শক ওয়েভ (shock wave) নিয়ে কিছু লেখার আগে আমি পাঠককে প্রথমে এক অন্য জগতে নিয়ে যাব – সেখানে চাপের পরিমাণ পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠে বায়ুমণ্ডলের যে চাপ (সমুদ্রপকূলে বাতাসের চাপের পরিমাণ হল ১ bar = ১০০,০০০ নিউটন/বর্গমিটার) তার লক্ষ বা কোটি গুণ, আর তাপমাত্রা আমাদের আশেপাশের বাতাসের তাপমাত্রার (প্রায় ২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস বা ২৯৮ K) দশ থেকে একশগুণ বা তারও বেশী হতে পারে। এ জগৎ আমাদের চেনাশোনা পরিবেশের থেকে অনেকটাই আলাদা। এরকম পরিবেশ খুঁজে পাওয়া যায় গ্রহদের অভ্যন্তরে। এই অচেনা পরিবেশে আমাদের চেনা পরিচিত পদার্থরা কি অবস্থায় থাকে, আর তাদের ব্যবহারই বা কেমন? কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক।
গ্রহদের অভ্যন্তরের কথা যখন তুলেছিলাম তখন শুরু করি পৃথিবীকে দিয়েই। পৃথিবীর একদম কেন্দ্রের অংশটিকে ভূবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে “core” (ছবি ১)।
ছবি ১. পৃথিবী এবং বৃহস্পতির অভ্যন্তরের বিভিন্ন গভীরতায় চাপ, তাপমাত্রা এবং গঠন। (উৎস : nature.com এবং tufts.edu)
পৃথিবীর এই কেন্দ্র অঞ্চলের চাপ প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ GPa (এই চাপ পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠে বাতাসের চাপের ৩০-৪০ লক্ষ গুণ; ১ GPa = ১ gigapascal = ১০,০০০ bar) আর তাপমাত্রা ৫০০০ সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। কেন্দ্রের বাইরের দিকটা (outer core) তরল লোহা (Fe) আর নিকেলের (Ni) সংমিশ্রণে তৈরী, আর ভেতরের অংশটা (inner core) তৈরী মূলত লোহা দিয়ে। Inner core অঞ্চলের চাপ আর তাপমাত্রা outer core এর থেকে বেশী হলেও এখানে লোহা কিন্তু তরল নয়, বরং কঠিন অবস্থায় আছে। চাপ আর তাপমাত্রার হেরফেরে লোহা কখনো তরল, কখনো কঠিন! কিন্তু পৃথিবীর কেন্দ্রের কঠিন লোহা আর আমাদের চারপাশে পড়ে থাকা লোহার গঠন কি এক? ভাববার বিষয়।
সৌরমণ্ডলের সবচেয়ে বড় গ্রহ বৃহস্পতি আবার তৈরী মূলত হাইড্রোজেন দিয়ে (প্রায় ৯০% হাইড্রোজেন)। বৃহস্পতির একেবারে কেন্দ্রে চাপ ও তাপমাত্রার পরিমান প্রায় ৭০০০ GPa বা ৭০ Mbar (পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠে বাতাসের চাপের ৭ কোটি গুণ!) আর ~২০,০০০ K, যেটা শুনে হয়ত অনেকেই ভিরমি খাবে (ছবি ১)। কেন্দ্রের অনেকটা বাইরেও (outer core region) যদি যাই, সেখানেও চাপ আর তাপমাত্রা কিন্তু কম নয়। এখানে চাপের পরিমাণ ১০০ GPa এর বেশি এবং তাপমাত্রা সূর্যের উপরিতলের (photosphere) তাপমাত্রার প্রায় সমান, মানে ৬০০০ K এর কাছাকাছি। এই পরিবেশে হাইড্রোজেন আর গ্যাসীয় অবস্থায় থাকে না, সংকুচিত হয়ে সে পরিণত হয় তরল ধাতুতে। বৃহস্পতির সাথে সাথে এই তরল হাইড্রোজেন ধাতুও প্রচন্ড বেগে ঘুরে চলেছে। এর ফলে বৃহস্পতির আশেপাশে একটা চৌম্বকক্ষেত্র তৈরী হয়েছে যেটা পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের থেকে প্রায় ১৪ গুণ বেশী শক্তিশালী এবং যার বিস্তৃতি প্রায় শনিগ্রহ পর্যন্ত। স্বাভাবিক অবস্থায় পারদ যে একমাত্র তরল ধাতু সেটা আমরা অনেকেই পড়েছি, কিন্তু কে ভেবেছিল যে বৃহস্পতির ভেতরে হাইড্রোজেন গ্যাসও তরল ধাতুতে পরিণত হয়? আবার দ্যাখো, পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের জন্যে দায়ী তরল লোহা, কিন্তু বৃহস্পতির চৌম্বকক্ষেত্র তৈরী করে তরল হাইড্রোজেন।
