অঞ্জন নন্দী
সিনিয়ার রিসার্চ সায়েন্টিস্ট
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সাইন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ, কলকাতা
প্রথম অংশে আমরা দেখেছিলাম মৌমাছির আপাত নিঃস্বার্থ কর্মজীবন কিভাবে ডারউইনের ন্যাচারাল সিলেকশন তত্ত্বকে বিপাকে ফেললো। যারা প্রজনন করেনা, তাদের বংশবৃদ্ধির তাগিদ দিয়ে বোঝানো যায় কি? আর ন্যাচারাল সিলেকশন তত্ত্বের মধ্যে নিঃস্বার্থ প্রকৃতির তো কোনো জায়গাই নেই! অথচ নিঃস্বার্থ আচরণ সর্বত্র চোখে পড়ে! দ্বিতীয় অংশে আমরা দেখলাম যে হ্যালডেন ও হ্যামিলটনের কিন সিলেকশন তত্ত্ব কিভাবে উদ্ধার করলো ডারউইনকে। তারা বললেন, প্রজনন ছাড়াও জ্ঞাতির সেবা করলেই নিজের জিন কে টিকিয়ে রাখা যায় এবং সেটা না ধরলে অঙ্কটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বিশেষ করে মৌমাছি বা হাইমেনপটেরা গ্রুপের প্রজাতিদের ক্ষেত্রে, যাদের প্রজনন পদ্ধতি মোটেই সোজাসাপটা নয়। এদের ক্ষেত্রে সব হিসেব ওলটপালট হয়ে যায়। যেমন, একজন কর্মী-মৌমাছি নিজে সন্তানের জন্ম না দিয়ে যদি নিজের বোনের দেখাশোনা করে, তাহলে সে সুবিধে পায় বেশি! কাজেই, আত্মীয়ের সেবা থেকে শুরু করে কয়েক প্রজন্ম পরে শুধু পরোপকারী কর্মীদেরই ভিড়।
কিন্তু, এতেই কি সব রহস্যের সমাধান হলো? বিজ্ঞানের ইতিহাসে সব সময়েই দেখতে পাবেন যখনই কোনো একটা ধাঁধার সমাধান হয়, আবার সেখান থেকেই শুরু হয়ে যায় নতুন কোনো ধাঁধা! মনে করে দেখুন, হাইমেনপটেরা-তে দুই বোনের মধ্যে জেনেটিক সম্পর্ক ৩/৪। কিন্তু সেটা কেবল তখনই যখন সেই বোনেরা একই বাবা মায়ের সন্তান! দুই সৎ বোন (একই মা কিন্তু আলাদা বাবা)-এর মধ্যে জেনেটিক সম্পর্ক অনেক কম, মোটে ১/৪। পরীক্ষা করলে কিন্তু রাণীদেরদের শুক্রাণুর থলিতে প্রায়শই একের বেশি পুরুষের শুক্রাণু পাওয়া যায়। তার মানে হল, কর্মীদেরদের মধ্যে জেনেটিক সম্পর্ক যতটা বেশি ভাবা হচ্ছিল, আসলে ততটা নয়।
অনেক প্রজাতিতে আবার কলোনীর হাতবদলও হয় – এবার এক রাণী গিয়ে যদি তার মেয়ে নতুন রাণী হয়, তাহলে নতুন জন্মানো কর্মীরা হবে পুরনো কর্মীদের বোনঝি। জেনেটিক সম্পর্কও যাবে অনেক কমে! এইসব কারণে বাস্তবে কর্মীদের মধ্যে গড় জেনেটিক সম্পর্ক ৩/৪ তো থাকেই না, ১/২-এরও অনেক কম হয়। এখন প্রশ্ন হল, তাহলে কর্মীরা কলোনীতে পড়ে আছে কেন? বেরিয়ে গিয়ে নিজেরা বাসা তৈরী করে ডিম পাড়লে তো অনেক বেশি ফিটনেস পাবে!
