, প্রতিটি কর্মকাণ্ডই যে আসলে জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়া ব্যতীত আর কিছু নয় এই বোধ উন্মেষের সাথে সাথে আর্হলিখ এও বোঝেন যে এই প্রক্রিয়াগুলিকে খুব নির্দিষ্ট ও স্বতন্ত্রভাবে রোধ করা সম্ভব এবং তার জন্য প্রয়োজন নির্দিষ্ট বস্তু যা কেবল সেই নির্দিষ্ট প্রক্রিয়াটিকেই বাধা দেবে। আন্টিবডি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তাঁর ধারণা আরো বদ্ধমূল হল যে, শারীরিক প্রক্রিয়াগুলি যে অণু বা মলিকিউল দ্বারা পরিচালিত তারা তালা-চাবির মত কাজ করে, অর্থাৎ প্রত্যেক মলিকিউলের সঙ্গে নির্দিষ্ট ভাবে সংযুক্ত হতে পারে এমন রাসায়নিক পাওয়া সম্ভব।
যদিও এর পূর্বে এমিল ফিশারের হাত ধরে এই “লক এন্ড কি মডেল” মান্যতা পেয়ে গেছিল। কিন্তু আর্হলিখের ভাবনা এই মডেলের শুধু বিস্তৃতি ঘটালো তাই নয়, একে গবেষণামূলক ও অভিজ্ঞতাজনিত ভিত্তিভূমির ওপর দাঁড় করালো এবং সেই সাথে জন্ম দিলো এক নতুন ভাবনার — “ম্যাজিক বুলেট” । সব ধরণের সংক্রমণ প্রতিরোধে বা রোগ নিরাময়ে কোনো এক বিশেষ রাসায়নিক এক বিশেষ মাত্রায় কাজ করবে, এই বোধ থেকে শুরু হলো এক প্রায় অসম্ভব ও প্রবল উচ্চাকাঙ্খী গবেষণা যার ফল স্বরূপ কিছু কিছু সংক্রমণের দাওয়াই মিলল: যেমন “সিফিলিস” (প্রাক অ্যান্টিবায়োটিক যুগে যা কম পাওনা নয়)। কিন্তু কেবলমাত্র একটি ঔষধ আবিষ্কারেই আর্হলিখ ব্যবহৃত প্রক্রিয়াটির সাফল্য বর্ণনা করা যায় না। অসংখ্য কেমিক্যালকে নানান মাত্রায় প্রয়োগ করে কোনো একটি রোগের দাওয়াই সন্ধানের মধ্যে দিয়েই শুরু হলো আধুনিক ঔষধ আবিষ্কারের পথ চলা। কিন্তু এর পরেও ক্যান্সার রয়ে গেল আর্হলিখের আয়ত্তের বাইরে। ঊনিশশো পনেরো সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত উত্তাল পৃথিবী ছেড়ে যখন তিনি বিদায় নিচ্ছেন তখনও তাঁর একনিষ্ঠ ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চলছে ক্যান্সারের ভ্যাকসিন খুঁজে বার করার, তৎকালীন চিকিৎসা ও জীববিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতার পরিপ্রেক্ষিতে যা ছিল সম্পূর্ণ অসম্ভব।
আর্হলিখের মৃত্যুর পরেও বিশ্বের প্রথম আংশিক সফল ক্যান্সার ভ্যাকসিনের আগমন ঘটতে লেগে গেলো প্রায় আরো একশো বছর। তাঁর দেখানো পথ ধরে ক্যান্সার গবেষণা বা সামগ্রিকভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হলো। আর তা ঘটলো এক ইহুদি বিজ্ঞানী সিজার মিলস্টাইনের হাত ধরে ১, ২, ৩।
সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে স্বাধীন বিজ্ঞানী হিসেবে মিলস্টাইনের পথ চলা শুরু। বুয়েনোস আইরেসে নিজের পি এইচ ডি গবেষণাপর্বে অ্যান্টিবডির গঠন নিয়ে কাজ করতে করতে ইমিউনোলজির প্রেমে পড়েন তিনি, যা তাঁর বাকী জীবনের সঙ্গী হয়ে যায় । অ্যান্টিবডির “স্পেসিফিসিটি” বা বিশেষ লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার ক্ষমতা বিজ্ঞানীদের গোচরে ছিল । কিন্তু একটি অ্যান্টিবডির দেহের শত সহস্র প্রোটিনের মধ্যে কেবল একটি প্রোটিনের সঙ্গেই সংযুক্ত হওয়ার ক্ষমতার কারণ ছিল এক জটিল ধাঁধা । এই সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে মিলস্টাইন তার নতুন ল্যাবরেটরিতে জর্জ কোহলারের (পোস্ট ডক্টরাল ফেলো) সঙ্গে তৈরী করে ফেললেন, “মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি” যা ক্যান্সার চিকিৎসার এক নবদিগন্তের সূচনা করলো ৪।
