জ্যামিতি আমরা সকলেই কমবেশি পড়েছি, মজাও পেয়েছি… কিন্তু এই প্রশ্নটা কি আমরা কখনো ভেবেছি যে এই যে জ্যামিতিতে এত উপপাদ্য-সম্পাদ্য , এগুলোর জন্যে আমাদের ঠিক কোন জিনিসগুলো লাগে? মানে ঠিক কতটুকু কেউ আমাদের দিয়ে দিলেই জ্যামিতির বাকিটা আমরা নিজেরাই ভেবে ভেবে বের করে ফেলতাম, অনেক সময় লাগত হয়ত…কিন্তু পারতাম।
আমি জানি অনেকের কাছেই এই প্রশ্নটাই অদ্ভুত লাগবে, কারণ জ্যামিতি তো সবটাই ভেবে ভেবেই বের করা, এতে আবার দেওয়া কি আছে, কি ই বা দেওয়া থাকবে বা থাকতে পারে? আজকে আমরা এই প্রশ্নগুলো নিয়েই মাথা ঘামাব –
- জ্যামিতিতে সত্যিই কিছু দেওয়া আছে কিনা?
- আদৌ কিছু দেওয়া থাকার প্রয়োজন আছে কিনা?
- যদি থাকে তবে কি দেওয়া আছে, কি দেওয়া থাকতে হয়?
- সবচেয়ে কম কতটুকু আমাদের দেওয়া থাকলেই আমরা জ্যামিতি বলতে আমরা যা বুঝি সেই সবটা করতে পারি ?
এই প্রশ্নগুলোকেই আমরা জ্যামিতির গোড়ার কথা বলব, গোড়া অর্থে এখানে ভিত … শুরু নয় মোটেই, কারণ এই প্রশ্নগুলোর কথা ভেবে কেউ জ্যামিতি শিখতে শুরু করেও না, করলে সেভাবে শেখাটা বেশ শক্তই হত । যাই হোক, প্রশ্ন যখন তুলেই ফেলা হয়েছে তখন ভাবনাচিন্তা শুরু- আর নিশ্চয়ই এর মধ্যেই আমাদের অনেকেরই মনে পড়েছে ইউক্লিডের[1] স্বতস্বিদ্ধগুলোর কথা । স্বতস্বিদ্ধগুলো যখন ধরে নিয়েই জ্যামিতি শুরু করতে হত , তখন সেগুলো দেওয়া থাকা জিনিসই, given, a priori ।
আলোচনা গড়াবার আগে চট করে একবার দেখে নি এই স্বতস্বিদ্ধগুলো কি ?
- যেকোনো দুটি বিন্দু দেওয়া থাকলে ওই দুটি বিন্দু দিয়ে যায় এরকম সরলরেখা আঁকা যায়
- যেকোনো সরলরেখাংশকে ক্রমাগত বর্দ্ধিত করে একটি সরলরেখা পাওয়া যায়
- একটি বিন্দু ও একটি দূরত্ব দেওয়া থাকলে ওই বিন্দুকে কেন্দ্র করে ওই দূরত্বের সমান ব্যাসার্ধের বৃত্ত আঁকা যায়
- সমস্ত সমকোণ পরস্পরের সমান
- একটি সরলরেখা অন্য দুটি সরলরেখাকে ছেদ করলে যদি কোন একটি দিকে অন্তর্বর্তী কোণদ্বয়ের যোগফল ১৮০ ডিগ্রীর কম হয় , তবে সরলরেখাদুটিকে অনির্দিষ্টভাবে বর্দ্ধিত করলে সেই দিকে মিলিত হবে
পাঁচ নম্বরটা খানিক খটমট, সেটায় আমরা পরে ফিরে আসব, কিন্তু প্রথম চারটেয় দেওয়া থাকার কি আছে? এইটাই মনে হচ্ছে না? অনেক কিছুর মতই এতেও ইউক্লিডের প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় যে তিনি বুঝেছিলেন বা আন্দাজ করেছিলেন যে এভাবে আলাদা করে এগুলো লেখার সুফল থাকলেও থাকতে পারে। আচ্ছা ২ নম্বরটাকে নিয়েই ভাবা যাক। আমরা একটা কাগজের উপর জ্যামিতি কষতে বসেছি, তাহলেই তো দ্বিতীয়টা সত্যি নয়। সরলরেখা অসীম, অথচ কাগজটা একসময় শেষ হয়ে যাবে। আবার ধরুন কাগজে দুটো বিন্দু এঁকে বিন্দু দুটোর মাঝখান দিয়ে কাগজটা ছিঁড়ে ফেললাম, ১ নম্বরটাও আংশিকভাবেও সত্যি নয় আর, মানে সরলরেখার জায়গায় সরলরেখাংশ চাইলেও নয়। আরও একটা উদাহরণ দি, একটা বৃত্ত আঁকুন, বৃত্তের ওপরে একটা বিন্দু নিন। এবার ওই বিন্দু থেকে ব্যাস টানলে সেটা উল্টোদিকে বৃত্তের যেখানে ছেদ করবে সেই বিন্দুটা আর আগের বিন্দুটাকে একটা সরলরেখাংশ দিয়ে যোগ করার চেষ্টা করুন। বৃত্তটা কম্পাস দিয়ে এঁকে থাকলে পারবেন না করতে, কারণ কম্পাস বসানোর জন্য বৃত্তের কেন্দ্রটা গেছে ফুটো হয়ে। তাহলে কিছু একটা দেওয়া আছেই, একদম ফালতু নয় ওগুলো। কিন্তু কি?