পৃথিবী এবং বৃহস্পতির কেন্দ্রে ঠিক কতটা চাপ তৈরী হয় সেটাকে তুলনামূলকভাবে দ্বিতীয় ছবিতে বোঝানো হয়েছে (ছবি ২)। প্রসঙ্গত, নক্ষত্রদের অভ্যন্তরে চাপ এবং তাপমাত্রা গ্রহদের তুলনায় এত বেশী যে পদার্থ কখনো প্লাজমা (plasma) অবস্থায় থাকে অথবা কখনো তার ঘনত্ব বা তাপমাত্রা এমন যে না তাকে কঠিন বলা যাবে না প্লাজমা। পদার্থের এই অবস্থার নাম বিজ্ঞানীরা রেখেছেন warm dense matter (WDM)।
ছবি ২. সমুদ্রতল, পৃথিবী এবং বৃহস্পতির কেন্দ্রে চাপের তুলনা। (source:NASA)
গ্রহ-নক্ষত্রদের ছেড়ে এবার ধরা যাক সোডিয়াম (Na) আর লিথিয়াম (Li) এই দুটি ধাতব মৌলের কথা। আমরা জানি যে স্বাভাবিক পরিবেশে এরা তড়িতের সুপরিবাহী। কিন্তু দেখা গেছে যে পৃথিবীর কেন্দ্রের মতন অতটা না হলেও, লিথিয়ামের ওপর যদি ৮০ GPa চাপ প্রয়োগ করা হয় তাহলে সে আর তড়িতের সুপরিবাহী থাকে না, বরং সেমিকন্ডাক্টরে পরিণত হয়। একইভাবে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে ২০০ GPa চাপে (সমুদ্রপৃষ্ঠের চাপের ২০ লক্ষ গুণ চাপ) সোডিয়াম ধাতুও সংকুচিত হয়ে তড়িতের অপরিবাহী বা নিদেনপক্ষে সেমিকন্ডাক্টরে পরিণত হয়। উপরন্তু সোডিয়াম এই চাপে আর অস্বচ্ছ নয়, বরং স্বচ্ছ, মানে এর মধ্যে দিয়ে আলো পারাপার করতে পারে। অদ্ভুত মজার ব্যাপার তাই না?
ওপরের উদাহরণগুলো থেকে এটা বোঝা যায় যে উচ্চচাপে পদার্থের অবস্থা আর ধর্ম দুয়েরই ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে – আমাদের চেনা ছকের সাথে অনেকসময়ই তার মিল পাওয়া যায় না। অনেক বিজ্ঞানী যাদের কোয়ান্টাম ফিজিক্স সম্পর্কে ভালো ধ্যানধারণা আছে তারা চেষ্টা করছেন কম্পিউটার এর সাহায্যে গাণিতিকভাবে উচ্চচাপে পদার্থের অবস্থা এবং ধর্ম বোঝার। কিন্তু তাদের গণনা কতটা সঠিক বা কোয়ান্টাম ফিজিক্সের যে তত্ত্বগুলো বিজ্ঞানীরা তাদের গণনায় ব্যবহার করছেন সেগুলো এই প্রচন্ড চাপ এবং তাপমাত্রাতেও ঠিকঠাক ভাবে খাটে কিনা – এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে পরীক্ষানিরীক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে পৃথিবী বা বৃহস্পতির ভেতরে গিয়ে সেখানকার পদার্থের অবস্থা নিয়ে পরীক্ষা করা সম্ভব নয়, বরং বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন যে গবেষণাগারের ভেতরেই যদি এই ধরনের উচ্চচাপ পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়। সেক্ষেত্রে পরীক্ষানিরীক্ষা আর গণনার মেলবন্ধন ঘটানো গেলে গ্রহ-নক্ষত্রদের ব্যাপারে অনেক কিছু জানাও যাবে আর একইসাথে পদার্থবিদ্যার তত্ত্বগুলিরও যাচাই করা সম্ভব হবে।
ছবি ৩. পারস্পরিক দূরত্বের সাথে পদার্থের দুটি অণু বা পরমাণুর মধ্যেকার আকর্ষণ ও বিকর্ষণজনিত স্থিতিশক্তির পরিবর্তন একটি সহজ মডেলের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। (উৎস: ucdavis.edu)
চাপ বাড়িয়ে কোনো পদার্থকে সংকুচিত করার ব্যাপারটা মোটেও সহজসাধ্য নয়। একটু খুলে বলা যাক। ওপরের ছবিতে (ছবি ৩) কোনো পদার্থের দুটি অণু বা পরমাণুর মধ্যে আকর্ষণ বা বিকর্ষণজনিত স্থিতিশক্তিকে সহজভাবে দেখানো হয়েছে। একটি নির্দিষ্ট সুস্থির দূরত্বে পরমাণু দুটির ওপর আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বল শূন্য, অর্থাৎ F = ০| এই দূরত্বে তাদের মধ্যেকার স্থিতিশক্তিও সর্বনিম্ন এবং সেই জন্যে পরমাণুদুটি সাধারণ অবস্থায় এই নির্দিষ্ট দুরত্বে থাকতে চায়। পদার্থটিকে সংকুচিত করা হলে তার পরমাণুগুলি একে অপরের কাছে চলে আসে, এবং