লক্ষ্য করে দেখুন, হ্যামিলটনের বিধানে কিন্তু জেনেটিক সম্পর্ক ছাড়া আরো দুটো ফ্যাক্টর আছে, লাভ বা বেনিফিট আর ক্ষতি বা কস্ট- এই দুটোর তারতম্যের জন্যেও কিন্তু শর্তটা পূরণ হয়ে যেতে পারে। একজন কর্মীকে কলোনী ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে, নতুন বাসা তৈরী করে, ডিম পেড়ে, সেই ছানাকে খাবার যুগিয়ে বড় করতে গেলে হাজারো হ্যাপা পোয়াতে হবে। আর ছানা বড় হবার আগে সেই কর্মী যদি নিজেই কারোর খাবার হয়ে যায়, তাহলে তো পুরো খাটুনিটাই মাটি। তার চেয়ে নিজের সন্তানের আশা জলাঞ্জলি দিয়ে (ক্ষতি বা কস্ট) সে যদি কলোনীতে থেকে যায়, তাহলে অনেক কম খাটুনি খেটে অনেক বেশি সংখ্যায় জ্ঞাতিদের দেখাশুনা করতে পারবে। জ্ঞাতিদের সঙ্গে জেনেটিক সম্পর্ক যদি কমও হয়, কুছ পরোয়া নেহি, তাদের সংখ্যা তো অনেক বেশি, তাই অনেক বেশি ফিটনেস (লাভ বা বেনিফিট) পাওয়াও তার নিশ্চিত।
মুশকিল হল, বাস্তবে এই আচার-আচরণের লাভ আর ক্ষতিগুলো মাপতে পারাটা ভীষণ কঠিন। তাই এই তত্ত্বটা কোনো প্রজাতির ক্ষেত্রে প্রমাণ করে দেখানোও কঠিন। আনন্দের কথা, এই দুরূহ কাজটাই বাস্তবে করে দেখিয়েছেন একজন ভারতীয় বৈজ্ঞানিক, প্রফেসর রাঘবেন্দ্র গদগকর, এই ভারতের মাটিতে বসেই। ব্যাঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স-এ বিশেষ প্রজাতির এক বোলতা, ‘রোপালিডিয়া মার্জিনাটা’-র ওপর দীর্ঘ গবেষণায় তিনি এই তত্ত্বের সত্যতা যাচাই করেছেন। নিঃস্বার্থ আচরণের ধাঁধার সমাধানে তাঁর এই ‘অ্যাসিয়োর্ড ফিটনেস রিটার্ন’ তত্ত্ব এখন একটা অন্যতম তত্ত্ব হিসেবে বিজ্ঞানীমহলে স্বীকৃত।
আর মানুষ? সে তো নিজের একটা ভাইয়ের জন্যই জীবনের ঝুঁকি নিতে রাজি! এমনকি কখনো হয়ত পাড়াতুত ভাইয়ের জন্যও! কোথায় গেল এখানে ‘কিন সিলেকশন’ তত্ত্ব? আসলে আপনি তো দেখলেনই, নিঃস্বার্থ আচরণের লাভ আর ক্ষতি মাপা কতটা কঠিন হতে পারে! এখনো পর্যন্ত হাতে গোনা কয়েকটা প্রাণীর ক্ষেত্রেই এই চেষ্টাটা করা গেছে। তাছাড়া পশুপাখিদের ওপর যে ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো যায়, মানুষের ওপর সেটা অসম্ভব! তাই মানুষের ক্ষেত্রে খুব সফলভাবে এসব মাপামাপি করে ওঠা যায়নি।
আরো একটা জরুরী ব্যাপার ভুললে চলবেনা। সহজ করে ভাবার জন্য এটা বলা হয় বটে যে নিঃস্বার্থ আচরণটা শুধুমাত্র কিছু জিনের প্রভাবে হচ্ছে। আসলে কিন্তু মানুষ কোন পরিস্থিতিতে পড়লে কী আচরণ করবে, সেটা আরো অনেক কিছুর ওপরই নির্ভর করে। এই যেমন তার বড় হয়ে ওঠার পরিবেশ, তার শিক্ষা-দীক্ষা, বংশানুক্রমে পাওয়া জ্ঞান, ইত্যাদি – এককথায় বলতে গেলে তার ‘সংস্কৃতি’টাও এসব ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই সমস্ত কিছুকে মিলিয়ে মিশিয়ে কোনো একটা ঠিকঠাক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এখনো দুরস্ত। তবে দিশাটা এখন অন্তত চোখে দেখা যাচ্ছে।
দিনবদলের পালা?
নিঃস্বার্থ আচরণের ধাঁধার সমাধান তো ডারউইন বা ওয়ালেস কেউই করে যেতে পারেননি। করেছেন হ্যালডেন আর হ্যামিলটন, তাও কিনা একশ বছর পরে! আপনি প্রশ্ন তুলতে পারেন, তাহলে কি ন্যাচারাল সিলেকশন তত্ত্বটাই ভুল ছিল? নইলে আবার একটা নতুন তত্ত্বের দরকার পড়লো কেন?