১ নম্বরটা আসলে বলছে যার ওপরে আমরা জ্যামিতি কষব সেই জিনিসটা অসীম, আর ২ নম্বরটা বলছে তাতে ছেঁড়া-ফাটা নেই, ফুটো-টুটোও নেই। অনেকক্ষণ ‘সেই জিনিসটা’ বলে চালাচ্ছি, এইবার সেই জিনিসটার একটা নাম দেব আমরা। এই জিনিসটাকে, যার ওপর জ্যামিতি করব আমরা তাকে বলে ইউক্লিডীয় স্থান, যার ইংরাজি নাম ইউক্লিডিয়ান স্পেস। স্থানের মাত্রার উপর অবশ্য নিয়ম-কানুন বিশেষ নেই, যেকোনো মাত্রা, মানে যেকোনো প্রাকৃতিক সংখ্যাই হতে পারে। দ্বিমাত্রিক ইউক্লিডীয় স্থান আমাদের ওই কাগজটার মতই, শুধু সবদিকে অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত আর ফুটো-ছেঁড়া এমনকি কোথাও কোঁচকানো বা ভাঁজ থাকাও চলবে না। আর একটা জরুরী জিনিস আমি আপনাদের বলছি না এখন, কিন্তু সেটা বরং থাক। ৫ নম্বরের আলোচনায় আমরা আবার সেটায় ফিরে আসব, ততক্ষণ আপনারাও একটু ভাবুন সেইটা কি হতে পারে। ত্রিমাত্রিক ইউক্লিডীয় স্থান আমাদের চারপাশের ফাঁকা জায়গার মতনই, শুধু এও সবদিকে অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত আর ফুটো-ছেঁড়া এমনকি কোথাও কোঁচকানো বা ভাঁজ থাকাও চলবে না। এখানে একটা বিশাল গোলমাল হবে, কারণ ত্রিমাত্রিক স্থানে ফুটো-ছেঁড়াটা আমরা বুঝতে পারলেও কোঁচকানো বা ভাঁজ থাকাটা কল্পনা করাও বেশ শক্ত আমাদের পক্ষে, আমরা ত্রিমাত্রিক জীব বলেই, কিন্তু তবু জ্যামিতির মত এত মজার একটা জিনিসের জন্যে সেই কষ্ট আমরা করলামই নাহয়।
পরের অংশে আমরা দেখব ৩ আর ৪ নম্বরটা কি বলছে।
প্রচ্ছদের ছবি : উইকিপিডিয়া
[1] ইউক্লিড, বা ইউক্লিড অফ আলেকজান্দ্রিয়া একজন গ্রীক গণিতজ্ঞ, খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৩-২৮৩ এই সময়কালে সক্রিয় ছিলেন বলে জানা যায় । Elements নামে তার লেখা একটি বিখ্যাত বইতেই আমরা স্কুলে যে সব জ্যামিতি করেছি সেই সবটা তো বটেই, বস্তুত বিংশ শতাব্দীর দোরগোড়া পর্যন্ত মানুষ জ্যামিতি সম্পর্কে যা কিছু জানত, সেই সবটাই লিখিত আকারে প্রথম পাওয়া যায়, যদিও এত গোছানোভাবে না হলেও এই বইয়ের অনেক কিছুই এর আগের যুগের গণিতজ্ঞরা জানতেন, বিশেষত ভারতীয় ও আরব গণিতজ্ঞরা – ফলত এই বইটি মূলত একটি সংকলন… তবে বলে রাখা ভাল যে একান্তভাবেই ইউক্লিডের নিজের অবদান এরকম বহু কিছুই এই বইতে আছে বলেই মনে করা হয় – আর তা ছাড়া এত যৌক্তিকভাবে সাজানো, স্পষ্টভাবে লেখা এই বই যে শুধুমাত্র সংকলন হলেও ইউক্লিডের প্রতিভার মৌলিকত্বের দাবি একটুও কমে না। মানব সভ্যতার ইতিহাসে মানুষের চিন্তাশক্তির সর্বকালের সেরা কৃতিত্বগুলোর মধ্যে একটা এই বই ।