তখন তাদের নিউক্লিয়াস ও ইলেক্ট্রনগুলি একে অপরকে বিকর্ষণ করে দূরে ঠেলে দিতে চায়। অন্যদিকে, পদার্থটিকে প্রসারিত করা হলে পরমাণুগুলি একে অপরের থেকে দূরে সরে যায় এবং তাদের মধ্যে আকর্ষণ বেড়ে গিয়ে নিজেদের কাছাকাছি আসতে চায়। এই কারণে পরমাণুদুটিকে সুস্থির দূরত্বের থেকে কাছে আনতে বা দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে হলে বাহ্যিকভাবে বলপ্রয়োগ করতে হয়, যারফলে শক্তিব্যয় হয়। ছবিটায় ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখবে যে কোনো পদার্থকে চাপ দিয়ে সংকুচিত করার কাজটা তাকে টেনে প্রসারিত করার থেকে কঠিন। আরো লক্ষ্য করবে যে কোনো পদার্থকে যত সংকুচিত করবে তাকে আরেকটু বেশি সংকুচিত করার কাজটা আরো অনেক কঠিন হয়ে দাড়ায় কারণ এর জন্যে প্রয়োজনীয় বাহ্যিক শক্তির পরিমাণটাও দ্রুতহারে বাড়তে থাকে। গ্রহ-নক্ষত্রদের ভেতরে উচ্চচাপে পদার্থের অবস্থা, গঠন বা ধর্ম নিয়ে যারা পরীক্ষানিরীক্ষা করছেন বা করার চেষ্টা করছেন তাদের একটা চ্যালেঞ্জ হলো পদার্থকে সংকুচিত করার জন্যে গবেষণাগারের ভেতরে এই বিশাল পরিমাণ বাহ্যিক শক্তির জোগান দেওয়া।
গবেষণাগারের ভেতর কোনো পদার্থকে সাধারণত দুই উপায়ে সংকুচিত করা হয়ে থাকে – ধীরে ধীরে সেকেন্ড বা তার বেশী সময় ধরে (static high-pressure compression) অথবা খুব দ্রুতহারে সেকেন্ডের লক্ষভাগেরও কম সময়ে (dynamic high-pressure compression)। স্ট্যাটিক হাই প্রেসার গবেষণাক্ষেত্রের জনক বলা হয় নোবেলজয়ী মার্কিন বিজ্ঞানী পার্সি ব্রিজম্যানকে (Percy W. Bridgman)। এক্ষেত্রে বর্তমানে যে যন্ত্রটি ব্যবহার করা হয় তার নাম হলো Diamond Anvil Cell (DAC)। সোডিয়াম আর লিথিয়ামকে সংকুচিত করার যে উদাহরণ ওপরে দেওয়া হয়েছে সেটা করা হয়েছিল DAC ব্যবহার করেই। অন্যদিকে, ডায়নামিক কম্প্রেশনের ক্ষেত্রে সাধারণত শক ওয়েভের সাহায্য নেওয়া হয়। এপ্রসঙ্গে বলে রাখি যে আমেরিকায় স্যান্ডিয়া আর লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞানীরা শক ওয়েভের সাহায্যে গবেষণাগারের মধ্যে হাইড্রোজেনকে সংকুচিত করে তরল ধাতু বা ধাতব অবস্থায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন, ঠিক যেমনটা বৃহস্পতি গ্রহের ভেতরে রয়েছে। আমি নিজে যেহেতু শক ওয়েভ নিয়ে গবেষণারত তাই আমার এখানে মূল উদ্দেশ্য হলো তোমাদের জানানো যে শক ওয়েভের সাহায্যে কিভাবে গবেষণাগারে গ্রহ-নক্ষত্রদের অভ্যন্তরের পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে বা করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু শক ওয়েভ সম্পর্কে যেহেতু অনেকেরই খুব বেশী ধারণা হয়ত নেই, তাই পরের পর্বে বলে নেব এই শক ওয়েভ জিনিসটা কি এবং এর সাহায্যে গ্রহ-নক্ষত্রের খবরাখবর ছাড়াও আর কি কি জানতে পারি।
আগ্রহী পাঠকদের জন্যে নিচে কয়েকটি লিংক দেওয়া হল, যেগুলো অনেকাংশে ওপরের লেখারও উৎস:
১. https://astronomy.nmsu.edu/tharriso/ast105/Jupiter.html
২. https://www.nature.com/nature/journal/v458/n7235/pdf/458158a.pdf
৩. https://str.llnl.gov/str/Nellis.html
৪. The Size, Composition, and Surface Features of the Planets Orbiting the Sun – An Anthology of Current Thought, edited by Ellen Foxxe, p. 90.
৫. https://www.bbc.com/future/bespoke/story/20150306-journey-to-the-centre-of-earth/index.html
প্রচ্ছদের ছবিটি প্রথম Diamond Anvil Cell-এর (NIST)