কিন্তু ভেবে দেখুন, ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ অনুযায়ী নিজের বৈশিষ্ট্যগুলোর ‘সিলেকশন’ মানে হল নিজের সন্তান-সন্ততির মাধ্যমে পাওয়া ‘ফিটনেস’ বেড়ে যাওয়া। ‘কিন সিলেকশন’ থিওরিতে সেই ধারণাটাই আরেকটু এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। বলা হলো যে নিঃস্বার্থ আচরণের বেলায় ‘সিলেকশন’ মানে হল নিজের ‘ইনক্লুসিভ ফিটনেস’ বেড়ে যাওয়া। কাজেই একে ন্যাচারাল সিলেকশনের একটা সম্পূরক বা ‘সাপ্লিমেন্টারী থিওরি’ বলা চলতে পারে।
আসলে কিন্তু ন্যাচারাল সিলেকশন তত্ত্ব থেকে শুরু করে অঙ্ক কষেও এই ‘কিন সিলেকশন’ তত্ত্বে পৌছনো যায়। তবে সেই অঙ্কটা কষা খুব কঠিন। ইনক্লুসিভ ফিটনেসের ধারণা বা ‘কনসেপ্ট’-টা সেই অঙ্কটাকে অনেক সোজা করে দেয়। আর সেই কারণেই এই তত্ত্বের চাহিদা।
তবে সেই কঠিন অঙ্কটা কষা হয়েছে খুব সম্প্রতি। সেটা কষেই বিজ্ঞানীমহলে হইচই ফেলে দিয়েছেন নবীন মার্কিন গবেষক মার্টিন নোওয়াক। তার ক্যালকুলেশনের ফলে এখন ‘কিন সিলেকশন’ থিওরির ভবিষ্যত নিয়েই প্রশ্ন উঠে গেছে।
২০১০ সালে নোভাক এবং উইলসন জনপ্রিয় বিজ্ঞান-পত্রিকা ‘নেচার’-এ এই গবেষণাপত্র ছাপান১। মজার ব্যাপারটা হল, এই কাজে নোওয়াক-এর সাথী উইলসন হলেন আসলে প্রকৃতিবিজ্ঞানের জগতের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ত্ব ই.ও. উইলসন (১৯২৯-)। যিনি ‘কিন সিলেকশন’ তত্ত্বের প্রস্তাবনার পর থেকে তাকে জনপ্রিয় করার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। এটা সত্যি যে ‘কিন সিলেকশন’ তত্ত্বের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। খুব নির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতিতেই এই তত্ত্ব কাজে লাগান যায়। এই সীমাবদ্ধতাগুলো স্মরণ করিয়ে দিয়ে নোওয়াক আর উইলসন দেখান যে, নিঃস্বার্থ আচরণের ধাঁধার সমাধানে এই তত্ত্বের কোনো প্রয়োজন নেই, ডারউইন-ওয়ালেস প্রস্তাবিত ন্যাচারাল সিলেকশন তত্ত্বই এর জন্য যথেষ্ট। এবং সেখানে এই সীমাবদ্ধতাগুলোও নেই।
এই গবেষণাপত্র নিয়ে বিতর্কের ঝড় ওঠে। গোটা বিজ্ঞানীমহল দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়, এমনকি সই-সংগ্রহ করে প্রতিবাদপত্রও যায় নেচার-এর দপ্তরে! আর এভাবেই বিজ্ঞান এগিয়ে চলে তার নিজের গতিতে। যদি ভবিষ্যতে ‘কিন সিলেকশন’ তত্ত্বের ঠাঁই হয়ওবা আস্তাকুঁড়ে, একথা কখনই ভোলা যাবেনা যে এই তত্ত্বই প্রথম দেখায় কিভাবে ন্যাচারাল সিলেকশনের মাধ্যমে নিঃস্বার্থ আচরণ ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর তাই নিঃস্বার্থ আচরণের ধাঁধার প্রাথমিক সমাধানের জন্য হ্যালডেন এবং হ্যামিলটন, দুজনকেই ইতিহাস মনে রাখবে।
(সমাপ্ত)
প্রচ্ছদের ছবি: হ্যালডেনের কাহিনীর চিত্ররূপ। শেডের তারতম্যে বোঝানো হয়েছে যে পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির জিনের কত ভাগ ডুবন্ত মানুষের মধ্যে রয়েছে। পাড়ের মানুষটি নিজের জীবনের ঝুঁকি তখনই নিচ্ছেন যখন নিজের তুলনায় বেশি সংখ্যক জিন বাঁচানোর সুযোগ রয়েছে। ছবিটি আঁকা হয়েছে ‘সারভাইভাল স্ট্র্যাটেজিস’ বইতে ছাপা সুধা প্রেমনাথ-এর আঁকা কার্টুনের অনুকরণে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: এই লেখাটি হাভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ছাপা প্রফেসর রাঘবেন্দ্র গদগকর-এর ‘সারভাইভাল স্ট্র্যাটেজিস’ বই-এর অনুসরণে লেখা। সঙ্গে গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য-র ‘বাংলার কীটপতঙ্গ’ বইটির সাহায্যও নেওয়া হয়েছে। লেখার ব্যাপারে মূল্যবান মতামত দিয়ে সাহায্য করেছেন পারমিতা সাহা, সৈকত চক্রবর্তী এবং সৌভিক ভট্টাচার্য।
তথ্যসূত্র:
[১] M. Nowak et. al. (2010) The evolution of eusociality, Nature 466, 1057-1062.