কিন্তু কি এই “মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি”? আমাদের দেহ যখন কোনো এক জীবানু দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন সেই জীবানুর মোকাবিলায় দেহের অন্যতম সক্রিয় প্রতিরোধ প্রক্রিয়াটি হলো অ্যান্টিবডি উৎপাদন। একধরণের বিশেষ কোষ (যার নাম প্লাসমা সেল) মূলত এই অ্যান্টিবডি তৈরীর কাজ করে। সবথেকে বৈশিষ্টপূর্ণ ঘটনা হলো একটি প্লাসমা সেল কেবল একধরণের অ্যান্টিবডিই তৈরী করে। একটি জীবানু যেহেতু বহু প্রোটিন দ্বারা গঠিত, তাই তার বিরুদ্ধে লড়তে আমাদের প্রয়োজন একাধিক প্লাসমা সেল নির্মিত অ্যান্টিবডির। মিলস্টাইন লক্ষ্য করলেন যখন এই প্লাসমা কোষের ক্যান্সার হয়, তখন সেই প্লাসমা সেলগুলি সুস্থ প্লাসমা কোষের থেকে অন্য রকম ব্যবহার করে – সে অমরত্ব লাভ করে এবং একই অ্যান্টিবডি তৈরী করতেই থাকে। তিনি ভাবতে থাকলেন, এই অমরত্বপ্রাপ্ত প্লাসমা কোষগুলিকে শরীরের বাইরে কৃত্রিম পরিবেশে রেখে কি এমন অ্যান্টিবডি তৈরী করা যায়, যা দিয়ে অন্য কোন ক্যান্সারের প্রতিষেধক বানানো যেতে পারে? অবশ্যই সেই অ্যান্টিবডিকে এমন হতে হবে যা সুস্থ কোষের উপর আক্রমন করবে না। এই প্রশ্নের সন্ধান থেকেই মিলল বিশেষভাবে নির্মিত “মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি” যা কেবল বেছে বেছে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষকেই আক্রমন করবে এবং সুস্থ কোষগুলি থাকবে অনাক্রান্ত।
মিলস্টাইনের হাত ধরে শুরু হওয়া এই পথ চলা আজ ক্যান্সার বিজ্ঞানে এক নতুন দিগন্তের সূচনা ঘটিয়েছে । উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ‘মেলানোমা’ নামক এক মারাত্মক ত্বকের ক্যান্সারের চিকিৎসা আজ অনেকটাই সফলভাবে সম্ভব হয়েছে এই প্রক্রিয়ার জোরে। শুধু ‘মেলানোমা’ নয়, বিগত এক দশকে বহু ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কার্যকর অসংখ্য মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি সফলভাবে বাজারে চালু হয়েছে। এর সঙ্গে, ক্যান্সার ইমিউনোথেরাপীর জগতে সংযোজিত হয়েছে আরো অনেক নূতন নূতন অস্ত্র সম্ভার যার ফলে ক্যান্সার থেকে মুক্তির পথ প্রতিদিন আরো বেশী উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ৫ । হয়তো সেই দিন বেশি দূরে নেই যেদিন ক্যান্সার রোগী সম্পূর্ণভাবে সেরে উঠবে , আর ক্যান্সারকে পরাজিত করে বিজ্ঞান জয়ের হাসিতে উদ্ভাসিত হবে।
References:
১. Marquardt, M. (2013). Paul Ehrlich. Springer-Verlag
২. Piro, A., Tagarelli, A., Tagarelli, G., Lagonia, P., & Quattrone, A. (2008). Paul Ehrlich: the Nobel Prize in physiology or medicine 1908. International reviews of immunology, 27(1-2), 1-17
৩. Strebhardt, K., & Ullrich, A. (2008). Paul Ehrlich’s magic bullet concept: 100 years of progress. Nature Reviews Cancer, 8(6), 473-480.
৪. Milstein, C. (1986). From antibody structure to immunological diversification of immune response. Science, 231(4743), 1261-1268.
৫. Mellman, I., Coukos, G., & Dranoff, G. (2011). Cancer immunotherapy comes of age. Nature, 480(7378), 480-489.
প্রচ্ছদের ছবিঃ পল আর্হলিখ এবং সিজার মিলস্টাইন (উৎস – www.nobelprize.org)